এক চিলতে রোদ সিজন ২ গল্পের লিংক

এক চিলতে রোদ সিজন ২ পর্ব ১+২+৩+৪+৫
Writer Nondini Nila

আকাশেও অল্প নীল,
ভুল হতো অন্তমিল
একা একা রং মিছিল,
ছিলে না যখন।
মুঠো ভরা মিথ্যে ফোন
ফিরে আসা ডাক পিয়ন,
মিছিমিছি মন কেমন,
ছিলে না যখন।
ভালোবাসা দিন কত টা রঙিন,
তা বুঝেছি তখন।
????????
সারাদিন ঠিকানাহীন ,
ঘুরি ফিরি সে বেদুইন।
লুকিয়ে ডানার ক্ষত, ওওওও
তুমি নেই ভাবলেই ব্যাথায় এসে দাঁড়াবেই,
উঁচু মিনারের মত।
শুকনো পাতা কাঁপত একা ঢালে,
গন্ধ খুঁজে ডুবেছি রুমালে।
কেমন ছিলাম এখন বুঝি (২)
আকাশেও অল্প নীল,
ভুল হতো অন্তমিল
একা একা রং মিছিল,
ছিলে না যখন।

গান শেষ হতেই চারপাশ থেকে বন্ধুদের হাত তালির শব্দের মুখরিত হতে লাগলো।
‘ সব সময় এর মতো জাক্কাস হয়েছে রে। কিন্তু একটা প্রেম ভালোবাসার রোমান্টিক গান গাইতি তাহলে ভালো লাগতো। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ছ্যাকা খাওয়া গান গাইলি‌ ক্যান রে ইহান।’ বলে উঠলো নাহিদ।
গিটার পাশে রেখে ইহান বললো, ‘ আমার যেটা মনে এসেছে সেটাই গাইছি।’
ফারিয়া কটমট করে তাকিয়ে আছে ইহানের দিকে। ইহান সেদিকে লক্ষ্য করলো না। ওর ফোন বেজে উঠলো। ও ফোনে কানে ধরে উঠে দাঁড়ালো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘হ্যা আম্মু।’
‘ভালো আছিস?’
‘ হ্যা ‌তুমি কেমন আছো?’
‘ আছি ভালোই‌।কবে আসবি বাসায়?’
‘কাল আসবো। বললাম না সকালে!’
‘ হ রে মনে ছিলো না। খাইছিস?’
‘ রাত এগারোটার বেশি বাজে। এখনো আমি কি না খেয়ে থাকবো তোমার মনে হয়?’
‘ বাড়ি না থাকলে তো তোর খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো হয়ই না‌। একটুও ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করিস না। ‘
‘ এতো চিন্তা করো না তো। আমি বাচ্চা না নিজের কেয়ার নিতে জানি।’
‘ বললেই কি আর মায়ের চিন্তা যায় রে। বুঝবি না।’
‘ তুমি এখনো জেগে আছো কেন বলো তো। ঘুমাবে না আজ?’
‘ ঘুম আসছে না রে। কাল তোর খালার বাসায় যামু।’

‘ সেখানে কেন যাবে?’
‘ ওই তোর খালা আমারে…
‘ আচ্ছা তোমার যেখানে খুশি যাও আম্মু। আমি একজায়গায় বেড়াতে এসেছি তুমি আর এতো কল করে ডিস্টার্ব করা অফ করো প্লিজ।’
ইলিনা বেগম ‘আচ্ছা সবাধানে থাকিস।’ বলেই কল কেটে দিলো।
ফারিয়া, নাদিম, মুক্তা , মেহেদী, সিয়াম, বসে আছে গোল হয়ে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে ইহান কথা বলছে।
কথা শেষ ইহান ওদের কাছে এসে বসলো। ওরা সবাই এখন আছে সিলেট। পাঁচদিনের টিপে এসেছিলো সব বন্ধুরা। আজকে লাস্ট। তাই রাত জেগে গানের আড্ডা জমিয়েছে রিসোর্ট এর বাগানে।
ইহার আসতেই সবাই ওর দিকে এমনভাবে তাকাল যে ও কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলো,

‘কি হলো সবাই আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?’
‘তুই নাকি গোপনে আরেকটা প্রেম করিস?’ মুক্তা বললো।
‘ হোয়াট?’
ইহানের চেঁচানো শুনে ফারিয়া বললো, ‘ চেঁচাচ্ছিস কেন? আমার তাই মনে হয়।তুই যদি আরেকটা প্রেম না করতি আর অন্য কাউকে পছন্দ ভালো না বাসতি তাহলে তুই বারবার আমাকে কেন ফিরিয়ে দিস। ইগনোর করিস? এতদিন ধরে তোর পেছনে পড়ে আছি আর তুই এখন অব্দি আমাকে আই লাভ ইউ বলতে পারলি না।’
‘ফালতু বকবক বন্ধ করবি। নাকি এখানে থেকে চলে যাব। এই এক কথা ছাড়া কী তোর মাথায় আর কোন কথাই আসে না।’

ফারিয়া বললো, ‘না আমার মাথায় আর কিছু আসেনা আর আসবেও না। যে পর্যন্ত তুই আমাকে ভালোবাসি না বলবি।’
‘আরে ভাই ভালো না বাসলে ও কি আমি মুখে মুখে তোকে আই লাভ ইউ বলব নাকি? সেটা কি তোর ভাল লাগবে? তুই কি আমার মুখ দিয়ে মিথ্যে কথা বলাতে চাচ্ছিস?’
‘মিথ্যে কেন বলবি মন থেকে ভালবাস না। আমি কি দেখতে অতটা খারাপ নাকি যে আমাকে তুই পছন্দ করতে পারিস না। আমি কি তোর যোগ্য না বল?’

‘এখানে আবার সুন্দরের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? আমি কি তোকে বলেছি তুই আমার অযোগ্য আমি হয়তো তোর যোগ্য না‌।আর শোন আমি মিথ্যে কথা বলতে পারবো না। মনে এক রেখে মুখে আরেক কথা আমি বলি না‌। মেজাজটাই খারাপ করে দিলি আমি রুমে যাচ্ছি তোরা নিজেরাই আড্ডা দে।’
বলেই ইহান গিটার হাতে উঠে দাঁড়ালো।
মেহেদী তা দেখে বলে উঠল, ‘ উঠছিস কেন এখানে আমরা রাত দুটো পর্যন্ত আড্ডা দেব কথা ছিল। কত কিছু অর্ডার দিয়েছি খাবার চলে আসতেছে আর তুই এখন বলছিস রুমে চলে যাবি।’
‘তোরা নিজেরাই আড্ডা দে আর খা। আমার আর আড্ডা দেওয়ার মুড নাই।’

বলেই ইহান রিসোর্ট ভেতরে ঢুকে গেলো। পেছন থেকে ইহানকে সবাই চিৎকার করে ডাকতে লাগলো। কিন্তু ইহান আর কারো কথা পাত্তা দিল না। ইহানের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে। সব সময় এক প্যাচাল শুনতে শুনতে ওর কান পচে গেছে। রুমের ভেতরে এসে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
এদিকে পাঁচজন গোমরা মুখে ইহানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। এবার সবাই ফারিয়ার দিকে তাকাল রাগী দৃষ্টিতে। কারণ ফারিয়ার জন্যই ইহান রাগ করে চলে গেল। ইহান চলে যাওয়ায় আড্ডা ও থেমে গেলো। ইহান ছাড়া কি আর আড্ডা জমে!
‘কি হলো তোরা আমার দিকে এমন বড় চোখ করে তাকিয়ে আছিস কেন?’
ফারিয়ার কথায় রেগে ফুঁসে উঠে বললো মুক্তা, ‘তোর এখন এইসব বলার কি দরকার ছিল? তোর জন্য আড্ডাটাই মাটি হয়ে গেল!’

