হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪০

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪০
তোয়া নিধী দোয়েল

নিশুতি রাতের গভীরতা প্রখর হচ্ছে। পরিবেশে গভীর নিস্তব্ধতা বিরাজমান। এই নিস্তব্ধতা ভেদ করে হাই-রোড দিয়ে সাঁই-সাঁই করে ছুটে চলেছে একটা সাদা কার৷ মাঝে মাঝে কয়েকটা ট্রাক-বাস ও ছুটে চলেছে নিজ গন্তব্যে। রাস্তার মাঝ বরাবর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে— ছোট ছোট পাখনা মেলে দিয়েছে ল্যাম্পপোস্ট গুলো৷ যাদের আলোয় রাতের গভীরতা বোঝা দায়।

গাড়ির ব্যাক-সিটে বসে রয়েছে আদনান-তুর্কি। তুর্কির মাথা আদনানের বাহুতে ঠেকানো। তখন ওই রকম একটা নিদারুণ সুন্দর মূহুর্ত ঘটার পর— একটা গাড়ি এসে থেমেছিলো বাড়ির সামনে। আদনান, তুর্কিকে অপেক্ষা করতে বলে— বাড়ির ভেতরে গিয়ে একটা লাগেজ আর সাথে তুর্কির হ্যান্ড-ব্যাগ নিয়ে এসেছিলো।
খুব সম্ভবত লাগেজের ভেতরে ওদের প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র এবং পরনের পোশাক।ওরা কোথাও বেরোচ্ছে! তুর্কি তখন থেকে জিজ্ঞাসা করছিলো— ওরা কোথায় যাচ্ছে? এত রাতে তো ওদের বাড়ি যাওয়ার কথা না। আর ওই বাড়ি গেলে ও এত লাগেজ-টাগেজ নিয়ে যাওয়ার কথা না। তবে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আদনান কোনো উত্তর দেয় নি। চুপ-চাপ গাড়িতে উঠতে বলেছিলো। গাড়িতে ও অনেক বার জিজ্ঞাসা করেছিলো কিন্তু, আশানুরূপ কোনো উত্তর পায়নি। তাই তুর্কি পরাজিত সৈন্যের মত পিছু হটে আদনানের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে রয়েছে। যেথায় খুশি নিয়ে যাক; শুধু এই লোকটা সাথে থাকলেই হলো!
তুর্কির পাশের জানালা খোলা। সেখান দিয়ে বাতাস বয়ে আসছে। ওর পরনে লাল শাড়ি৷ আদনানের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন তুর্কি। ঘুমন্ত মুখের উপর কপালের কিছু চুল বার বার উড়ে এসে যন্ত্রণা করছে। তুর্কি শতবার হাত দিয়ে সরালে ও তারা অবাধ্য হয়ে উড়ছে। আদনান তুর্কির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। অবাধ্য চুল গুলোকে কানের পিঠে গুঁজে দেয়। তারপর তুর্কির শান্ত মুখশ্রীতে সন্তর্পণে হাত বুলিয়ে কপালে আলতো করে চুমু খায়।

তুর্কির মাথা বাহু থেকে সরিয়ে নিজের বক্ষস্থলে রাখে। এক হাত দিয়ে তুর্কিকে চেপে রাখে বুকের মাঝে। স্বস্তির এক শ্বাস ফেলে তুর্কির ঘুমন্ত মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে মনের কিছু অব্যক্ত ভাষা তুলে ধরে—
-আমার কাছে এমন কোনো ভাষা নেই বেগম সাহেবা, যেই ভাষার মাধ্যমে বোঝাতে পারি; কতটা ভালোবাসি তোমায়! শুধু এই টুকু জানি; আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভালোবাসা আর শুধুই ভালোবাসি!

বারান্দায় পায়চারি করছে রেজুয়ান। ঘুম আসছে না। উপমার সাথে কাটানো সুন্দর মূহুর্ত গুলো— পুনরালোচনা করছে নিজের সাথে। অজান্তে বুকের ভেতর এক অদ্ভুত যন্ত্রণা দিচ্ছে। মন বলে— তাকে বলে দেই ভালোবাসি! কিন্তু আবার ভয় হয়, যদি সে না বাসে।
ভীষণ বিরক্তিতে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যায় রেজুয়ান। অসহ্য লাগছে। মুজাহিদের ঘরের দিকে নজর পড়তে দেখে— ঘরে আলো জ্বলছে। তার মানে মুজাহিদ জাগ্রত। হাজারো অশান্তির মাঝে ওর শান্তির এই দুই জায়গা৷ এক মুজাহিদ। দুই আদনান। ও মুজাহিদের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
রাত গভীর হওয়া সত্ত্বেও, মুজাহিদের চোখে ঘুম নামে নি। তার কারণ, পরীক্ষার খাতা। আগামীকালের মধ্যে সব খাতা জমা দিতে হবে। কিন্তু, একটু ব্যস্ততার মাঝে সব গুলো খাতা দেখে ওঠতে পারে নি৷ তাই, আজ একটু প্যারা লাগছে।

স্বভাবতঃ কোনো প্রকার অনুমতি না নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে রেজুয়ান। মুজাহিদের মেলানো পা জোড়া দেখে ছুটে গিয়ে কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মুজাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলে—
-কিরে? ঘুমাস নি?
-ভালো লাগছে না।
মুজাহিদ খাতা দেখার ওপর মনোযোগ রেখে বলে—
-কেনো? আমি বিয়ে করি না বলে?
– না। বুকের ভেতর কেমন যেনো করছে।
এই প্রথম, রেজুয়ানের মুখে কোনো প্রকার খোটাযুক্ত বাক্য না শুনে অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকায় মুজাহিদ৷ ওকে ভালোভাবে পরখ করে বলে—
-ঠিক আছিস তো?
রেজুয়ান দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে—

