সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৩

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৩
নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

“ তুমি কি আমার সাথে মজা কোরছো?”
তীব্রর কণ্ঠ শক্ত শোনাল। হিমালয় থেকে ধ্বসে পড়ে তুষার খণ্ডের চাইতেও শীতল তার আঁচ। যার তোপে নূহার শীর্ণ দেহও ছলকে ওঠে একটু!
চোখ তুলতে চেয়েও পারল না। কথা বলতে গেলে বুঝল শব্দভাণ্ডার থিঁতিয়ে এসেছে প্রায়। এতটা ভয় তো ওর কোনোদিন কাউকে লাগেনি।
মাকেও না। যেদিন তীব্রর আসল পরিচয় জানলো,সেদিনও না। তবে আজকে বুকের এমন উত্তালতা কীসের? ভয়ডরে শুকিয়ে আসা গলার এমন ভাবটাই বা কেন?
মেয়েটা ঢোক গিলল। খুব আস্তে ঘাড় নাড়ল দুপাশে। বোঝাল, “ না ”।
মিরাজের ঘাম ছুটেছে। বাকিরা শঙ্কায় একশা।
তীব্রর তাও বিশ্বাস হোলো না। কণ্ঠে বিরক্তি ঢেলে বলল,

“ নূহা,আমি সাত মাস পর পুষ্পিতার কাছে এসেছি। দেশে ফিরে এক দণ্ড সময় নিয়ে বিশ্রামও করিনি।
হ্যাভ ইউ এনি আইডিয়া,ওকে দেখার জন্যে আমার ভেতরটা কেমন করছে? আদৌ বুঝতে পারছো তুমি? তাহলে এরকম ফালতু মজার মানেটা কী? তোমার মনে হয় আমি এখন এসব ইয়ার্কি সহ্য করার অবস্থায় আছি?
ফর গড শেইক,তোমার সঙ্গে আমাকে রুড হতে বাধ্য কোরো না। পুষ্পিতা কোথায়,ডাকো।”
নূহা অসহায় চোখে চাইল। অক্ষিকূটে এক প্রস্থ জল নিয়ে বলল,
“ আমি মিথ্যে বলছি না,ভাইয়া। মজাও করছি না। আমি তো জানি আপনি পুষ্পিতাকে কতটা ভালোবাসেন তাহলে এরকম জঘন্য মজা আমি কেন করব?”
তীব্রর এবার রাগ হোলো। পৃথিবী জ্বালিয়ে দেয়া রাগ। দাঁত পিষে শ্বাস ফেলল সে।
চটে কিছু বলতে গেলে মুখ খুলল মিরাজ। বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ নূহা ঠিক বলছে রে, বিট্টু। পুষ্পিতার সত্যিই বিয়ে হয়ে গেছে,ওর মণির বান্ধবির ছেলের সাথে।”
তীব্রর চোখমুখ পাল্টাল। বদলে গেল মুখের পেশী। কোথা হতে কিছু একটা সাই করে এসেই,বসল ঠিক বক্ষভাগে।
একটু আগের লৌহ কণ্ঠ সহসা ভীষণ ধীরুজ হয়। সামান্য হেসে বলে,
“ তোরা সবাই মিলে কিছু একটা প্ল্যান করেছিস তাই না?
কোথায় ভীতু মেয়ে, লুকিয়ে আছে? বাসায় না বাইরে?”
শাফিন করুণ কণ্ঠে বলল ,

“ কোনো প্র‍্যাংক হচ্ছে না বিট্টু! ওরা সত্যি বলছে রে। পুষ্পিতা আর তোর নেই। সে এখন অন্যের স্ত্রী!”
তীব্রর ঘোলা নেত্রমণি এক মুহুর্তের জন্যে থমকে বসল জায়গায়। হাত খসে গোলাপের তোড়াটা মাটিতে পড়তেই নূহা নিম্নোষ্ঠ দাঁতে পিষে নিলো। কান্নার তোড়ে একটা বড়োসড়ো বাঁধ ফেলেও ব্যর্থ হলো পরপর।
ফোঁপানোর সাথে সেটা ছুটে এলো বাইরে।
তীব্রর স্তব্ধের ন্যায় সবাইকে দেখে নেয় এক পল। কারো ঠোঁটে এক ফোঁটা হাসি নেই। তার বন্ধুদের মুখায়বের এই মলীনতা সে চেনে না। নূহাকে এমন কাঁদতে তো কোনোদিন দেখেনি!
এতগুলো মানুষের নিভন্ত মুখশ্রীই সাক্ষী যোগায়,তাদের কথায় ভুল নেই। তীব্র সব ঘটনা পরপর সাজাল। ও গাজীপুরে আসবে শুনে মিরাজদের অভিব্যক্তি পালটে যাওয়ার ছাপ টুকু স্পষ্ট প্রমাণ রাখল আরেকবার।

