হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৮

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৮
তোয়া নিধী দোয়েল

ছেলে গুলো রেজুয়ান-কে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। পাঁচজন ছেলে রেজুয়ানকে কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে ঘুরতে থাকে। রেজুয়ানের মাথায় ঢুকছে না ওরা কি চাচ্ছে। কি-ই বা ওদের পরিচয়। তবে, বয়স ওর বয়সের কাছাকাছি। ব্যাপার টা সুবিধার ঠেকছে না। ছেলে গুলো যে ওকে এমনি এমনি ঘিরে ধরে -নি, তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে।
রেজুয়ানের ফোন হাতে-ই ছিলো। তাই, ও চোরা চোখে ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে আদনান কে এসএমেস করে। ‘Bhai ektu taratari nimtuli aso.’ এইটুকু এসএমেস সেন্ড করতেই, পাশ থেকে একটা ছেলে ওর ফোন নিয়ে যায়। রেজুয়ান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,

– তুই আমার ফোন নিলি কেনো?
ছেলেটা ফোন হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে হাসতে থাকে। সাথে হেসে উঠে বাকি ছেলে গুলো-ও৷ রেজুয়ান কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকে। রেজুয়ানের সামনে যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে ছিলো সে এগিয়ে এসে বলে,
-তোর নাম মীম?
রেজুয়ান সামনে তাকিয়ে বলে,
-কেনো?
ছেলেটি ব্যঙ্গ স্বরে বলে,
-তোর নাকি বাড় বেড়েছে? রাতের বেলা রাস্তায় মার-পিট করছ?
রেজুয়ান ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করে ছেলেটির কথা। ও কবে মারা-মারি করলো? কার সাথে করলো। সেটাই ভাবার চেষ্টা করছে। কিছু সময় পর ছেলেটি আবার বলে উঠে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-কিরে, হিরো হতে চাস?
রেজুয়ান কিছুক্ষণ স্মৃতির পাতা বিচরণ করে; মনে করে সেই রাতের কথা। যে দিন রাতে রাস্তায় দুইটা ছেলেকে মেরেছিলো। ছেলেগুলো কি তাহলে সেই কথা বলছে? রেজুয়ান সামনে থাকা ছেলেটার কথার উত্তর না দিয়ে, পাশে থাকা ছেলেটির দিকে তাকায়; যে ওর ফোন নিয়েছে। ও আবারও ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলে,
-আমার ফোন দে।
-নে।
ছেলেটি রেজুয়ানের মাথার উপর দিয়ে ফোন নিক্ষেপ করে অন্য আরেকজনকে দেয়। হেসে বলে,
-কিরে হিরো ধরতে পারিলা? রাতে তো খুব মারা-মারি করিস। এখন সাধারণ ফোনটাই ধরতে পারিলা?
এই বলে হাসিতে ফেটে পরে সবাই। রেজুয়ানের ক্রোধ তরতর করে বাড়তে থাকে। ও কঠিন স্বরে বলে,
-তোদের সমস্যা কি? কি চাই তোদের?
আরেকটা ছেলে হাসতে হাসতে বলে,

-ওই, ও নাকি এখনো বোঝেনা আমাদের কি চাই।
আবার হাসিতে ফেটে পরে পাঁচজন ছেলে। রেজুয়ান প্যাডেলে পা দিয়ে সাইকেল ঘোরাতে চায়। তবে পেছন থেকে একটা ছেলে সাইকেলের ব্যাক-সিট ধরে। রেজুয়ানের মাথায় রক্ত উঠে যায়। একে তো ওর রাস্তা আটকিয়েছে, ফোন নিয়েছে, আবার সাইকেল ও হাত দিয়েছে। সাইকেলটা মুজাহিদের। ও চায় না সাইকেলের কোনো ক্ষতি হক। তাই, ও রাগের বসে সাইকেল থেকে নেমে পেছনের ছেলেটির কলার চেপে ধরে।

