মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩
ইফা আমহৃদ

“মিস্ চড়ুই, আমি কি তোমাকে স্পর্শ করেছি?
আঘাত করেছি, মে’রে’ছি, গায়ে পানি ঢেকে দিয়েছি, কটু কথা বলেছি, পাবলিক প্লেসে অশোভন আচরণ করেছি, কাউকে ভালোবাসি বলতে বলেছি, না-কি কিস্ করেছি, তাহলে?
তাহলে কোন অ্যাঙ্গেল দিয়ে মনে হয়েছে, আমি তোমাকে র‍্যাগিং করেছি?”
ক্লাসে এসে বসতেই ধ্রুব স্যারের প্রবেশ ঘটল। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে উক্ত কথাটি বলেন তিনি। না বোঝার দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। তার কথাগুলো ধীরে ধীরে আওড়ালাম। অতঃপর লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলাম। অস্বস্তিতে মুখ কুঁচকে এলো আমার। বসা থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। মিনমিনিয়ে বললাম, “মানে..

“মানে? তুমি অভিযোগ করেছ, আমি তোমাকে র‍্যাগিং করেছি?”
আমি তো তার নামে অভিযোগ করিনি, তিনি আমার শিক্ষক। আমি কীভাবে তার নামে অভিযোগ করতে পারি? হ্যাঁ, তার ব্যবহারে আমার প্রবল ক্ষোভ জন্মেছিল। তাই বলে অভিযোগ। কখনোই না। সোজাসাপ্টা বললাম,
“আমি কেন আপনার নামে অভিযোগ করব?”
“তাহলে এটা কী হ্যাঁ।” বলেই তিনি একটা কাগজ ছুঁড়ে ফেললেন। আমি কাগজটা দ্রুত তুলতেই ‘চোখ আমার চড়কগাছ’।
কালকে ঘটা যাওয়া প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। নিচে আমার নামও লেখা আছে, চড়ুই। অথচ একটা আমার হাতের লেখাই নয়। নির্বিকার কণ্ঠে বললাম, “এটা আমার হাতের লেখা নয় স্যার।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তুমি লেখনি, অন্য কাউকে দিয়ে লেখিয়েছ?” একরোখা জবাব দিলেন ধ্রুব স্যার।
“আশ্চর্য! বলছি তো, আমি লিখিনি কিংবা কাউকে দিয়ে লেখাই নি।” একপ্রকার তেজ নিয়ে চ্যাঁচিয়ে বললাম কথাটি। পরক্ষণেই গাল পুড়ে উঠল যাতনায়। ছলছল হল নেত্রযুগল। গালে হাত ঠেকল আপনাআপনি। লহমায় দ্বিগুন তেজ নিয়ে বলেন,
“আমার সাথে কথা বলবে শান্ত গলায়। চ্যাঁচিয়ে কিংবা চোখ রাঙিয়ে নয়। এখানে মাছের বাজার বসেনি, চ্যাঁচিয়ে চ্যাঁচিয়ে মাছ বিক্রি করতে হবে নতুবা খাবার জুটবে না।” রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন। মাথা নত করে ফেললাম মুহুর্তেই। মিথ্যা বললে একদমই সহ্য হয়না আমার। এতটা হাইপার হয়ে গিয়েছিলাম, ভুলেই গেছিলাম আমি স্যারের সাথে কথা বলছি।
ওষ্ঠদ্বয় শতচেষ্টা করেও বিচ্ছিন্ন করতে পারলাম না। তাই শব্দহীন স্বরে বললাম,

“র‍্যাগিং নয় তো কী, হ্যাঁ? আপনি সবার সামনে আমার মাথার দুইপাশে দুইটা ঝুঁটি করে দেননি? জোর করে আমার হাতে ললিপপ ধরিয়ে দেননি? আমার ছবি তুলেননি? সোশ্যাল মিডিয়া আপলোড করবেন, বলেননি? তার ক্যাপশনে লিখবেন, প্রাপ্ত বয়স্ক ভার্সিটি পড়ুয়া একজন তরুণীর বাচ্চাসুলভ আচরণ। বলেননি?”
আমার কণ্ঠধ্বনি তার শ্রবণপথে গেল না, কারণ কথাগুলো জোর দিয়ে বলার সাহস নেই আমার। তবুও দুইপা এগিয়ে এলেন তিনি। আমার হাত ধরে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললেন, “আমি যতদিন এই ভার্সিটিতে আছি, তোমার জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলব। ভেবেছিলাম, আর ক্লাস নেব না। কিন্তু এখন ভাবছি আরও দু’টো নেব। র‍্যাগিং কাকে বলে, সেটাও শেখাব!”
নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম, এই বলছে ক্লাস নেবে এই বলছে নেবে না। আস্ত একটা গিরিগিটি!

