হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ১৮

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ১৮
তোয়া নিধী দোয়েল

রেজুয়ান চেয়ারে হেলান দিয়ে জানালার সামনে বসে কাঠগোলাপটা দেখছে। ফুলটা ভীষণ সুন্দর! ঘ্রান ও অসাধারণ! ও ফুলটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“তোমার সাথে আরেকটা বার দেখা হোক কাঠগোলাপ! আরেকটা বার!”
ডান পা বাম পায়ের উপর দিয়ে দোলাচ্ছে। ফুলটার দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবে কিছু ভাবছে।
মুজাহিদ রেজুয়ানের ঘরে এসে দেখে রেজুয়ান জানালার সামনে এক ধ্যানে বসে আছে। স্কুল থেকে আসার পর আজ রেজুয়ানের সাথে এক বার ও দেখা হয়নি। তাই, সে এসেছে ওর খোঁজ নিতে। বিছানায় বসতে বসতে বলে,

“কিরে বাচ্চা! কই ছিলি? আজ একবার ও ঘরে গেলি না। কি হয়েছে?”
রেজুয়ান ফুলটা মুজাহিদের দিকে নিয়ে বলে,
“ফুল টা সুন্দর না?”
“হুম! কি ফুল এটা?”
“ফুলটার মালিক আরও সুন্দর! না সুন্দর না।”
রেজুয়ান কিছু ভেবে বলে,
“ফুলের মালিক শুধু সুন্দর না। অদ্ভুত সুন্দর! কেমন যেনো সুন্দর!”
মুজাহিদ চোখ ছোট ছোট করে বলে,
“কোন মালিক?”
“এই যে এই অদ্ভুত সুন্দর ফুলের মালিক!”
মুজাহিদ কিছু বলার আগে রেজুয়ান আবার বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“বাপের ভাই, তোমার কাছে একটা রিকোয়েস্ট করি। এই কাঠগোলাপকে আমার চাই। তুমি যে ভাবে পারো এই কাঠগোলাপকে তোমার ছেলের বউ করে দেও।”
“তুই না সে দিন কাকে যেনো চাইলি। সেটার কি হলো?”
আদনান ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
“বাহ্! ভুতের মুখে রাম রাম। ভূতে কয় কাশী যাম।”
মুজাহিদ হাত উঁচু করে বলে,
“বাচ্চা হাই-ফাই।”
আদনান মুজাহিদের হাতে তালি দিয়ে দু’জনে হো হো করে হেসে উঠে। ওদের হাসি দেখে রেজুয়ান ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,

“হাসছো কেনো?”
“তুই করবি বিয়ে! সিগারেট খাস জানতাম। কিন্তু, গাঁজা খাওয়া ধরলি কবে সেটা বল।”
ব্যঙ্গ স্বরে বলে মুজাহিদ। আদনান দৃষ্টি কঠোর করে বলে,
“তোকে সিগারেট খেতে মানা করছি না?”
“প্রতিদিন খাই না। মাঝে একটা।”
“ওই একটাই খাবি কেন?”
রেজুয়ান ফুলটা টেবিলের উপরে রেখে উঠে এসে বলে,
“ভাই একটা কথা বলি? আজ আমি একটা অদ্ভুত সুন্দর স্নিগ্ধ মুখশ্রীর মেয়ে দেখেছি৷ মেয়েটা নিজ থেকে আমাকে এই ফুল দিছে। কেনো জানিনা মেয়েটাকে দেখার পর থেকে আমার মাঝে অদ্ভুত কিছু টের পাচ্ছি। এইটাকে কি বলে?”
মুজাহিদ বিছানায় শুয়ে বলে,
“গাঁজা আর লাল পানি বেশি সেবনের ফল বলে।”
রেজুয়ান বিরক্ত নিয়ে বলে,
“আরে এই মেয়েটা সত্যি অন্য রকম। মানে এক দম অন্য রকম! ওকে দেখার পর আমার হৃদয়ে কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু, কি হয়েছে সেটা জানিনা।”
মুজাহিদ আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,

