হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৬
তোয়া নিধী দোয়েল
ঘণ্টা-খানিক আগে প্রকাশিত হয়েছে এসএসসি রেজাল্ট। তুর্কির খুশির সীমা নেই। জিপিএ-৫ পেয়েছি সে। জুবাইরা রেজাল্ট শোনার সাথে সাথে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করার জন্য জায়নামাজের পাটিতে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না, তাঁর মেয়ে এত ভালো রেজাল্ট করেছে। তুর্কি ফোনে ‘হুক্কাবার’ গানে নাচ্ছে। সোফিয়াকে অনেকবার কল করেছে তুর্কি কিন্তু, সোফিয়া ফোন ধরেনি। নামাজ শেষ করে জুবাইরা তুর্কির কাছে আসে। অবাক হয়ে জানিতে চায়
-মা, তুই পাশ করলি কী ভাবে?
তুর্কি চোখ ছোট ছোট করে বলে,
-মা….
জুবাইরা তুর্কির মাথায় হাত দিয়ে বলে,
-মা, তুই সত্যি করে বল তো, তুই কি কালো জাদু করে পাশ করছস নাকি নকল করে? আমার কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে।
-অহ্ মা…তুমি কি আমাকে এত-টাই গোবর স্টুডেন্ট ভাবো? যে আমি পাশ করতে পারবো না? শুধু পাশ কেনো আমি প্লাস পেয়ে দেখিয়েছি।
-তোর মাথায় যে গোবর আছে এইটা ভাবার কি হলো? তোর মাথায় সত্যি গোবর আছে। আমার একটু সন্দেহ হচ্ছে। তোর যে ব্রেন, সেই ব্রেন দিয়ে পাশ করায় দায় তার উপর আবার প্লাস পেয়েছিস! ব্যাপারটা ঠিক আমার হজম হচ্ছে না। যাইহোক, আমার ফোনে টাকা নেই; তোর মামি খালা-রে একটু কল দে তো জানা-ই তাদের।
-কুত্তায় কামড়ায়ছে তো আমারে! আমার টায় জীবনে টাকা ভরি?
-আচ্ছা, থাক আমি রবিনের ফোন দিয়ে বলে আসি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছে তুর্কি। আজ ওর কলেজে ভর্তি হওয়ার দিন। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। জীবনের প্রথম ও কলেজে যাবে। এই ভেবে ভেবে আনন্দে একটু পর-পর আয়নার সামনে নাচ্ছে। জুবাইরা খাবার নিয়ে এসে তুর্কি কে খাইয়ে দিতে থাকে। আর বলে,
-তুই কিন্তু সাইন্স নিবি না। তোর দোহাই লাগি।
এই এক বাক্য সেই রেজাল্টের দিন থেকে বলে যাচ্ছে; কিন্তু, তাতে কোনো লাভ হয়-নি। তুর্কি যে সাইন্স নিয়ে-ই পড়বে এতে সে মন স্থির করেছে।
তাই, এই বার তুর্কি কোনো জবাব দেয় না। আনন্দের সাথে খেতে থাকে। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে দুই মা মেয়ে বাস ধরে কলেজে যাওয়ার জন্য। মানিকগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে নেমে একটা রিকশা নেয়; দেবেন্দ্র কলেজের গেটে পৌঁছানোর জন্য। মানিকগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড থেকে কলেজ গেট বেশি দূর নয়।
প্রথম গেটে নেমে কলেজের সামনে এক কম্পিউটারের দোকান থেকে ফ্রোম তুলে তা পূরণ করতে থাকে। মায়ের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে তুর্কি ইন্টারে ও সাইন্স নেয়। এত কথা বলে ও যখন কোনো লাভ হয়-নি। তাই, জুবাইরা হেরে যাওয়া সৈনিকের মত পিছু হটে যায়। তবে বলেছে যদি ও পরে গ্রুপ চেঞ্জ করতে চায় ;তখন ওকে রকমান পাগলের সাথে বিয়ে দিবেন। আর তা-না হলে মেরে ফেলে দিবেন।
