প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৪ শেষ অংশ
Writer Mahfuza Akter
মালিহা যখন ঘুম থেকে উঠে তরীকে নিজের চোখের সামনে দেখতে পেল, তার অশান্ত হৃদয় যেন মুহূর্তেই স্থির হয়ে গেল। সেই শীতল এবং স্থির দৃষ্টিতে তরীর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। তরীর ঠোঁট ভেঙে এলো, নাক কুঁচকে গেল এবং চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। মালিহার মনে হচ্ছে, তিনি যেন স্বপ্ন দেখছেন। আসলেই কি এটা স্বপ্ন? নাকি বাস্তবতা? মালিহা তরীর গালে হাত রাখলেন। তরী এইবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না, আবেগে ভেসে মালিহার বুকে হামলে পড়লো। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সৌহার্দ্য সবটা দেখছে। মনের মধ্যে স্বস্তি এবং অস্বস্তির এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে তার। মালিহাকে এখানে নিয়ে আসাটা কি ঠিক হলো? ডক্টর আরমান জানতে পারলে আবার তার মাথা খাওয়া শুরু করবে। তবে তাকে না জানিয়েও যে উপায় নেই!
মুগ্ধ বিরস বদনে ক্যান্টিনে বসে আছে। নিজের প্রতি লজ্জা, বিরক্তি এবং ক্ষোভে মাথার চুল খামচে ধরে নাক মুখ কুঁচকে রেখেছে সে। আজ সকালে ল্যাবওয়ার্ক শেষে বের হওয়ার সময় অরুণীর সাথে এক ভয়াবহ মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে তার। যদিও ধাক্কা লাগার পিছনে দুজনেরই দোষ ছিল, তবে এতে অরুণীর একটু ক্ষতি হয়েছে। ধাক্কাটা বেশ প্রবলভাবে লাগলেও অরুণীর নিজেকে পড়ে যাওয়া থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল। তবে তার হাতে থাকা বই, নোটবুক, ফাইল এবং তার চশমাটা মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। অরুণীর চশমাটা ভেঙে একেবারে দু-টুকরো হয়ে গেছে। ফ্লোরে নিজের দ্বিখন্ডিত চশমাটা দেখেই অরুণী মুগ্ধর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“এটা কী করলে তুমি?”
মুগ্ধ বেশ অপ্রস্তুত গলায় বললো,
“আমি আসলে আপনাকে খেয়াল করিনি। আপনিও তো বেখেয়ালি হয়ে হাঁটছিলেন!”
অরুণী তিক্ত গলায় বললো,
“কিন্তু ক্ষতিটা তো আমার-ই হলো, তাই না? এইটা আমার সবচেয়ে পছন্দের চশমা ছিল।”
শেষের কথাটা অরুণী কিছুটা মন খারাপ করেই বললো। অরুণীর নিষ্প্রভ মুখশ্রী দেখে মুগ্ধরও মন খারাপ হয়ে গেল। সে অরুণীকে কিছু বলার আগেই অরুণী ল্যাবের ভেতর ঢুকে গেল। মুগ্ধ তাকে পিছন থেকে ডাকলেও সে প্রত্যুত্তর করল না।
মুগ্ধ ত্যাক্ত-বিরক্ত ভঙ্গিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ঠিক তখনই তার ফোনে একটা মেসেজ এলো। অরুণী হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়েছে। মুগ্ধ তাড়াতাড়ি মেসেজটা ওপেন করলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো বাংলা হরফের লেখা,
“কোথায় আছো এখন?”
মুগ্ধ অবাক হল। কপাল কুঁচকে ভাবতে লাগলো, অরুণী তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে চেয়েছে? এটা সত্যিই অরুণী তো? মনে সংশয় নিয়ে মুগ্ধ মেসেজের উত্তর দিল,
“ক্যান্টিনে আছি।”
অরুণী সাথে সাথেই মুগ্ধর মেসেজটা পড়লো। যেন সেই মুগ্ধর উত্তরেরই অপেক্ষা করছিল! তবে সে আর কোন প্রশ্ন করল না। অরুণীর থেকে আর কোন সাড়া না পেয়ে মুগ্ধ নিজে থেকেই প্রশ্ন করলো,
“আপনি কেন জানতে চাইছেন?”
এইবারও অরুণী তার মেসেজটা সেন্ড হওয়ার সাথে সাথেই দেখলো। তবে উত্তরটা আর লিখিতভাবে এলো না৷ মাধ্যম পরিবর্তিত হলো। অরুণীর ঝাঁঝালো কন্ঠস্বর শোনা গেল,
“আমি তোমাকে সারা কলেজ জুড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আর তুমি এখানে বসে বসে কোল্ড কফি খাচ্ছো?”
অরুণীর গর্জনে মুগ্ধ চমকে উঠলো। চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো, অরুণী তার সামনেই টেবিলের অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। মুগ্ধ হতভম্ব হয়ে বললো,
“আপনি আজ এভাবে হুটহাট এন্ট্রি নিচ্ছেন কেন বলুন তো? আমাকে এট্যাক-ফ্যাট্যাক করিয়ে মে’রে ফেলার শখ হয়েছে নাকি আপনার?”
অরুণী বিরক্ত হয়ে বলল,
“একদম বাজে কথা বলবে না। তুমিই তো আমাকে জ্বালিয়ে মা’রছো!”
মুগ্ধ কপালে গভীর ভাজ ফেলে তাকালো,
“আমি আপনাকে জ্বালিয়ে মা-রছি? সব দোষ তাহলে আমার? একটু আগে বললেন আপনি আমাকে খুঁজছিলেন। কেন খুঁজছিলেন আমাকে বলুন তো?”
