পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ২
মম সাহা

রাত নেমেছে আকাশের বুকে। ভীষণ নিস্তব্ধ রাত। বিষন্ন রাত। যে রাত মন খারাপ গুলো লুকিয়ে রাখে নিজের বুকে। দর্শিনী শুয়ে আছে ছাদের হিমশীতল হয়ে থাকা মেঝেতে। শাড়ির আঁচল বিছিয়ে আছে পাশেই। নিষ্পলক চেয়ে আছে আকাশের পানে। হিসেব মেলাচ্ছে হয়তো। পাওয়া না পাওয়ার হিসেব। যেদিন বিপ্রতীপের সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিলো,তখন ভরা আষাঢ় পরিবেশে। তুমুল বর্ষণের দিনে দেখা। তারপর কত বর্ষণ গেলো। দর্শিনীর চোখ আর অন্য পুরুষকে দেখে নি। এক পুরুষের মায়ায় আটকে যে গেলো, তা আর ফেরানো গেলো না। মা তো ঘোর আপত্তি, বিয়ে এখানে দিবে না। তবে বাবা ছিলেন মেয়ে ভক্ত। মেয়ের তুষ্টিতেই তার সন্তুষ্টি। অবশেষে বিয়েটা হলো আরেক আষাঢ়ে। যা তাসেরঘরের মতন ভেঙে গেলো বছর তিন না পেরুতেই।

“দিদি,তুমি এখানে অমন করে শুয়ে আছো যে!”
এক নারী কণ্ঠে এক আকাশ বিষ্ময় মাখা প্রশ্ন শুনে ধ্যান ভাঙে দর্শিনীর। সে উপলব্ধি করে,চোখে তার অশ্রুকণা। মনে তার ভিষণ প্রলয়ঙ্কারী তান্ডব। উন্মাদনা তার শিরায় শিরায়। দর্শিনী সময় নিলো। নিজেকে ধাতস্থ করলো। রাতের আধাঁরে লুকালো অশ্রুকণা। বেশ স্বাভাবিক ভাবে উঠে মাথা ঘুরিয়ে পিছে তাকালো। পিছে তাকাতেই তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। দরজায় যেনো কেনো রাজকন্যা দাঁড়িয়ে আছে! কপালে তার মোটা করে সিঁদুর লেপ্টানো। হাতে সাদা শাখা। লাল টুকটুকে শাড়ি তার শরীরে জড়ানো। এ কোনো স্বর্গের অপ্সরা! এ জন্যই বিপ্রতীপের মাথা ঘুরেছে। একমাত্র প্রেমে অন্ধ আর বোকা পুরুষ ছাড়া এ নারীকে কেউ প্রত্যাখ্যান করবে না। আর বিপ্রতীপ বরাবরই চালাক।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দর্শিনীকে চুপ থাকতে দেখে এগিয়ে এলো মায়া। প্রানবন্ত চমৎকার মেয়ে। দস্যিপনা যেনো তার রক্তে। মুখে সেই সকালের মতন হাসি ঝুলিয়ে দর্শিনীর পাশে গিয়ে ধপাস করে বসলো। দর্শিনী ক্ষাণিকটা চমকালো। মেয়েটা এত উড়নচণ্ডী কেনো? পরক্ষণেই সে নিজের কথা ভেবে থম মেরে যায়। সেও কী কম উড়নচণ্ডী ছিলো! সময়ের বিবর্তনে আজ তার চেয়ে বড় নিস্তব্ধতা কারো নেই। এই বিশাল রাতের আকাশেরও নেই।
তন্মধ্যেই মায়া আবার তার ঝলমলে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি কী কথা কম বলো,দিদি?”
“না তো। তোমার বুঝি তাই মনে হলো?”
রাতের আধার ভেদ করে দর্শিনীর কণ্ঠ মায়ার কাছে যেন দারুণ শোনালো। ষোড়শী কিশোরী খিলখিল করে হেসে বললো,
“হ্যাঁ, তাই মনে হয়েছিলো। তোমার কণ্ঠ কিন্তু দারুণ। আর তুমি দারুণ গানও জানো। আমাকে শুনাবে?”

