মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২
ইফা আমহৃদ

“প্রথমদিন ক্লাস নিতে এসেই স্টুডেন্টদের র‍্যাগিং করছে। মনে হয়, সিনিয়র ভাবটা এখনো যায়নি স্যারের।”
নির্ভীক কণ্ঠস্বর প্রিয়ার। প্রিন্সিপাল স্যারের শ্রবণ হয়েও হল না এমন ভাব। তার কথনের ইতি টেনে বললেন, “মানে!”
থমথমে হল পরিবেশ। তীক্ষ্ণত্ব নেত্রযুগল প্রিয়ার দিকে নিবদ্ধ করতেই নিশ্চুপ হয়ে গেল সে। সৌজন্য হাসি দিয়ে বলে, “বিদেশি স্যার তো। খুব ভালো পড়িয়েছে। সারাজীবন মনে থাকবে। আমরা ধন্য স্যারকে পেয়ে।”
স্যার নিজেও যেন একটু হাসির রেখা ফুটালেন ওষ্ঠদ্বয়ে। সেটা বাধ্যবাধকতা কিংবা গুপ্ত নয়, খোলামেলা এবং প্রাণোচ্ছল। তিনি কথা বলতে একটু স্বস্তি পেলেন। নির্দ্বিধায় বললেন,
“কাল মেলার জন্মদিন। ব্যস্ততার মাঝে মেয়েকে সময় দেওয়া হয়না। মেয়ের দু’টো চাওয়া, কালকের দিনটা সম্পূর্ণ তাকে দেই আর দ্বিতীয়ত, তোমরা ওর জন্মদিনে উপস্থিত থাকবে। ওকে সাজিয়ে দিবে।
কিন্তু কয়েকদিন পর বসন্তী উৎসব।”

স্যার দোটানায় পড়লেন। একদিকে নিজের মেয়ের জন্মদিন অন্যদিকে বসন্তি উৎসবের আয়োজন। লহমায় মুঠোফোন বেজে উঠল আমার। স্যারের থেকে বিদায় নিয়ে খানিকটা দূরে গেলাম। মামার কল ইতোমধ্যে কেটে গেছে। কিয়ৎক্ষণ অধিক আগ্ৰহে অপেক্ষা করলাম। অবসান ঘটিয়ে নিজেই ফোন করলাম বাড়ির পুরোনো ল্যান্ড ফোনটায়। এই সময়ে মামা বাড়িতে থাকেন। চেয়ে থাকতে থাকতে রিসিভ হল। নত কণ্ঠে সালাম বিনিময় করে ফোন দেওয়ার কারণ জানতে চাইলাম। তিনি তেমন কিছু বললেন না। গম্ভীর গলায় বলেন ক্লাস শেষ করে সোজাসুজি বাড়িতে যেতে। আমি প্রতুক্তি করে রেখে দিলাম। প্রচণ্ড হতাশ হলাম। আজকে আর কোচিং সেন্টারে যাওয়া হবে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

জনমানব শূন্য ক্যান্টিনের চারিপাশ। সবাই ক্লাসে গেছে। এদিকটা ফাঁকা অথচ খেয়ালই করি নি। দ্রুত পা চালিয়ে সামনের দিকে অগ্ৰসর হলাম। চোখ আঁটকে গেল অন্য ডিপার্টমেন্টের করিডোরে। ধ্রুব স্যার রেলিংয়ে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশেই তিথি ম্যাম। অথচ আকাশ পাতাল পার্থক্য তাদের মধ্যে। বড্ড সহজ সরল স্বভাবের তিনি। কেউ প্রোপজ করলে বারণ করতেই পারেন না। এই নিয়ে সাতবার ব্রেকআপ হয়েছে। প্রতিবারই সুইসাইডের চেষ্টা করে হসপিটালে ভর্তি থাকে। এবার কী ধ্রুব স্যারের সাথে। কিন্তু স্যারকে দেখে তো মনে হয়নি, সে এমন ধাঁচের মানুষ। দেখা যাক কী হয়!