‘ আমার সাথে এমন করছিস কেন? ওই কি শুধু তোদের ফ্রেন্ড আমি কিছুই না‌। ও যে সব সময় আমাকে ফিরিয়ে দেয় সেটা কিছুই না।’
‘ জোর করে কিছু পাওয়া যায় না। আর তুই এখন এসব না বললেই হতো। ধুর’
সিয়াম পরিস্থিতি সামলাতে বললো, ‘ চুপ সবাই থাম এবার একটু। কাল চলে যাচ্ছি তাতেই মন খারাপ আর আজ সবাই নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করে সবাই রাগারাগী করছিস। থাম! ইহান গেছে ওকে রুমে থেকে ধরে নিয়ে আসবো। আজকে আড্ডা থামবে না।’
বলেই নাদিম কে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সিয়াম। ইহান কে জোর করে ধরে নিয়ে এলো রুমে থেকে। আস্তে আস্তে সব রাগারাগী ভুলে সবাই মন খুলে আড্ডা দিতে লাগলো। ইনজয় করতে লাগলো।

গ্ৰামের বুকে কখনো পা রাখা হয়নি। দেখা হয়নি সবুজে ঘেরা দেশ। ক্ষেত ভড়া ধান। সবুজ গাছপালার সমাহার। নদীতে হাঁস প্যাক প্যাক করছে।পাখির কিচিরমিচির ডাক! আহ কি মিষ্টি!
মন ভরে শ্বাস ফেলা যায়। চোখ বন্ধ করে জানালা দিয়ে মুখ বের করে রেখেছি তখন আমার হাত ধরে টেনে কেউ ভেতরে নিয়ে জানালা আটকে দিলো।
আমি চমকে রাগ মিশ্রিত চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। আম্মু ধমক সুরে বলল,
‘ এসব কি ঊষা? তুমি মাথা বের করে রেখেছো কেন?’
‘ আম্মু ছাড় আমাকে। ওই ভাবে আমার ভালো লাগছিলো কি সিগ্ধ বাতাস!’
‘ না ওই ভাবে মুখ বের করে রাখবে না আর। দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, ‘ নানু বাসা কতো দূরে আর?’
‘ এইতো চলে এসেছি।’

জানালার বাইরে আর মাথা রাখা হলো না ভেতরে থেকে তাকিয়ে আছি। অনেক পুরাতন একটা দোতলা বাড়িতে এসে গাড়ি থামলো। বাসার রং একবারে বাজে হয়ে গেছে। দেখতে খুব বিশ্রী লাগছে। আব্বু, আম্মু ও আমি গাড়ি থেকে নেমে পরলাম। বাড়িটা দেখছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমি।আম্মু ভিতরে যাচ্ছে আমিও পেছনে পেছনে যেতে লাগলাম।জীবনে প্রথমবার নানু বাড়ি এসেছি। এর আগে কখনো এখানে আসা হয়নি। আম্মু আব্বু ও কখন ও আসতো না। না আসার একটা লম্বা কাহিনী আছে অন্য সময় বলবো‌।ভেতরে থাকে কারো কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে আমি তাড়াতাড়ি ভেতরে গেলাম। ভেতরে গিয়ে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।

আমার মায়ের মতো আরেকটা মহিলা মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। আমি বিস্মিত হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছি।
তিনি আমাদের ভেতরে নিয়ে চেয়ারে বসতে দিল। এরমধ্যে জানতে পেরেছি তিনি আমার খালা। আর আমার মায়ের একমাত্র জমজ বোন। আমি গোল গোল চোখ করে দু’জনকে পরোক্ষ করছি সেম টু সেম।
শুধু একটু শুকনো আমার খালা।

বাইরে থেকে বাসাটার বাজে অবস্থা থাকলেও ভেতরে এসে এতটা খারাপ লাগছে না কারণ ভেতরে রং করা জিনিসপত্র যথেষ্ট গোছানো সুন্দর। তখনই একটা কাপড় পরা মহিলা এলো যার হাতে খাবারের বাটি তার পাশে একটা ছেলে ছয় কি সাত বছরের। তিনি আমাদের দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে। আমার আম্মু তাকে দেখেই হাসি মুখ করে উঠে ভাবি বলে উঠল। তিনি হয়তো আমাদের আশা করেননি। তিনি পিছনে ঘুরে আম্মা আম্মা বলে ঘরের দিকে চলে। একটু পরে একজন সাদা পাকা দাড়িওয়ালা ফর্সা পাঞ্জাবি পরিহিত লোক বেরিয়ে এলো।

তিনি অনেক লম্বা আর চেহারা অনেকটা আমার আম্মুর সাথে মিল আছে আমার মনে হয় উনি আমাদের নানাজান। তার পেছনে একজন ছুটে এলো কাপড় পরিহিত তিনি আমার আম্মুকে দেখে তো জড়িয়ে ধরল আম্মু উঃ তাকে জড়িয়ে ধরে মা বলে উঠলো।

সবার কান্না চলছিলো। আর আমি সেখানে নিরব শ্রোতা হয়ে সব দেখছিলাম। বাবা চেয়ারে বসে আছি চুপ করে। আমি সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। হঠাৎ একটা ঝড় বয়ে গেল। সেই ঝড়ে আমার খুঁটিয়ে দেখা বন্ধ হয়ে গেল সবার কান্না থেমে গেলো। আমি ভয়ার্ত চোখে আমার একমাত্র
নানা জানের দিকে তাকিয়ে আছি।

যে আশা নিয়ে আসা হয়েছিল তার কিছু হলো না। কারো এক ফোঁটা রাগ কমলো না। শুধু আমার খালা আর নানু আমাদের জন্য কান্নাকাটি করতে লাগলো কিন্তু নানা জানের মন গললো না। কিন্তু আমার সাথে খারাপ বিহেভ ও করেনি। আম্মু আব্বুর সাথে কথা না বললেও আমার সাথে কথা বলেছে গম্ভীর মুখ করে। এতো দূরে থেকে যাওয়া হয়েছে তাই থাকতে বললো নানু কিন্তু আম্মু রাজি না। চোখের জল মুছে তখনি বেরিয়ে এলো। আমার খুব খারাপ লাগছিল সাথে কষ্ট ও। ইশ নানাজান এমন কেন এতো গম্ভীর রাগী। মা বাবাকে মেনে নিলে কি হতো।

প্রেম করে বিয়ে করলে এতোটা অপরাধী হয় নাকি। জীবনের প্রথম বার নানু বাড়ি এসেও তাদের আদর খেতে পারলাম না। সবাই মুখ ভার করে চলে এলাম নিজেদের গন্তব্যে। সারা রাস্তা আম্মু কাঁদলো আব্বু আম্মুকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। আমি জানালাতে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। মনটা খুব খারাপ। অল্পতেই মন খারাপ হ‌ওয়ার দারুন অভ্যাস আমার। আর এখন তো খুব কষ্টের মুহূর্ত কষ্ট না পেয়ে কি উপায় আছে।এতো দিন পর নিজের বাড়ি গিয়ে ও আম্মু কারো থেকে সহানুভূতি পেলো না। ভালোবাসা পেলো না। দুজন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো বলে কি খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছিলো। আম্মু আব্বু কতো হ্যাপি কিন্তু তাও তাদের মনে শান্তি নাই। আমি কখনো নানুবাড়ির আদর পাইনা‌‌। এক রাশ আফসোস নিয়ে বসে র‌ইলাম।

বাসায় আসতে রাত হয়ে গেলো। আমি গাড়িতে ঘুমিয়ে পরেছিলাম। আম্মুর ডাকে চোখ কচলে গাড়িতে থেকে নেমে পরলাম। সারা রাস্তা ঘুমিয়ে কাটিয়েছি এজন্য রুমে এসে শাওয়ার নিয়ে টিভির সামনে বসে পরলাম। পছন্দের কার্টুন দিয়ে চিপস খেতে লাগলাম।
নয়টা বাজে আমি টিভি দেখতে মগ্ন তখন ফোনে কল এলো তাকিয়ে দেখি তুলি কল করেছে।
‘ হ্যালো,
‘ কোথায় তুই বলতো। আজ স্কুলে আসলি না কেন?’
‘ এক জায়গায় গিয়েছিলাম। কাল আসবো আগেই চলে আসিস।’
‘ কোথায় গেছিলি?’
‘ নানু বাসায়‌।’
‘ কি তোর নানা বাড়ি?’
‘ হুম।’
‘ কোনদিন তো তোকে নানাবাড়ি যাওয়ার কথা শুনি নাই। আজ হঠাৎ!’
‘ ওই এমনি, রাখছি খাবো এখনো। কাল কথা বলি।’
‘ আচ্ছা।’
আম্মু খেতে ডাকছে তাই কল কেটে টিভি অফ করে খাবার টেবিলে চলে গেলাম। আমি ও আব্বু ঠিক মতো খেলেও আম্মু খেলো না।তার মনের অবস্থা খারাপ জানি তাই কেউ কিছু বললাম না। আমি দ্রুত খাবার খেয়ে চলে এলাম।
আজ আর পড়া হবে না তাই বিছানায় শুয়ে পরলাম।

