হামিংবার্ড পর্ব ৩৬
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
বিকেলবেলা। জানালার ফাঁক গলে নরম রোদ ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছে। অরার স্যালাইনের ব্যাগে এখন সামান্যই তরল বাকি। নিঃশব্দে ফোঁটা ফোঁটা করে নামছে শেষ ক’ফোঁটা। আরিশ অরার পাশে বসে আছে। সেই দুপুর থেকে এভাবেই বউয়ের পাশে বসে থেকেছে সে। এক মুহুর্তের জন্যও সরেনি। অরা কাঁধের উপর দিয়ে মাঝে মাঝে চুপি চুপি তাকাচ্ছে আরিশের দিকে। তারপর আবার তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিচ্ছে । এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় কাজ করছে ভেতরে ভেতরে।
লোকটা তো ভীষণ খারাপ তবে এত কেয়ার করে কেন? তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল অরা। অরার যে কী হয়েছে সেটাই বুঝতে পারছে না বেচারি। অরার জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরিশের আশেপাশে গেলেই বুক ধুকপুক করে, নিঃশ্বাস যেন ঘন হয়ে আসে। আরিশের বলা কিছু কথা তো মাঝে মাঝে স্লো মোশনে শুনতে পায় সে।
স্যালাইন শেষ। এসো, সুঁচটা খুলে দেই।”
চমকে উঠল অরা। গলায় এক ঢোঁক শুকনো নিঃশ্বাস গিলে আমতা আমতা করে বলল,
“না-নার্স আপু কোথায়?”
“উনি তো চলে গেছেন। কেন? ভয় পেও না, আমি খুলে দিতে পারি।”
অরা জানে, পেছানো তার পক্ষে সম্ভব না। তবু স্বভাবে অল্প একটু পেছনোর চেষ্টা করল। কিন্তু পেছনে এগোনোর মতো আর জায়গাও নেই।
আরিশ তার সেই চেষ্টা দেখে মিটিমিটি হাসল।
“আপনি… আপনি নার্সকে কল করুন।”
“ওনার বাচ্চা নাকি কাঁদছিল। তাই আগেভাগেই আমাকে বলে চলে গেছেন।”
“তাহলে ডাক্তার! ডাক্তারকে কল করুন।”
আকস্মিক অরার চুলগুলো শক্ত করে চেপে ধরল আরিশ। চমকাল, থমকাল অরা৷ আরিশের এমন আচরণের কারণ বুঝতে পারছে না মেয়েটা৷ লোকটার চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ ডাক্তার কেন? আমি আছি না? আমার থেকে ডাক্তারের ওপর বেশি বিশ্বাস তোমার? ওই ডাক্তার আর আসবে না। আগামীকাল মহিলা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। এখন চুপ করে বসে থাকো। “
আরিশের ধমক আর চুলের টানে ব্যথা পেয়ে অরা আর কিছু বলল না। সব ভয়, সব অস্বস্তি চেপে রেখে চুপচাপ বসে রইল সে। আরিশ ধীরে ধীরে অরার হাতটা ধরল। সুঁচটা বের করার জন্য অগ্রসর হলো সে। অরা চোখ শক্ত করে বন্ধ করে আছে। এক ঝলক তাকাল আরিশ তার মুখের দিকে। তারপর এক নিঃশ্বাসে দ্রুত সুঁচটা বের করে ফেলল। মৃদু গোঙানির মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এলো অরার মুখ থেকে। হঠাৎ করেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল আরিশের বুকে। চমকে উঠল আরিশ। বুকের ভেতর কেমন করে ধক করে উঠল। অরা এক হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে তার পিঠ, মুখটা ঠেকিয়ে রেখেছে আরিশের ঘাড়ে। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আর ঠোঁটের স্পর্শে যেন আরিশের শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ল।
আরিশও ধীরে ধীরে, নরম হাতে জড়িয়ে ধরল অরাকে। তার ঘাড়ে এক মৃদু কামড় বসিয়ে দিল। আবারও গুঙিয়ে উঠল মেয়েটা। তবু একটুও সরে এল না। তখনই হঠাৎ হুঁশ ফিরল আরিশের।
“ আমার লাগছে, আরিশ।”
অরার কণ্ঠে হালকা ব্যথার সুর।
আরিশ নিস্পৃহ গলায় বলল,
“কামড় দিলে যদি ব্যথা না লাগে, তবে কামড় দেওয়ার মানেই বা কী?”
“মানে, আমি ব্যথা পেলেও আপনি চালিয়ে যাবেন?”
ভ্রু কুঁচকে কিছুটা বিরক্ত গলায় বলল অরা,
“আপনি আসলেই একদম পাগল। ক্রেজি একটা মানুষ!”
কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল অরা। নিজেকে আরিশের থেকে দূরে সরিয়ে নিলো। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আরিশ৷ অরা কি রাগ করলো? এই মেয়ে রাগ করতেও জানে? বাহ! ইন্টারেস্টিং!
“ হেই হামিংবার্ড! তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছো?”
“ না, একদম না। রাগ করা তো আপনার জন্মগত অধিকার। আমি কেন রাগ করবো? আপনার ইচ্ছে হলে আপনি কামড়ে দিবেন, ইচ্ছে হলে চুল ধরে টানাটানি করবেন আবার ইচ্ছে হলে জোর করে আদ…….”
থেমে গেল অরা। বাকিটুকু আর বলল না।
হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেল। এক মুহূর্তে নিজেকেই অপরিচিত লাগল তার। এই রাগ, এই অভিযোগ –এসব কোথা থেকে এলো?
অভিমান জমেছে মনে? না কি ভালোবাসার কোনো অভাব? লোকে বলে, যখন ধৈর্য ফুরিয়ে যায়, যখন ভালোবাসার ঘাটতি টের পাওয়া যায়– তখন নাকি মানুষ সহজেই রেগে যায়।
হয়তো তাই হচ্ছে তার সঙ্গে। হয়তো… সে ক্লান্ত, হয়তো… সে অভিমানী। আরিশ এতক্ষণ অবাক নয়নে তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। এই ছোট্ট পাখিটা, এই হামিংবার্ডটা –রাগলে এতটা সুন্দর লাগে,সেটা আগে কখনো দেখতে পায়নি সে।
“কথা শেষ করো, বউপাখি।”
আরিশের গলায় একধরনের আদেশ-মেশানো সুর।
“না… মানে… কিছু না।”
লাজুক অথচ ধরা পড়ে যাওয়ার গলায় বলল অরা।
“জোর করে আদর করব?”
চোখ কপালে তুলে তাকাল অরা।
শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল,
“আমি… আমি অসুস্থ। শরীর খুব দুর্বল।”
“তুমি না বললে তো আমি জানতেই পারতাম না!”
নাটুকেপনা মেশানো হাসিতে বলল আরিশ,
“থ্যাংক ইউ, মিসেস অরা!”
হঠাৎ যেন অরা দ্বিধায় পড়ে গেল। লোকটা কি রেগে গেলো? তাই এমন করে কথা বলছে? না-কি সত্যি সত্যি মজা করছে? তেজরিন খান আরিশ মজাও করতে জানে?
“আপনি রাগ করেছেন?”
সন্দেহ মেশানো গলায় জিজ্ঞেস করল সে।
“হ্যাঁ, রাগ করেছি। কারণ রাগ করা আমার জন্মগত অধিকার।”
আরিশ অরার গাল টেনে হালকা টিপে দিয়ে বলল,
“আর অধিকারের জায়গায় আমি খুব কঠোর। সহজে ছাড়ি না।”
গালে আরিশের স্পর্শে এক মুহূর্তে অরা নিশ্চিত হলো আরিশ মজা করছে। তবু সে এক রহস্যময় মানুষ– এই ভালো, এই খারাপ!
কখন যে কী করে বসবে, তা কেউ জানে না।
“ভালো।”
নরম স্বরে বলল অরা।
“কিছুক্ষণ রেস্ট করো। আমি গিয়ে গোসল সেরে আসি।”
“এখন?”
কণ্ঠে অজান্তেই লজ্জা মেশানো টান।
“তুমি চাইলে একটু পরেও করতে পারি। উপযুক্ত কারণ দাঁড় করিয়ে… তারপর… তুমি চাও?”