-বাপের ভাই, আমি কাঠগোলাপকে ভালোবাসি! ওকে কীভাবে বোঝাবো বলো তো।
– বীজগণিত না বুঝলে বুঝিয়ে দিতে পারি। জ্যামিতি না বুঝলে বুঝিয়ে দিতে পারি। কিন্তু ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি = তুমি আমার হয়ে যাও’ এই জটিল সম্পর্কের সমাধান অথবা প্রমাণ করার সাধ্য এতি বিনে কারোর নেই! তাই তাকে বোঝানো বাদ দিয়ে শুধু ভালোবেসে যাও।
মুজাহিদের জটিল কথা শুনে কিঞ্চিৎ ভাবনার সাগরে ডুব দেয় রেজুয়ান। অসম্ভব! কাঠগোলাপ কে ওর চাই। হাজার হোক ভালোবাসে তো..! রেজুয়ান দ্রুত মুজাহিদের কোলে থেকে মাথা তুলে বলে—
-এই রকম করে বলো না, বাপের ভাই। আমি ওকে সত্যি ভালোবাসি।
-তাকে ভালোবাসি = দুনিয়ায় সব দুঃখ আমাকে সইতে হবে। ( প্রমাণিত)
রেজুয়ানের সাথে কথা বলতে গিয়ে একটা খাতায় ও এই সব লিখে ফেলে মুজাহিদ। পরক্ষণেই দ্রুত কেটে রেজুয়ানের উদ্দেশ্যে বলে—
– তুই সর তো এখান থেকে। তোর জন্য ভুল করছি। অনেক খাতা দেখা বাকি।
মুজাহিদ, রেজুয়ানেকে উপেক্ষা করে খাতা দেখায় মনোযোগ দেয়। রেজুয়ান অর্থহীন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে মুজাহিদের দিকে।

সকালের সতেজ আবহাওয়া উপভোগ করার জন্য ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে উপমা। বাসার নিচ থেকে ক্ষণে ক্ষণে হর্ণের টুং-টুং আওয়াজ ভেসে আসছে। দূর থেকে কাকের ‘কা-কা’ বেসুরু ডাক ভেসে আসছে।
দীর্ঘ এক শ্বাস নিয়ে চোখ মেলে তাকায়। স্মৃতির পাতা বিচরণ করার ফলে মানসপটে ভেসে উঠে কাল রাতের ঘটনা। রেজুয়ান ওই ভাবে দৌড়েছিলো বলে কিঞ্চিৎ ভীত হয়ে গেছিলো। পরপরই রেজুয়ানের কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠেছিলো। এত বড় ছেলে নাকি ভাইয়ের ভয়ে ওই ভাবে দৌড়েছিলো!

রেজুয়ানের কথা মনে হতেই ঠোঁটের কোটেরে ফোটে অজানা এক মৃদু হাসি৷ পরপক্ষণই মনে পড়ে— ‘ আচ্ছা ওদের মধ্যে তো কোনো সম্পর্ক নেই! তাহলে রেজুয়ান ওতো ভয় পেয়েছিলো কেনো?’
রেজুয়ানের কাছে শুনতে হবে। ও কিছু একটা ভেবে পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে ফোন নেয়৷ ছোট একটা বার্তা পাঠাতেই; রুম থেকে ফারুকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে৷ উপমা বাবার কণ্ঠস্বর শুনে ফোন ফেলে রুমে ঢুকে।
সকাল-সকাল বাবাকে দেখে উপমার মন কিঞ্চিৎ দ্বিধান্বীত হয়। এত সকালে কী প্রয়োজন। ও নম্র কণ্ঠে বলে—

-বাবা কোনো প্রয়োজন?
ফারুক বিছানায় বসে ওকে চেয়ারে বসতে বলে। উপমা ও কোনো প্রশ্ন না করে বাবার আদেশ পালন করে। ফারুক বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলে—
-কাল রাতে কই গিয়েছিলে?
ফারুকের কথা শুনে কপালে ভাঁজ পড়ে উপমার! ও আবার কই গিয়েছিলো? ও দ্বিধান্বীত কণ্ঠে বলে—
-কই? কোথাও না তো। কেনো?
ফারুক চোখ ছোট ছোট করে বলে—
-সত্যি কোথাও না!
উপমা কিছুক্ষণ স্মৃতির পাতা বিচরণ করে বলে—
-রাতে একবার সূচির সাথে মেলায় গিয়েছিলাম। তুমি কি সেটার কথাই জিজ্ঞাসা করছো?
ফারুক ফের গম্ভীর কণ্ঠে বলে—

-শুধু কি সূচি ছিলো? নাকি আরও কেউ ছিলো?
উপমা ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বলে—
-কই আর কেউ তো ছিলো না।
ফারুক এইবার কণ্ঠে তেজ ঢেলে বলে—
-বাবার সামনে মিথ্যা বলতে লজ্জা লাগে না? কাল তোমার সাথে একটা ছেলে ও ছিলো।
রেজুয়ানের প্রসঙ্গ উঠে আসতেই উপমা আবার বলে—
-জি আব্বু। আমার এক ফ্রেণ্ড।

-ফ্রেণ্ড? রাতের বেলা কোনো ছেলের সাথে ঘুরাঘুরি করা শুধুই বন্ধুত্ব? তাও আবার অন্য একটা লোক এসে তোমার বাবার কাছে বলছে ‘মেয়েকে তো অনেক ভালো মনে করেছিলাম। তা দেখলাম মেয়ে রাত্রে বেলা ছেলেদের সাথে ঘুরছে’। তুমি জানো একজন বাবার কাছে এই কথা কতটা অপমানজনক? তুমি তোমার বাবার কথা একবার ও ভাবো না? এই শিক্ষা পেয়েছো?
বাবার দীর্ঘ বক্তব্য শুনে দৃষ্টি নিচু করে ফেলে উপমা। সাধারণ একজন ফ্রেণ্ডের সাথে ঘুরলে সমস্যা কোথায়? আর কে কী বললো তা নিয়ে ওর কোনো সময় মাথা ব্যথা ছিলো না। ও জানে পরিষ্কার কণ্ঠে বলে—
-আমি এত দূর ভাবিনি বাবা। আর মানুষের কথা আমি একটু কম-ই শুনি। তবু ও আমার কাজের জন্য দুঃখিত। আর…

উপমার কথা থামিয়ে দিয়ে ফারুক বলে—
-আর কোনো কথা না। আজ তোমাকে দেখতে আসছে। খুব দ্রুত তোমার বিয়ে।
বিয়ের কথা শুনে; বাবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় উপমা। অবাক কণ্ঠে বলে—
-বাবা, প্লিজ এইটা আমার লাস্ট ইয়ার৷ এক্সাম শেষ হোক। তারপর…
-তার আর কোনো পর নেই। আমার ডিশেশনই ফাইনাল। আমি চাই না তোমার জন্য আমার সম্মান খোয়া যাক।
এই বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় ফারুক। বাবার কথা শুনে চোখ থেকে গাল গড়িয়ে শ্রাবণ ধারা নামে। ও এখনি বিয়ের বোঝা মাথায় নিয়ে চায় না। পড়াটা শেষ হোক আগে।
ও দুই-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে গভীর ভাবে ভাবতে থাকে। মনে মনে মা-কে খুঁজতে থাকে৷ মা-হীন পৃথিবীতে নিষ্ঠুর আর কিছুই হতে পারে না।