রেজুয়ানের এসএমেস পাওয়ার সাথে-সাথে আদনানের মাথা ঘুরে উঠে। ছেলেটা কোন বিপদে পড়লো আবার! ও দ্রুত গতিতে রুম থেকে বেরিয়ে মুজাহিদের ঘরে যায়। কিন্তু, মুজাহিদকে ঘরে পায় না।
রান্নাঘরে মুজাহিদ তুর্কি আর হুমাইরা মিলে খোশগল্পে মেতেছে। তুর্কি বসে বসে হুমাইরার কাজ দেখছে। আর মুজাহিদ পরোটা ভাজছে। রচনা, মোহোনা -সূচনা কে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে।
নিত্য দিনের মতো মুজাহিদের বিয়ে না করা নিয়ে হুমাইরা তাকে কথা শোনাচ্ছে। আর মুজাহিদ হেসে তা উড়িয়ে দিচ্ছে৷ হুমাইরা বিদ্রোহী কণ্ঠে বলে,

-না। আমি এইবার আর কোনো কথা শুনবো না। আমি এইবার যে মেয়ে দেখবো, তাকেই তোমাকে আনতে হবে।
মুজাহিদ পরোটা এপিঠ-ওপিঠ করতে কর‍তে বলে,
-তোমার ছোট ছেলে বিয়ের জন্য ক্ষেপেছে। তুমি বরং ওর জন্য পাত্রী খুঁজো।
হুমাইরা চালের হাড়ি চুলার উপর দিয়ে বলে,
-হ্যাঁ। তোমার আগেই তোমার ভাইস্তারা-ই বিয়ে করুক। আর তুমি…
আদনান হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে মুজাহিদের উদ্দেশ্যে বলে,
-জাহিদ মাস্টার। তাড়াতাড়ি আসো। নিমতুলি যাবো।
মুজাহিদ ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
-কেনো?
আদনানের অস্থিরতা দেখে হুমাইরা বলে,

-কি হয়েছে রে?
তুর্কি চুপচাপ আদনানের দিকে তাকিয়ে থাকে। ও আদনানকে কখনো এমন অশান্ত দেখে না। আদনান কারো কথার উত্তর না দিয়ে, মুজাহিদের দিকে এগিয়ে এসে মুজাহিদের হাত ধরে টেনে বলে,
-আগে আসো।
-আরে পরোটা চুলায়।
-মা দেখবে।
এই বলে, মুজাহিদ কে টেনে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়। বের হওয়ার সময় পাশে থাকা একটা বস্তার সাথে হোঁচট খায়। হুমাইরা বলে,
-একটু দাঁড়িয়ে বা বসে যা।
-না মা। আমার সময় নেই।
-আরে বের হওয়ার সময়…
আদনান আর কোনো কথা শুনে না। মুজাহিদ কে নিয়ে দ্রুত চলে যায়।

রেজুয়ান ছেলেটার কলার টেনে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
-আমার রাস্তা ছেড়ে দে বলছি। নইলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।
পাশ থেকে একটা ছেলে পকেট থেকে একটা রূপালি রঙের মোটা চেইন বের বের করে দুই হাতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলে,
-বাহ্! হিরো তো চেতে গেছে।(কিঞ্চিৎ হাসির স্বরে)
রেজুয়ান যে ছেলেটার কলার ধরে রেখেছে, সেই ছেলে টা সব ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলে,
-ওই তোরা দেখছোস কি? বাই** কে ধর।

রেজুয়ান ছেলেটার পেট বরাবর জোরে লাথি দিয়ে ফেলে দেয়। ছেলেটা লাথি খেয়ে পেট ধরে বসে পড়ে। বাকি চারজন ছেলে তেড়ে আসে ওর দিকে। এক জন পকেট থেকে ছুরি ও বের করে। সেই দিন রাতে রেজুয়ান যে ছেলে দু’টাকে মেরেছিলো; হয়তো সেই প্রতিশোধ নিতেই আজ ওরা এসেছে।
রেজুয়ান আশে পাশে তাকিয়ে দেখতে পায় দোকানের পাশে ছোট দুইটা বাঁশের খণ্ড রাখা আছে৷ ও ছুটে বাঁশের খণ্ড আনতে যায়। মুদি দোকানি ওদের মারা-মারি দেখে সাটার নামিয়ে দেয়। রেজুয়ান বাঁশ হাতে ওদের দিকে তাকায়। ও একা চারজনের সাথে পেরে উঠবে না। কারণ ওদের চারজনের মধ্যে দুই জনের হাতে অস্ত্র। ও মনে মনে আদনানের উপস্থিতি কামনা করতে থাকে।

