হামিংবার্ড পর্ব ১৩
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
অরা চুপ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো অনেকক্ষণ। মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার ফলে একসময় আরিশের হাতের ওপরই ঘুমিয়ে পড়লো সে। কিন্তু আরিশ ঘুমায়নি। একদৃষ্টিতে অরার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
মেয়েটা দেখতে সুন্দরী, দারুণ ফিগার, স্বভাবও চমৎকার। শুধু বয়সটা একটু কম—এইটুকুই যেন একটা প্রশ্নচিহ্ন। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ভাবনার প্রবাহ থামে না আরিশের।
অরার গরম নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে তার গা। তাজরিন খান আরিশ—এতগুলো বছর নারীসঙ্গ ছাড়া কাটিয়েছে, অথচ এই মেয়েটাকে কাছে পেলেই তার ভিতরটা এলোমেলো হয়ে যায়। সেটা কি ভুল? নাকি স্বাভাবিকই?
আরিশ ধীরে ধীরে অরার গলায় আঙুল ছুঁইয়ে দিতে দিতে নামিয়ে আনল। বক্ষবিভাজনের কাছে এসে থেমে গেল সে। আলো-আঁধারির মাঝে অরার বুকের দিকে নজর পড়তেই নিঃশ্বাস ঘন হতে লাগল তার।
অচেতন অরাকে আদর করতে চায় না আরিশ। সে চায়, অরাকে নিজেই উঠিয়ে বসাক। অথচ মেয়েটার চোখে তখনও তীব্র ঘুম, শরীরে জমে থাকা ক্লান্তির ছাপ। মুচকি হাসল আরিশ।
কিন্তু সেই হাসির পরেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল—অরা তো তালহার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসেছিল! মুহূর্তেই মেজাজ বিগড়ে গেল তার। কোনো ভণিতা না করে অরার চুলগুলো শক্ত করে ধরে ওকে শোয়া থেকে টেনে তুলে বসাল। ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ চুলে এমন তীব্র টান লাগায় কেঁপে উঠল অরা। চোখ মেলে তাকাল, চোখে তখনও ঘুমের ঝাপসা। চারপাশ বুঝে উঠার আগেই যেন একটা অদৃশ্য দংশনে আটকে গেল সে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“হেই হামিংবার্ড! তুমি তো আমার দিকে না হেসে তাকিয়েই ঘুমিয়ে গেলে। কেনো গেলে, বলো তো?”
অরা পিটপিট করে তাকাল আরিশের দিকে। ঘুমঘুম চোখে বলল,
“আপনার দিকে তাকিয়ে কেনো হাসব আমি? হাসার মতো কি কিছু হয়েছে? না-কি আপনি জোকার?”
‘কেনো হাসবে?’—কথাটা আরিশের কানে বাজতে লাগল বারবার। তার মানে—তার দিকে তাকিয়ে হাসবে না অরা!
আরিশ দারুণ ক্ষেপে গেলো। এক ঝটকায় অরাকে কোলে বসিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল।
অরার ঘুম এক লহমায় উড়ে গেল। যদি পড়ে যায় সেই ভয়ে, দ্রুত আরিশের গলা জড়িয়ে ধরে, দু’পাশে পা ছড়িয়ে পিঠ আঁকড়ে ধরল সে। মস্তিষ্ক সজাগ হতেই মনে পড়ল—এই লোকটা তার স্বামী, তাজরিন খান আরিশ। এক আধপাগল পুরুষ! একটু আগে কী বলেছে সেটা ভাবতেই ভয়ে আঁতকে উঠল অরা।
“শুনুন, আমার চোখে তখন ঘুম ছিলো। আমি আসলে ওসব বলতে চাইনি। প্লিজ রাগ করবেন না।”
“তুমি বলেছ, আমার দিকে তাকিয়ে কেনো হাসবে।”
আরিশ আরকিছু না বলে অরাকে ওভাবেই কোলে করে নিয়ে দোতলা থেকে নেমে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
বিশালদেহী আরিশের কোলে অরা সত্যিই যেন এক খুদে পাখি। তাকে এভাবে বয়ে নিয়ে যাওয়াটা আরিশের কাছে কোনো কষ্টের কাজ নয়, কোনো ব্যাপারই না।
“আমি ভুল করে বলেছিলাম। আমি শুধু আপনার দিকেই তাকিয়ে হাসব।”
“তাহলে হাসো।”
“এখন?”