সিলেট থেকে এসেই লম্বা ঘুম দিয়েছে ইহান। কোথাও বেড়াতে গেলেই সারাদিন বিছানাতেই কাটাতে হয় ওর। ঘুম ভাঙে রাত এগারোটার। পেটে খিদের যন্ত্রণায়। মা বাসায় নেই তাই এভাবে বিকেলে থেকে ঘুমাতে পেরেছে শান্তিতে না হলে কতোবার যে বিরক্ত করতে আসতো। এতে ইহান অবশ্য বিছানায় থেকে নামতো না কিন্তু ইলিনা বেগম চেঁচিয়ে ছেলেকে ডেকেই যেতো। বাসায় এসে জানতে পেরেছে সকালেই মা বড় খালার বাসায় চলে গেছে। এতো রাতে কেউ তো আর জেগে নাই। নিজেকেই খাবার নিয়ে খেতে হবে। মুখে পানির ছিটা দিয়ে ড্রায়নিং টেবিলে এসে বসলো। খাবার গরম করতে যাবে কে এখন। বিরক্ত হয়ে ফ্রিজ থেকে ফল বের করে নিলো, সাথে মিষ্টি। সেসব গেয়ে রান্না ঘরে গিয়ে কফি বানিয়ে রুমে চলে এলো। বেলকনিতে বসে কফি খাচ্ছে আর ফোন টিপছে। ফারিয়ার অনেক গুলো কল দেখলো। কিন্তু নিজে থেকে আর ব্যাক করলো না।

সকালে দরজা ধাক্কায় উঠে বসে ইহান বাইরে ইমার গলা পাওয়া যাচ্ছে। দরজা খুলতেই ইমা রেগে ঘরে ঢুকে বললো,
‘ কাল না খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলি কেন? কতো ডাকাডাকি করলাম শুনলি না তুই।’
‘ না খেয়ে ঘুমাবো কেন? আমি রাতে উঠে খেয়েছিলাম।’
‘কি খেয়েছিস? কিছু তো গরম করা ছিলো না।’অবাক হয়ে বললো ইমা।
‘গরম করা ছাড়া যা পেয়েছি তাই খেয়েছি। বাবা কোথায়?’
‘ বাবা তো অফিসে চলে গেছে। কেন?’
‘ এমনি।’
‘ আচ্ছা তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয় একসাথে ব্রেকফাস্ট করবো।’
‘ আচ্ছা আসছি আমি।’

ইমা চলে গেলো। একসাথে ব্রেকফাস্ট করে নিলো। ইলা, ইমা ও ইহান।
ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় ফারিয়ার কল এলো। ফারিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে ইহান ভার্সিটিতে এসে উপস্থিত হলো। ইহান অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সবাই ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছে আর খাচ্ছে। বাইক রেখে ইহান ওদের পাশে গিয়ে বসলো। ওকে খেতে বললে খেলো না কিছু। কফি নিয়ে বসেই আছে।
‘ ইহান তোকে এক জায়গায় গান গাইতে হবে।’

‘ কিহ? কপাল কুঁচকে বললো ইহান। ও গান শখ করে গায়। সেটা বন্ধুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যা নাই কিন্তু এই অনুষ্ঠানে গাওয়াটা এক দম পছন্দ করে না। বিরক্ত লাগে ওর। রাগে গজগজ করতে লাগলো ও। এই ভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা নিজাম উদ্দিন হাজারীর আরেকটা স্কুল আছে সেখানে নববর্ষের অনুষ্ঠান হবে খুব ধুমধাম। আর সেখানেই ইহানকে গান গাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। ইহান ভার্সিটির অনুষ্ঠানে গান গেয়ে থাকে এজন্য সবাই জানে ওর মুগ্ধ গানের গলা।যা সবার পছন্দের এজন্য তিনি এই কথা বলেছে। স্কুল টা ভার্সিটি আসতে রাস্তায় পরে। কখনো যাওয়া হয়নি ইহানের। নিজাম উদ্দিন হাজারীর কথা শুনে ওরা ওর হয়ে সম্মতি দিয়ে দিয়েছে। তাতে ইহান আরো রেগে গেলো।
‘ আমাকে না বলে তোরা রাজি কেন হয়েছিস? আমি কোন গান ফান গাইতে পারবো না।’

‘ প্লিজ দোস্ত এখন আর আমাদের মান সম্মান ডুবাইস না। তিনি বললো আর আমরা কিভাবে জানি রাজি হয়ে গেলাম। বিশ্বাস কর তোকে জানাতে চাইছিলাম কিন্তু নাম্বার বিজি ছিলো।’
ইহান কলেজে আসার সময় ফারিয়ার সাথে কথা বলেছে। তার মানে তখন কল করেছিলো।ডিজগাস্টিং ‌
ফারিয়া আজ ভার্সিটি আসবে না। ইহানকে রাজি করানো গেলো না। সবাই ওর পেছনে ঘুরতে লাগলো‌। রাজি করানোর জন্য। রাজি না হলে মান সম্মান সব যাবে। ইহান ধমক দিয়ে বসে আছে।
বন্ধু দের মান সম্মান যাক এমন কিছু করতে পারবে না ইহান তাই রাজি হতেই হলো। যত‌ই না করুক ওদের কথা ও ফেলতে পারেনা।

লাল সাদা শাড়ি হাতে বসে আছে ঊষা। ও একটু ও শাড়ি পরতে চায় নি‌। কিন্তু তুলি নাছরবান্দা অনেক ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে ঊষাকে রাজি করিয়েছে শাড়ি পরে যেতে। ঊষা শাড়ি একদম সামলাতে পারে না। খুব আন‌ইজি লাগে শাড়ি পরলে। আর মনটা ভয়ে থাকে এই বুঝি খুলে যাবে।
কিন্তু সব এক পাশে ফেলে আজ ওকে শাড়ি পরেই যেতে হবে। আম্মু এসে নিজে হাতে সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিলো আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার শাড়ি পড়ানো দেখালাম। সাদা শাড়ি ও লাল ব্লাউজ, লাল চুড়ি, আর চুল খোঁপা করে গাজড়া দিয়ে দিলো।

সাজতে আমার কোন কালেই পছন্দ না কিন্তু শাড়ি পরে একটুও না সাজলে ভালো লাগবে না তাই আম্মু আমাকে হালকা সাজিয়ে দিলো। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিলাম, মুখে ফেসপাউডার, কানে ঝুমকা। আম্মু কাজল দিতে বললো কিন্তু আমি কাজল দেয়না কখনো আজ ও দিলাম না। আমার চোখ চুলকায় কাজল দিলে। তাই এটা বাদ র‌ইল। শাড়ি হয়ে আছি বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসে আছি।স্কুলে কখনো সেজে গুজে যাই নাই‌। আজ শাড়ি পরে যেতে আমার লজ্জা নাক মুখ লাল হয়ে উঠছে। সবাই কেমন করে তাকিয়ে থাকবে সেসব ভেবে আমি লজ্জায় লাল হয়ে বসে নখ খুচাচ্ছি।

তুলি এসে আমাকে এই ভাবে বসে লজ্জার লাল হতে দেখে বললো,
‘ এই তুই এমন লজ্জা লাল নীল হচ্ছিস কেন? নতুন ব‌উ এর মতোন।’
‘ আমি শাড়ি পাল্টে অন্য ড্রেস পরে যাই রে আমার না খুব লজ্জা লাগছে এই ভাবে কলেজে যেতে।’
‘ কিইই অসম্ভব। চুপচাপ চল।’
‘ আমার লজ্জা লাগছে বুঝতে পারছিস না।’
তুলি আমার আম্মু কে ডাক দিলো।