“ এর মানে সত্যিই ভীতু মেয়ের…”
তীব্রর পৃথিবী দুলে ওঠে। পায়ের তলার জমিন সরে যায়।
বলবাণ দেহটা দূর্বলের ন্যায় এক পা পিছিয়ে যায় অমনি। শাফিন এগোতে চাইলে হাত তুলে মানা করল। মেঝের বুকে এলোমেলো পাতা ফেলে বলল,
“ সব মিথ্যে! পুষ্পিতা আমি ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতেই পারে না! আমি অন্তত বিশ্বাস করি না।”
নূহা চোখ মুছে বলল,
“ আপনি একটু দাঁড়ান।
আমি আসছি!”
শোবার ঘরের দিকে ছুটে গেল মেয়েটা।

তীব্র শূন্য চোখে চেয়ে রয় সে পথে। রুদ্ধ মস্তকে সচল কিছু নেই।
এইত,কিছুদিন আগে যে মেয়েটা তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ কোনোদিন ছেড়ে যাবে না!” সে হুট করে অন্যের বউ হবে?
এত সহজ সব কিছু? না না, ভীতু মেয়েকে তীব্র চেনে। যে কেউ যা কিছু বললেই হোলো। নিজের ভালোবাসার প্রতি তীব্রর বিশ্বাস নেই?
তীব্রর সুস্থির দম জোরালো হোলো। নিঃশ্বাসের ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ স্পষ্ট।
ঘন ঘন জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে দেখল এদিক-ওদিক। তার ভেতরের উন্মাদনা হয়ত বুঝল আরমান। হাত ধরে বলল,
“ তুই বোস বিট্টু! একটু বোস।”

“ ওরা কী বলছে আরমান? ভীতু মেয়ে কেন বিয়ে করবে? ওতো আমাকে ভালোবাসে, তাই না?”
আরমান ভেজা গলায় বলল,
“ একটু বোস তুই প্লিজ!”
অশান্ত তীব্রকে ধরে কোনোমতে সোফায় বসাল আরমান।
এর মাঝেই এসে দাঁড়াল নূহা। একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে সময় নিলো একটু। থেমে থেমে বলল,
“ এটা,এটা পুষ্পিতা আপনাকে দিতে বলেছিল।”
দেয়ার সময় নূহার হাত যতটা কাঁপল? তার চেয়েও অধিক কাঁপল তীব্রর শক্ত শরীর। থরথরে আঙুল নিয়ে খামটা ধরল সে।

বুক কাঁপছে। পরিষ্কার হৃদপিণ্ডের বিকলতা।
আস্তেধীরে খামের পিন ছুটিয়ে ভেতরে হাত দিতেই, বেরিয়ে আসে কাগজে লেখা কয়েক লাইনের চিঠি। পেছনে আরেকটা কিছু ঝুপ করে মেঝেতে পড়ে যায়। তীব্র সেদিকে দেখল না।
পুষ্পিতার হাতের লেখা সে চেনে। ক্লাসে বহুবার দেখেছিল। তার মনোযোগ এখানেই।
চিঠিটা মেলতে গিয়েও থমকায় একবার। মন দিয়ে চায়, ভেতরে এমন কিছু না থাকুক,যেটা সহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই।
তীব্র মাথা নুইয়ে শ্বাস নিলো। যেন জোর বাড়াল বুকের। তারপর ঝট করে কাগজটাকে মেলে ধরল সামনে,