আরিশ কোনো উত্তর দিল না। তার চোখের কোণায় রাগের কুয়াশা ঘন হয়ে আসছে। হাসতে বলেছে সে—তা-ও আবার জিজ্ঞেস করে, ‘এখন?’
অরা আরিশের চুপ করে থাকা দেখে একটু কেঁপে উঠল। ভেতরে এক অজানা ভয়। এতটা নিঃশব্দ হয়ে গেলে তাজরিন খান আরিশ কী করতে পারে—তা সে জানে না, তবে আঁচ করতে পারে।
‘কোথায় যাচ্ছে আরিশ?’
চোখ দু’টো বড় করে তাকাল—রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছে সে!কিন্তু কেনো?
“শুনুন না… আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
আরিশ চুপ করে রইলো। অরাকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেই কোল থেকে নামিয়ে দিলো তাকে। ঠাস করে দরজাটা আঁটকে দেওয়াতে ভয়ে কেঁপে উঠল অরা।
আরিশ ফের সেভাবেই কোলে তুলে নিলো অরাকে। রান্নাঘরের মাঝখানে থাকা উঁচু কিচেন কাউন্টারে—যেটার ওপর সাধারণত ফল, বাটি বা কফির মগ রাখা থাকে—সেখানেই বসিয়ে দিলো তাকে। দুই পা ফাঁক করে, নিজে দাঁড়াল সেই ফাঁকে।
অরা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কেবল।
আরিশ একহাত অরার কোমরে রেখে, অন্য হাতে ওর চুলগুলো জোরে চেপে ধরে ঠোঁটজোড়া নিজের দখলে করে নিলো। চুলের ব্যথায় মাথায় ব্যথা লাগছে অরার। কিন্তু মুখ থেকে কোনো শব্দ পর্যন্ত করতে পারছে না সে। কী এক মুসিবতে পড়ল ভেবে কান্না পাচ্ছে তার।
অরা যখন ছটফট করা বন্ধ করে দিলো, ঠিক তখুনি আরিশ তার ঠোঁট সরিয়ে নিলো। প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে লাগলো অরা।
“যে ঠোঁট দিয়ে অন্য পুরুষের দিকে তাকিয়ে হাসো, অথচ আমার বেলায় হাসার কারণ খোঁজো—
সেই ঠোঁটকে তো শাস্তি পেতেই হবে, হামিংবার্ড!”
আরিশের কণ্ঠে জ্বালাময় রাগ আর তীব্র অধিকারবোধ। কিন্তু অরার শরীর শিউরে উঠল আতঙ্কে। ওর চোখ বড় হয়ে গেল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল।
“না… দয়া করে… এমন কিছু করবেন না।
আপনি এমন কেন করছেন?
একটু শান্ত থাকুন প্লিজ। প্লিজ আরিশ, ডোন্ট ডু দিস…”
আরিশ একচুলও নড়ল না। বরং আশপাশে নজর বোলাল নিস্তব্ধভাবে। তারপর রান্নাঘরের তাকে রাখা একটা কৌটা তুলে নিল। আবার সেই আগের মতো, অরার দু’পায়ের মাঝে দাঁড়িয়ে, ওর মুখোমুখি।
হাতের কৌটার দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল অরা।
মরিচের গুঁড়ো!