‘ আন্টি আপনি কোথায়? দেখুন ঊষা কী বলছে ও নাকি শাড়ি পাল্টে ফেলবে আপনি অন্তত কিছু বলেন। এই মেয়ে এতো লজ্জা কেন পায় আমি বুঝি না। যেন নতুন ব‌উ উনি।’
আম্মু এসে আমাকে জোর করে তুলির সাথে পাঠিয়ে দিলো। নিজেদের গাড়ি করে এলাম আজ।সব সময় লোকালে চলাচল করি আমি এতেই আমার ভালো লাগে। কিন্তু আজ তা করলাম না। শাড়ি পরে আমার অটোতে যেতে ইচ্ছে করছে না।
স্কুলে এসে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম। কারণ সবাই শাড়ি পরে সেজে গুজে এসেছে। এটা দেখে কিছুটা লজ্জা কমলো আমার। আর গাড়ি থেকে নেমে পরলাম।

আমি আর তুলি চারপাশের সাজানো দেখতে দেখতে গেটের ভেতরে ঢুকছি তখন কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে শাড়িতে পা বেজে ধপাস করে পরে গেলাম। আমি মৃদু চিৎকার করে উঠলাম। ইশ কি লজ্জা! লজ্জায় এবার মরেই যেতে ইচ্ছে করছে! মাথা নিচু করে ঘাসের উপর বসে আছি আমি। কোন দিকে তাকাচ্ছি না। তাকানোর সাহস হচ্ছে না আমার। আজকেই এইভাবে পরতো হলো। ইশ সবাই নিশ্চয়ই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। লজ্জায় আমার গাল লাল হয়ে গেছে চোখের কোণে জল চলে এসেছে। আমার চোখ বন্ধ করে এই মুহুর্তে ছুটে বাসায় চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
‘ ইউ ইডিয়েট গার্ল! এটা কি করলে তুমি!দেখে চলতে পারো না। আমার ফোন‌।’ চেঁচিয়ে উঠলো ইহান। ধাক্কা খেয়ে ওর হাতের ফোন নিচে পরে গেছে। শুধু পরেই ক্ষান্ত হয়নি। কানে ছিলো ফোন ধাক্কায় কিছুটা হেলে গেছিলো ইহান এজন্য ওর হাত ছিটকে ফোন বাম পাশের দেয়ালে লেগে গ্লাস ভেঙ্গে একদম খামচোড়।

নিচে বসে লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিলাম না। তখন সামনের ওই ধাক্কা দেওয়া খাটাশ লোকটার মুখে ককর্শ আওয়াজ শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার‌। লজ্জা পেলেও আজকে এই ছেলেটার ধমকানি শুনে আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। আমি নিজের রক্তাক্ত হাতের দিকে তাকিয়ে পাশে তাকালাম। চুড়ি একটা ভেঙে পরে আছে আর চুড়ির আঘাতে হাত কেটে গেছে জ্বলছে। আমি সেসব ঠোঁট কামড়ে ধরে সহ্য করতে লাগলাম। তুলি আমাকে টেনে দাঁড় করালো।

শাড়ি ছিলো সাদা আহারে মাটিতে পরে ডিসকালার হয়ে গেছে।
‘ এই মেয়ে কথা বলছো না কেন? দেখে চলতে পারো না যতসব ফালতু। এভাবে কেউ ধাক্কা দেয়। আমার ফোনটা গেলো।’ আফসোস সুরে বলল ইহান।
শাড়ির কুঁচি ঠিক করে ধরে ছেলেটার দিকে তাকালাম। চোখ লাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে এইভাবে ফেলে দিয়ে সবার সামনে হাসির পাত্র করে এখন ধমকানো হচ্ছে কতো বড় বেয়াদব। রেগে গেলাম আমি।
‘ এই যে শুনুন। একদম আমাকে ধমক দিবেন না বলে দিচ্ছি। আমি আপনাকে ধাক্কা দিয়েছি মানে কি সব বলছেন। ধাক্কা তো আপনি আমাকে দিয়েছে। ফোনে কথা বলছিলেন এতো মগ্ন হয়ে যে এক জল জ্যন্ত মানুষ আসছে দেখেও না দেখার ভান করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। চোখ কি পকেটে নিয়ে ঘুরেন??’

আঙুল তুলে কথাগুলো বললাম। রাগে ও লজ্জায় আমার শরীর কাঁপছে। আশেপাশে অনেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তা দেখে আরো রেগে গেছি।
আমার কথা শুনে সামনে জন আরো রেগে গেলো। তার পাশে আরো কয়জন দাঁড়িয়ে আছে। একটা ফর্সা করে শর্ট ড্রেস পড়া মেয়ে এগিয়ে এলো,

‘ এই মেয়ে সুন্দর ছেলে দেখলেই ধাক্কা দিতে মন চায় তাই না।’ চেঁচিয়ে বললো ফারিয়া।ফারিয়া এসব দেখে তো রেগে আগুন। ইহান এর সাথে কোন মেয়ের ধাক্কা লেগেছে দেখেই ওর রাগ উঠে গেছে।
‘ মুখ সামলে কথা বলুন। দোষ উনার উনি আমাকে ধাক্কা দিয়েছে।’
ইহান ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। একদম ফোনের স্ক্রিন শেষ। কিছুদিন‌ আগেই কিনেছিলো আই ফোন আর তা এই ইডিয়েট মেয়েটা নষ্ট করে দিলো। তার উপর আবার ওকেই দোষারোপ করছে। ফারিয়াকে সরিয়ে নিজে আবার বলতে লাগলো,

‘ এই মেয়ে, নিজের দোষ আমার উপর চাপাচ্ছ কেন? তোমার অসাবধানতার জন্য আমার এতো দাম এর ফোনটা গেলো।ইউস ও করতে পারলাম না।দোষ করে বড় বড় কথা বলছো খুব বেয়াদব তো তুমি।’
‘ কিহহ বললেন আমি বেয়াদব। আপনি বেয়াদব। সবার সামনে ফেলে আমার শাড়ি নষ্ট করে দিলেন।’
ইহান কিছু বলতে যাবে সিয়াম ওর বাহু চেপে ধরলো। আর ফিসফিস করে বললো,
‘ প্লিজ চল এখানে থেকে।ছোট মেয়েদের সাথে এই ভাবে ঝগড়া করতে নেই। সবাই কিভাবে তাকিয়ে আছে দেখ। এখানে আমরা গেস্ট! নিজেদের রেপটেশণ কেন নষ্ট করছিস।’

‘ মেয়েটা আমার ফোনটা নষ্ট করে আবার বড় বড় কথা বলছে দেখছিস না। একবার সরিও বললো না উল্টা ঝগড়া করছে।’
‘ আরে বাদ দে তো। সুন্দরী মেয়েদের রাগ বেশি থাকে জানিস‌ই তো।আর তুই ও কম ঝগড়া করছিস না।’
‘ এই তুই আমার বন্ধু হয়ে ওই মেয়ের হয়ে কথা বলছিস।’
সিয়াম আর কথা না বলে ইহানকে টেনে নিয়ে গেলো।সাথে সবাই ওদের পেছনে গেলো শুধু ফারিয়া বাদে ও ঊষার দিকে কটমট করে তাকিয়ে পরে গেলো।
এদিকে

তুলি বললো, ‘ দোস্ত আমি এসব কি দেখছি? এটা কি আমার সেই ভীতু দোস্ত ঊষা নাকি অন্য কেউ?’
আমি তুলির কথা শুনে গরম চোখে করে তাকালাম।
‘ সত্যি ঊষা তুই এতো কথা বলতে পারিস আগে জানতাম না তো। এই ভাবে তালে তাল মিলিয়ে ঝগড়া করলি। আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না।’
‘ চুপ ফাজিল। ছেলেটা আমাকে কিভাবে অপমান করলো দেখলি তাও কিছু বললি না। চুপ করে তামাশা দেখলি শুধু।’
‘ আমি আর বলার সুযোগ কোথায় পেলাম। তুই তো কম বললি না।’
‘ তো বলবো না। এইভাবে আমাকে ফেলে কি অবস্থা করেছে দেখ। শাড়ির অবস্থা এটা পরে এখন আমি ভেতরে যাব কি করে?’