ঢাকা— মৌলভীবাজার মহাসড়ক/N207- এ ডান দিকে বাঁক নিয়ে মৌলভীবাজার শহর পেরিয়ে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে ছুটে গাড়ি।
তুর্কির ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগে। শ্রীমঙ্গলের পথের দু ধারে চা বাগানের মনোহর দৃশ্য পরিলক্ষিত হতেই; দু চোখে শান্তির বর্ষা নামে। যতদূর যেদিকে দৃষ্টি যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। রাস্তায় তেমন ভীড় নেই। তাই সবুজের মাঝ দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটিছে গাড়ি৷
তুর্কি প্রকৃতি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আদনানের দিকে তাকায়। অবাক কণ্ঠে বলে—
– স্যার, হোয়াট এ সারপ্রাইজ! আল্লাহ্!
আদনান মৃদু হেসে তুর্কি ডান হাতের পাঁচ আঙুলের ফাঁকে ওর হাতের পাঁচ আঙুল গুঁজে দিয়ে তুর্কির দিকে তাকিয়ে বলে—

-বেশি কিছু না। ব্যাস্ ছোট-খাটো একটা ইচ্ছে পূরণ!
তুর্কি মৃদু হেসে বলে—
– থ্যাঙ্কিউউউ!
তারপর আবার ঘাড় ঘুরিয়ে প্রকৃতি দেখায় মনোনিবেশ করে।
কবে যেনো তুর্কি একবার বলেছিলো, ও আদনানের সাথে পাহাড় ঘুরতে চায়। সবুজ অরণ্যে হারিয়ে যেতে চায়। তাই, ওর জন্মদিনটা একটু স্পেশাল করার জন্য দুই-দিনের টুর‍্যে শ্রীমঙ্গল এসেছে। এই সব প্ল্যান অনেক আগে থেকেই করা।

শ্রীমঙ্গল থাকার জন্য আদনান বালিশিরা রিসোর্টের একটা কটেজ বুক করেছে। বালিশিরা রিসোর্টের চেইক-ইন টাইম দুই টায়৷ তাই রিসোর্টে যাওয়ার আগে; এই আধাবেলা শ্রীমঙ্গলের কিছু জায়গা ঘুরে দেখবে। সকালের নাস্তা করতে গাড়ি এসে থামে পাংসী হোটেলে।
সকালের নাস্তা সেরে ফ্রেশ হয়ে; আবার গাড়ি ছুটে চা বাগানের উদ্দেশ্যে। চা বাগানে পৌঁছাতে-পৌঁছাতে সারে আটটার মত বাজে।
চা বাগানের সকাল তখন পূর্ণ যৌবনে।
সূর্যের আলো পাতার ফাঁক গলে এসে চোখে-মুখে পড়ে; হালকা কুয়াশা যেন ধোঁয়ার মতো ভাসছে বাতাসে।
পাখিরা তখনো শেষ রাতের গান গেয়ে চলেছে, আর দূর থেকে শ্রমিক নারীদের হাসির আওয়াজ ভেসে আসে হাওয়ার ভেতর দিয়ে।

আদনান-তুর্কি হাত ধরে বাগানের ভেতর, পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি এক ঢালু টিলার পাদদেশে। ঘাসের গায়ে জমে থাকা শিশির পায়ের নিচে ভিজে দিচ্ছে, আর পাশে ঝোপের গা ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে প্রজাপতি।
উপরে উঠে দাঁড়ানোর পর এক মুহূর্তের জন্য পলক ফেলতে ভুলে যায় তুর্কি—
সামনে শুধু সবুজ, সবুজ, আর সবুজের ঢেউ!
নিচে চা গাছের সারি, দূরে পাহাড়, তার পেছনে মেঘে ঢাকা সীমান্ত রেখা।
রোদে চিকচিক করছে পুরো চা বাগান, যেন কেউ আঙুল দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়েছে প্রতিটা পাতা।
হঠাৎ তুর্কি আদনানের হাত ছিঁড়ে সামনের দিকে দৌড় গেলে।
টিলার একেবারে কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়ে দুই হাত মেলে দিলে আকাশের দিকে। ওর লাল শাড়ির আঁচল বাতাসের দরুন একটু উড়তে লাগলো।
আদনানের কিছু বলার আগেই তুর্কির কণ্ঠ পাহাড়ে গড়িয়ে পড়ে। ও ভীষণ জোরে চিৎকার করে বলে ওঠে—

– আই লাভ ইউ, স্যার! আই লাভ ইউ! আমি আপনাকে ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি!
তুর্কির চিৎকারে যেন পাতারা কেঁপে উঠলো।
একটা বক উড়ে গেল ডাল ছেড়ে, হাওয়া থমকে রইলো কিছুক্ষণের জন্য।
আদনান তখনো হাওয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে—
কিছুটা বিস্ময়ে, কিছুটা আনন্দে, আর অনেকটা অভিভূত হয়ে রয়েছে। ও ধীর পায়ে তুর্কির দিকে এগিয়ে আসে। তুর্কি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আদনানের দিকে। ও ভেবেছিলো হয়তো আদনান ওর কথা উত্তর দিবে। কিন্তু, আদনান ওর কপালে থাকা চুল কানে গুঁজে দিয়ে বলে—

-শাহরুখের ফ্যান?
এত সুন্দর করে ভালোবাসার কথা প্রকাশ করলো তুর্কি; অথচ এই ফাজিল লোকের কোনো উত্তর নেই। তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে বলে—
-মোটে ও না। আমি আমার জামাইয়ের ফ্যান ছাড়া অন্য কারো ফ্যান না। বিয়ের আগে একটু-আরদু ছিলাম। কিন্তু, বিয়ের পর জমাই রেখে অন্য সব কিছু আমার কাছে ডাস্টবিন মনে হয়!
তুর্কির কথায় হো-হো করে হেসে ওঠে আদনান৷ তুর্কি এগিয়ে এসে আদনানের হাত ধরে উলটো ঘুরে দৌড়ে যায়। সবুজের আঁকাবাঁকা পথ ধরে কিছুক্ষণ দৌড়িয়ে একটা গাছের সামনে এসে দাঁড়ায়। তুর্কি একটা ইটের টুকরো নিয়ে বলে—
-দাঁড়ান স্যার। এইখানে আমাদের নামের অক্ষর লিখে যাই। এই চা বাগান সাক্ষী থাকুক আমাদের প্রেমের।
যেই ভানা সেই কাজ। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে তুর্কি গাছে খোদাই করে লিখলো ‘Adnan +Turrki’ পাশে একটা হার্ট ইমোজি।
আদনান শুধু ওর পাগলামি দেখে গেলো। অনেকক্ষণ চা বাগানে ঘুরাঘুরি করে; লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের দিকে অগ্রসর হয়।