স্যারের দৃষ্টির অগোচরে ধীরে ধীরে পা চালালাম। পাশের লাইব্রেরীতেই ঢুকলাম। বাইরে উঁকি দিতেই দেখলাম তিনি এই দিকটায়ই তাকিয়ে আছেন। বই খুঁজতে লাগলাম। যদি এই সময়ের মাঝে তিনি স্থান ত্যাগ করেন, এই প্রতিক্ষায়। লাইব্রেরীয়ান নেই। প্রয়োজনীয় বইটা দেখছি না। প্রয়োজনীয় সময়ে হাতের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিসটা না পেলে মাথা আর মাথা থাকে না। জ্বলন্ত উনুনের রুপ নেয়। ভেতরের ক্ষোভ সংযত করতে ব্যর্থ হয়ে হাত দিয়ে আঘাত করলাম বুকসেল্ফেল উপর। অবিলম্বে উপরের তাকে অবস্থানরত বইগুলো একে একে করে পড়তে লাগল নিচে। আমি মাথায় হাত দিয়ে নুড়ে গেলাম। তৎক্ষণাৎ কোনো শক্তপোক্ত পুরুষালি বলিষ্ঠ হাত সরিয়ে নিল আমায়। অবলোকন করতেই ধ্রুব স্যারকে দৃষ্টিগোচর হল। আমাকেসহ নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে পিঠ ঠেকিয়ে দিলেন পেছনের বুকসেল্ফের সাথে। তার বুকে ধাক্কা খেলাম আমি। ফট করে মাথা তুলে তার দিকে তাকালাম।

লহমায় উপরে রাখা ভারী ভারী কার্টনগুলো মাথায় উপর পড়তে লাগল। মাথা নুইয়ে অধর জোড়া স্পর্শ করল ধ্রুব স্যারের গালে। থমকালাম, ভিশন চমকালাম। পলকহীন নেত্রযুগল। দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে ধ্রুব স্যারের শার্ট আঁকড়ে ধরলাম। হয়ে গেল ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের ‘চোখে চোখে কথা বলো, মুখে বল না।’ পায়ের শব্দে বিঘ্ন ঘটল।
ধ্রুব স্যার আমার ভাবাবেগ না পেয়ে থমথমে গলায় বলল, “সরো।”
“জি!”
প্রত্যুত্তর না করেই আমাকে সরিয়ে সরে গেলেন তিনি। সম্পূর্ণ মনযোগ স্থির করে বই তুলে বইয়ের পাতায় কিছু খুঁজতে লাগলেন। আমি নামক একটা তরুণী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সেদিকে কোনো ভাবাবেগ নেই। এতবড় একটা ঘটনা ঘটল, তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছেনা। মানুষটিকে না দেখেই ধ্রুব স্যার জড়তাহীন কণ্ঠে বললেন,

“রাহাত। তোকে কতবার বলেছি, শব্দ করে হাঁটবি না। বিশ্রী লাছে শুনতে।”
“শোন ধ্রুব, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি না। যে শব্দ শুনে মেয়ে পালিয়ে যাবে।
বাই দা ওয়ে, তুই এখানে আর আমি তোকে সব জায়গায় খুঁজে এসেছি। একটু আগেই তিথি ম্যামের সাথে দেখেছি, এখানে এলি কখন?”
“একই ভার্সিটির টিচার আমরা। একটু আধটু কথা বলতেই পারি না-কি সেটাও বলা যাবে না?”
“অহেতুক রাগ করছিস তুই। আমি জাস্ট জিজ্ঞাসা করছি। চশমা পড়ে ভুল দেখলাম কি-না সেটা।”
এতক্ষণ বোধগম্য হল তিনি আমাদের ভার্সিটির আরেক নতুন টিচার। যতদূর শুনেছি, তারা বেস্ট ফ্রেন্ড। জার্মানে একসাথে পড়াশোনা, খেলাধুলা, সবকিছুই। দেখতে ধ্রুব স্যারের থেকে কোনো অংশে কম নয়। সিল্ক চুল, গায়ের রং একটু চাপা। চোখে আমার ন্যায় মোটা ফ্রেমের চশমা পড়েন। মুখে চকচকে হাসিটা লেগেই থাকে। তবে ধ্রুব স্যারের গায়ের রং ধবধবে ফর্সা, নিম্ন ওষ্ঠের উপরে নীলাভ তিল। যখন দাঁত দ্বারা ওষ্ঠ কামড়ে ধরে তখন দেখা যায়। শুধু গম্ভীরভাবে জ্ঞান দিতে পারেন। বেস্ট ফ্রেন্ড যেহুতু, সেহেতু বন্ধুর হাঁটা চলা, খাওয়া দাওয়ার ধরণ সবই তার জানা। আমার ভাবনার ফোড়ন কেটে বললেন,

“না! ভুল দেখিস নি। কেন খুঁজছিলি সেটা বল।”
“সেটা পরে বলছি, তোর গলা ছুলে গেল কী করে?”
ধ্রুব স্যার লহমায় গলা স্পর্শ করল। নজ্জানত হলাম। একটু আগের দৃশ্য মনে পড়তেই কেঁপে কেঁপে উঠছি। ভীত হয়ে তার শার্ট চেপে ধরেছিলাম, ভুলবশত তখনই।
“তোর না জানলেও চলবে।”
বলেই স্থির পা জোড়া গতিশীল করে কক্ষ ত্যাগ করলেন। তার পেছন পেছন রাহাত স্যার যেতে গিয়েও ফিরে এলেন। আমার নাকের ডগায় আঙুল চেপে আনমনে বলে,
“বাহ্ এই পুতুলটা তো সুন্দর।”
আমি একগাল চাপা হাসল। রাহাত স্যার বাকহীন হলেন।
“আমি মানুষ, পুতুল নই। আপনার জানের দোস্ত আমার এই অবস্থা করেছে।”
ধ্রুব স্যার রাহাত স্যারকে না পেয়ে ফিরে এলেন। আমাদের দুজনকে একসাথে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। নাক ফুলালেন। বাম ভ্রু কুঁচকাল। আমার কাঁধ থেকে ব্যাগ টেনে নিলেন। টেনে টেনে বললেন,