আরিশ ঠোঁটে সেই চিরচেনা অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে বলল—
” ইয়েস, হামিংবার্ড.. আই ডু ইট। ”
অরা উঠে যেতে চাইলে আরিশ শক্ত করে চেপে ধরল তাকে। তার বিশাল দেহ আড়াল করে রেখেছে পুরোটা জায়গা—অরার দুই পায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে, তাই উঠে দাঁড়াতেও পারল না মেয়েটা।
আরিশের ঠোঁটে ফুটে উঠল একরকম শয়তানি হাসি। কৌটা খুলে এক আঙুল দিয়ে সামান্য মরিচের গুঁড়ো তুলে নিল। তারপর ঠোঁটের ওপরে আলতো করে ঘষে দিলো অরার কাটা ঠোঁটে।
হঠাৎ ঝলসে উঠল সেই জায়গাটা।লিপ কিসের আগ্রাসী চাপে যা আগেই ফেটে ছিল, এখন সেখানে লেগেছে আগুন! অরা কেঁপে উঠল ব্যথায়। একটা বিকট চেঁচিয়ে উঠল সে—
“আহ্! না… না প্লিজ! এটা—”
আরিশ নিজের জায়গায় অটল, দৃঢ়, শীতল।
ওর চোখে স্পষ্ট ভোগান্তির সুখ।
অরার ছটফটানি, কাঁপা কাঁপা শরীর… সবটাই সে দেখছে।
“আপনি কি মানুষ! কেউ এরকম করে? উফ, আল্লাহ!”
অরা কেঁদে ফেলল রাগে, ব্যথায়, অপমানে।
আরিশ ঠান্ডা গলায় বলল,
“আমি মানুষ। তবে খারাপ মানুষ। খুব খারাপ। বুঝলে?”
অরার চোখ নিচু, কাঁধ কেঁপে কাঁপে, মুখ ঝুঁকিয়ে কাঁদছে চুপচাপ। আরিশ বেসিনে গিয়ে ধুয়ে ফেলল নিজের হাত। অরা এখনও রান্নাঘরের কাউন্টারে বসে আছে। চাইলেও পালাতে পারবে না, এই কয়দিনে এতটুকু সে বুঝে গেছে।
“লুক অ্যাট মি, লিটল বার্ড।”
অরা তাকায় না। আরিশ তার থুতনি ধরে মুখটা উপরের দিকে তুলল। চোখের কোণে জমা জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে।।হঠাৎই অরার কাঁপা ঠোঁটে নিজের ঠোঁট রেখে দিলো আরিশ। চমকে উঠল অরা। ঠোঁটে মরিচ গুঁড়ো থাকা স্বত্বেও কেনো কাছে এলো সে? এবার তো আরিশেরও ঝাল লাগবে! অরা আরিশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কোমর আঁকড়ে ধরে গভীরভাবে চুমু দিচ্ছে আরিশ। এই চুমুটা একদম আলাদা, যেখানে কোনো হিংস্রতা নেই। আছে শুধু কোমলতা। যেন আরিশ তার ঠোঁট দিয়ে অরার ঠোঁটের সমস্ত ঝাল নিজের ঠোঁটে টেনে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ এভাবেই চলল। চুপ করে বসে থাকল অরা, তাকিয়ে থাকল আরিশের চোখে।
কিছুক্ষণ পর আরিশ থামল। অরাকে কাউন্টারে সেভাবেই বসিয়ে রেখে ফ্রিজ থেকে বের করল একটা ছোট বাটি। অরা ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াল।
“এবার আবার কী মাখিয়ে দিবে ঠোঁটে!”
মনে মনেই বলে ওঠে সে, চোখে আতঙ্ক।
আরিশ যখন অরার দিকে এগিয়ে এল, অরা ভয় আর সন্দেহে গলাটা একটু কাঁপিয়ে বলল,
“আবার কী লাগাবেন ঠোঁটে?”
আরিশ শান্তভাবে উত্তর দিলো,
“ঠান্ডা টক দই।”
“কী?”
অরার চোখ কুঁচকে গেল।
“তুমি যা শুনলে, ঠিক সেটাই। টক দই।”
আরিশ একদম কাছে এসে দাঁড়াল।
অরা কাঁপা চোখে বাটির দিকে তাকাল—সত্যিই তো! বাটিতে রাখা ঠান্ডা দই, আর কিছুই না।
“যেভাবে বসেছিলে, সেভাবেই বসো আবার।”
কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে আগের মতোই বসে পড়ল অরা।
আরিশ আবার দাঁড়াল তার ঠিক সামনে, পায়ের মাঝখানে, আগের মতো। তারপর আঙুলে নিয়ে ধীরে ধীরে ঠোঁটে টক দই মাখাতে লাগলো।
নরমভাবে, কোনো তাড়াহুড়ো নেই। যেন একটু আগের ঝলসে দেওয়া মুহূর্তের প্রলেপ দিচ্ছে এই ঠান্ডা ছোঁয়ায়।
অরা তাকিয়ে থাকল চুপচাপ। কিয়ৎক্ষণ পর নিচু গলায় জানতে চাইল,
“এগুলো কেন দিচ্ছেন?”