আরিশের দৃষ্টি যেন চুম্বকের মতো। অরা কিছু বলল না। শুধু চোখ নামিয়ে নিলো। লোকটার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেও কথাই বলা যায় না। সবসময় কেমন একটা রস ভরা বাঁক, যেন প্রতিটা বাক্যে ইশারার ফাঁদ।
আরিশ ধীরে ধীরে তার পাশে এসে বসল।
ডান হাতের আঙুল ঠোঁটে রেখে নিচের দিকে আলতোভাবে নামাতে শুরু করল – একটানা, অতি ধীর লয়ে। অরার শিরদাঁড়া বেয়ে এক অদ্ভুত শিহরণ নেমে গেল। চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হলো সে। আঙুলের নরম চলাচল যেন আর শরীর ছুঁয়ে নয়, আত্মা ছুঁয়ে যাচ্ছে। শরীরটা হালকা থরথর করে উঠছে –আর হৃৎস্পন্দন যেন নিয়ম মানছে না।
” টেল মি, হামিংবার্ড। ”
অরা হঠাৎ চমকে তাকাল আরিশের দিকে। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। ওই চোখ দুটো যেন তাকে গিলে ফেলতে চাইছে – নেশাগ্রস্ত, পাষাণ নরম চোখ। অরার দৃষ্টি নেমে এলো নিজেই, বুকের ভেতর কেমন ঝড় উঠেছে। আরিশ তার নীরবতার সুযোগ নিচ্ছে না, বরং ধীরে ধীরে তাকে অনুভব করছে। হাতের প্রতিটি স্পর্শে অরার ত্বকে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। অরা যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছে, প্রতিরোধ করার সামর্থ্যটুকু হারিয়ে ফেলেছে। মাঝখানে আটকে গেছে –না চাইতেও চাওয়া, না বলতে গিয়েও থেমে যাওয়া।
আরিশ খুব সন্তর্পণে, বুঝেশুনে অরার ঠোঁট ছুঁয়ে ফেলল। একটা মৃদু কাঁপন ছড়িয়ে পড়ল অরার ছোট্ট শরীরজুড়ে। চোখ দুটো নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে গেল তার। সে আর কিছুই ভাবতে পারল না, শুধুই অনুভব করল। দুই হাতে জড়িয়ে ধরল আরিশকে। আরিশ থেমে গেল হঠাৎ। হতবাক হয়ে অনুভব করল – এই প্রথম অরা তাকে নিজে থেকে আলিঙ্গন করছে। বুকের গভীরে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ভর করল তার। যেন এটাই ছিল তার চাওয়া, বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত।
অরার অবস্থা তখন দিকহারা পথিকের মতো। কিছুই বুঝতে পারছে না –কী করেছে, কী করবে। এক অচেনা ঘোরে ডুবে আছে, যে ঘোরে যুক্তি নেই, আছে শুধু হৃদয়ের স্পন্দন।
“ কী হলো? “
আরিশের প্রশ্নে অন্য দিকে ফিরে তাকাল সে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নিতে কয়েক মিনিট সময় লাগলো তার। আরিশ মিটিমিটি হাসছে। অরাকে বশ করার মন্ত্র শিখে ফেলেছে যেন সে। জোর করে নয় এবার অন্যভাবে কাছে টানবে অরাকে।
“ হামিংবার্ড? “
“ হুম। “
“ কিছু লাগবে? “
“ নাহ। “
মুচকি হেসে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল আরিশ। ওয়াশরুমের দিকে এগোতে এগোতে বলল,
“ তখন বলেছিলে আমি জোর করে আদর করি, এখন আমি বলছি – তুমি নিজে থেকেই আমার কাছে আসবে। আমি তোমাকে বাধ্য করবো, আমার কাছে আসার জন্য। “
অরা চুপচাপ বসে রইল। মুহূর্তটা যেন স্থির হয়ে আছে তার ভেতরে। কী হয়েছিল একটু আগে–সেটাই বিশ্লেষণ করতে ব্যস্ত মন। এই কি দুর্বলতা? এই কি আকর্ষণ? নাকি নিছকই এক মানসিক বিভ্রান্তি? একটা ভয় ধীরে ধীরে গা বেয়ে উঠছে– সে কি সত্যিই একটু আগে রাগী ভূতটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল? মাথা নাড়িয়ে নিজেকে ধমক দিলো অরা। নাহ, এই লোককে ভালোবাসা যায় না। যে মানুষ চোখের পলকে বদলে যায়, যে রাগের মাথায় একদিন খুন করেও ফেলতে পারে, তার প্রতি টান মানে আত্মঘাতী প্রবণতা!
অরা নিঃশ্বাস ফেলল ধীরে, নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল,
“সবই হরমোনের খেলা, প্রেম না। ঠান্ডা মাথায় ভাব অরা, এই লোক একটা বিপদ।”
আচমকা ফোনের রিংটোনের শব্দে নড়েচড়ে উঠল অরা। রনি কল করেছে! অরা ওয়াশরুমের দিকে উঁকি দিলো একবার। না, আরিশ মাত্রই ওয়াশরুমে ঢুকল, নিশ্চয়ই বের হতে সময় লাগবে। অরা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে কল রিসিভ করলো।
“ কী রে অরু? এভাবে ভুলে গেলি? “
“ না রে। জানিসই তো সব। “
“ হ্যাঁ, সবই জানি৷ আকাশের থেকে সবকিছু শুনেছি। সে যাইহোক, যেটার জন্য এতদিন অপেক্ষা করছিলাম, আজকে ওটার রেজাল্ট বেরিয়েছে।”
“ আমার মনে হয় লেখাপড়া হবে না, রনি৷ “
“ ওমা! কেন? তোর অত হাইফাই, বড়লোক বর। অথচ তোকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিটও করাবে না? “
চুপ করে রইলো অরা। কীসের জন্য এমন কথা বলেছে সে, তা তো রনি জানে না। যেখানে তালহা ভাইকে নিয়েই আরিশের এত সমস্যা সেখানে কীভাবে ভার্সিটিতে যেতে দিবে?