দর্শিনীর ভ্রু কুঁচকে এলো। সে যে গান জানে সেই কথা নতুন বউ জানলো কেমন করে! দর্শিনী পাহাড়সম বিস্ময় নিয়ে বললো,
“তুমি জানো কীভাবে আমি গান জানি?”
মায়া কৌতুক হেসে গেয়ে উঠলো,
“তোর আমার প্রেমে ছিলো রে বন্ধু, ছিলো পুরোটাই পাপ।”
দর্শিনী হোঁচট খেলো মনে মনে। এ গান তো বিপ্রতীপকে শুনিয়ে ছিলো বিকেলের দিকে। তবে মেয়েটা জানলো কীভাবে? বিপ্রতীপ বলেছে! নাহ্,নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতন ছেলে তো সে না। তবে? মেয়েটা কী তখন শুনে ফেলেছে কথা গুলো?
“কী ভাবছো, দিদি?”
দর্শিনীর আবারও ভাবনার রাজ্যে ভাঁটা পড়লো। থতমত খেয়ে বললো,
“না কিছুই ভাবছি না। তুমি অনেক চতুর কিন্তু।”
“তাই নাকি? কেনো এমনটা মনে হলো?”
“তোমার কথা বার্তা শুনে মনে হলো আর কি।”
“ওহ্,তাই বুঝি? আমি তো তত চতুর ছিলাম না। নাকি তোমার সতীন হয়েছি বলে চতুর বললে?”

এবার যেন দর্শিনীর মাথা ঘুরে উঠলো। মেয়েটা বেশ হেয়ালি করে কথা বলে। কিন্তু মেয়েটা এ কথা জানলো কীভাবে? শশুর বাড়ির সবাই তো বেশ সতর্কতা অবলম্বন করে ছিলো এ ব্যাপারে। তবুও জেনে গেলো?
দর্শিনী ভাবনা বাদ দিয়ে নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
“কী বলছো এসব? আমি তোমার সতীন হতে যাবো কেনো? আমি তোমার কেউ না।”
“আচ্ছা মানলাম। তা দিদি,সামনের ছাদে একটা ছেলে যে এত রাতেও ড্যাবড্যাব করে আমাদের দেখছে সেটা কী জানো?”
দর্শিনী ভড়কে আশেপাশে তাকালো। হ্যাঁ দক্ষিণ দিকের বাড়ির ছাদে একজন দাঁড়িয়ে আছে। এটা নতুন ছেলেটা না? পাড়ায় নতুন এসেছে এ ছেলে। গত পরশুই তো এলো। ছেলেটার দৃষ্টি দর্শিনীর আগেই ভালো লাগতো না। কেমন করে এ বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। অদ্ভুত!
দর্শিনী উঠে দাঁড়ালো। সাথে মায়াকেও টেনে তুললো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“চলো। ছাদ থেকে নিচে যেতে হবে। আজ তো কাল রাত্রি। কাল ফুলসজ্জা। নতুন বউ এত রাতে ছাদে থাকে না।”
“পুরাতন বউরা বুঝি থাকতে পারে?”
দর্শিনী জবাব দেয় না। এ মেয়ের সাথে কথায় পারা যাবে না তা সে ভালোই বুজেছে। তাই গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো ছাদ থেকে। মায়া দাঁড়ালো। পাশের ছাদে থাকা মানবটার দিকে তাকিয়ে রহস্য মাখা হাসি দিলো। পরক্ষণেই নিচে চলে গেলো।

বাড়িতে রমরমা আয়োজন। আজ বৌভাতের অনুষ্ঠান। ছেলের দ্বিতীয় বিয়েতে যতটা জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়েছে, প্রথম বিয়েতে তার একাংশও বোধহয় করা হয় নি। দর্শিনী কেবল ড্যাবড্যাব করে সে আয়োজন দেখছে। মিটমিটিয়ে হাসছে। ভাগ্য তার বেলাতেই দারুণ খেলেছে।
“এই বউ,তুমি ঘরে গিয়ে বসতে পারো না? বন্ধ্যা মেয়েমানুষ শুভ জিনিসে থাকে না। তাছাড়া তোমার কী একটু কষ্টও লাগে না?নিজের স্বামীর বিয়ে দেখছো আবার হাসছো!”
দর্শিনী নিজের কাকী শাশুরির কথায় ফিরে তাকালো। সোফায় আরেকটু কোণ ঘেঁষে বসে বললো,
“আমার স্বামীর তো কষ্ট লাগে নি। তবে আমার কেনো লাগবে!”
দর্শিনীর প্রশ্নে ভদ্রমহিলা হতবাক। ছিঃ ছিঃ করে বলে উঠলো,
“একে তো নিজের সংসার টিকিয়ে রাখতে পারো নি। আবার বড় বড় কথা বলো? তুমি কেমন মেয়ে মানুষ?”