“ওর ঐ টা নাকি হৃদয়! আমি তো এত দিন জানতাম ঐ টা গার্লস হোস্টেল।”
এই বলে দু’জন আবারো হাসিতে ফেটে পড়ে। রেজুয়ান হতাশার দৃষ্টি নিয়ে বলে,
“ভাই, তোমরা আমার সাথে এমন করছো কেনো। আমি সত্যি বলছি। আচ্ছা বাপের ভাই, তুমি তো বুঝবে। না তুমি তো বাপের ভাই আমাকে কি ভাবে বুঝবে।
ভাই, (আদনানের দিকে ঘুরে) তুই তো বুঝবি আমাকে৷ তুই তো আমার আপন ভাই। মায়ের পেটের ভাই৷ আমি…আমি সত্যি বলছি এই মেয়েটা অন্য রকম।”
আদনান রেজুয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে বলে,
“ভাই আমার, বড় ভাই হিসেবে আমার উচিত নেশা করার জন্য তোকে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলা। কিন্তু, কোনো ভুলের জন্য প্রথমে কোনো স্টেপ নিলে সেটা ভালোর চেয়ে খারাপ হয় বেশি৷ আগে বোঝাতে হয়। তাই তোকে ভালো মতো বুঝিয়ে বলছি নেশা কাটা। আর জীবনে এই রকম ভুল করিস না।”
রেজুয়ান হতাশার শ্বাস ফেলে বলে,

“ভাই, আমি সত্যি সিরিয়াস। বিশ্বাস করো আমার লাইফে এত মেয়ে, এত মেয়ে কিন্তু, আগে কখনো এই রকম কিছু অনুভব করিনি।”
মুজাহিদ ব্যঙ্গ স্বরে বলে,
“তুই যদি সিরিয়াস হোস, তাহলে শয়তানে ভণ্ডামি বাদ দিয়ে জিকির করতে বসবো।”
রেজুয়ান দুই ভ্রুর মাঝে ভাঁজ ফেলে বলে,
“বা* গেলাম আমি। আমার কথা তোমরা কখনো বুঝবা না। একটা সিরিয়াস কথা বলতেছি তবু ও মজা নিচ্ছো। থাকবো-ই না এখানে।”

এই বলে ও উলটো ঘুরে বাইরে যাওয়ার জন্য। আদনান মুজাহিদ নিজেদের মধ্যে কথপোকথন শুরু করে। ওকে কেউ আটকাছে না বলে ও মুজাহিদ আর আদানানের দিকে ঘুরে।
“ভাই আমি রাগ করে চলে যাচ্ছি। আটকাও অন্ততঃ!”
মুজাহিদ রেজুয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কাল লেবু আনছিলাম। ভাবির কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে খেয়ে আয়৷ তারপর দেখছি তোর নেশা কি ভাবে না কাটে।”
রেজুয়ান হতাশার শ্বাস ফেলে। ভণ্ডামি করতে করতে এমন পর্যায়ে চলে গেছে এখন সিরিয়াস কথা বলে ও কেউ বিশ্বাস করে না। ও কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আবার ঘুরে আসে। মুজাহিদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে

“কিরে এত তাড়াতাড়ি চলে এলি। লেবু খাইছস? নেশা কাটছে?”
রেজুয়ান টেবিলের উপর থেকে ফোন নিয়ে আবার বেরিয়ে যায়।
আবারও রুমে ঢোকে। মুজাহিদ মাথায় হাত দিয়ে বলে,
“আল্লাহ্! আদনানরে ও তো শুধু পাতা খায় নাই। সাথে লাল পানি ও খাইছে। কয় বার রুমে আসলো দেখছস?”
“জাহিদ মাস্টার বিমানের চাবি কই রাখছো?”
আদনান বলে,
“রাতের বেলা কই যাবি?”
“অভ্রর বাসায়। তোমরা তো আমার কথাটা বুঝতেছো না।”
“টেবিলের উপর। বেশি রাত করিস না। আর আসার সময় লেবু খেয়ে আসিস।”
দেবেন্দ্র কলেজের গার্লস হোস্টেলের পাশে প্রধান অধ্যক্ষের নিবাস। উপমা পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে। ও অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।