মত্ত থেকে নিমতুলি বেশি দূর নয়। আদনান মুজাহিদ রিকশা করে আসছে৷ আদনান ভীষণ উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। কেনো রেজুয়ান ওকে যেতে বলেছে তাই ভাবছে। পাশ থেকে মুজাহিদ ওর অস্থিরতা দেখে ওকে সামাল দেয়।
-আরে বাচ্চা, এত অস্থির হচ্ছিছ কেনো?
-জানিনা বাপের ভাই। কেমন যেনো অস্থির লাগছে৷ ও কোনো বিপদে পড়ে নি তো।
-আরে ধুর। শান্ত হো তুই। কিছু হয়নি৷ দেখ শয়তানটা আবার কোন কাণ্ড বাঁধিয়েছে।
রেজুয়ানের হাতে বাঁশ দেখে ছেলে গুলো হেসে কুটিকুটি হয়।
-বাঁশ নে। আর গাছ নে৷ আজ তোর জীবন কেউ বাঁচতে পারবে না। তুই সাইমম ভাইয়ের জিনিসের দিকে নজর দিছস। তোর চোখ উঠিয়ে ফেলবো।
রেজুয়ান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,

-সাইমম কে?
-ভাব মারাও। সাইমম কে চেনো না?
-আমি কাউকে চিনতে চাইনা। তোরা কি চাইছিস সেটা বল। তা না হলে তোদের অবস্থা খারাপ করে দিবো।
-তুই যে মেয়েটার পিছ ধরছস; সেই মেয়েটার পিছু ছেড়ে দে। তাহলেই আমরা তোকে ছেড়ে দেবো।
আরেকটু অবাক হয় রেজুয়ান। ও কোন মেয়ের পিছু ধরলো। ও যৎসামান্য অবাক কণ্ঠে বলে,
-কোন মেয়ে?
একটা ছেলে এগিয়ে এসে বলে,
-নাটক চো**। কোন মেয়ে চিনস না? ঐ যে কলেজে তোকে একটা মেয়ে ফুল দিলো। তারপর সেই দিন রাতে যে মেয়েটার সামনে হিরো সাজলি ঐ মেয়ে।
রেজুয়ান ক্ষণকাল ভেবে ছোট করে উচ্চারণ করে,
-কাঠগোলাপ!

-ওই মেয়েটা শুধু সাইমম ভাইয়ের। ভালোই-ভালোই বলতাছি মেয়েটার পিছু ছেড়ে দে। তা না হলে…
রেজুয়ান ছেলেটার মুখের বাক্য কেড়ে নিয়ে শব্দে করে হেসে উঠে। দোকানের সামনে থাকা সিঁড়ির মধ্যে বসে বলে,
-আরে ঐ টা তো আমার বাগানের ফুল। তোদের ভাবি। তোরা আমার বাগানের ফুল কে, আমার কাছ থেকে তুলতে এসছস? বেশ ইন্টারেস্টিং তো।
-ওই…
একটা ছেলেটা ক্রোধ নিয়ে এগিয়ে আসে। রেজুয়ান বসা থাকা অবস্থায় ছেলেটার পা বরাবর বাঁশ দিয়ে বাড়ি মারে। ছেলেটা উবু হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়৷
-ভুলে ও কাঠগোলাপ তোলার সাহস দেখাইছ না। বাগানের মালিক কিন্তু, মোটে ও ভালো না। ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে তোদের।

ছেলেটাকে পড়ে যেতে দেখে বাকি ছেলে গুলো ক্রোধ নিয়ে এগিয়ে আসে।
ততক্ষণে আদনানদের রিকশা এসে পৌঁছায় নিমতুলির মোড়ে। রেজুয়ানের দিকে ছেলেগুলোকে তেড়ে যেতে দেখে ; আদনান দ্রুত রিকশা থেকে নামে ছুটে যায়। মুজাহিদ ভাড়া পরিশোধ না করেই ‘বাচ্চা’ বলে ছুটে যায়।
রেজুয়ান, আদনান মুজাহিদ কে দেখে আরও সাহস সঞ্চার করে। আদনান মুজাহিদ এসে ছেলে গুলোর সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে। রেজুয়ান ও বসা থেকে উঠে আরেকটা বাঁশের খণ্ড এনে মুজাহিদের হাতে দেয়। মুহূর্তেই সৃষ্টি হয় একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশ।