“ঝাল কমে যাবে,” শান্ত সুরে জবাব দিলো আরিশ।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরা। ব্যথা দেয় যে, সান্ত্বনাও দেয় সেই—কী অদ্ভুত এই লোকটা! দই লাগানো শেষ করে এবার তার চুলগুলো আলতো করে গুছিয়ে খোঁপা করে দিলো আরিশ।
“এভাবে পছন্দ তোমার?”
আরিশের গলায় কেমন যেন দুষ্টুমির আভাস।
অরা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে তাকাল তার দিকে,
“কী বললেন?”
আরিশ হালকা হেসে, চোখের ইশারায় নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হাউ ডু ইউ ফিল অ্যাবাউট ডিস পোজিশন?”
অরা থমকে গেলো। মুখটা লাল হয়ে উঠল তৎক্ষণাৎ। কী বলল আরিশ? মাথা নিচু করে ফেলেছে ছোট্ট পাখিটা। মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। আরিশ ব্যাপারটা বেশ এনজয় করছে। অরাকে পাঁজা কোলা করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে সে,
“বুঝতে পেরেছি…”
আরিশ ফিসফিস করে বলল,
“এভাবে তো আগে কখনো হয়নি, তাই না? এজন্যই তুমি কোনো উত্তর দিতে পারোনি।”
এক মুহূর্ত থেমে, আরেকটু এগিয়ে গিয়েই বলল,
“আমি কিন্তু তোমার উত্তর পাওয়ার ব্যবস্থা করব, হামিংবার্ড। নিশ্চিতভাবে। বুঝতে পেরেছ?”
অরা চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরে রইল। কিছু বলার মতো ভাষা নেই তার।
শহরের সকালের বাতাস এক অদ্ভুত মিশ্রণ তৈরি করেছে—ট্রাফিক জ্যাম, তাজা চায়ের গন্ধ, আর মানুষের ব্যস্ত পদচারণা। রাস্তায় গাড়ির হর্ন, ফুটপাথে চলন্ত পায়ে পায়ে সাপের মতো ঘুরে আসা মানুষ, আর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভিখারির গলার হাঁকাচি শব্দে শহর যেন কখনো থামে না। শহরের এই দৃশ্য, এই মুহূর্তগুলোর কোলাহল, সবার কাছে যেন আলাদা কিছু। কেউ একটু ভালো থাকার আশায় বের হয়, কেউবা জীবনের গতিতে দৌড়াতে থাকে, আর কেউ কেউ চুপ করে দাঁড়িয়ে শুধু দেখতেই থাকে।
সকাল সকাল কলিংবেলের শব্দে হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন রোকসানা মল্লিক। নয়না সকালের নাস্তা করছে, আর সোলাইমান মল্লিক কিছুক্ষণ আগে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন।
“কেমন আছো, রোকসানা?”
“মকবুল ভাই! আপনি! কেমন আছেন? আসুন, আসুন। ভেতরে আসুন আগে।”
হামিংবার্ড পর্ব ১২
মকবুল চৌধুরী সোলাইমান মল্লিকের বাল্যবন্ধু। ছোটবেলা থেকে একসাথে হেসেখেলে বড় হয়েছেন তারা। জীবিকার তাগিদে সোলাইমান শহরে বসবাস করলেও, মকবুল এখনও গ্রামের বাড়িতেই আছেন। সোলাইমান পরিবার নিয়ে গ্রামে গেলে, মকবুলের সাথে দেখা হয় এবং তারা একে অপরের বাড়িতে নিয়মিত যাওয়া-আসা করেন। রোকসানা মল্লিকের পিছুপিছু বাসার ভিতরে ঢুকলেন মকবুল। বসার ঘরের সোফায় বসে পড়লেন তিনি। নয়না নাস্তা খাওয়া শেষ করে বসার ঘরের দিকে উঁকি দিল, আর মুহূর্তেই তার গলা শুকিয়ে গেলো আতঙ্কে।