চা বাগান থেকে লাউয়াছড়ায় পৌঁছাতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না। সকালের আলো তখন ঘুম ভাঙাচ্ছে লাউয়াছড়ার বনভূমিকে।
সামনের রাস্তা যেন পাতার সুড়ঙ্গে ঢুকে গেছে—দু’পাশে শতবর্ষী গাছের সারি, মাথার উপর সবুজ ছায়ার ছাউনি। এদের মধ্যে চাপলিশ, গন্ধরুই, ঝাওয়া, মূলী বাঁশ সহ আরও নানান গাছের সমাহার।
সূর্যের আলো গাছের পাতা ভেদ করে মাটি ছুঁয়ে পড়ছে, ঠিক যেন আলোর বুনট দিয়ে কেউ বুনে দিয়েছে এক বিস্ময়ের পথ।
আদনান-তুর্কি হাত ধরে হাঁটছি সেই গহিন বনের ভেতর।
পায়ে পড়ে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ, বাতাসে ভাসছে অজানা ফুলের গন্ধ আর বনের ভেতরকার প্রাণের নিঃশব্দ স্পন্দন।

একটা বাঁক ঘুরতেই সামনে পড়ে একটা ছোট খালের মতো জলের ধারা।
পাশে কয়েকটা পাহাড়ি গাছ, ডালে একদল হনুমান ঝুলছে—তাদের ডাকে হঠাৎ বনটা যেন আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে।
তুর্কি দৌড়ে গিয়ে পানিতে পা ছুঁয়ে বললে,
– স্যার, এইদিকে আসুন। আমার পায়ের পাশে আপনার পা পানিতে দিন।
আদনান তুর্কির পাশে গিয়ে বসে ওর পা ও ডুবিয়ে দেয় পানিতে। ঠান্ডা স্পর্শে শরীর শিরশির করে ওঠে। তুর্কি, আদনানকে ফোন বের করে ওদের পায়ের ছবি তুলতে বলে।
তারপর পা ওঠিয়ে ওরা একটা গাছের গোড়ায় গিয়ে বসে৷ ওখানে বসে পাখির ডাক, বাতাসের শব্দ আর মাঝেমধ্যে দূরের কাঠবেড়ালির ডাক শোনে।

তুর্কি চা বাগান থেকে সেই ইটের টুকরো টা নিয়ে এসেছে। ও মনস্থির করেছে যেখানে যাবে সব জায়গায় ওদের নাম লিখে আসবে। এইখানে ও একই কাজ আরম্ভ করে। একটা গাছে খোদাই করে ওদের নাম লিখে।
আদনান গালে হাত দিয়ে তুর্কির দিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ সময় নিয়ে ‘Adnan+Turrki’ লিখে একটা হার্ট ইমোজি ও আঁকে। তার পর আদনানকে দেখিয়ে বলে—
– স্যার, এই বন ও সাক্ষী রইলো আমাদের প্রেমের। চলুন একটা ছবি তুলি।
অতঃপর ওরা আরও কিছু সময় পার করতে থাকে নিজেদের মাঝে।

বেলা দুপুর দুটোর আগেই ওরা রিসোর্টে এসে পৌঁছায়৷ সময় মত যাবতীয় ফর্মালিটি শেষ করে রিসোর্টের ভেতরে প্রবেশ করে। প্রথমে চোখে পড়ে সামনে বিশাল বড় সাইনবোর্ড লেখা ‘Wellcome To Balishira’। তার নিচে সবুজ ঘাস দিয়ে ডিজাইন করে লেখা ‘B R’। বাঁ দিকে কার পার্কিং এর জায়গা। একটু হেঁটে গেলেই রিসেপশন, রেস্টুরেন্টে।
ইটের সুরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে নিজেদের কটেজে পৌঁছায় ওরা। রাস্তার দু’পাশে মাঝামাঝি আকৃতির গাছ। তার পাশ দিয়ে বড়- ছোট সব ধরনের গাছ। মূলত বালিশিরা রিসোর্টে-টা সবুজ অরণ্যে ঘেরা। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। তবে আদনান-তুর্কির শরীর ক্লান্ত থাকায় দ্রুত নিজেদের কটেজে চলে যায় ওরা।

ওদের কটেজের নাম ‘Kalbela (কালবেলা)।’ যা কটেজের প্রবেশদ্বারের পাশের সাদা দেয়ালে মাঝারি আকৃতির সাইনবোর্ডে লেখা। রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে ওরা। রুমটা বেশ সাজানো-গোছানো। রুমের ভেতরে সাদা চাদর বিছানো বেশ বড় সাইজের বেড। বেডের ওই পাশে ছোট একটা চেয়ার-টেবিল।
আদনান লাগেজ জায়গা মত রেখে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। জানালার পাল্লা খুলতেই সবুজ অরণ্য চোখে পড়ে। যার নিচ দিয়ে বয়ে গেছে এক ঝিরি। তুর্কি উত্তর দিকের বারান্দার দরজা খুলতেই চোখে পড়ে প্রাইভেট সুইমিং পুল৷ যার পানি নীল রঙের। পুরো বারান্দা ঘেরা বড় পর্দা৷ আর পর্দার ওপারে সবুজ গাছ-পালা।
সুইমিং পুল দেখে তুর্কির ক্লান্ত শরীর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলো। তাই দ্রুত আদনান কে টেনে নিয়ে এসে সুইমিং পুলে নেমে পড়ে৷ দীর্ঘক্ষণ দু’জন পানিতে ভিজে, হাসা-হাসি করে ওঠে আসে।

তুর্কি আদনানের পছন্দের লাল শাড়ি পরে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে থাকে। আদনান ওর আগেই পোশাক পরিধান করেছে। কটেজের নাম অনুযায়ী— সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’ বইটি রাখা ছিলো টেবিলের উপর। তুর্কি ছিলো না বিধায় আদনান বইটি নিয়ে বিছানায় বসে দেখছিলো।
আদনানের হাতে বই দেখে জ্বলে ওঠে তুর্কি৷ মানে ও ভেবে পায় না একটা মানুষ কী পরিমাণ আনরোমান্টিক হলে হানিমুনে ও বই নিয়ে যায়। ও কপাল চাপড়ে তোয়ালে মেলে দিয়ে এসে আদনানের সামনে বসে। কণ্ঠে একটু বিরক্তি ফুটিয়ে বলে—