আদনান একটা ছেলেকে রাস্তার মধ্যে ফেলে, রাস্তার সাথে মাথায় আঘাত করতে থাকে। মুজাহিদ ও একটা ছেলেকে রাস্তায় ফেলে বাঁশ দিয়ে পেটাতে থাকে। একটা ছেলে হাতে ছুরি নিয়ে ছুটে যায় মুজাহিদের দিকে। মুজাহিদ কে পেছন থেকে আঘাত করতে গেলে আদনান ছুটে আসে। মুজাহিদ কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ছেলেটার হাতের ছুরির আঘাত আদনানের পিঠের বাম পাশে লাগে। আদনান দ্রুত ডান হাত দিয়ে পিঠের বাম পাশে চেপে ধরতে গেলে, আরেকটা আঘাত এসে লাগে ওর ডান হাতের তালু তে। বৃদ্ধাঙ্গুলির নিচ থেকে কনিষ্ঠ আঙুলের নিচ বরাবর তেড়ছা ভাবে আঘাত লাগে। রক্তে রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় আদনানের গেঞ্জি। সাথে হাত। মুজাহিদ ধাক্কা খেয়ে ঘুরে তাকায় আদনানের দিকে। আদনানকে ঐ ভাবে দেখে তার বুকের পাঁজর টনটন করে উঠে। ‘বাচ্চা’ বলে ছুটে যায়।

রেজুয়ান যে ছেলেটার সাথে লড়ছে করছে সেই ছেলেটা হাতে রূপালি রঙের মোটা চেইন। রেজুয়ান মুজাহিদের চিৎকার শুনে পাশে তাকাতেই; ছেলেটা ওকে মোটা চেইন দিয়ে হাতে আঘাত করে। ওর হাত থেকে বাঁশের খণ্ড পড়ে যায়। তারপর, আবারও ছেলেটা ওর পায়ে আঘাত করে। ও পা ধরে কুঁজো হয়ে যায়। তিনটা ছেলের অবস্থা খারাপ, তাই বাকি দুইটা ছেলে ওদের আঘাত করে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
রেজুয়ান খুঁড়াতে খুঁড়াতে ভাই বলে এগিয়ে আসে। মুজাহিদ নিজের সাথে চেপে ধরে আদনানকে। তাঁর হাত পা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে থাকে। রেজুয়ান আদনান তার চোখের মণি। তাঁর জীবনের চেয়ে বেশি মূলবান তাঁর এই দুই ভাতিজা। ওদের কিছু হলে সে নিজেও বাঁচবে না।

পিঠের আঘাত টা তীব্র না হলে ও হাতে জখম ভালোই হয়েছে। আদনান মুজাহিদের উদ্দেশ্যে বলে,
-জাহিদ মাস্টার, আমি ঠিক আছি। তুমি ঠিক আছো?
মুজাহিদ আদনানের রক্ত মাখা হাত ধরে তাঁর বুকের সাথে চেপে ধরে। কিঞ্চিৎ ভেজা কণ্ঠে শোনা যায়
-বাচ্চা! আমার বাচ্চা!
আদনান রেজুয়ানকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসতে দেখে, দ্রুত ওঠার চেষ্টা করে। তবে পিঠে টান লেগে আরও রক্ত বের হয়। রেজুয়ান আদনানের কাছে এসে বলে,
-ভাই।
আদনান দ্রুত কণ্ঠে বলে,

-দেখি পায়ে কোথায় ব্যথা পেয়েছিস।
-ভাই আমি ঠিক আছে। তোমার হাত।
ও আদনানের বাহু চেপে ধরে।
-আমি ঠিক আছি৷ তোরা ঠিক আছিস।
আদনানের হাত থেকে ক্রমাগত রক্ত বের হয়েই যাচ্ছে। ঐ দিকে রেজুয়ানের হাত পা ব্যথায় টনটন করছে। তবে ও ভাইয়ের জন্য বেশি উদগ্রীব। মুজাহিদ আশে পাশে তাকিয়ে কোনো রিকশা বা অটোর খোঁজ করে৷ তার শরীরে তেমন আঘাত লাগেনি। সে দ্রুত উঠে রিকশার সন্ধান করে। রেজুয়ান আদনানের হাতে পিঠে চেপে ধরে রক্তক্ষরণ কমানোর চেষ্টা করে। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে একটা অটোরিকশা পেয়ে ও যায়। আদনান আগে উঠে। মুজাহিদ রেজুয়ানেকে ধরে উঠাতে গেলে, রেজুয়ান পাশে ওর ফোন পড়া দেখতে পায়। মুজাহিদ বলে,