অরুণী নিজের ব্যাগ থেকে ভাঙা চশমাটা বের করে সেটা মুগ্ধর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এটার ক্ষতিপূরণ চাইতে!”
মুগ্ধ চশমাটা হাতে নিয়ে সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বললো,
“এটার ক্ষতিপূরণ? গ্লাস ভাঙেনি দেখছি। এটাকে সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিলেই তো সমস্যা শেষ!”
অরুণী বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল,
“সুপার গ্লু? আমাকে নতুন চশমা কিনে না দিলে তোমার হাত পা ভেঙে দেবো। সুপার গ্লু দিয়ে জোড়া লাগিয়ে নিও।”
মুগ্ধ কপট ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলল,
“আপনার এই রুদ্রানী রুপে তো আমি আবার ঘায়েল হয়ে যাবো! এমন রুদ্র-মূর্তির আকার ধারণ করবেন না, সিনিয়র….”
মুগ্ধর কথাটুকু শেষ হওয়ার আগেই অরুণী থেকে আঙ্গুল তাক করে বলল,
“আরেকবার সিনিয়র আপু বললে কিন্তু সত্যি সত্যি আমার হাতে মা-র খাবে!”
মুগ্ধ দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
“সিনিয়র আপুদের হাতের মারে-ই ভালোবাসা থাকে। তাদের হাতের স্পর্শে প্রেম লেগে থাকে। ওসব আপনি বুঝবেন না। চলুন, আপনাকে নতুন চশমা কিনে দেই।”
মুগ্ধ হাসতে হাসতে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল। মুগ্ধর কথা শুনে অরুনী তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেও কিছু বলল না। চুপচাপ তার পিছু পিছু বেরিয়ে গেল। এর শিক্ষা সে মুগ্ধকে অন্য একদিন দিবে।
আজ রাতে হসপিটাল থেকে ফেরার পথে প্রহরকেও বাসায় নিয়ে এসেছে সৌহার্দ্য। সৌহার্দ্য অনেকটা জোর করেই তাকে নিয়ে এসেছে। ঢাকায় আসার পর প্রহর এই প্রথম সৌহার্দ্যের বাসায় এলো। সৌহার্দ্য তাকে বসার ঘরে বসিয়ে ভেতরে গেল।
মালিহা প্রহরকে দেখে বেশ খুশি হয়ে বলল,
“কতদিন পর তোমাকে দেখলাম! ভালো হয়েছে এসেছো। গ্রাম থেকে তো হুট করে আমার থেকে বিদায় না নিয়েই চলে এলে!”
মালিহার রান্না ঘরে চলে গেল। প্রহর মালিহাকে দেখে বেশ অবাকই হয়েছে। সৌহার্দ্য তাকে বলেনি যে মালিহা এখানে আছে। কিন্তু তার বিস্ময় বৃদ্ধি পেল মধুকে দেখে। মধু রান্নাঘর থেকে এক গ্লাস পানি এনে প্রহরের সামনে রাখলো। মূলত মালিহাই তাকে দিয়ে প্রহরের জন্য পানি পাঠিয়েছে। তাই নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও মধু তাকে পানি দিতে এসেছে। প্রহর মধুর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কিন্তু মধু যেন তার দৃষ্টি গ্রাহ্যই করল না। একবারের জন্য প্রহরের দিকে তাকালোও না। পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখেই তরীর ঘরের দিকে চলে গেল। প্রহর অবুঝের মতো তার চাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। কী আশ্চর্য! মেয়েটা কি তাকে চিনতে পারছে না?
মধু তরীর ঘরে প্রবেশ করেই তরীকে জিজ্ঞেস করল,
“ভাইয়া কোথায়?”
তরী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল ,
“তোর ভাই তো এখনো ফিরেনি! রাস্তায় আছে হয়তো!”
মধু অবাক হয়ে বললো, “ভাইয়া তো কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে! এই ঘরে আসেনি?”
তরীর মন হুট করেই খারাপ হয়ে গেল। সৌহার্দ্য আর তার ঘর যে এখন আলাদা! এই কথাটা যদিও মালিহা বা মধু কেউ জানে না এখনও। কিন্তু এটা তো আড়াল করে রাখাও সম্ভব না! আজকালের মধ্যে তারা জেনেই যাবে। তরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে মধু বিরক্ত হয়ে বলল,
“ঐ বিরক্তিকর লোকটাকে এই বাড়িতে নিয়ে এসে ভাইয়া কোথায় গায়েব হয়ে গেল বলতো?”
তরী মধুর কথার মানে বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল,
“কোন বিরক্তকর লোক? কে এসেছে?”
মধু তিক্ত গলায় বললো, “নিজেই গিয়ে দেখে আয়! আমি আজ আর ঘর থেকে বের হবো না। আমাকে কেউ ডাকাডাকি করবি না। ঐ লোক চলে গেলে আমি নিজেই রাতের খাবার খেয়ে নেবো।”
মধু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তরী চিন্তায় পড়ে গেল। কার আসার কথা বলে গেল মধু? সেটা দেখার জন্য তরী নিজেও বের হলো। তরীর পাশের ঘর থেকে সৌহার্দ্যও একই সময়ে বের হয়ে এলো। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই দুজনের দেখা হয়ে গেল। সকালেও সৌহার্দ্য তরীর সাথে দেখা না করেই চলে গেছে। গত রাতের পর আজ সারাদিনে এই প্রথম দেখা হলো তাদের। তরী বেশ আহত চোখে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যের দিকে। তবে সৌহার্দ্য তাকে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললো,
“প্রহর এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে!”
প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৩৪
তরী সৌহার্দ্যের কথা শুনেও শুনলো না যেন! অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “আপনি কি আর কখনো আমার সাথে এক ঘরে থাকবেন না?”
সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্পষ্ট গলায় উত্তর দিলো, “না।”