“ শুরুতে কোনো সম্বোধন করলাম না! কারণ, যখন আপনি চিঠিটা পড়বেন,তখন আপনাকে সম্বোধন করার মতো কোনো অধিকার থাকবে না আমার। জানি,
চিঠিটা পড়ার পর আপনি আমাকে ঘৃনা করবেন। হয়ত কখনো আমার মুখ দেখারও ইচ্ছে হবে না। কিন্তু, সত্যি এটাই আমি মণির বিরুদ্ধে যেতে পারিনি।
কী করে যাব বলুন, ঐ মানুষটা আমাকে এতিমাখানা থেকে এনে মায়ের মতো আদর-স্নেহ দিয়ে বড়ো করেছে। কোনোদিন নিজের ছেলেমেয়ের থেকে আমায় আলাদা করে দেখেনি।
সেই মণি যখন এসে বলল,আপনাকে ভুলে যেতে। সে চায় না আমি কোনো মাস্তানের বউ হই,তখন আর আমি মুখের ওপর না বলতে পারিনি।

ঊনিশটা বছর যে ভালোবাসল,দুদিনের ভালোবাসার জন্যে তাকে আমি ফেরাই কী করে? তাই মণির সিদ্ধান্তকেই আমি মাথা পেতে নিয়েছি।
আপনি আরো অনেক ভালো মেয়ে পাবেন। আমি তো আপনার যোগ্য কোনোদিনই ছিলাম না। তাই ভুলে যাবেন আমাকে। ধরে নেবেন, পুষ্পিতা আপনার জীবনে আসা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল৷
আমি সুখে আছি। আপনার সুখও কাম্য রইল!
ইতি,
পুষ্পিতা….”

চিঠি শেষ। নিচে কলমের একটা দাগও নেই। বাকরুদ্ধ তীব্র বরফের ন্যায় জমে রইল কিছুক্ষণ। পুষ্পিতার লেখা একটা লাইন তুখোড় ভাবে বেজে চলল মাথায়,
“ ঊনিশটা বছর যে ভালোবাসল,দুদিনের ভালোবাসার জন্যে তাকে আমি ফেরাই কী করে?”
ছেলেটা টের পেলো তার বুক আর কাঁপছে না।
বরং আস্ত শরীরটা রক্ত জমাটের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে আসছে। কোনো কিছু কানে যাচ্ছে না। চেয়েও শুনতে পাচ্ছে না তীব্র। সব কেমন ঝাপসা,স্বচ্ছতা হীন!

এই ব্যথাটাকে কী বলে? এটাই কি মরে যাওয়ার মতো কষ্ট? এই যে তীব্রর শ্বাস আটকে আসছে,এই যে তীব্রর সামনে সব ধোঁয়াসা হয়ে ভাসছে,একেই কি মরণ যন্ত্রণা বলে?
আরমান চোখের জল ফেলে দিলো গালে। বলল,
“বিট্টু এবার নিজেকে কী করে সামলাবে বলতো!”
শাফিন বলল,

“ জানি না রে! যে মেয়ের জন্যে সব ছেড়ে এসেছিল সেই মেয়েই ওকে…
তারপর ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। মিরাজ কাছে এগিয়ে এলো। মেঝেতে তীব্রর হাঁটুর কাছে বসে ওর দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ!
তীব্রর চোখের একটা পাতাও নড়ছে না। কেমন অনুভূতিশূন্যের ন্যায় চিঠির লেখা দেখছে। ও হাঁটুতে হাত রেখে বলল,
“ সেদিন তুই পুষ্পিতাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলি। আমরা এতবার ফোন করলাম,কিন্তু কাউকেই পাচ্ছিলাম না। দুজনের ফোনই সুইচড অফ! এদিকে আঙ্কেলও তোকে না পেয়ে নাহিদকে ফোন করলেন।
আমরা চিন্তায় বড্ড অস্থির হয়ে পড়ি। ঠিক বিকেল নাগাদ
খবর পেলাম তোদের এক্সিডেন্ট হয়েছে।