ভার্সিটি ছুটি হয়েছে সবে। এখন পর্যন্ত কেউ বাইরে বের হয়নি। ক্যান্টিনে, করিডোরে, মাঠে অথবা ক্লাসে বলে বন্ধুমহলের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। আজকে কেউ আসেনি। আনমনে মাঝখান দিয়ে হাঁটছি। আজকে মেলার জন্মদিন তাই ক্লাস হয়নি। ধ্রুব স্যারের ক্লাসে ছিল না। তিনি আমাকে হুমকি দিতে এসেছিলেন শুধু। হুমকি দেওয়া শেষ হতেই চলে গেছেন। এখন আমি প্রিন্সিপাল স্যারের কেবিনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। স্যারের কাছে কে অভিযোগ করেছে এটাই জানতে হবে। আমি যতদূর জানি অভিযোগ লিখে তা ‘অভিযোগ বক্স’ এ জমা দিতে হয়। তাহলে স্যার জানবে কীভাবে?

যদি হাতের লেখা চেনা কারো হয়ে থাকে, এই আশায়।
প্রিন্সিপাল স্যারের কেবিনের কাছে আসার সাথে সাথে তরল কিছু পড়ল মাথার উপর। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। জামার কিছুটা অংশ ভিজে গেছে। চোখের চশমাটা ঝাঁপসা হয়ে গেছে। উপর থেকে পানি ফেলা হয়েছে। আমি চশমা পরিস্কার করে চোখে পড়লাম। ভিড় জমে যেতে শুরু করছে। জামা আঁটসাঁট হয়ে লেপ্টে আছে শরীরে। চোখ বেড়ে অশ্রু গড়াল। ধ্রুব স্যার র‍্যাগিংয়ের কথা বলেছিলেন। তিনিই হয়ত এমনটা করেছেন। নাহলে হুট করে পানি আসবে কোথা থেকে। তৎক্ষণাৎ ধ্রুব স্যারের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

“এখানে এত ভিড় কিসের। সরো! দেখতে দাও।”
ধ্রুব স্যার ভিড় ঠেলে সামনের দিকে অগ্ৰসর হতেই মাথা নুইয়ে ফেললাম আমি। হাত দিয়ে শরীর ঢাকার প্রচেষ্টা করলাম। বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। নিজের দিকে অবলোকন করলেন। অতঃপর ছুটে এসে আমার ওড়না খুলে গায়ে জড়িয়ে দিলেন। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে মাথানত করে রইলাম। চ্যাঁচিয়ে বললেন,
“এই নোংরা পানি কে ফেলেছে? সিনিয়রদের বসন্ত উৎসবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মানে কি যা ইচ্ছে তাই করবে?
আর ভার্সিটি আরও আগে ছুটি হয়েছে। এখনো তোমাদের কী কাজ আছে? দশ মিনিটের মধ্যে পুরো ক্যাম্পাস ফাঁকা দেখতে চাই। যাও..

তার বুকের সাথে মিশে থাকার ফলে “যাও” শব্দটায় কেঁপে উঠলাম আমি। ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে লাগল সবকিছু। শরীর থেকে বিশ্রী গন্ধ আসছে। আমাকে ধ্রুব স্যারের কেবিনে যেতে বললেন। আমি তার পিছু পিছু গেলাম। সিলিং ফ্যান চালু করে দিলেন। ওয়াশরুম থেকে টাওয়াল এনে ধরিয়ে দিয়ে ধমকে বলেন,
“এবারে সং সেজে বসে না থেকে চুল মুছে ফ্যানের নিচে বসে শুকিয়ে নাও। আমি বাইরে আছি। শুকিয়ে গেলে ডাকবে বাড়িতে‌ পৌছে দিব।”
“আপনি নিজেই পানি ফেলে এখন ভালো সাজছেন? ভেবেছেন আমি কিছু বুঝতে পারব না। দাঁড়ান, আপনি দেখুন আমি কী করি?”