বাড়ি এসে খুব উল্লাসের সাথে ও নাচতে থাকে। মানে একটা বড়লোক বড়োলোক ফিল হচ্ছে ওর। ইন্টারে সাইন্স মানে অনেক বড় কিছু! এবার তাকে ডাক্তার হতে কেউ বাধা দিতে পারবে না।
ভর্তি হওয়ার দুই দিন পর।
তুর্কি মায়ের সাথে রওনা দিয়েছে টাউনের উদ্দেশ্যে। সব বই কিনতে। ভর্তি হওয়ার দিন বই কিনতে চেয়েছিলেন কিন্তু, অনেক লাইব্রেরি ঘুরে জানতে পেরেছে, বই আসতে আরও দুই দিন সময় লাগবে।
আজাদ লাইব্রেরির সামনে এসে রিকশা থামে। মানিকগঞ্জ টাউনে বড় বড় লাইব্রেরি গুলোর মধ্যে আজাদ অন্যতম বড় লাইব্রেরি। তুর্কি সিঁড়ি দিয়ে আগে আগে লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকে। জুবাইরা ভাড়া পরিশোধ করে আসে। তুর্কি ইন্টারের সব বই দিতে বলে। এক কর্মচারী ইন্টারের সব বই সামনে এনে হাজির করে। তুর্কি ভ্রু কুঁচকে ফেলে! এত মোটা মোটা বই কেনো? আর এত গুলা কেনো? ও ধীর কণ্ঠে মৃদু হেসে বলে, আংকেল ইন্টারের বই চেয়েছি; আপনি তো অনার্স-মাস্টার্সের বই দিচ্ছেন! কর্মচারী উত্তর দেয় ‘ইন্টারের বই দিছি আপা। এখানে তো মাত্র কয়েকটা দিলাম। সব এখনো আসে-নি। আপনি আপাতত গ্রুপের বই গুলা নিয়ে যান। বাংলা, ইংরেজি, আইসিটি তো বোর্ড বই; তাই ওই গুলা আসতে একটু দেরি হবে। দেশের যে পরিস্থিতি’।
তুর্কি বই গুলার দিকে তাকিয়ে থাকে। মানে! প্রথম পত্র? দ্বিতীয় পত্র কেনো? তাও আবার এত মোটা-মোটা! আল্লাহ্!!! ও ঢোক গিলে মায়ের দিকে তাকায়।
জুবাইরা মেয়ের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। তিনি আগে-ই বলে দিয়েছে গ্রুপ আর চেঞ্জ করতে দিবে না। তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সব গুলা কিনে নেয়। আসার সময় তুর্কি বলেছিলো ওর প্রিয়, নিজামের মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনবে। কিন্তু, বই গুলা দেখার পর ওর সব শখ মিটে গেছে। ও শুধু ভেবে যাচ্ছে এই বই ও কী ভাবে শেষ করবে!
বাড়ি এসে তুর্কি ফ্রেশ হওয়া বাদ দিয়ে আগে বই গুলা খুলে দেখলো। রসায়ন প্রথম-পত্র বইয়ের সূচি পত্র দেখে খুব অবাক হলো। মাত্র পাঁচটা অধ্যায়! এর পর রসায়ন দ্বিতীয় পত্র বইয়ের সূচিপত্র বের করে দেখল ও এটা ও মাত্র পাঁচটা অধ্যায়! সিরিয়াস্লি!! মানে রসায়ন মোট দশটা অধ্যায়। উপফফফফ ভাই! এই বই গুলাকে যত মোটা দেখা যায়, এরা তত আহামরি কিছু নয়। বাঁচা গেলো। ও আর কোনো বই বের না করে ফ্রেশ হতে যায়।
মাগরিবের নামাজ আদায় করে জুবাইরা বসেছে চা বানাতে। তুর্কি খুব মনোযোগ সহকারে জুলজি বইয়ের নবম অধ্যায় ‘মানব জীবনের ধারাবাহিকতা’ পড়ছে। আর মিটিমিটি আসছে। বই পাওয়ার সাথে সাথে সে সর্বপ্রথম এই অধ্যায় দিয়ে ইন্টারের যাত্রা শুরু করেছে। বীপ বীপ সাউন্ড করে ফোন বেজে উঠে। ও একটু বিরক্ত হয়। কে এই অসময় ফোন দিলো। যদি সোফিয়া হয় তাহলে আজ-ই ওর শেষ ফোন দেওয়া হবে। ও বিরক্ত মুখে ফোন তোলে। আননোন নাম্বার! তুর্কি ভ্রু যুগল কুঁচকে ফোন রিসিভ করে
-আসসালামু-আলাইকুম।
ও পাশ থেকে সুন্দর মেয়েলী কণ্ঠ ভেসে আসে।
-ওলাইকুমুস-সালাম কামরুন। কেমন আসিস?