-তুই ওঠ। আমি নিয়ে আসছি।
মুজাহিদ রেজুয়ানের ফোন নিয়ে তুলে; সাইকেল লিটনের দোকানে রেখে আসে। অটোরিকশাটা বড় হওয়ার দরুন তিনজনের জায়গা বেশ ভালো মতই হয়ে যায়।

যাওয়ার পথে আদনানের ঐ ভাবে হোঁচট খাওয়া দেখে তুর্কির মন যেনো কেমন করছে। ভীষণ অস্থির লাগছে। তার উপর হুমাইরা বললো একটু বসে যেতে। আদনান তাও বসলো না। ও চিন্তিত ভঙ্গিতে বৈঠক খানায় বসে রয়েছে। হুমাইরার রান্না তখন ও বিদ্যমান।

কিছুক্ষণ পর সদর দরজায় টোকা পড়ে। তুর্কির হৃদপিণ্ডের চলন একটু বেরে যায়। ও দ্রুত উঠে দরজা খুলে। বেশিক্ষণ বসে থাকার দরুন রেজুয়ানের পায়ের ব্যথা বেরেছে। তাই, মুজাহিদ ওকে এক হাত দিয়ে ধরেছে। আরেক হাত দিয়ে ধরেছে আদনানের রক্ত মাখা হাত। দরজা খোলার সাথে সাথে তুর্কির প্রথমে চোখ পড়ে মুজাহিদের আদনানের রক্তমাখা হাতের উপর। ওর হৃদপিণ্ডের স্পন্দন আরও দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ওর হাত পা কাঁপতে শুরু করে। এই তো সন্ধ্যায় ঐ হাতটা ধরে ও ঘুরছিলো। ঐ হাত দিয়ে একটা ফুল ওর কানে গুঁজে দিয়েছিলো। আর এখন কিনা সেই হাত থেকে রক্ত বের হচ্ছে! ও দ্রুত আদনানের দিকে এগিয়ে এসে যৎসামান্য কাঁপা কণ্ঠে বলে,

– স্যার!
মুজাহিদ আদনানের হাত তুর্কির হাতের উপর দিয়ে বলে,
-ওর হাতে তাড়াতাড়ি ঔষুধ লাগাও।
তুর্কি আদনানের হাত ধরে কেঁপে উঠে। আল্লাহ্! কতখানি কেটে গেছে৷ তুর্কির চোখের কার্নিশে পানি জমা হয়। ও অন্য দ্রুত আদনানের বাহু ধরে বলে,
– স্যার, কি ভাবে কাটলেন হাতটা?
আদনান হাত সরিয়ে বলে,
-আরে ঐ সামান্য একটু কেটেছে। তুমি মাকে ডাকো। মীম এর পা ফুলে গেছে। ওকে দেখতে বলো আগে।
মুজাহিদ তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে,
-কি দেখছো মা? আমি রেজু ওর জন্য আছি। তুমি ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে যাও। এমনি তেই অনেক রক্ত পড়েছে৷ আর দেরি করো না।

-আগে…
তুর্কি আদনানের কথা থামিয়ে দিয়ে বলে,
-একদম কথা বলবেন না। আপনি চলুন আমার সাথে।
এই বলে তুর্কি আদনানের বাহু টেনে চলে যায়। মুজাহিদ রেজুয়ানকে ধরে ধরে ভেতরে নিয়ে আসে। তবে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে রেজুয়ান পায়ে আরও ব্যথা পাবে। এই ভেবে মুজাহিদ রেজুয়ানকে পাঁজা কোলে তুলতে যায়। রেজুয়ান এক লাফে দূরে সরার চেষ্টা করে। তবে পায়ে টান লাগে। নাক মুখ কুঁচকে বলে,
-বাপের ভাই, তুমি আমার মান-সম্মান খাবা নাকি? কি মেয়েদের মত কোলে তুলবে।
মুজাহিদ কিঞ্চিৎ রাগী স্বরে বলে,