বলেই চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। নজরে এলো পানি ভর্তি জগ। ক্ষোভ সংযত করতে ব্যর্থ হয়ে জগ খুলে সব পানিগুলো তার উপর ছুঁড়ে ফেলি। ‘ইউ স্টুপিড’ বলে পিছিয়ে গেলেন তিনি। তবে সম্পূর্ণ পানি তার শরীরে। রক্তচক্ষু করে চাইলেন। হাত থেকে জগটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন অদূরে। কাঁচের জগ হওয়াতে লহমায় ভেঙে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পুনরায় কেঁপে উঠলাম আমি। ভয়ংকর রেগে আছেন তিনি। আরও একটা ভুল করে ফেললাম, ভেবেই গালে হাত দিয়ে আড়াল করলাম। এই বুঝি পুনরায় গাল লাল করে দেয়। তেমন কিছু করল না। দাঁতে দাঁত চেপে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললেন,
“তুমি দেখেছ, আমাকে পানি ফেলতে? ইচ্ছে করছে চড়িয়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দেই, অস’ভ্য মেয়ে কোথাকার। বেরুও। এক্ষুনি এখান থেকে যাও। যাও..
“মানে?”
“তুমি সবসময় মানে মানে কর কেন? আমি কি চাইনিজ ভাষায় বলছি। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।”

প্রতুক্তি দেওয়ার পূর্বেই হাত ধরে টেনে কেবিন থেকে বের করে দিলেন। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলাম। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। আতঙ্কের কারণে ডাকতেও পারলাম না। ভীত হয়ে পিছিয়ে গেলাম। ধ্রুব স্যারের এক ধমকে ফাঁকা সবকিছু। আমি পথ ধরলাম। কিছুদূর যেতেই রিক্সা পেলাম। বাড়িতে গিয়েই সোজা শাওয়ার নিতে ঢুকলাম। শরীর থেকে ছিপছিপে দুর্গন্ধ আসছে। মামনি দেখলে হাজারটা প্রশ্ন। তাই তার চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্যালকেনি বেয়ে উপরে উঠতে হল।
শাওয়ার শেষ করে লাঞ্চ না করেই বেডে গা হেলিয়ে দিলাম। নিদ্রা ভঙ্গ হল সন্ধ্যার দিকে। মেলার জন্মদিনে যাবো না-কি যাবো না, বুঝতে পারছি না। গালে হাত দিলাম ভাবছি। গেলেই ধ্রুব স্যারের সাথে দেখা হবে। প্রিন্সিপাল স্যার যা মানুষ। ধ্রুব স্যারকে দাওয়াত দিবে না, এটা হতেই পারে না। নিজের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করে অবশেষে তৈরি হলাম। স্যার বারবার যেতে বলেছেন, না গেলে অসম্মান হবে।

স্যারের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী সিএনজি করে এলাম। একটা পাঁচতারা হোটেলে আয়োজন করা হয়েছে। বন্ধুমহল আগেই পৌঁছে গেছে সেখানে। দাড়োয়ানকে দেখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“এখানে কি প্রিন্সিপাল নুরুল ইসলামের মেয়ে জন্মদিনের আয়োজন করা হয়েছে।”
দাড়োয়ান কিছু বলার প্রয়াস করতেই পেছন থেকে একজন ছেলে বলে, “হ্যাঁ। আপনি আমার সাথে চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।”
আমি বাধ্য হয়ে তার সাথেই গেলাম। দোতলায় আরও একজন দাড়োয়ান। সেখানে যেতেই ছেলেটি একটা কার্ড বের করে এগিয়ে দিল। সন্দেহ হল আমার। সন্দিহান স্বরে বললাম, “এটা কিসের কার্ড?”
“কার্ড ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়না।”

ভেতরে ঢুকলাম। আশেপাশে পরিচিত কাউকে নজরে এলো না। সবাই অপরিচিত, কালে দেখা হয়নি। আমার ভাবনার মাঝেই ছেলেটি অন্যদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“আজকে রাতের জন্য একটা পাখি নিয়ে এসেছি। পাখি নিজেই দরজার সামনে শিকারির অপেক্ষা করছিল। তাই ধরে এনেছি জবাই করতে।”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২

[জানি, কালকের নিচের অংশটা বুঝতে পারেননি। কয়েকটা পর্ব যাক, বুঝে যাবেন]

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৪