‘ তোর অবস্থা দেখেছি। কিন্তু ওই হ্যান্ডসাম ছেলেটার ফোন ভেঙে গেছে রে তাই রেগে গেছিলো।’
‘ তো আমি কি করবো। তার নিজের দোষ এ তার ফোন গেছে আমার কি দোষ। উনি নিজের ফোনটাও ভাঙলো সাথে আমার অবস্থা ও নাজেহাল করলো।’
‘ এই তোর হাত তো কেটে গেছে।’
‘ হুম।’
‘ আচ্ছা তুই দাড়া আমি আসছি।’
‘ কোথায় যাবি?’
তুলি ব্যান্ডেজ নিয়ে এলো পাশের দোকান থেকে। হাতে লাগিয়ে দিয়ে বললো,
‘ চল চেয়ারে বসে পরি। আর উঠবো না বসে অনুষ্ঠান দেখবো।’
‘ আমি বাসায় চলে যাই। এই ভাবে যেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘ আরে কেউ খেয়াল করবে না আমাদের।ওই দেখ অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।সবার মনোযোগ ওইখানে আমরা চেয়ারে বসে পরলো জাস্ট প্লিজ!’
মনটাই খারাপ হয়ে গেছে ওই অসভ্য ছেলেটার জন্য। তাও ভেতরে গিয়ে চতুর্থ সারিতে বসলাম। বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে।গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে।
প্রথম সারিতে সেই অসভ্য ছেলেটাকে দেখলাম। হেসে হেসে বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। আমি ভেংচি কেটে চোখ সরিয়ে নিলাম।
আমাদের ক্লাসের দীপ্তি নাচ করলো। ও খুব সুন্দর নাচে প্রতি অনুষ্ঠানে নাচে অংশ গ্ৰহণ করে। ছেলেরা তো লাফালাফি করছে। দীপ্তির দিকে তাকিয়ে আছি মেয়েটা ভালো নাচে কিন্তু এখন না নাচলেই ভালো হতো। কারণ ছেলেরা বাজে নজরে ওকে দেখে।

পরপর নাচ গান, নাটক হলো। বারোটা বাজে বিরতি দিলেই আমি চলে যাব।
এদিকে ইহানের গানের সময় দিয়েছে বিরতির পর। তাই ওর রেগে আছে। গান না করেই চলে যাব বলছে কারণ বিকেলে ওর ইলা আপুকে আনতে যেতে হবে এয়ারপোর্ট এ।
নাদিম চলে গেলো কথা বলতে। আর বললো বিরতির আগেই ওর গানের ব্যবস্থা করে দিবে‌।
আমি পেয়াজু খাচ্ছি। তুলি কিনে এনেছে কিছু খাবার।আমি আর উঠি নাই‌।তুলি কয়েকটা পিক তুললো আমি শুধু মুখের ছবি তুললাম।
আমার পাশে বসে আছে মায়া আর ওর বন্ধুরা। ওরা কাকে নিয়ে যেন কথা বলছে। ক্রাশ খেয়েছে বলছে। মায়া ওর বান্ধবীদের বলছে।

‘ আমি ওই যে প্রথম সারিতে দেখ কাঁধে গিটার ওয়ালা নীল রঙের শার্ট পরা ছেলেটা! ফর্সা তার উপর ক্রাশ খাইছি। কি সুন্দর হাসি রে। আর দেখতেও হ্যান্ডসাম কতো। মনে হয় গান করে কাঁধে গিটার রাখা‌।’
আমিও ওদের কথা শুনে তাকিয়ে দেখি সেই ধাক্কা দেওয়া ছেলেটা।‌ ওই খাটাশ ছেলেটার উপর ক্রাশ খাইছে আল্লাহ! তখন দেখলাম ওই ছেলে গিটার হাতে স্টেজে যাচ্ছে। এই ফাজিল ছেলেটার গান গাইবে নাকি…
ভেবে তাকিয়ে আছি স্টেজ এর দিকে।
ইহানের নাম ডাকতেই উঠে যায় ও। তারপর গান গাইতে লাগে চোখ বন্ধ করে।
তুমি হাসলে আমার ঠোঁটে হাসি,
তুমি আসলে জোনাকি রাশি রাশি…
রাখি আগলে তোমায় অনুরাগে,
বলো কিভাবে বুঝায় ভালোবাসি..
সব চিঠি সব কল্পনা জুড়ে,
রঙ মিশে যায় রদ্ধ দুপুরে,

সেই রঙ দিয়ে তোমাকেই আঁকি আর কিভাবে বলো ভালোবাসি,
প্রাণ দিতে চাই, মন দিতে চাই সবটুকু ধ্যান সারাক্ষণ দিতে চায় তোমাকে, ওওওতোমাকে,
স্বপ্ন সাজাই নিজেকে হারাই,
আর দুটি নয়নে রোজ শুতে যাই তোমাকে ওওও তোমাকে,
জেনেও তোমার আঁখি চুপ করে থাকি,
রোজ দুই ফোঁটা যেন আর ভালো লাগে,
লারে অভিসারে,চায় শুধু বারে বারে তোমাকে ওওও তোমাকে….
যেদিন কানে কানে সব বলবো তোমাকে,
বুকের মাঝে জাপ্টে জরিয়ে ধরবো তোমাকে…

পথ চেয়ে র‌ই, দেরি করো না যত‌ই, আর ভুলা যাবে না জীবনে কখনো তোমাকে ওওও তোমাকে, ওওও তোমাকে..
জেনেও তোমার আঁখি চুপ করে থাকি,
রোজ দুই ফোঁটা যেন আর ভালো লাগে,
লারে অভিসারে,চায় শুধু বারে বারে তোমাকে ওওও তোমাকে….
ফাজিল হলেও গান তো ভালোই গায়। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। গান শেষ করে চোখ খুললো। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। আর হাত তালি দিলাম না। আমি ছাড়া সবাই হাত তালি দিলো।
স্টেজ ফাঁকা হয়ে গেলো। বিরতি দিয়ে সবাই নেমে গেছে। আমি কাচুমাচু মুখ করে বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। সবার চেয়ার ছেড়ে উঠার অপেক্ষা করছি।সবাই জায়গা ত্যাগ করলো না। অনেক এখানে বসেই আড্ডা শুরু করে দিয়েছে। অনেকে দোকানে গিয়ে ভীড় জমাচ্ছে।
আমি কাচুমাচু করেই উঠে দাঁড়ালাম।

‘ তুই এইভাবেই থেকে যা না। একা আমার ভালো লাগবে না।’ তুলি বলে উঠলো।
‘ চৈতি দের সাথে থাকিস। আমি আর এই অবস্থায় থাকবো না রে অনুরোধ করে লাভ নাই‌।’
‘ আচ্ছা সাবধানে যা।’
নিচের দিকে তাকাতে থেকে গেট পেরিয়ে এলাম। বাইরে এসে ওই ধাক্কা দেওয়া ছেলেটাকে দেখতে পেলাম। ছেলেটার নাম শুনেছিলাম যখন গান গাইতে স্টেজে থেকে নাম ডাকলো,
কি যেন বললো?
ভেবেও মনে করতে পারলাম না। আমাকে দেখেনি মনে হয়। দেখলে আবার সেই ফোন নিয়ে ঝামেলা করতে এসে পরতে পারে মনে হলো তাই মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে র‌ইলাম।

অটো পেতেই ঝটপট উঠে গেলাম। তখন এতো কথা কিভাবে বললাম নিজেও জানিনা কিন্তু এখন যদি আবার ছেলেটা ঝামেলা করতে আসে আমি একটা কথাও বলতে পারবো না জানি। তাই ওই ছেলের নজরে না পরা টাই ভালো।
অটোতে উঠে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো ছেলে গুলো। অটো তাদের অতিক্রম করে যাবে আমি তাকিয়ে ছিলাম সেই মেয়ের দিকে যে আমাকে কথা শুনাতে এসেছিলো।
‘ এই ঝগড়ুটে মেয়ে! আমার ফোন ভেংগে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’

আমার নজর ঘুরে গেলো। আমি ঢোক গিলে ছেলেটার দিকে তাকালাম। আমার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। আর চেঁচিয়ে কথা গুলো বলছে। আমার নিজের শাড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবছি। দোষ তো উনার উনার জন্য শাড়ি নষ্ট হলো সাথে আমার অনুষ্ঠান দেখা ভঙ্গ হলো। তাতে কিছু না যেন‌। আমাকে আবার চেঁচিয়ে বকা হচ্ছে খুব বাজে ছেলেটা।
বাসায় আসতেই আম্মু বললো,