অরাকে চুপ করে থাকতে দেখে রনি বলল,
“ একবার কথা বলে দেখিস। চেষ্টা তো অন্তত কর। লেখাপড়া ছাড়া গতি নেই ভাই, নিজের ভালো বুঝবার চেষ্টা কর। লেখাপড়া আজীবন সাথে থাকবে, মানুষ থাকুক বা না থাকুক। বিশেষ করে, মেয়েদের আত্মনির্ভরশীল হওয়া জরুরী। জব না করলে করবি না, কিন্তু লেখাপড়া জানা থাকলে কখন কাজে লাগে বলা যায় না। “
রনির কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতোও না। অরা গভীর মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনছিল এতক্ষণ।
“ ঠিক আছে। আমি আরিশকে বলে দেখব। যদিও তিনি রাজি হবেন না, কিন্তু বলব। “
“ ঠিক আছে, রাখছি। পরে তোর সুবিধামতো কল দিস না হয়। “
“ ওকে, বায়। “
“ বায়। “
কথা শেষ হতেই হঠাৎ এক ধরনের অস্বস্তি গ্রাস করল অরাকে। যেন কারও দৃষ্টি তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে নীরবে। ভয়ে ভয়ে পাশ ফিরতেই চোখে পড়ল আরিশ –সাদা তোয়ালে জড়ানো ভেজা, উন্মুক্ত শরীর। অরার গলা শুকিয়ে এলো। এই চেহারায় আরিশকে সে বহুবার দেখেছে, তবু আজ যেন আলাদা লাগছে। নিজের ভেতর জন্ম নেওয়া আকাঙ্ক্ষাটা সামলানো দুষ্কর হয়ে উঠছে।
ইচ্ছে করছে… খুব ইচ্ছে করছে ওকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে একবার, দু’বার… হয়তো তার চেয়েও বেশি। কিন্তু সেই ইচ্ছেগুলোকে অগোচরে গিলে ফেলে চুপচাপ বসে থাকে সে – নিজেকেই বোঝাতে চায়, এ আকাঙ্ক্ষা একেবারেই নিজের ভ্রম।
“ কে কথা বলছিল ফোনে? “
আরিশের কথায় হুঁশ ফিরল অরার। আচমকাই একরাশ আতংক ঘিরে ধরলো তাকে৷ নিশ্চয়ই আরিশ কিছু একটা করবে এখন। হয়তো ফোন ভেঙে ফেলবে নয়তো জোর করে কিছু । বারবার নতুন ফোন ব্যবহার করতে ভালো লাগে না অরার৷
“ র..রনি, আমার ক্লাসমেট। ভার্সিটিতে যাওয়ার কথা বলছিল, ওরা সবাই….. “
“ সুস্থ হও, তারপর নিয়ে যাবো। “
অরা বিস্ময়ে আবারও শুধালো,
“ কী? “
“ বললাম তুমি সুস্থ হও, তারপর ভার্সিটিতে নিয়ে যাবো। “
অরা খুশিতে বসা থেকে উঠে একপ্রকার লাফিয়ে আরিশের গলা ধরে তার কপালে চুমু খেলো। আরিশ যেন বরফের মতো জমে গেলো তাতে। আকস্মিক ঘটনায় অরা নিজেও ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে আছে। কী করলো এটা!