-একটা লাত্থি খাবি। তুই আমার বাচ্চা। ছোট থেকে আমার কোলে মানুষ হলি; আর এখন বাহানা করছিস। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে পায়ে আরও ব্যথা লাগবে। চুপ চাপ এই দিকে আয়।
-জীবনেও না। আমি হাঁটতে পারবো। তুমি শুধু হাত ধরো।
রেজুয়ানের বারণ সত্ত্বেও মুজাহিদ ওকে পাঁজা কোলে তোলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে। রেজুয়ান নাক মুখ কুঁচকে বলে,
-বউকে কোলে তোলার বয়সে, বাচ্চা কোলে তুলে ঘুরছো। লজ্জা লাগে না? এখন একটা বিয়ে করো।
এই সময়ে এসে ও যে রেজুয়ান রসিকতা করছে, এই ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মুজাহিদ। তবে, কিছু বলে না। ওকে বলে লাভ নেই। তাঁর চেয়ে ও বড় কথা ওর এখন কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। তাঁর বাচ্চা গুলো যে, তাঁর কাছে আছে এতেই অনেক।

তুর্কি দ্রুত ফার্স্ট-এইড এর বক্স নিয়ে আসে। তুলাতে আ্যান্টিসেপটিক নিয়ে আদনানের হাত পরিষ্কার করতে থাকে। আদনানের ক্ষত দেখে তুর্কি চোখের কার্নিশে জমে থাকা পানি বের হয়ে আসে। তুর্কির চোখের পানি কয়েক ফোটা আদনানের হাতে পড়ে। আদনান বিছানায় আধ- শোয়া অবস্থায় বসে ছিলো। চোখ বোজা ছিলো। হাতে গরম পানির ফোটা পড়তেই ও চোখ খুলে। তুর্কি মাথা নিচু করে যত্ন সহকারে ওর হাতে পরিষ্কার করছে। মেয়েটাকি কান্না ও করছে! ও শান্ত কণ্ঠে ডাকে,
-বেগম সাহেবা!
তুর্কি মাথা তুলে তাকায়। যৎসামান্য রাগান্বিত স্বরে বলে,

-হাতে ব্যথা পেলেন কি ভাবে? আবার নিশ্চয়ই মারা-মারি করেছিলেন?
ওর চোখ জল চিকচিক করছে। আদনান মৃদু হেসে ওর দিকে এগিয়ে আসে। ওর চোখে চোখ রেখে বলে,
-বেগম সাহেবা, তুমি কাঁদছো?
তুর্কির দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে যায়। আদনানের ক্ষততে যে ওর হৃদয় ও ক্ষত হয়ে গেছে। তবে তা ও আদনানকে বুঝতে দেবে না। ও আমতা আমতা করে বলে,
-না..না। ঐ..ঐ চোখে যেনো কি পড়েছে।
তুর্কি চোখে কিছু পড়ার অজুহাতে চোখ কচলাতে থাকে। তুর্কি যে ওর ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে আদনান তা বেশ বুঝতে পারছে। আদনান মৃদু হেসে বাম হাত দিয়ে তুর্কির থুতনি ধরে নিজের দিকে করে। পিঠে কিঞ্চিৎ টান অনুভূতি হয়। যৎসামান্য অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে‘আহ্!’

তুর্কি দ্রুত আদনানের দিকে ঘোরে। দ্রুত কণ্ঠে বলে,
-আর কোথায় ব্যথা পেয়েছেন?
আদনান চোখ বুজে, বামে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
-এই খানে।
-এই খানে মানে? পিঠে?
আদনান আর কিছু বলে না। ও হাত দিয়ে গেঞ্জি খোলার চেষ্টা করে। হাতের কারণে তুর্কি বলে,
– দাঁড়ান দাঁড়ান, আমি সাহায্য করছি।
তুর্কি আদনানের গেঞ্জি খুলতে সাহায্য করে। আদনানের পিঠে চোখ পড়তে আতকে উঠে। এই জায়গায় তো অনেক ক্ষত হয়েছে। তুর্কি আবারও অস্থির কণ্ঠে বলে,
-আল্লাহ্! এই জায়াগায় ও তো ব্যথা পেয়েছেন।