আমরা ছুটে যাই। পুষ্পিতাকে ততক্ষণে স্থানীয়রা হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু তোকে পাওয়া যাচ্ছিল না। পুলিশ
জিপের খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিল, ওটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলের গাড়ি। তারপর ওরা আঙ্কেলকে খবর দেয়। আঙ্কেলই জানিয়েছিলেন আমাদের।
পুলিশ সন্দেহ করে তুই হয়ত নদীতে পড়ে গেছিস। যদিও নদীর গভীরতা কম! কিন্তু তোর মাথার অত গভীর চোটের জন্যে তুই তখন একটা লাশের থেকে কম কিছু ছিলি না!
নদী থেকে উদ্ধার করা মাত্রই আঙ্কেল তোকে সোজা ঢাকায় নিয়ে যায়। আমরাও সাথে যাই।
পুষ্পিতার খবর নিলাম,শুনলাম ও বেঁচে আছে। নূহা,আয়েশা আন্টি, ওর মণি সবাই ছিল ওর কাছে।
আমরা তোকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। নাহিদও আমাদের সাথে ছিল।
তোর অবস্থা এত খারাপ! ডাক্তার কোনো ভরসাই দিতে পারছিলেন না। আন্টির কান্নাকাটি! এমনকি আঙ্কেলও ভেঙে পড়লেন।

ঐ সময় আমরা সবাই হাসপাতালেই ছিলাম। এরপর যখন কোনো কিছুতেই কোনো লাভ হচ্ছিল না,আঙ্কেল আর রিস্ক নিতে চাননি। তোকে নিয়ে
সিঙ্গাপুরে রওনা করলেন। আর আমরা গাজীপুরে ফিরে আসি।
কিন্তু এসে আর পুষ্পিতাকে পাইনি। জানতে পারলাম ওকে ওর মণি নিয়ে গেছে । আঙ্কেল তো দেশে মাঝে কয়েকবার এসেছিলেন,খবর পাই তুই কোমায় চলে গেছিস। কবে জ্ঞান ফিরবে,কেউ জানে না। হঠাৎ একদিন
পুষ্পিতার মণি এলেন। এক্সিডেন্টের সময়েই উনি জেনে গেছিলেন তুই কে!
খবরে দেখাচ্ছিল তোদের এক্সিডেন্টের ব্যাপারটা। আর তোর আসল পরিচয় জানার পর উনি তোর সাথে পুষ্পিতার বিয়ে কিছুতেই দেবেন না।

আমরা তো নিশ্চিত ছিলাম,পুষ্পিতা অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। ও তোকে ভালোবাসে।
কিন্তু যখন এই চিঠি আর ছবিটা পেলাম না? আমাদেরও সব বদলে গেল রে,বিট্টু। অন্যের চিঠি পড়া ঠিক না জেনেও,আমরা পড়েছি। শুধুমাত্র পুষ্পিতার দিকটা শুনতে।
পুষ্পিতা মণির অমতে যাবে না বলে অন্য একজনকে বিয়ে করে ফেলেছে। ওই মহিলা ভয়ে ছিলেন, তুই যদি সুস্থ হয়ে ফিরে কোনো সমস্যা করিস?
তাই তোর ফেরার আগেই উনি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
পুষ্পিতা কোথায় আছে,আমরা কেউ জানি না। এমনকি নূহার সাথেও ওর কোনো যোগাযোগ নেই।”
নূহা বলল,

“ আমি অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম,যোগাযোগ করতে। কিন্তু আন্টি রাজি হননি। পুষ্পিতার অতীতের কোনো ছাঁয়া ওর ওপর পড়ুক আন্টি চান না।”
তীব্র একটা কথাও বলল না। মেঝেতে উলটো হয়ে পড়ে থাকা কাগজের মতো বস্তুটাকে তুলে চোখের সামনে ধরল। নিভু বিলাতি নয়নজোড়া চমকে উঠল অমনি। ধারালো ছুরির মতো কিছু একটা খণ্ডখণ্ড করল তার পাঁজরটাকে।
লাল টুকটুকে বউ সেজে পুষ্পিতা কিছু একটাতে সই করছে। কাবিন নামা নিশ্চয়ই! কদাকার এই দৃশ্যটা তীব্রর সব কিছু এক লমহায় চুরমার করে দেয়। ভেঙে গুড়িয়ে দেয় ভালোবেসে গড়া তার স্বপ্ন শৃঙ্গটাকে।
শাফিন এসে কাঁধে হাত রাখে।

“ তুই ঠিক আছিস,বিট্টু?”
তীব্র চোখ তুলে চাইল। নিষ্প্রাণ চাউনীতে শাফিনের বুক মোচড় দেয়।
কিছু বলতে হাঁ করলে,তীব্র হাত তুলে মানা করল।
উঠে দাঁড়াল হঠাৎ।
সব সময়কার মতোন গতিতে আজ দাপট নেই। পদযুগল যেন টেনেহিঁচড়ে নিচ্ছে । বাইরে যেতে নিলেই আরমান শুধাল,
“ কোথায় যাচ্ছিস?”
উৎকণ্ঠিত সে।
“ আমি একটু একা থাকতে চাই!”