তুর্কি কান থেকে ফোন এনে মুখের সামনে ধরে
-কণ্ঠ শুনে মনে হলো ও মেয়েটাকে চিনে। কিন্তু, ঠাওর করতে পারে না মেয়েটা কে। মনে দ্বিধা নিয়ে ফোন আবারো কানে ধরে বলে,
-জি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?!
– আলহামদুলিল্লাহ। আমাকে চিনতে পেরেছিস?
তুর্কি কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
-মিহি আপু!!
-হ্যাঁ।
-আপিই……. কেমন আছো তুমি? এত দিন পর। আমাকে তো ভুলেই গেছো।
-হ্যাঁ, ভালো আছি। আমি ভুলেছি না তুই? ফুপু কই? ফুপু ও তো কখনো কল দেয় না।
-আর বলো না অনেক ব্যস্ত থাকে আম্মু। তোমার লেখাপড়া কেমন চলে?
-হ্যাঁ, ভালো৷ তুই এই বার কোন ক্লাসে যেনো পড়ছিস?আজ আব্বু হঠাৎ করে বললো, জুবাইরার মেয়ে কোন ক্লাসে পড়েরে? আমি বললাম হয়তো এই বার এসএসসি দিছে। তাই বললো খোঁজ নিতো।
-এইবার এসএসসি দিলাম। আলহামদুলিল্লাহ এ+ আসছে।
-আলহামদুলিল্লাহ। কই ভর্তি হইছস? মিষ্টি কবে খাওয়াবি?
-তোমার বাবার কলেজেই ভর্তি হইছি। তুমি ও তো ওই কলেজেই পড়ো তাইনা? আমি যে দিন যাবো তুমি কিন্তু, আমার সাথে দেখা করবে।
-আমার বাবা কলেজের প্রিন্সিপাল বলে, ওইটা আমার বাবার কলেজ? পাগল।
উত্তরে তুর্কি হাসে। দেবেন্দ্র কলেজের প্রিন্সিপাল সাইদুজ্জামান ফারুকের মেয়ে মিহি উপমা। উপমা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স করছে। ফারুক সম্পর্কে জুবাইরার চাচাতো ভাই হয়।
রাতে খাওয়ার সময় তুর্কি উপমার ফোন দেওয়ার কথা জানায় জুবাইরা কে। জুবাইরা ভুলে গেছিলো তাঁর চাচাতো ভাই যে কলেজের প্রিন্সিপাল। তাঁর সাথে একটু কথা বলা উচিত। যদি তুর্কি কে একটু পাশ টাশ করিয়ে দিতে পারেন। তাই খাওয়া শেষে জুবাইরা তুর্কির কাছ থেকে উপমার নাম্বার নিয়ে ফারুকের সাথে কথা বলে। কিছুক্ষণ খোশগল্প শেষ করে জুবাইরা বলে,
-ভাই একটা কথা বলি?
-হ্যাঁ, বল।
-ভাই, আমার মেয়ে তো ইন্টারে ফেল করবো। আমি কত বার বলেছি ইন্টারে সাইন্স নিছ না। কিন্তু, কোনো কথা শুনলো না। এখন কি করা যায় বলো তো।
-দেখ জুবাইরা, পড়াটা হচ্ছে নিজের। যে পর্যন্ত এই জিনিসটা কেউ না বুঝবো ততক্ষণ তাকে দিয়ে কিছু-ই করানো যাবে না। তবে তোর মেয়ে তো ভালো স্টুডেন্ট-ই। তুই চিন্তা করিছ না ও পারবো।
– না ভাই, আপনি ওরে চিনেন না। ও কিচ্ছু পারে না। আমার মনে হয় ও নকল করে পাশ করছে। এসএসসি তে যাই করছে কিন্তু, এখন চিন্তা একটু বেশি লাগছে। কী-যে করি ওরে নিয়ে।
হৃদয়ের সঙ্গোপনে পর্ব ৫
-আচ্ছা, তুই চিন্তা করিছ না৷ কাল কলেজে আয়। দেখি কিছু করতে পারি কিনা। আমার সাথে দেখা ও হয়ে যাবে; আর তোর ভাবির সাথে-ও।
জুবাইয়রা কিচ্ছুক্ষণ ভেবে বলে ঠিক আছে। যদি মেয়েটাকে একটু পাশ করিয়ে দিতে পারে।