– স্যার, আপনি বউ ছাড়া থাকতে পারবেন; কিন্তু, বই ছাড়া থাকতে পারবেন না তাইনা? কোন মানুষ হানিমুনে এসে ও বই নিয়ে আসে? আমাকে বোঝান।
আদনান বইয়ের পাতা বন্ধ করে বলে—
-আমি নিয়ে আসি নি। এখানে ছিলো।
-হুম। আপনার হানিমুন বলে কথা। সেখানে বউ না থাকলে ও চলবে। কিন্তু, বই ছাড়া চলবে না। তাইনা? তাই তো রিসেপশনের লোকেরা আগে থেকেই এখানে বই রেখে দিয়েছে। অসহ্য!
তুর্কির কথা শুনে তুর্কি শব্দ করে হেসে উঠে আদনান। তুর্কি এই বলতে বলতে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তুর্কি। দীর্ঘক্ষণের জার্নিতে শরীর ক্লান্ত হয়ে গেছে। আদনান ও বই জায়গা মত রেখে এসে তুর্কির পাশে গা এলিয়ে দেয়। তুর্কি মা- শাশুড়ী কে কল করে।

আকাশী-সাদা সংমিশ্রণে একটা থ্রি-পিস পড়ে আয়নার সামনে বসে আছে উপমা। ভীষণ অসহ্য লাগছে ওর। একটু পড়েই পাত্র-পক্ষ নাকি আসবে। তাই ওকে দ্রুত তৈরি হতে বলা হয়েছে। ওর মনে হচ্ছে ওর হাতে-পায়ে শিকলে বাঁধা৷ আর্তনাদ করলে ও কেউ শুনবে না। কেউ বুঝবে না মনের ব্যথা।
আনমনে আরও কিছু ভাবতে-ভাবতে ফোনে টুং করে শব্দ তুলে কারো বার্তা আসে। উপমা কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে ফোন হাতে তুলে নেয়। সূচি-কে আসতে বলেছে। মেয়েটা কেনো এখনো আসছে না। হোয়াটসঅ্যাপের পৃষ্টা খুলতে চোখে পড়ে রেজুয়ানের বার্তা। অজান্তেই অজানা এক কারণে বুকের ভেতর কেমন যেনো করে ওঠে। বার্তা টা এই রকম—

‘kathgolap‚ curi pore ekta chobi dio to. Tokhon to bhirrer majhe dekhte parlam na‚ curi gulo tomar hate thik-thak vabe hoyeche kina’
চুড়ির কথা মনে হতে টেবিলের উপর রাখা প্যাকাটের দিকে চোখ পড়ে উপমার। গতকাল জন্মদিনের উপহার হিসেবে এই এক মুঠো চুড়ি উপহার দিয়েছে রেজুয়ান। প্যাকেট টা হাতে নিয়ে চুড়ি গুলো বের করে। খুব সাধারণ জিনিস৷ রৌদ্রজ্বল দিনে আকাশ যে রঙের হয়—ঠিক সেই রঙ। গাঢ় আকাশী রঙের। চুড়ি গুলো খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে থাকে উপমা। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সেই দিম। সূচি এসেছে।

—দোস্ত।
উপমা চুড়ি গুলো ফেলে সূচির কাছে ছুটে যায়। কিঞ্চিৎ ভেজা কণ্ঠে বলে—
-দোস্ত, আমার কিছু ভালো লাগছে না। কেমন যেনো অস্থির লাগছে।
-দোস্ত, তুই শান্ত হো। আংকেল এত তাড়াতাড়ি সব কিছু ঠিক করলো কীভাবে?
-জানিনা দোস্ত। আমার মাথায় কাজ করছে না। পাগল পাগল লাগছে।

দুপুরে রিসোর্টে এসে আর বাইরে যায়নি আদনান-তুর্কি। তুর্কি বলেছে, অর্ধেক রাতের জার্নি আবার আধাবেলার ঘুরাঘুরির পর; আজ আর শক্তি নেই। আগামীকাল রিসোর্টের বাইরে ঘোরা শুরু করবে।
বালিশিরা রিসোর্ট-টা তুর্কির ভীষণ ভালো লেগেছে। তাই বেশিক্ষণ সময় কটেজে অতিবাহিত না করে রিসোর্টে টা দেখার জন্য বের হয়েছে। আজ বাকি সময় টুকু বালিশিরা রিসোর্ট-টা ঘুরে দেখবে। সবুজ অরণ্যে ঘেরা চারিপাশ। রিসোর্টের এক পাশে অনেক উঁচু একটা খাড়া টিলা। টিলের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এক ঝিরি। যার কল-কল শব্দে মুখরিত পরিবেশ।

ঝিরির পাশে বাঁশ তৈরি বসার জায়গায়; লালা শাড়ি বসে রয়েছে তুর্কি। ওর দুই হাতে লালা চুড়ি। মাথার লম্বা কেশগুচ্ছ এসে থেমেছে কোমড় পর্যন্ত। আদনান ওকে এখানে বসিয়ে রেখে রিসেপশনে গেছে৷ হয়তো কোনো ফর্মালিটি বাকি রয়েছে।
ক্ষণকাল পার হওয়ার পর পিছন থেকে ডাক আসে আদনানের—
-বেগম সাহেবা!
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তুর্কি। আদনান ওর পাশে এসে বসে। আদনানের পরনে ফর্মাল ব্ল্যাক শার্ট। দু’জন পাশাপাশি বসে ঝিরির কল-কল শব্দ শোনে। কিছু মূহুর্ত পর তুর্কি জিজ্ঞাসা করে—

– স্যার, এত সব কবে করলেন?
-অনেক আগেই। প্ল্যান ছিলো আরও আগে আসার। তোমার বার্থডে পুরো সময় এখানে কাটানোর। তবে, তোমার অসুস্থতার কারনে এই বিলম্ব।
এই বলে তুর্কির দিকে তাকায় আদনান। তুর্কি মৃদু হেসে বলে—
-তাই বলে এত কিছু !