তারপর সিঁড়ি বেয়ে সোজা নেমে গেল তীব্র। চলে যাওয়া শরীরটার দিকে ব্যথিত নয়ন মেলে রাখল ওরা।
গোটা মফস্বল তখনও জেগে। রাস্তা দিয়ে একেরপর এক বাহন ছুটে যাচ্ছে। খোলা রাস্তার বুকে টালমাটাল কদমে হাঁটছে তীব্র। হাতের মুঠোয় পুষ্পিতার বউ সাজের ছবিটা।
তার চোখের ভাষা দিশাহীন! কোথায় যাচ্ছে,কোন লেনে হাঁটছে কে জানে! মাঝে দু একটা গাড়িতে ধাক্কা লাগতে লাগতেও লাগেনি। এক ড্রাইভার চ্যাঁচিয়ে গালি দিলেন। অন্যজন কর্কশ ভাষায় বললেন,
“ শালা,দেখে হাঁটতে পারিস না?”
তীব্র ওসব শুনলোই না। শ্রান্তের ন্যায় একটা বিস্তর সফর শেষ করতে রওনা করল সে। চোখ,কান সবেতে পুষ্পিতার দখলদারি। মেয়েটা হাসছে,কথা বলছে,কাঁদছে কখনো।
কখনো দুষ্টু হেসে বলছে,

“ ইস,বখাটে!”
তীব্র চোখ বুজে ঢোক গিলল।
এসে থামল ঠিক সেই জায়গায়,যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তার সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে ওঠার গল্প!
উত্তাল শ্রাবণীর তাণ্ডবকে ছাপিয়ে পুষ্পিতা যখন ছুটে এসে হামলে পড়ল বুকে। সব কিছু তুচ্ছ করে বলল,
“ আমি আপনাকে ভালোবাসি, স্যার!”
ধপ করে বসে পড়ল তীব্র। হাঁটুর শক্ত দুই হাড় তখন পিচের দখলে।

আজকে বৃষ্টি নেই। মেঘের গর্জনও নেই কোথাও। অথচ তীব্রর ভেতরটা মেতে উঠল প্রকাণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে। । টলমলে চোখ তুলে অন্ধকার বসতটাকে দেখল সে। এই গেট,এই রাস্তা,এই বাড়ি সবাই তার ভালোবাসার সাক্ষী। এখান থেকে ওদের কাছাকাছি আসার শুরু। অথচ কী হলো? যাকে নিজের চেয়েও প্রচণ্ড ভালোবাসায় মুড়িয়ে দিলো তীব্র,সে আর ওর নেই? ও অসুস্থ হতেই অন্য কারো বউ হয়ে গেছে?

তীব্রর নিরেট বনিয়াদ চূর্ণ হয়। বুকের ভেতর ক্লেশের জোয়ার ধেয়ে আসে। ভেঙে যায় পোক্ত সত্ত্বার সমস্ত শক্ত থাকার নিয়ম। হাত থেকে ছবিটাকে ছুড়ে ফেলল প্রথমে। অল্প হাওয়ায় উড়ে উড়ে সেটা আবার ওর কাছেই ফিরে এলো। ঠিক চোখের সামনে পড়ে রইল, পুষ্পিতার ঝুঁকে সই করার দৃশ্য!
তীব্রর বাম চোখের জলটা অল্প নেমে আসে। গাল ছুঁতে ছুঁতেও দাঁড়িয়ে থাকে।
তীব্রর চোখ তখন ছবিতে। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ ছলনাময়ী! বিশ্বাসঘাতিনী!
কী করিনি তোর জন্য?
বাবা মা,নিজের সব কিছু ছেড়ে এসেছিলাম। শুধুমাত্র তোকে পাওয়ার জন্যে! আর তুই!
আমার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেললি? যদি ছেড়েই যাবি ভালোবাসার নাটক করলি কেন? কেন?”