‘ এতো তাড়াতাড়ি বাসা এলি কেন? বিকেল পর্যন্ত না বলে থাকবি!
বলতে বলতে আম্মু আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললো, ‘ একি শাড়ির এই অবস্থা কেন?’
আমি বললাম, ‘ আমি পরে গেছিলাম কলেজে।’
‘ কিহহ! কিভাবে পরলি? কোথায় পরেছিলি? আর ব্যাথা পেয়েছিস নাকি দেখ!”
বলেই আমাকে চেক করতে লাগলো।আর হাতের আঘাত দেখে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
আম্মু আব্বু এমনি আমার একটু কিছু হলেই পাগল হয়ে যায়। আব্বু কে ভয় পেলেও আম্মু আমার বন্ধুর মতো। তাকে আমি সব বলি তাই আজ ও বাদ দিলাম না। ধাক্কা লাগা থেকে ঝগড়া করা সব কিছু আম্মু কে খুলে‌ বললাম। আম্মু সব শুনে খুশি হলো খুব যেন।

আম্মু বললো, ‘ আমার ভীতু মেয়েটা এতো কথা বলেছে বাব্বাহ। ছেলেটা আবার গান ও গায়। আচ্ছা দেখতে খুব হ্যান্ডসাম নাকি রে তোর পছন্দ হয়েছে?”
আমি অবাক গলায় বললাম, ‘ মানে কি? কি সব বলছো? পছন্দ হ‌ওয়ার কথা এখানে আসছে কেন? ছেলেটা কতোটা বাজে তুমি দেখেছো। তার কিছু বলছো না উল্টা কেমন দেখতে এসব নিয়ে পরলে কেন?’
‘ পছন্দ হয়েছে কিনা না জানলে বুঝবো কেমনে প্রেম হবে নাকি?’
আমি মাথা হাত দিয়ে বললাম, ‘ তুমি আমার মা নাকি বান্ধবী বুঝতেছিনা। এই ভাবে কেউ প্রেমের কথা বলে। আমার বুঝি লজ্জা করে না। আরেকটা কথা ওই সভ্য ছেলের সাথে আমি কখনো প্রেম করবো না।’

‘ তার মানে দেখতে ভালো না।’
‘ আমি কি বলেছে দেখতে খারাপ। দেখতে ভালো কিন্তু আমার জন্য না। আমি রুমে গেলাম এখানে থাকলে আজেবাজে কথা বলবে। তোমাকে এসব বলাই উচিত হয়নি।’
আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমি রাগ দেখিয়ে রুমে চলে এলাম।

(কাল একটা শব্দ ভুল লিখেছিলাম। ইলা আপু কে ইহান এয়ারপোর্ট থেকে আনতে যাবে সেখানে হবে জেরিন আপু।)
জেরিন আপু কে ইহান ও ইহানের বড় খালু আনতে গিয়েছে। সেখানে থেকে ইহান ও বড় খালার বাসায় গিয়েছে। ইলিনা বেগম ছেলেকে দেখে খুশি সাথে বোনের মেয়েকে দেখে আরো খুশি। হা করে বিদেশি কালচারের বোনজিকে দেখছেন। কিন্তু বোনজি তার সাথে কথা বললো ইংরেজি তে তাতে তিনি আগামাথা কিছু বুঝলো না। বোকা চোখে তাকিয়ে র‌ইলো।

ইহানকে ধরে বেঁধেও রাতে রাখতে পারলো না। নয়টায় ই বেরিয়ে পরলো। ইলিনা বেগম অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু কাজ হলো না। ছেলে তার কথা শুনলো না মুখ কালো করে র‌ইলো।
বাসায় এসে ইহান ফ্রেশ হয়ে কফি খাচ্ছে। ফোনের জন্য মনটা আনচান আনচান করছে। ল্যাপটপ নিয়ে ভিডিও কলে বন্ধুদের সাথে কথা বললো। ফোনের জন্য মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। আর ওই ইডিয়েট মেয়েটা উপর রাগ লাগছে। রাগে গজগজ করতে লাগলো ও কল কেটে। এখন বাসায় ফোনের কথাও বলা মুশকিল। এক মাস হয়েছে ফোনের এখন আবার ফোন চাইতে হবে। বাবার কথা শুনতে হবে।

আজ টিফিন টাইমে, দুপুরেই স্কুল ছুটি হয়ে গেলো‌। তুলি হাত ধরে বলছে ওর সাথে শপিংমলে যেতে। আমার যাওয়ার ইচ্ছা নাই‌। একা কখনো শপিং মলে যায় না আমি সব সময় আম্মু আব্বুর সাথে যাই‌। একা যাওয়ার অভ্যাস নাই। তাই তুলিকে বলছি যাব না কিন্তু ও তা মানতে নারাজ। ও একা যাবে না। আমাকে নাকি যেতে হবে‌। কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলো।

‘ আচ্ছা চল। দেরি করবি না কিন্তু।’
‘ আরে দেরি করবো কেন! কেনা হলেই চলে আসবো আমার এতো সময় লাগে না।’
‘ হুম জানি তো। মিশু দের সাথে গেছিলি তখন কতো লেট করেছিলি জানি না তো আমি। তাই না।’
‘ আরে ঊষা সেদিন তো অনেক জিনিস কিনেছি তাই এতো সময় লেগেছিলো। আজ এতো জিনিস কিনমু নাকি শুধু একটা স্ক্যাপ কিনবো।’
‘ আচ্ছা দেখা যাবে। চল তারাতাড়ি।’

দশ মিনিটের রাস্তা এখানে থেকে শপিং মলের তাই চাইলেই হেঁটে যাওয়া যাবে। কিন্তু তা নেওয়া হলো না। কারণ আকাশে রোদের তাপ তীব্র। তাই রিকশা নেওয়া হলো।
শপিং মলে ঢুকে গেলাম আমি আগেই এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে। তুলি ভাড়া মিটিয়ে এসে আমাকে নিয়ে লিফটের কাছে এলো। দুতালায় যেতে হবে এখন। মানে কি স্কাপ তো নিচেই আছে উপরে কেন যাচ্ছি।
‘ এই দুতালায় কেন যাচ্ছিস? স্কাপ তো নিচেই আছে।’
‘আমার একটা ঘড়ি ও কিনতে হবে চল না প্লিজ। দোতালায় ঘড়ির দোকান।’
‘ সে তো আমি জানি। কিন্তু তুই তো বলেছিলি শুধু স্কাপ কিনবি।’
‘ঘড়ির কথা তোকে বলতে মনে ছিল না।’

আমি রাগী চোখে ওকে দেখছি। আর কতো কিছু আছে আল্লাহ জানে। কিন্তু কি আর করার। এসেছি যখন সহ্য তো করতেই হবে। লিফটের দরজা খুলেই ঢুকে পরলাম। আমাদের সাথে আর দুইজন ঢুকলো। তাদের একজন কে দেখে আমার চোখ দুটো বড় হয়ে গেলো।এই তো সেই ধাক্কা দেওয়া ছেলেটা। এখানে কি করছে?
ছেলেটা আমার দিকে বড় চোখ করে তাকিয়ে এগিয়ে এলো।
‘ এই তো পেয়েছি । সেদিন পালিয়ে গেছিলে না। এখন আমার ফোন কেনার টাকা দাও।তোমার জন্য আমি ফোন ছাড়া চলছি দুইদিন যাবত।’

আমি বললাম, ‘ আমি আপনাকে ফোন কেনার টাকা কেন দেবো? ফোন আপনার দোষে ভেঙেছে। নিজের দোষ আমার ঘাড়ে কেন চাপাচ্ছেন? আর সেই দিন আমি পালিয়ে গিয়েছে কে বলল আপনাকে? আমি কি চোর নাকি যে পালিয়ে যাবো?’
‘ পালিয়েই তো গেছো। আমাদের দেখে তারাতাড়ি অটো করে হাওয়া।’
‘দেখুন আপনার জন্য আমার শাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাতে তো আমি আপনাকে শাড়ি কিনে দিতে বলছি না। আর আপনি নিজের দোষে ফোন ভেঙে আমার পেছনে পড়ে আছেন টাকার জন্য? কি ফাজিল আপনি!”
‘তুমি শাড়ি কেনার কথা বলবে কেন তোমার শাড়ির আর কয় টাকা দাম হবে। আমার ফোন কত দামি ছিল জানো? দেড় লাখ টাকার ফোন ছিল ওইটা।’