আদনান তুর্কির হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। তুর্কি ও বসা থেকে ওঠে। হাঁটতে আরম্ভ করে বলে—
-তোমার ইচ্ছে ছিলো আমার সাথে পাহাড় দেখার। স্বামী হিসেবে আমার অর্ধাঙ্গিনীর এই টুকু ইচ্ছা কীভাবে অপূর্ণ রাখি বলো।
তুর্কি শব্দ করে হেসে বলে—
– স্যার, আমি তো আপনাকে বিরক্ত করার জন্য বলতাম। এত সিরিয়াস নেওয়ার কিছু ছিলো না। তবে হ্যাঁ, আপনার সাথে পাহাড়, সমুদ্র, নীল আকাশ, খোলা মাঠ দেখার ইচ্ছে আমার সত্যি জাগে।
ইটের সুরু আঁকা-বাঁকা রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে দুজন। রাস্তার পাশে দিয়ে মাঝারি আকৃতির নাম না জানা গাছ। যারা সারি বেঁধে লাইন তৈরি করেছে। লাইনের ডান পাশে কিন্ডস্ জোন। সেখান কিছু বাচ্চারা খেলছে। বাম পাশে ট্রি-হাউজ, জামতলা, বাঁশঝাড় সহ আরও নানা ধরনের গাছের সমাহার। তুর্কি বাচ্চাগুলো কে দেখে আদনানের দিকে ফিরে বলে—

– স্যার, আমাদের একটা ছোট পুচকু থাকলে ভালো হতো তাইনা? ওরা ও এখানে এসে খেলতে পারতো।
আদনান জায়গা-টা একবার পরখ করে বলে—
-আমার সাথে তো অলরেডি একটা আছে। আসো নিয়ে যাই।
তুর্কি দাঁত কটমট করে বলে—
-আমাকে আপনার বাচ্চা মনে হয়?
আদনান উপরে নিচে মাথা নাড়ে। তুর্কি আবারও তেজি কণ্ঠে বলে—
-কীইইই!
-কিছু না। বলতে চাচ্ছি যখন আমাদের একটা পুচকু হবে; তখন আমরা আবার আসবো। ওকে।
তুর্কি মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে ফিরে। কিছুদূর এগোনোর পর নজরে পড়ে দোলনা, হ্যামক। তুর্কি দোলনায় বসে কিছুক্ষণ দোল খায়। ধীরে ধীরে পুরো রিসোর্ট ঘুরে দেখার চেষ্টা করে ওরা। দীর্ঘ-সময় পার করে নিজেদের মধ্যে।
রাতের বেলা রিসোর্ট যেনো আরও মনোহর হয়ে ওঠে। চারিদিকে রংবেরঙের আলোয় ভরে ওঠে। আদনান-তুর্কি রাতের খাবার শেষ করে নিজেদের কটেজের উদ্দেশ্যে যায়।

কটেজের দরজা খুলে বিস্মিত হয়ে যায় তুর্কি! রুম থেকে গোলাপ ফুলের মন-কাড়া ঘ্রাণ ভেসে আসছে। পুরো রুমের ফ্লোর জুড়ে লাল হার্ট শেপের বেলুনের ছড়া-ছড়ি। যারা মৃদু বাতাসে উড়ছে। বেডের সামনে ফ্লোরে ছোট ছোট ক্যান্ডেল দিয়ে একটা হার্ট শেপ করা হয়েছে। মাঝে বেশ অনেকটাখালি যায়গা।
বিছানায় সাদা স্লিকের চাদরে ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে রয়েছে লাল গোলাপের পাপড়ি। দেয়ালে বড়ো করে লেখা ‘Happy Birthday Queen of My heart!’

রুমে কোনো আর্টিফিশিয়াল লাইট জ্বালানো নেই। ছোট ছোট ক্যান্ডেলের হলুদ আলোয় ভরে উঠেছে চারিপাশ!
সাউন্ড বক্স থেকে ভেসে আসছে মৃদু গানের কণ্ঠস্বর।
‘তোর ওই দু হাতের আলতো ছোয়াতে
মন ছেয়ে যায় প্রেমের উষ্ণ ধোয়াতে,
তোর ওই দু হাতের আলতো ছোয়াতে
মন ছেয়ে যায় প্রেমের উষ্ণ ধোয়াতে।’
সব কিছু দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে তুর্কি। লোকটা কখন এত সব করলো! আদনান ওর পিছনে দুই পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। তুর্কিকে পলকহীন নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঘাড় বাঁকিয়ে ওর কানের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে—

‘Happy Birthday My Dear Wife!’
আদনানের ফিসফিস আওয়াজে শোধবোধ ফিরে পায় তুর্কি। অপ্রস্তুত হয়ে যায় ওর কণ্ঠে। আদনানের দিকে তাকিয়ে নম্র কণ্ঠে বলে—
-কখন করলেন এত সব?
আদনান পকেটে থেকে এক হাত বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে—
-আগে বলো কেমন হয়েছে? তোমার মনের মত?
একটু থেমে আবার বলে—
-আমাদের ফার্স্ট নাইটের মত?!

‘ফার্স্ট নাইটের’ কথাটি শুনে অপ্রস্তুত হয়ে যায় তুর্কি। দ্রুত চোখ খিঁচে ফেলে। মানসপটে ভেসে ওঠে ওর বলা সেই বাজে কথা গুলো। পরপরই চোখ মেলে দ্রুত কণ্ঠে বলে—
– না স্যার। এই রকম ছিলো না। শুধু বিছানায় কিছু পাপড়ি ছিলো। তা-ও আপনি আমার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে ছিলেন!
হার্ট শেপের বেলুন গুলো পেরিয়ে রুমে ঢুকে আদনান-তুর্কি। আদনান, তুর্কির হাত ছেড়ে দরজা লক করে। তুর্কি মেঝে থেকে একটা বেলুন উঠিয়ে আদনানের দিকে ঘোরে। আদনান ওর দিকে ঘুরলেই ও ধাম করে শব্দ তুলে বেলুন টা ফাটায়। আদনান, তুর্কির দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলে—
-কারণ, ওই দিন রুম আমি সাজিয়েছিলাম না। কে যে সাজিয়ে ছিলো তাও জানিনা।
ওদের দৃষ্টি সংযোগ হলে আদনান ওর হাত বাড়িয়ে তুর্কি ডান হাত ধরে। ধীর পায়ে হেঁটে ছোট ছোট মোমবাতি দিয়ে তৈরি হার্টের মাঝে গিয়ে দাঁড়ায়। আদনান ওকে ইশারা করে খালি জায়গায় বসতে। আদনানের কথা মত তুর্কি ওই হার্টের খালি জায়গায় বসে পড়ে।