“ আসলে… আমি… মানে। আমার ভুল হয়েছে। “
অরা দূরে সরতে চাইলে আরিশ তার কোমরে হাত রেখে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলল।
“ তুমি আমাকে কিস করলে হামিংবার্ড! নিজে থেকে, এই প্রথম! আরেকটা করবে? প্লিজ? “
আরিশের কোমল, শান্ত কণ্ঠস্বর শুনে অরার মনটা কেমন আকুপাকু করছে। আর সত্যি বলতে আরিশকে এভাবে সদ্য গোসল করে আসা অবস্থায় দেখে অরা নিজেও কিছুটা দূর্বল অনুভব করছিল। আরিশ কপালে কপাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“প্লিজ হামিংবার্ড… গিভ মি আ কিস।”
কণ্ঠে এমন এক অসহায়তা, যা অরার বুকের ভেতরটা কেঁপে তুলল।
আরিশের ঠোঁট ছুঁয়ে গেল অরার কপালে। জোর করে যতই যা করুক, অরার স্পর্শ পাবে না সে। আর পেলেও তাতে কোনো অনুভূতি থাকবে না– এটা আরিশ ভালো করেই জানে৷ আজকের আরিশ যেন ভিন্ন। একটুকরো ভালোবাসার আশায় মরুভূমির মতো শুকনো হৃদয়টা বাড়িয়ে দিয়েছে সে। ভালোবাসার কাঙাল সে। অরার মায়া হলো তার ওপর। চোখ বন্ধ করে, নিঃশ্বাস আটকে রাখার মতো সাহস জড়ো করে, ধীরে আরিশের ঠোঁটে চুমু দিলো সে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল আরিশ। লজ্জায় আরিশের বুকে মুখ গুঁজে ফেলল অরা।
“ বিশ্রাম নাও। সন্ধ্যায় পার্টি আছে। “
অরাকে কোলে করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো অরা,
“ কীসের পার্টি?”
“ বউ নিজে থেকে কিস করেছে সেই আনন্দে পার্টি দেবো। বাড়ির লোকজনই থাকবে আর তালহাকে তোমার বাবা-মা আর নয়নাকে নিয়ে আসতে পাঠাবো।”
আজকে যেন অরার চকমকানোর পালা। এক এক করে আরিশের আচরণে কেবল চমকেই যাচ্ছে সে। ভার্সিটিতে যেতে দেওয়া, বাবা-মাকে নিয়ে আসতে চাওয়া সবকিছুই স্বপ্নের মতো লাগছে অরার। আরিশ অরার চোখমুখ পর্যবেক্ষণ করে হেসে বলল,
“ সেই খুশিতে কি আরেকটা কিস করবে?”
ফিক করে হেসে উঠল অরা। আরিশও হাসতে হাসতে ওয়ারড্রবের দিকে এগোল। চেঞ্জ করে নিচে যেতে হবে, সন্ধ্যায় পার্টি মানে অনেক কাজ বাকি!
মাগরিবের আজান দিচ্ছে। দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছে নয়না। আজকে বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা পায়নি বলে হেঁটে বাসায় যেতে হচ্ছে তাকে। বাসা থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রায় পনেরো মিনিটের পথ। তবে রিকশা করে গেলে কম সময় লাগে। এমনিতেই সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তার ওপর একা! না চাইতেও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ভয় মনে উঁকি দিচ্ছে তার৷ দম আটকে আসছে যেনো। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো নয়না। একটা গাড়ি থেমেছে, ওর পাশেই। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে এলো নয়নার। গাড়ির জানালার দিকে তাকাল একবার।
“ গাড়িতে উঠে এসো, নয়না। তোমাদের বাসায় যাচ্ছি আমি। “
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল নয়না। এটা তালহা ভাই । গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে তালহা, নয়না মুচকি হেসে তালহার পাশের সিটে বসলো। গাড়ি চলতে শুরু করেছে আবার।
“ হঠাৎ আপনি এলেন? “
“ তোমার দুলাভাইয়ের হঠাৎ মনে হলো, তোমাদেরকে নিয়ে যাওয়া দরকার। “
“ নিয়ে যাবেন মানে? কোথায়? “
“ধুর! অর্ধেক কথা বললে বুঝবে কীভাবে! বিকেলেই হুট করে ভাইয়া বলল, সন্ধ্যায় বাড়িতে একটা পার্টি আছে। ভাবি মা’র মন ভালো হবে যদি তোমাদেরও আনা যায়, তাই ভাইয়া আমাকে পাঠিয়েছে—তোমাদের নিয়ে যেতে। আন্টির সাথেও অলরেডি কথা বলে নিয়েছে।”
হামিংবার্ড পর্ব ৩৫
“ ভাবি মা? “
তালহা জোরে হেসে উঠল।
“ হ্যাঁ। আমার ভাইয়ের আদেশ, তার বউকে ভাবি মা বলে ডাকতে হবে। প্রচুর টক্সিক উনি, সাথে ওভার পজেসিভ। “
“ আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু মা কি বলেছে, পার্টিতে যাবে সবাই? “
“ হ্যাঁ, বললেন বলেই তো নিতে এলাম আমি। “
নয়না বেশ খুশি হলো। হাসি হাসি মুখে বলল,
“ আমি আজ আপুর সাথে থেকে যাবো। “
“ বেশ, যেও৷ “
“ আচ্ছা। “