‘জানি না জানতেও চাই না আমি কোন ফোন টোন কেনার টাকা পয়সা দিতে পারব না। যেটা দোষ আমার নয় তার খেসারত আমি দিতে যাব কোন সুখে?’
দুলাতায় চলে এসেছি দেখে ছেলেটাকে বললাম, ‘ সরে দাঁড়ান আমরা নামবো।’
‘ আমার ফোনের টাকা দাও।’
‘ বললাম তো দেবো না।’
‘ তাহলে আমি ও সরবো না।’
‘ পাগল নাকি। সরুন

কিন্তু অসভ্য বদ ছেলেটা খাম্বার মত দাড়িয়ে আছে। কি মুসিবতে পরলাম। এবার তুলি কথা বললো। কিন্তু সরলো না। ছেলেটার সাথে একটা ছেলে ছিলো সে এবার এগিয়ে এলো আর ছেলেটাকে টেনে ধরে বললো,
‘ ইহান সামান্য কারনে একটা মেয়ের সাথে এমন করছিস কেন? ছেড়ে দে না। তুই তো কখনো কোন মেয়ের সাথে এমন বিহেভ করিস নি আজ তাহলে এমন করছিস কেন?’
সামনে ফাঁকা পেতেই দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে এলাম। কি ডেঞ্জারাস! আর কোনদিন যেন এই হাফ পাগল ছেলেটা সাথে দেখা না হয় আল্লাহ! এ তো আমাকে একটা সামান্য ফোন এর জন্য যেখানে সেখানে চেপে ধরবে আর অত টাকা নাই কোথা থেকে দেবো। মেয়েদের হেনস্তা করা শুধু। পাশের ওই বন্ধুটার না থাকলে আজকে নিশ্চিতই টাকার জন্য আমাকে আটকে রাখতো।

এক হাত উঁচু করে মুখ ঢেকে অন্য হাতে গাউনের কোনা ধরে তাড়াতাড়ি সবার থেকে আড়ালে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। উফফ কোথাও গিয়ে কি আমি একটু শান্তি পাবো না। যেখানেই যাই সেখানেই এই বেয়াদব ছেলেটা কোথা থেকে চলে আসে আল্লাহ জানে। চেয়ার টেনে একা গালে হাত দিয়ে বসে তাকিয়ে আছি আমার কয়েকদিনের মধ্যে তৈরি করা শত্রুর দিকে। এখানেই আব্বু আম্মু আছেন তাদের সামনে এমনকি এই বাসায় যদি ছেলেটা আমার সাথে মিসবিহেভ করে আমার মান সম্মান সব যাবে। লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। না বাবা কিছুতেই তার নজরে পরা যাবে না। আমাকে সতর্কতার সাথে পালিয়ে থাকতে হবে। বাবাগো সেদিন লিফটে কি অবস্থা করেছিলো। আজ ও তেমন করলে একেবারে শেষ। আব্বু আমায় খুব বকবে।

একটা ছেলে এগিয়ে এসে আমার দিকে কোল্ড ডিংক্স এর গ্লাস এগিয়ে বললো,
‘ ম্যাম একটা নিন।’
‘ নো থ্যাংক্স!’
‘ কেন ম্যাম একটা অন্তত নিন। একা একা খালি মুখে বসে আছেন।’
‘ আমি এসব খাই না।’
‘ কিন্তু…
‘ জুস দিন।’
‘ আচ্ছা ‘

বলেই জুসের গ্লাস দিয়ে চলে গেলো। আমি গ্লাস হাতে বসে র‌ইলাম গোমড়া মুখে। পিপাসা পেয়েছে কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না। এই খানে এসে আমি চমকের উপর চমক পেয়েছি খাওয়া আর আসবে কি করে। আম্মু আব্বু কিছুটা দূরে তাদের বন্ধু দেয় সাথে আড্ডা দিচ্ছে আর আমি চুপচাপ লুকিয়ে এক স্থানে বসে আছি ভাবা যায়।

শয়তান মাইয়া তুলি আমাকে চারটা পর্যন্ত নিয়ে ঘুরেছে শপিং মলে। রাগ আমার মাথায় উঠে ছিলো। আমার হাতে আইসক্রিম কিনে দিয়ে ও এক বছরের ড্রেস মনে হয় কিনলো। কিন্তু না মাত্র একটা স্কাপ, একটা ঘড়ি ও নেলপালিশ কিনেছে এতেই ওর দুই ঘন্টা লেগেছে ভাবা যায়। এই মাইয়া এতো দাম ভনিভনা করে তার তুলনা নাই। এক জিনিস কিনতেও দশ দোকান ঘুরে। আমি রাগ দমিয়ে দাঁত চেপে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।বাসায় আসার পর জানতে পারি আব্বুর কোন এক বন্ধুর মেয়ের জন্মদিনে যেতে হবে‌। ফ্রেশ হয়ে ঘুম দেয়। সন্ধায় মায়ের ধাক্কানিতে উঠে বসি।

‘ তোর আব্বুর বন্ধুর মেয়ের বাথর্ডে পার্টিতে যেতে হবে ভুলে গেলি নাকি‌। তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নে। এখন বের হবো আমরা।’
আমি বিরক্তিকর মুখ করে বলি, ‘ আমার ঘুম পাচ্ছে খুব। তোমরা যাও আমি যাব না।’
‘ কি একা একা বাসায় থাকবি। অসম্ভব! চুপচাপ রেডি হয়ে আয়। নাহলে এইভাবেই নিয়ে যাব।’
‘ ধ্যাত। বিরক্ত হয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকতে হলো। আম্মু আমার জন্য ড্রেস বিছানার উপর রেখে গেছে। এই গাউন এখন পরতে হবে ভাল্লাগে না। সবুজ রঙের গাউন পড়ে রেডি হয়ে নিলাম। আম্মু এসে চুল বেঁধে দিলো সুন্দর করে। চোখে কাজল ও ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক দিয়ে বেরিয়ে পরলাম।

এখানে এসেই আব্বু বন্ধুর মেয়েকে দেখে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো এই তো সেই অসভ্য মেয়ে। আমাকে ওই দিন ধাক্কা দেওয়া ছেলেটার হয়ে অপমান করে ছিলো।
আমি কটমট করে তাকিয়ে আছি। তার একটু পরেই আমার চোখ গেলো ইহান ছেলেটার দিকে। যে আমায় ধাক্কা দিয়েছিলো। নামটা জানতে পেরেছি লিফটে থেকে।তার বন্ধু তাকে এই নামে সম্বোধন করেছিলো। সেখান থেকে নামটা শুনে নিয়েছি।

ছেলেটা হাসছে কিছু বলে। তখন ওই বাথর্ডে গাল গাল ফুলিয়ে ইহানে সামনে গিয়ে কিছু বললো। ইহান হাসি হাসি মুখটা গম্ভীর করে কিছু বললো। ফারিয়া কেকের সামনে চলে এলো গাল ফুলিয়েই। ফারিয়া ওই মেয়েটার নাম‌। আব্বুর থেকে জেনেছি। কেক কাটলো তখন ইহান ছেলেটা একটা বক্স নিয়ে দিলো ফারিয়ার দিকে‌। ফারিয়া তার রাগ মাটি করে খুশি হয়ে জরিয়ে ধরলো ইহানকে। আমার দিকে তাকালো ইহান আমি সাথে সাথে পেছন ঘুরে …
‘ এই যে মিস ঝগড়ুটে!! আপনি এখানে কি করছেন?’

আচমকা কথার আওয়াজে চমকে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম। সামনে তাকিয়ে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা সামনে ইহান ছেলেটা তাকিয়ে আছে দুষ্টু হাসি দিয়ে। আমি এতোটা চমকালাম যে আমার হাতে ধরে রাখা জুসের গ্লাস হাত থেকে পরে আমার পোশাকটা নষ্ট হয়ে গেলো। সাথে গ্লাসটা ও নিচে পড়ে ঝনঝন শব্দ করে গড়িয়ে পড়ে ভেঙে গেলো। আমি ভয়ার্ত চোখে গ্লাস থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালাম। ইহান এসব থেকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।
আমি ভাবছি ছিঃ কি করলাম এটা। আত্নীয় বাড়ী এসে কি আকাম করে বসলাম। কি ভাববে আমাকে! লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো আমার মুখ মন্ডল। আশেপাশে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম অনেকেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জা আমি আরো কুঁকড়ে গেলাম। নিজের জামা ভিজে গেছে সেদিকে আমার খেয়াল‌ই নাই।

আম্মু আব্বু দূরে ছিলো বিধায় এসব তাদের নজরে পরে নি। আমি নিচু হয়ে বসে আছি সবাই দুই সেকেন্ড তাকিয়ে নিজেদের কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। ইহান এখনো আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। আমি ভাবছি এই ছেলে যায় না কেন গেলে তো আমি উঠতে পারি। কিন্তু এর সামনে আমার উঠতেও সংকোচ হচ্ছে।
‘ এটা কি হলো? এতো ভয় পেলে কেন আমাকে?’