ঘর অন্ধকার। শুধু টেবিলে টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। উপমা মৃদু পা নাড়াছে। এইটা ওর খুব বাজে স্বভাব। বসে থাকলে শুয়ে থাকলে পা নাড়ায়। তবে, আজ ক্ষণে-ক্ষণে পড়ার গতি হারিয়ে ফেলছে। মাথায় হানা দিচ্ছে অন্য চিন্তা।
ও বিরক্ত হয়ে বই বন্ধ করে। এই ভাবে পড়া যায় না। ও চেয়ার ছেড়ে উঠে; ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। মৃদু বাতাস বইছে। চারিপাশে হালকা কুয়াশা পড়েছে। শীত প্রায় শেষের দিকে। দিনের বেলা শীত তেমন লাগে না। তবে, রাতে মোটামুটি ঠান্ডা পড়ে।
রাস্তায় একটু পর পর অটো, রিকশা যাচ্ছে। ও ব্যালকনিতে থাকা দোলনায় বসে। আকাশের দিকে তাকায়। আজ এমন কেনো লাগছে। ওই ছেলেটার বলা কথা মনে পড়ছে। নিজের প্রতি অনেক রাগ হচ্ছে। কেনো নিজের জেদ বজায় রাখার জন্য ওই রকম একটা কাজ করলো। কেনো ওর লাইফে সব সমস্যা এসে হাজির হয়। কিছুক্ষণ ভাবার পর সূচির নাম্বারে ডায়াল করে।

“হ্যাঁ, দোস্ত বল। কি করছিস?”
“কিছু না। তুই?”
“পড়তেছি। তুই হঠাৎ অসময় কল দিলি? কিছু হয়েছে?”
“এমনি দোস্ত ভালো লাগছে না।”
সূচি কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
“ওই ঘটনাটা নিয়ে ভাবছিস তাই তো?”
উপমা দীর্ঘ শ্বাস নেয়। ছোট করে জবাব দেয়,
“হুম।”
“তুই আমার কথা কখনো শুনিস না। কত বার বললাম মেয়েটা তোকে ইচ্ছে করে ঐ সবের মধ্যে জড়াচ্ছে। শুনলি না।”
“দোস্ত! (দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে)।”
“হুম।”

“আমার লাইফে কেনো একটুকরো শান্তি নেই? কেনো আমি কোনো কিছুতে শান্তি অনুভব করি না? মানুষ বলে টাকা সব সুখের মূল। আব্বু তো আমার লাইফে টাকার অভাব রাখেনি। তাহলে…তাহলে কেনো আমার এই রকম লাগে?”
উপমার কণ্ঠ ভেজা শোনায়। সূচি অস্থির হয়ে বলে,
“দোস্ত দোস্ত। শান্ত হো। কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেনো? এত অস্থির হচ্ছিস কেনো? আন্টি কিছু বলেছে?”
“উহুম। (চোখ বুঝে)।”
“চিন্তা করিস না। ঐ ঘটনা ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে পেইন দিস না।”
“দোস্ত, আমি সত্যি কি খুব খারাপ? সেই জন্য…..সেই জন্য মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। সেই জন্য আমার জীবন এত অগোছালো। এত অশান্তি লাগে সব কিছুতে। এক….এক ফোটা ভালোবাসা দেওয়ার মত কেউ নেই?”
উপমার চোখ থেকে পানি নামে। সূচি উপমাকে শান্ত করার জন্য বলে,
“একটা চড় খাবি। কি সব বলছিস?”

“দোস্ত কেনো আমি কারো সাথে মিশতে পারি না। কেনো সব কিছুতে আমার রাগ হয়। সকাল বেলা আমার জেদের জন্য এত বড় একটা প্রব্লেম এ পড়লাম। কেনো ঐ ছেলেটার সামনে গেলাম।”
“চিন্তা করিস না। কিচ্ছু হবে না। আর আংকেল তোকে খুব ভালোবাসে। আর আমি তো আছি-ই।”
উপমা মৃদু হেসে বলে,
“আব্বু তো আব্বুই। আমার লাইফে টাকা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে কিন্তু, এক ফোটা ভালোবাসা দিতে পারে না।”
“দোস্ত, তুই শান্ত হো। সকালের ওই ঘটনা মাথা থেকে বের কর। উল্টা-পাল্টা চিন্তা করে নিজের ক্ষতি করিস না। পৃথিবীতে সবাই তোর থেকে দূরে গেলে ও আমি তোর সাথে আছি। মনে রাখিস কেউ তোকে ভালো না বাসলে ও তোর সূচি তোকে ভীষণ ভালোবাসে।”
“ভালোবাসার উৎস হচ্ছে মা। আর আমার জীবনে সেটা-ই নেই। আব্বুর নতুন ওয়াইফ মাঝে মাঝে ঠিক-ই বলে আমার জন্য-ই আমার মা হারিয়ে গেছে। আমি অপয়া। কেনো আমার মুক্তি হয় না এই পৃথিবী থেকে? কেনো মা আমাকে নিয়ে যায় না?”
সকালের ওই ঘটনা ভীষণ ভাবে প্রভাব ফেলেছে উপমার উপর। কিন্তু, উপমা তো ভেঙে পড়ার মেয়ে নয়! সূচি উপমাকে বলে,