আদনান লাকেজ থেকে একটা বক্স বের করে তুর্কির পিছনে এসে বসে। তুর্কি দৃষ্টি ঘুরিয়ে রুমটা দেখায় ব্যস্ত। আদনান বক্সটা খুলে। বক্সের ভেতরে একটা লাভ পার্ল নিকলেস। আদনান চেইন টা বের করে ঝিনুকের কৌটা খোলে৷ তাতে ছোট একটা সাদা মুক্তা। মুক্তা টি নিয়ে লকেটের ভেতর দেয়। তার পর চেইনের মাঝে ফেলে দুই পাশে ধরে তুর্কির সামনে নেয়।
তুর্কি সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আদনান তুর্কির গলা বরাবর চেইনটা ধরতেই তুর্কির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে। হাত বাড়িয়ে লকেট টা ছোঁয়।
আদনান চেইনটা তুর্কির গলার কাছে এনে, ওর ঘাড়ের চুল গুলো আলতো স্পর্শে সরিয়ে কাঁধের এক পাশে রাখে। আদনানের স্পর্শে মেরুদণ্ড সোজা করে বসে তুর্কি। আদনান তুর্কির গলায় চেইন পড়িয়ে দিয়ে হুক লাগিয়ে দেয়। তুর্কি ধীর কণ্ঠে বলে—

-এত সব কখন করলেন, স্যার?
আদনান কোনো উত্তর দেয় না। বক্সে গান বিদ্যমান।
‘এসেছি তোর মনের ই দেশে,
আমি এক মুসাফির বেশে
দে না ঠাই একটু হেসে, ভালবেসে…
এসেছি তোর মনের ই দেশে,
আমি এক মুসাফির বেশে
দে না ঠাই একটু হেসে, ভালবেসে…!
আদনান দুই হাত বাড়িয়ে পিছন থেকে তুর্কির কোমড় জড়িয়ে ধরে। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে, তুর্কির গ্রীবাদেশে সন্তর্পণে অধর ছুঁয়ে দেয়। আদনানের ঠোঁটের ছোঁয়ায় কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে দুই চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলে তুর্কি। আদনান মন্থর কণ্ঠে বলে—

-এত সব প্ল্যান এক দিনে করা সম্ভব, বোকা মেয়ে? এই সব কিছু অনেক দিনের প্ল্যান। সব জাহিদ মাস্টার করে দিয়েছে।
তুর্কি কোনো উত্তর দেয় না। আদনান তুর্কির কোমড়ে জড়িয়ে রাখা হাত ছেড়ে তুর্কির চুড়ি পড়া হাত ধরে। এক হাত দিয়ে তুর্কির চুড়ি পরা হাতের চুড়ি গুলোর উপরে ধরে, অন্য হাত দিয়ে একটা একটা চুড়ি খুলতে থাকে। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে-ই একটা একটা চুড়ি খুলতে খুলতে একটা একটা কথা মন্থর কণ্ঠে বলে—

-তোমাকে বলেছিলাম, আমাকে বোঝা, জানা না পর্যন্ত তোমাকে স্পর্শ করবো না। কারণ, আমাদের বিয়েটা একটু অন্য রকম ভাবে হয়েছিল। তাই, আমার সাথে সহজ হওয়ার ব্যাপার তোমার কাছে দুষ্কর লাগতো। এমতবস্থায়, তোমার উপর অধিকার ফলানো আমার মতে, নিছক অন্যায়-বেমানান ছাড়া কিছুই নয়।
আমাদের মনের মিল হওয়া ভীষণ প্রয়োজন ছিলো৷ মনের মিল না হলে দাম্পত্য জীবন সুখের হয় না৷ যেখানে শুধু আমি আগে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু, বিয়ে মানে তো আর শুধু একপাক্ষিক প্রণয় নয়। বিয়ে মানে দুটো মানুষ, যাঁরা একে অপরের জীবন হয়ে ওঠে— না গলে মিশে যায়। একে অপর ছাড়া অসম্পূর্ণ লাগে।

আমি চাই, আমরা একে অপরের ভেতরে আশ্রয় খুঁজে নেই। যেখানে ভালোবাসা কেবল অনুভব নয় — তা হবে এক প্রকার প্রতিজ্ঞা, একে অপরকে সত্য করে জানা। আমি চাইনা আমার স্ত্রী কে কোনো খাঁচায় বন্দি করতে। তার উপর জোর করে স্বামীর অধিকার ফলাতে। এতে ক্ষণিকের অভিলাষ পূরণ হবে ঠিকই কিন্তু, আমরা কখনো সুখী হতে পারতাম না। কারণ, বিয়ে মানে — দুটো ডানা, যারা একে অপরকে উড়তে দেয়, আকাশে মিলেমিশে একটাই নীড় গড়ে। যা ভালোবাসা, বিশ্বাস আর কিছু প্রতিজ্ঞা দিয়ে তৈরি করা হয়। তাই, তোমাকে সময় দিয়ে ছিলাম আমার সাথে সংগম করার। তো এখন বলো,
এক হাতের চুড়ি খোলা শেষ হলে আদনান অপর হাতের চুড়ি গুলো ও খুলতে আরম্ভ করে তুর্কির। মনোহর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে—

-বিশ্বাস হয় আমাকে বেগম সাহেবা? ওই দূর আকাশে নীড় গড়বে আমার সাথে, বেগম সাহেবা? এক সাথে বহু বছর পারি দিবে? যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে। এই যৌবন থেকে প্রবীন হওয়ার আগ পর্যন্ত!?
চুড়ি খোলা শেষ হলে, তুর্কি ঘাড় ঘুরিয়ে আদনানের দিকে তাকায়। আদনানের চোখে চোখে রাখতেই অব্যক্ত অনুভূতি জেঁকে ধরে।

আদনানের কথা সব সময়-ই তুর্কির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আজ ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ও সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজারবার শুকরিয়া আদায় করে। ওর জীবনে এমন একজন জীবনসঙ্গীকে নির্বাচন করেছে। যে ওর হাজারো বায়না, পাগলামি সহ করে, ওর থেকে ওকে বেশি ভালোবাসে। ওকে ওর মত করে বুঝে। একজন স্ত্রীর কাছে এর থেকে আর বড় প্রাপ্তি কী হতে পারে! ওর মনে হয় সব আদর্শ স্বামীদের মাঝে— আদনান ও একজন।
তুর্কি দুই হাত বাড়িয়ে আদনানের গাল স্পর্শ করে। আদনানের মুখের দিকে একটু ঝুঁকে ওর কপালে ছোট করে একটা চুমু খায়৷ মন্থর কণ্ঠে বলে—