আমি কাচুমাচু মুখ করে তাকালাম, ‘ আপনি প্লিজ যান এখান থেকে। আর দয়া করে ফোনের জন্য এখানে সিনক্রিয়েট করবেন না। এখানেই সবার সামনে এসব বললে আমাকে খুব…..
‘আরে ওয়েট ওয়েট, তোমাকে কে বললো আমি এখানে ওইসব বলতে এসেছি?’
‘ তাহলে কেন এসেছেন? আমি জানি আপনি আবার ফোন, টাকা চাইবেন!’
‘ আরে না। আমি তো তোমার কাছে এলাম আড্ডা দিতে। তুমি এখানে একা বসে আছো। তাই দেখতে পেয়ে এলাম। ‘
‘ কি আপনি আমার সাথে আড্ডা দিতে এসেছেন?’ অবাক গলায় বললাম।

‘ ইয়েস। আর লিফটের ব্যবহারের জন্য সরি। আসলে আমার মাথাটা তখন খুব গরম ছিল। আর গরম হবেই না কেন বল? কেবল কিছুদিন আগে ফোনটা কিনেছি আর বেশিদিন ইউজ করতে পারলাম না তার আগেই শেষ ওইটা তো ঠিক ও করা যাবে না। ফোনের চিন্তায় আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছিলো কি থেকে কি করেছি কিছুই বুঝতে পারি নাই। দোষটা আসলে আমাদের কারোরই না এইটা একটা এক্সিডেন্ট।’
ছেলেটার কথা শুনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। উনি আর ওমন বিহেভ করবে না জেনে আমার বুকের উপর থেকে যেন পাহাড় নেমে গেল। কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম এই কয়দিন।
‘তুমি আমাকে দেখে এতটাই ভয় পেয়ে গেছো যে নিজের জামাটা নষ্ট করে দিলে! আবার আমার ভয়ে এই এইখানে বসে আছো তাই না?’

আমি লাজুক হেসে মাথা নাড়ালাম। আমার মাথা নাড়ানো দেখে ওনি হা হা করে হাসতে লাগলো।
‘ওরে বাবা দুইদিন যে ঝগড়া করলে এখন আবার তুমি আমাকে দেখে ভয় পাও! হা হা হা
আমিও হাসলাম।‌হাত দিয়ে জামা মুছছি। তা দেখে বললো,
‘ ওয়েট টিস্যু এনে দিচ্ছি।’
বলেই এগিয়ে গিয়ে টিস্যু এনে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। আমি কাচুমাচু করে তা নিলাম।
‘ তুমি এখানে কিভাবে?’
‘ এটা আমার আব্বুর বন্ধুর বাসা।’
‘ ও আচ্ছা। তোমার নামটা?
‘ মানে?’
‘ মানে তোমার নামটা কি যেনো? এতো ঝগড়া করলাম কিন্তু এখনো তোমার নামটাই জানা হলো না?’
আমি হেসে উঠে বললাম, ‘ ঊষা।’

‘ কি বললি ওই ছেলের সাথে তোর সব মিটমাট হয়ে গেছে!’
‘ হুম এক কথা আর কতো বার জিজ্ঞেস করবি বলতো। আমি তো এসেই সব তোকে বললাম। কি হয়েছিলো সেদিন। ছেলেটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা না।’
‘ আসলেই আমার তো প্রথম থেকেই ভালো লেগেছে আহা কি সুন্দর দেখতে ঠোঁট গুলো লাল টকটকে। হাসলেই গালে টোল পরে। আমি না প্রেমে পরে গেছি রে দোস্ত। কিন্তু একি করলি সব মিটমাট করে ফেললি এখন আমি ওই হ্যান্ডসাম কে ক‌ই পামু।’

তুলির দিকে বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে বললাম,
‘ তুই কি চাইছিলি এই ঝামেলা না মিটুক।’
‘ আরে এমন করে তাকাচ্ছিস কেন? আমি তো জাস্ট এজন্য বলেছি কারণ এই উসিলায় ওই ছেলেটা আমাদের ফলো করতো আর আমি ওকে পটিয়ে নিতাম। ‘
‘ চুপপ ফাজিল মেয়ে।
স্যার এলো। ক্লাস চলতে লাগলো। তুলি আমাকে ডিস্টার্ব করছে কথার জুলি খুলে।
‘ আরে চুপ যা না প্লিজ। কিছু বুঝতে পারছি না। আমাকে শান্তিতে ক্লাস করতে দে নাহলে আমি অন্য সিটে গিয়ে বসবো বলে দিলাম।’
‘ ধুর তোর সাথে কথা বলেও শান্তি নাই। এতো পড়া পাগল কেউ হয়‌। এতো পড়ে কি হবে। কয়দিন পর তো বিয়ে করে শশুর বাড়ি গিয়ে রান্না করতে হবে‌।’
‘ চুপ করবি।’

এবার আর কথা বললো না। তুলি অমনোযোগী ভাবে বসে আছে।
স্কুল থেকে বের হয়ে আজ কেন জানি হাঁটতে হচ্ছে করলো। কিছুটা পথ হেঁটে তারপর রিকশা নেবো। যেই ভাবা সেই কাজ।‌ ব্যাগের ফিতা ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছি আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। সামনে আমড়া ওয়ালা পেলাম। দেখেই আমার জিভে জল চলে এলো। রোড পার হতে হবে। এটা করতে খুব ভয় পাই আমি কিন্তু আমড়া খাওয়ার লোভ এ সব ভুলে দৌড় দিলাম কিন্তু মাঝরাস্তায় আসতেই পা থেমে গেল। হাত পা কাঁপছে আমার। সামনে থেকে মালপত্রের বড় গাড়িটা এগিয়ে আসছে। আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছি।

নড়তে পারছি না। পা যেনো আটকে আছে এখানে। সারা শরীর কাঁপছে ভয়ে। আমার এই এক বাজে অভ্যাস, চাইলেই এই গাড়ি আসার আগেই রোড ক্রস করা যাবে কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব না‌। আমি এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভীতু। ভয়ে আমি নড়তেই পারবো না এখনো পারছি না। আমি চোখ বন্ধ করে বুকে হাত রেখে আল্লাহ কে ডাকছি। এখন কি এই গাড়ির নিচে চাপা পরে আমাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে। আব্বু আম্মুর হাসি মুখটা ভেসে উঠছে। তুলির বিরক্ত মনে পরছে। ইশ সবাইকে ছেড়ে আমাকে এতো তাড়াতাড়ি মরে যেতে হবে। খুব কষ্ট লাগছে চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরছে। এই মুহূর্তে আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরিহ লাগছে।

গাড়ির হর্ন কাকে বাজছে কথাও আসছে কারা যেন সরতে বলছে আমি তো সরতে পারছি না। এই বুঝি নিঃশ্বাস টা বন্ধ হয়ে যাবে ঊষা নামক মিষ্টি মেয়েটি মরে যাবে এই সুন্দর ভুবন ছেড়ে। আব্বু আম্মু আমি মরে গেলে খুব কষ্ট পাবে একটা মাত্র মেয়ে তাদের আমি। কতো শত চিন্তা করছি তখন একটা পুরুষালী ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলাম নিজের হাতে। সাথে টেনে নিয়ে সে আমাকে ধাক্কা দিলো পরতে পরতে পরলাম না। আমি চমকে চোখ মেলে তাকালাম। সামনের মানুষটির দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম, -‘ইহান!

এক চিলতে রোদ সিজন ২ পর্ব ৬+৭+৮+৯+১০