“আচ্ছা শোন, আমি আব্বু কে বলছি আমাকে তোদের বাসায় নিয়ে আসতে। আমি আজ তোর সাথে থাকবো। ওকে। আর মন খারাপ করিস না। আমি আসছি।”
এই বলে সূচি কল কেটে দেয়। উপমা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ফোন টেবিলের উপর রাখে।
উপমার মা হেলেনা বেগম, মারা গেছেন প্রায় তেইশ বছর। উপমা পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার কিছু সময় পর মারা যায়। ছোট উপমাকে একা সামলাতে না পেরে বাবা সাইদুজ্জামান ফারুক দ্বিতীয় বিয়ে করে। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রোজা, কয়েক বছর উপমার সাথে ভালো ব্যবহার করলে ও ধীরে ধীরে তাঁর ব্যবহার পালটে যেতে থাকে। ক্রমশ বিরক্ত জ্ঞাপন করেন। যদি ও সব সময় ফারুকের সামনে ভালোমানুষি দেখায়।

বিরক্ত হওয়ার আরও বড় কারণ রোজার নিজের কোনো সন্তান নেই। উনার ধারণা উপমা একটা অপয়া মেয়ে। ও এই বাড়ি আছে দেখে তাই কারো ভালো হয় না। ওর জন্য-ই ওর আসল মা মারা গেছে।
যখন থেকে উপমা বুঝতে পারে তাঁর নতুন মা তার উপর নারাজ; তখন থেকে ও নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়। নিজেকে গড়ে তোলে ভীষণ কঠোর। নিজেকে বোঝায় মা ছাড়া পৃথিবীতে কেউ আপন নয়। মা ছাড়া পৃথিবীতে কেউ ভালোবাসতে জানেন না। আর যদি ভালোবাসা দেখায়, তবে তা কোনো লোভে পড়ে। তবে, ছোট বেলা থেকে সূচি মেয়েটি ওর জীবনে একটা অধ্যায় হয়ে রয়েছে। যে কোনো সার্থ ছাড়াই ওকে ভালোবাসে। আগলে রাখে। একটু হলে ও বোঝে। কিন্তু, এত কঠোর হৃদয় তৈরি করার পর ও মাঝে মাঝে ভালোবাসার অভাব অনুভব করে। মাঝে মাঝে ভীষণ ভাবে চায় মায়ের মত করে কেউ ভালোবাসুক। ভীষণ ভালোবাসুক! যাকে ও সারাজীবন হৃদয়ের সঙ্গোপনে কঠোর ভাবে বেঁধে রাখবে।

উপমা উঠে ব্যালকনির হাফ ওয়াল ধরে দাঁড়ায়। ব্যালকনিটা ভীষণ সুন্দর। হাফ ওয়ালের উপর কোনো রেলিং নেই ধরার। এক দম খোলা। মনে হয় হাত বাড়ালে খোলা আকাশ ছোঁয়া যাবে। ও আশে পাশে তাকিয়ে রাতের সৌন্দর্য অবলোকন করে। ডান পাশে সরু রাস্তায় চোখ পড়তে নজরে পরে এক অপ্রীতিকর দৃশ্য। দূরে এক মেয়ের সাথে দুইটা ছেলে ধস্তাধস্তি করছে। ও আরেকটু ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, ঠিকই তো! আশে পাশে কেউ নেই। উপমা আর দেরি না করে ছুটে ঘর থেকে বের হয়।
মেইন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে পড়ে। খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই ও ড্রয়িংরুমে রুমে এসে রান্নাঘরে গিয়ে বঁটি নিয়ে বের হয়।
সরু রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে অভ্র আর রেজুয়ান। রেজুয়ান সাইকেল হাতে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। অভ্র রেজুয়ানকে পরখ করে বলে,