“যে সংসার কভু আমার হয় নি,তা টিকানোর কথাও বা আসছে কোথা থেকে?”
মহিলা এবার দমে গেলো। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি নারীরা নত স্বীকার করতে কখনো চায় না। সেই বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কাকী শাশুড়িও চুপ রইলেন না বরং আরও কিছু কথা শুনিয়ে দিলেন। দর্শিনী কেবল চুপ করে সামনে থাকা টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। তার যেনো রাজ্যের কাজ টিভিতে।
কাকী শাশুড়ি চলে যেতেই দর্শিনী ঘরে চলে গেলো। সেখানে থাকলে কেবল এক গাদা কথাই শুনতে হবে। এর চেয়ে ঘরে থাকা ভালো। আর তো কয়েকটা দিনই এ বাড়িতে আছে। তারপর মুক্তি দিবে সবাইকে। সাথে সে নিজেও মুক্ত হবে মিছে বন্ধন থেকে।
দর্শিনী খাটের সাথে থাকা জানালার গ্রীল ধরে বসে আছে। আজকাল তার মরতে ইচ্ছে হয় না। বরং মনে হয় এই পৃথিবীতে যত বেঁচে থাকবে তত মানুষের খোলশ বদলানোর খেলা দেখতে পাবে।

ভাবনার মাঝেই দর্শিনীর চোখ পাশের বিল্ডিং এ গেলো। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সামনের বিল্ডিং এর সাদা টাইলস করা বারান্দাটায়। দর্শিনী চেনে ছেলেটাকে। পাড়ায় নতুন এসেছে যে,এটা সেই ছেলে। ছেলেটা এই বিল্ডিং এই তাকিয়ে আছে কেমন করে। দর্শিনী সাথে সাথে জানালা বন্ধ করে দিলো। এ কোন আ’প’দ এসে জুটলো? সকাল নেই, সন্ধ্যা নেই সবসময়ই তাকিয়ে থাকে! অদ্ভুত!
দর্শিনী অনুভব করলো তার পাশে কেউ হুড়মুড় করে বসেছে। দর্শিনী পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো মায়া। মেয়েটা আজও লাল জামদানী পড়েছে। ছোট্ট একটা মেয়ে কিন্তু কী দারুণ তার দেহ গঠন। দর্শিনী নিজেই বার বার চোখ জুড়িয়ে নেয় মেয়েটাকে দেখে।
মায়া খাটে সোজা হয়ে বসে চঞ্চল মনে বলে উঠলো,
“কী করো?”
“আকাশ দেখি।”
“আকাশ দেখো! কেনো?তোমার কী মন খারাপ?”
দর্শিনী ভ্রু কুঁচকালো। অদ্ভুত হেসে বললো,
“আকাশ দেখার সাথে মন খারাপের কী সম্পর্ক?”

“সম্পর্ক আছে। মন খারাপ যখন হয় তখন আকাশ পরিমাণ হয়। কোনো কিছুতেই ভালো হয় না। তুমি যদি আকাশের দিকে তাকাও তবে আর মন খারাপ থাকবে না। তুমি জানবে পৃথিবীতে তুমি একা না, ঐ আকাশও বিশালতা থাকা স্বত্তেও একা। সবার ভাগ্য কী আর পোষ মানে!”
দর্শিনী মুগ্ধ এতটুকু একটা মেয়ের কথায়। যেখানে এ মেয়েটার উপর রাগ আসার কথা সেখানে মুগ্ধতা কাজ করছে। মেয়ে হয়েই তার এ অবস্থা। বিপ্রতীপের তাহলে দোষ কী?
“জানো আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবে সম্বন্ধ করে হয় নি।”

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ১

মায়ার এহেন বাক্যে হতবাক দর্শিনী। সে তো জানে দুই পরিবার মিলেই দেখে শুনে বিয়েটা ঠিক করেছে। তবে? মেয়েটা এত উদ্ভট কথা কেনো বলে! দর্শিনী অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“তবে?”
মায়া বাঁকা হেসে ফিসফিস বললো,
“আমাদের প্রেমের বিয়ে।”

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