তীব্র চিৎকার করে উঠল। সুতনু পুরুষের হাহাকার মিটে গেল শনশনে হাওয়ায়। দু একজন পথচারি যেতে যেতে অদ্ভুত ভাবে দেখে গেল তাকে।
তীব্রর তাতে ভ্রুক্ষেপ হলে তো! দুহাতে মাটি খামচে ধরল সে। সাদাটে চোখ রক্তিম।
মটমট করে উঠল নিরেট চিবুক। কটমটিয়ে বলল,
“ ঘৃনা করি তোকে। তোর মতো প্রবঞ্চক,স্বার্থপর মেয়েকে আমি ঘৃনা করি!”
ছবিটা হাতে তুলেই এক টান মেরে ছিঁড়ে ফেলল তীব্র।
কিন্তু রাগ,কষ্ট এক চুলও কি কমেছে?

কমেনি। ছেলেটা উন্মাদের মতো মাথা চেপে ধরে। টেনে ছিঁড়তে চায় সোনালী চুল।
কখনো হাঁসফাঁস করে চ্যাঁচায়। কখনো ঘুষি বসায় পিচের ওপর।
প্রকোপে আঙুল থেতলে দেয়ার চেষ্টা। গেটের দারোয়ান আজ নেই। কোথায় গেছে কে জানে!
তীব্র বুক খামচে ধরল ব্যথা কমাতে। কমল না। রাগে,জেদে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বাম হাতটা কামড়ে ধরল নিজের। শুভ্র ত্বকে দাঁত ডেবে গেল। চামড়া ফেটে নোনতা স্বাদ লুফে নিলো জ্বিভ। রক্তের আঁচ পেয়েও তীব্র ছাড়ল না। মুখ সরাল না।

আচমকা কেউ ঝড়ের বেগে এসেই হাতটা টেনে সরিয়ে দেয়।
শাফিন তীব্রর মাথা টেনে রাখে। মিরাজ ধরে রাখে হাতটা।
তীব্র একা ছাড়তে বললেও,ওরা থেমে থাকেনি। পিছু পিছু এসেছে।
মুশফিক সিক্ত কণ্ঠে উদ্বেগ এনে বলল,
“ কী করছিস বিট্টু! এভাবে কেউ নিজের ক্ষতি করে?”
তীব্রর কব্জি থেকে রক্ত ছুটে এসেছে। কুণ্ডলির মতো লাল হয়েছে জায়গাটা। কিন্তু থামল না সে। জোরসে এক ধাক্কা মারল মুশফিককে। ছেলেটা পড়তে পড়তে সামলায় নিজেকে। তীব্র হাতটা ঝাড়া মেরে ছাড়িয়ে আনল। রুষ্ট চোখে বলল,

“ বলেছি না আমি একা থাকতে চাই? বলেছি না? যা এখান থেকে!”
আরমান কেঁদে কেঁদে বলল,
“ বিট্টু এরকম করিস না। তুই এখনো অসুস্থ! একটা বাইরের মেয়ের জন্য কেন এত কষ্ট দিবি নিজেকে? ও ভালো আছে। তুইও ওকে ভালো থেকে দেখিয়ে দে!”
তীব্র ঝুপ করেই কেমন শান্ত হয়ে গেল৷ এক লহমায় নিবৃত্ত বুকের বিক্ষিপ্ত শ্বাস। নীরস গলায় বলল,
“ আমি ওকে ছাড়া ভালো থাকতে পারব?”

আরমান জবাব দিতে পারল না। চোখের জল তার উপচে আসার দশা। বাকিদের নীরবতার মাঝেই
শাফিন ওকে টেনে নেয় বুকে। বোজা গলায় দৃঢ়তা এনে বলে,
“ পারবি! তোকে পারতেই হবে। তুই বিট্টু,আমাদের বিট্টু! বাকি সব
ভুলে যা। ভুলে যা পুষ্পিতাকে।”

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫২

“ পুষ্পিতাকে ভুলে যা!” তীব্রর মস্তিষ্কের বন্ধ গতি হেথায় এসে অচল হয়ে থাকে।
যে মেয়েকে ও স্বেচ্ছায় নিজের শিরায় মেশাল।
মেশাল বক্ষকোষের সমস্ত ফাঁকে,মেশাল হৃদয়ের প্রকোষ্ঠ গুলোয়, চাইলেই কি তাকে ভুলে যাওয়া যায়!”

সে আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ পর্ব ৫৪