“দোস্ত তোকে আমার বিশ্বাস হয় না। তুই মেহুর জন্য এই কথা বলেছিলি। ওর জন্য নাকি তোর কেমন লাগে। তার দুই দিন পর শুনি ব্রেকআপ করে চলে আসছস।”
“আরে বা* তোরা কেনো কেউ আমার কথা সিরিয়াস নিতেছস না? বাড়িতে জাহিদ মাস্টার, ভাইকে ও বুঝাতে পারলাম না। এখন তুই ও বুঝতেছস না।”
“আচ্ছা তুই বল তুই মেহুর জন্য পাগল হোস নাই? বলছস নাই মেহুকে তোর চাই?”
“আরে ভাই কাঠগোলাপ সত্যি অন্য রকম। মেহু….।”
রেজুয়ান কথা থামিয়ে দূরে দৃষ্টি স্থির করে। কারা যেনো ধস্তাধস্তি করছে। একটা মেয়ে ও আছে। রেজুয়ান দ্রুত সাইকেলে উঠে। সাইকেলের পেছনে উঠে অভ্র। দ্রুত সাইকেল চালিয়ে ওই জায়গায় চলে যায়।
উপমা বঁটি হাতে দৌড়ে আসছে। লম্বা বেণী ডানে বামে দুলছে। ওড়নার এক প্রান্ত বড় আরেক প্রান্ত ছোট হয়ে উড়ছে। উত্তেজনার বসে কোমড়ে বাঁধতে ভুলে গেছে।

রেজুয়ান দ্রুত গতিতে সাইকেল চালিয়ে আসে। অভ্র আগে নেমে ছেলে গুলোর কাছে যায়। রেজুয়ান এক পাশে কোনো রকমে সাইকেল রেখে ঘুরে দাঁড়ায়। ছুটে ছেলেগুলোর দিকে যেতে গেলে সজোরে ধাক্কা খায় কারো সাথে!
উপমা ধাক্কা খেয়ে নিজেকে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। দ্রুত ক্রোধ নিয়ে সামনে থাকা ব্যক্তিটির উদ্দেশ্যে হাতের বঁটি উঁচু করে ধরে। রেজুয়ান বঁটি দেখে দুই পা পিছিয়ে দুই হাত স্যারেন্ডারের মত করে উঁচু করে।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারী রণমুর্তিকে দেখে দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে। অজান্তে-ই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়! সেই স্নিগ্ধ অদ্ভুত সুন্দর মুখশ্রী! কপালের কয়েকটা চুল বাতাসের জন্য উড়ছে। তবে চেহারায় ফুটে উঠেছে তীব্র ক্রোধ। রেজুয়ান মুগ্ধ দৃষ্টি মোহময় কণ্ঠে উচ্চারণ করে,

“কাঠগোলাপ!”
উপমা তিব্র ক্রোধ নিয়ে বলে,
“ওই মেয়েটাকে ছেড়ে দিন। তা না হলে এক কো*পে ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেবো।”
পেছন থেকে অভ্রর কণ্ঠ ভেসে আসে,
“মীম, তাড়াতাড়ি এই দিক আই ভাই। বাই** গুলাকে ধর।”
উপমা রেজুয়ানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওর পেছনে নেয়। রেজুয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনে তাকিয়ে আবার সামনে তাকায়। উঠানো হাত নামিয়ে বলে,
“কাঠগোলাপ! আমরা একই পথের পথিক।”
উপমা ক্রোধ নিয়ে বলে,