“একঘণ্টা সময় দিলাম। এগুলো ঠিক করে ব্যাগ নিয়ে যেও। সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসে আছি। লেট হলে পাবে না।”
“মানে?”
“এগুলো যখন তুমি ফেলেছ, তাই তুমিই ঠিক করবে। উইথ আউট অ্যানিওয়ান হেল্প। ইউর টাইম স্টার্ট নাও।”
বলেই ধ্রুব স্যার রাহাত স্যারকে নিয়ে প্রস্থান করলেন। আমি ধীরে ধীরে গুছাতে লাগলাম। যেহুতু আমি এগুলো ফেলেছি অবশ্যই আমাকে গুছাতে হবে। তারমধ্যেই বন্ধুমহল হাজির। তাই বেশি কষ্ট করতে হয়নি আমায়। বিশ মিনিটেই হয়ে গেছে।
পুরো ভার্সিটি খুঁজেও দেখা পেলাম না ধ্রুব স্যার কিংবা রাহাত স্যারের। প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে কোথাও গেছে দু’জনে। উপায়হীন হয়ে বাড়িতে চলে এলাম। অনেকে বলাবলি করছে,
স্যার টিসু দিয়ে গাল ঘষে ঘষে রক্তিম করে ফেলেছে। চামড়াও উঠে গেছে খানিকটা। তাই ওয়ান টাইম লাগানো হয়েছে।
তার কারণটা বোধগম্য হতে বাকি রইল না।

অন্তরিক্ষ অন্ধকারে আবৃত। মিটিমিটি তাঁরা জ্বলছে চাঁদকে কেন্দ্র করে। একফালি চাঁদের কাছে তাঁরাগুলো তুচ্ছ। ব্যালকেনিতে বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছি। পাশেই একজোড়া চড়ুই পাখি খাঁচায় বন্দী। তারা বন্দী নয়, আমার কাছেই থাকে। উড়িয়ে দিলে ফিরে আসে।
মৃত্যুর পূর্বে মায়ের দেওয়া শেষ এবং শ্রেষ্ঠ উপহার। মামা বাড়িতে ছিলেন না। মাত্র ফিরেছেন, বাবুই জানিয়েছে। মামার মেয়ের ডাকনাম বাবুই। ঠাণ্ডা কফি তলানিতে ঠেকেছে। চুমুক না দিয়েই মামার ঘরে যাওয়ার উদ্যেগ নিলাম। তার পূর্বে মামা নিজেই হাজির।
“চড়ুই, শরীর খারাপ মা? কখন ডাকলাম আসলি না।”
“কফি খাচ্ছিলাম মামা। তুমি বসো, তোমার জন্যও নিয়ে আসছি।”
“রমিলা মহতাব ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে। ঊনত্রিশ ফ্রেব্রুয়ারি ধ্রুবের জন্মদিন। চারবছর পরপর ধ্রুবের জন্মদিন আসে। আগের জন্মদিনে ধ্রুব মায়ের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছিল। এবার রমিলা মহতাব তার ছেলেকে ডিভোর্স পেপার উপহার দিয়ে সবকিছু ঠিক করে নিতে চায়। একটা চিঠিও পাঠিয়েছেন। তুই কী সাইন করে দিবি মা?”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১

মগ নিয়ে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলাম। মাঝপথেই মাথা বলে উঠলেন। পরবর্তী পা ফেলা হলনা। অদৃশ্য কোনো শিকড় মাটির ফাঁক দিয়ে এসে পা জোড়া আঁকড়ে ধরল। ওষ্ঠদ্বয় চেপে দাঁড়িয়ে রইলাম। গাল ভিজে উঠল। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেল। যেই সত্যি নামক পাতাটাকে জীবনের ডাইরী থেকে ছিঁড়ে ফেলতে চাই। সেটা আজও ছেঁড়া হয়নি। তাচ্ছিল্যের স্বরে বললাম,
“যে পাখি ঘর বাঁধে না, তাকে কী জোর করে ঘর বাঁধানো যায়। চড়ুই পাখির সংসার হয়, চড়ুইয়ের সংসার নাই বা হল।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