তুর্কি দ্রুত আবারও অন্য তুলাতে আ্যান্টিসেপটিক নিয়ে আদনানের পিঠের ক্ষতস্থানে লাগায়।
-কি ভাবে এত ব্যথা পেলেন? হ্যাঁ? আপনি কেনো এত মারা-মারির মধ্যে জড়ান?
-আর বলো না। মীম কে কয়েকটা ছেলে মারতে এসেছিলো। তাই ওদের মেরে পাঠিয়ে দিয়েছি।
-তো নিজে এত ব্যথা পেলেন কি ভাবে? হ্যাঁ? আপনি বুঝেন না আপনার কষ্ট হলে আমার কষ্ট হয়?
না চাইতেই অদ্ভুত একটা সত্য কথা ফেলে তুর্কি। সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুখ চেপে ধরে। ও এটা কি বলে ফেললো। আদনান মৃদু হেসে ঘাড় কিঞ্চিৎ বাকিয়ে বলে,

-কি বললে?
তুর্কি কোনো উত্তর দেয় না। দ্রুত জায়গাটা পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দেয়। হাত ব্যান্ডেজ করে দেয়।
-আপনি রেস্ট করুন। আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।
তুর্কি বিছানা থেকে নামতে গেলে আদনান ওর হাত টেনে ধরে। তুর্কি পা যুগল থেমে যায়। বুক টিপটিপ কর‍তে থাকে। আদনান শান্ত কণ্ঠে বলে,
-বেগম সাহেবা, ক্ষত স্থানে চুমা দিলে ক্ষত দ্রুত সেরে যায়। আমার কষ্টে যখন তোমার কষ্ট হচ্ছে; তাহলে একটা কাজ করও। আমার হাতে আর পিঠে একটা চুমা দেও। দেখবে আমার সব পেইন দূর হয়ে গেছে। এতে তোমার পেইন ও কমে যাবে।

আদনানের কথা শুনে তুর্কির মুখ লাজে রাঙা হয়ে যায়। লোকটা কি ভাবে নির্দ্বিধায় চুমু খাওয়ার কথা উচ্চারণ করতে পারলো! তুর্কি আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– স্যার…আপনি আসলে একটা অসভ্য লোক।
এই বলে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে বিড়বিড় করে,
-অসভ্য মার্কা খারাপ লোক।
আদনান মৃদু হেসে বলে,
-তোমার মুখে এই কথাটা অনেক মিস করছিলাম।

রেজুয়ান বিছানায় শুয়ে রয়েছে। পাশে বসে ওর হাতে পায়ে বরফ চেপে ধরেছে মুজাহিদ। জায়গাটা ফুলে গেছে। ব্যথা ও করছে খুব। ও চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে৷ মুজাহিদ ওকে জিজ্ঞাসা করে,
-ছেলে গুলো কে ছিলো?
রেজুয়ান চোখ বন্ধ করা অবস্থায় উত্তর দেয়,
-জানিনা।
-তোকে কেনো মারতে এসেছিলো?
-পরে বলছি দাঁড়াও। আমার ফোন কই রেখেছো?
-ঐ যে টেবিলের উপরে।
রেজুয়ান হাত বাড়িয়ে ফোন হাতে নেয়। ফোন অফ হয়ে রয়েছে৷ ও ফোন অন করে; নেট অন করে। দেখে অভ্র অনেক গুলা এসএমেস পাঠিয়েছে। ও এসএমেস চেক করতেই এক অবিশ্বাস্য জিনিস দেখতে পায়। ও খুশিতে বসে পড়ে। মুজাহিদ ধমকে উঠে,

-আরে কি হয়েছে৷ শো। ব্যথা পাবি।
রেজুয়ান খুশিতে মুজাহিদের দিকে ফোন তুলে বলে,
-বাপের ভাই…কাঠগোলাপের নাম্বার পেয়ে গেছি।
মুজাহিদ বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
-এমন ভাবে বললি, যেনো গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছিস। শো এখন।
-আরে বাপের ভাই, তুমি জানো না আমি কি পেয়েছি। গুপ্তধনের চেয়ে ও বেশি। ওর জন্য আজ আমি মার খেয়েছি। তুমি বলো ওকে কি ছাড়া উচিত হবে আমার?