“সরুন সামনে থেকে। নয়লে বঁটির একটা কো/প আপনার গলায় ও পড়ে যাবে।”
এই বলে উপমা ওই মেয়েটির দিকে ছুটে। ওই-খানে উপস্থিত দুইটা ছেলে। একটা ছেলে অভ্রর সাথে মারামারি করছে। অন্য জন ওই মেয়েটার দিকে হাতে ছুরি নিয়ে এগোচ্ছে। উপমা ছেলেটাকে ধর‍তে গেলে রেজুয়ান এক থাবা দিয়ে ছেলেটার পিঠের শার্ট খামছে ধরে। উপমা দাঁড়িয়ে যায়। রেজুয়ান তিব্র রাগ নিয়ে বলে,
“শু***বা** তর জন্য বেয়াদবির জন্য আমার কাঠগোলাপ তোকে ছুঁতে এসেছে। তোর কি অবস্থা করি দেখ।”
এই বলে ছেলেটার শার্ট টেনে ছিঁড়ে ফেলে। ঘাড় ধরে পেটে লাথি মেরে রাস্তায় শোয়ায়। মাথার তালুর চুল ধরে রাস্তার সাথে জোরে জোরে আঘাত করতে থাকে। উপমা মেয়েটার কাছে ছুটে যায়। অবাক হয়ে বলে,

“সুমা তুমি!”
“আপা আপা আমি মায়ের জন্য ঔষধ কিনতে আসছিলাম। আমার মা খুব অসুস্থ। ঔষধ কিনে যাওয়া পথে এই জা**গুলা আমার রাস্তা আটকায়।”
এই বলে সুমা কান্না করতে থাকে। উপমা এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ওকে। শান্ত করে বলে,
“কান্না করো না। কিচ্ছু হবে না।”
পাশে একটা রিকশা এসে থামে। রিকশাটা খালি। রিকশাওলা এখানে মারা-মারি দেখে ভয় পেয়ে যায়। মারা-মারি থামাতে হবে তা না হলে কেউ বড়ো-সড়ো আঘাত পাবে। উপমা রিকশাওয়ালার কাছে গিয়ে বলে,
“মামা, সাহায্য করুন। সামনে তো থানা। দয়া করে পুলিশ নিয়ে আসুন।”

রিকশাওয়ালা ডান পাশে মাথা কাত করে দ্রুত রিকশা নিয়ে থানার দিকে যায়।
ওইদিকে অভ্র কে এক ঘুষি দিয়ে ছেলেটা পকেট থেকে ছুরি নিয়ে, সুমার দিকে আসে। সুমা চ্যাঁচিয়ে উঠে। উপমা ছেলেটাকে আসিতে দেখে সুমাকে এক পাশ করে বঁটির উলটোপাশ দিয়ে আঘাত করে। ছেলেটা উবু হয়ে পড়ে যেতে গিয়ে উপমার পায়ে পা লেগে উপমা ও পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তবে, ও পড়ে যাওয়ার আগে একটা হাত এসে ওর এক হাত শক্ত করে ধরে। উপমা কিঞ্চিৎ হেলে পড়ে। যে পাশের ওড়না লম্বা ছিলো তা রাস্তায় গিয়ে ঠেকে। ছেলেটার হাতের ছুরি উপমার ওড়নার কাছে পড়ে। রেজুয়ান ঘাড় কিঞ্চিৎ বাকা করে বলে,
“ভয় নেই কাঠগোলাপ। আমি থাকতে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।”
একটা ছেলে ওর হাত হাত ধরেছে! এইটা অনুভব হওয়ার সাথে সাথে ও তেজি কণ্ঠে বলে,

“হাত ছাড়ুন।”
“কাঠগোলাপ! তোমার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আমাদের সাক্ষাৎ বার বার হবে। তুমি যত-ই এটা কে ডেয়ার অথবা গেম বলো। আমি বলবো তুমি আমার হার্ট হ্যাকার! তুমি আমার প্রথম প্রেম!”
উপমা দাঁতে দাঁত চেপে বলে—
-আপনি হাত ছাড়ুন। না হলে…

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ১৭

উপমা আর কিছু বলার আগেই রেজুয়ান ওর হাত ছেড়ে দেয়। উপমা ছাড়া পেয়ে রেজুয়ান কে চোখ রাঙিয়ে ওর সামনে থেকে সরে যায়। ওই মেয়েটার কাছে গিয়ে — মেয়েটাকে নিজের বাসায় নিয়ে যায়।
রেজুয়ান ও, ওই দুই ছেলেকে আরেকবার শাসিয়ে জায়গা ত্যাগ করে।

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ১৯+২০