-আপনাকে কতটা বিশ্বাস করি এটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। তবে এই টুকু তো বলতেই পারি— একজন অন্ধ-লোক তার হাতের লাঠিকে যতটুকু ভরসা করে আমি ঠিক সেই রকম আপনাকে ভরসা করি। অন্ধলোক জানে তার হাতের লাঠি থাকলে সে কখনো পড়বে না। আমি ও ঠিক সেই রকম, স্যার। এর থেকে বেশি কিছু ব্যক্ত করতে পারবো না! আর ভালো তো আপনাকে অনেক আগেই থেকেই বাসি। কিন্তু, আপনি বুঝেন না।
তুর্কির কথা শুনে মৃদু হাসে আদনান। স্বভাবতঃ তুর্কির নাকে টোকা দেয়। তুর্কি চোখ বন্ধ করে ফেলে। আদনান হাত বাড়িয়ে মোমবাতি তুলে নেয়। তুর্কির মুখের সন্নিকটে এনে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে প্রতিটা মোমবাতি একই ভাবে নিভিয়ে দেয়। তুর্কি ঠোঁটে আঁকা হাসি নিয়ে দেখতে থাকে আদনান কে। রুমের চারিদিকে অন্ধকারের আগমন শুরু হয়। শুধু বিছানার কাছে দুইটা ছোট মোম জ্বল-জ্বল করছে।

আদনান আগে ওঠে তুর্কিকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। ধীর পায়ে হেঁটে বিছানার দিকে এগোতে থাকে। আদনানের প্রতিটা কদমে তুর্কির মনে লজ্জা-আড়ষ্টতায় গ্রাস করে ফেলে! বুকের ভেতর টিপ-টিপ করতে থাকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আদনানের গলা।
আদনান ধীরেসুস্থে তুর্কিকে বিছানায় বসায়। তুর্কি দু পায়ের হাঁটু বুকের সাথে মিশায় বসে। আদনান ওই পাশ দিয়ে ঘুরে এসে ওর সামনে বসে। বিছানার পাশে থাকা একটা মোম হাতে তুলে নেয়। তুর্কি ও হাত বাড়িয়ে অন্য একটা মোম হাতে তুলে নেয়। দু’জন দু’জনের দিকে ধরে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করে। দু’জনের মনে প্রেমানলের দহন শুরু হয়। দু’জন দু’জনকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে।

তুর্কির গলার চেইন মোমের হলুদ আলোয় জ্বল-জ্বল করছে। হাত-কান খালি। খোলা চুল মৃদু বাতাসে উড়ছে। আদনান মনের অভিলাষকে প্রশ্রয় দিতে হাত বাড়িয়ে—তুর্কির কপালে উড়তে থাকা চুল কানের পিঠে গুঁজে দেয়।
তারপর নিজের হাতের মোম তুর্কির দিকে দৃষ্টি রেখেই ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়। এখন বাকি শুধু তুর্কির হাতের মোম। ঐ টা ও নিভাতে গেলে তুর্কি অন্য হাত দিয়ে নিভে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। আদনানের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে

– অসভ্য লোক!
আদনান মৃদু হেসে— তুর্কি হাত ধরে ওই মোম ও নিভিয়ে দেয়। তারপর মোমটা হাত থেকে নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে দেয়। মোমটা মৃদু শব্দ তুলে মেঝেতে পড়ে।
পুরো রুম এখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। শুধু গোলাপের মিষ্টি ঘাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। আর ভাসছে দুটি প্রাণের পূতরচিতা আকাঙ্ক্ষা।
তুর্কি মন্থর কম্পিত কণ্ঠে বলে—
– স্যার, আমার কেমন যেনো অস্থির লাগছে!
আদনান, তুর্কির মুখের দিকে ঝুঁকে ওর দুই হাত ধরে; কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে—
-ভয় পাচ্ছো?
-অন্ধকার!
– অন্ধকার? নাকি আমাকে?
-আমা…
আদনান তুর্কির ঠোঁটে তর্জনী আঙুল দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে—
-হুঁশশ…আর কোনো কথা নয়! এই দিকে আসো…!

আদনান মনের বাসনা পূরণ করতে— তুর্কি ঠোঁটে রাখা হাত ঠোঁট ছেড়ে গালে রাখে। অন্য হাত দিয়ে তুর্কির কোমড় জড়িয়ে ধরে অধরে অধর ছুঁইয়ে দেয়। গম্ভীর চুম্বনে লিপ্ত হয় দুইজন। তুর্কি আদনানের বুকের শার্ট সজোড়ে খামছে ধরে। তুর্কির হাতের ধারালো নখে আঁচড় কেটে যায় আদনানের বুকে। ধীরে ধীরে ঠোঁট থেকে তুর্কির চিবুক, গলা ভরে ওঠে প্রগাঢ় চুম্বনে।

রাত্রি গভীর হওয়ার সাথে-সাথে প্রগাঢ় হয়ে ওঠে ভালোবাসা। রুম জুড়ে ছড়ায় উষ্ণ তাপের ছোঁয়া। গোলাপের পাপড়ি গুলো ও সঙ্গ দেয় তাপিত দুটি দেহে। দু’জন একে ওপরকে গভীর ভাবে কাছে টেনে নেয়। ভালোবাসার বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয় একে-অপরকে। মধুচন্দ্রিমার এই লগ্নে দু’জন-দু’জনকে উৎসর্গ করে এক মধুময় কবিতা—
‘এই রাত যেনো কেটে না যাক, সময় থেমে যাক।
তুমি হারিয়ে যাও আমাতে, আর আমি তোমাতে।
নরম আলো, গোলাপের ঘ্রাণ, জোনাকিরা রয়,
তোমার ছোঁয়ায় অন্তর কাঁপে, মনে বাজে স্নয়।
শরীর জুড়ে প্রেমের ছবি, জ্বলছে একেক স্পর্শে,
তুমি আমি মিশে গেছি — লুকোচুরির হর্ষে।
সব ভয় ভুলে যাও আজ,

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৩৯

রাতটা হোক আমাদের, সময় থামুক সাজ।
এই মধুচন্দ্রিমার লগ্ন, শত দিনের আশা,
তোমার সর্বাঙ্গে এঁকে দিলাম— অনন্তকালের ভালোবাসা।’

হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৪১