তুর্কি আদনানের জন্য খাবার এনে ওকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। কাঁথা টেনে দিয়ে বলে,
-এবার শুয়ে পড়ুন, স্যার।
আদনান শুতে শুতে বলে,
-বেগম সাহেবা, তুমি কিন্তু হ্যাক টা ট্রায় করতে পারো। সত্যি বলছি সব পেইন দূর হয়ে যাবে।
তুর্কি ব্যস্ত কণ্ঠে বলে,
-আমার অনেক পড়া বাকি, স্যার। আপনার সাথে ফালতু কথা বলার টাইম নেই।
আদনান ভূত দেখার মত চমকায়। অবাক কণ্ঠে বলে,
– বাব্বা! ভূতের মুখে রাম রাম? তুমি পড়ার কথা বলছো? সত্যি! আমি তো নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছি না।

-বিশ্বাস করতে হবে না। চুপ চাপ শুয়ে পড়ুন।
-ভেবে দেখতে পারো। দুইজনের পেইনই কমতো।
তুর্কি আর কোনো উত্তর দেয় না। এ লোক ব্যথা পেয়ে আজ অসভ্য হয়ে গেছে। ও স্টাডি টেবিলে বসে বই খুলে৷ তবে পড়ার উদ্দেশ্যে নয়। আদনানের ঘুম আসার অপেক্ষায়।
বেশ কিচ্ছুক্ষণ পড়েই আদনান ঘুমের কোলে ঢোলে পড়ে। তুর্কি শুধু বইয়ের পেজ উলটে যাচ্ছিলো৷ আর অপেক্ষা করছিলো কখন আদনান ঘুম আসবে
কিচ্ছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ও ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ায়৷ ওর হৃদ স্পন্দন স্বাভাবিকের তুলনায় গতি বাড়তে থাকে৷ ও এক পা এক পা করে আদনানের দিকে এগোতে থাকে। যত এগোই বুকের স্পন্দন তত বাড়তে থাকে। যদি আদনান উঠে যায়। ও কি লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারবে? তবে এইটা ওকে করতে হবে। এতে যদি আদনানের ব্যথা সত্যি কমে তবে ও লজ্জায় মরে যেতে ও রাজি।

ও ধীর পায়ে হেঁটে আদনানের পাশে বসে। আদনান ডান কাত হয়ে শুয়েছে। উন্মুক্ত পিঠ কিঞ্চিৎ দৃশ্যমান। ও মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে। যাতে আদনান জেগে না যায়। ও দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে আদনানের পিঠের বাম পাশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ক্ষত স্থানে মলম লাগানোর কারণে ; তার থেকে কিঞ্চিৎ নিচে ওর ওষ্ঠ যুগল নিয়ে যায়। চোখ ও শ্বাস বন্ধ করে ছোট করে একটা চুমু খায়। সঙ্গে সঙ্গে ওর হৃদপিণ্ডের চলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ও ধীরে ধীরে মাথা তুলে ফেলে। বুকে হাত দিয়ে বুকের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করে। নাহ্! হৃদযন্ত্র টা পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছে। ও আবার বিছানার উপরে উঠে আদনানের হাতের কাছে যায়। এবার ও চোখ শ্বাস বন্ধ করে ব্যান্ডেজ করা হাতের তালু তে চুমু খায়।

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৭

পরপর দুইটা দুঃসাহসিক কাজ করার পর; তুর্কির হাত পা অসাড় হয়ে যায়।
বুকের যন্ত্রটার গতি বাড়তেই থাকে। ওর নিজের মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি বয়ে যায়। ও দ্রুত টেবিল ল্যাম্পের আলো নিভিয়ে দিয়ে আসে। তবে আজ মাঝে কোল-বালিশ দিতে গিয়ে থেমে যায়। যদি কোল-বালিশের সাথে সংঘর্ষ লেগে আদনানের হাতে ব্যথা লাগে। সেই ভেবে আজ আর কোল-বালিশ মাঝে দেয় না। দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে। নিজের করা দুঃসাহসিক কাজের কথা ভাবতে থাকে।

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ২৯