মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা গল্পের লিংক || ইফা আমহৃদ

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১
ইফা আমহৃদ

ভার্সিটিতে নতুন প্রফেসরের আগমন ঘটতে না ঘটতেই র‍্যাগিংয়ের শিকার হতে হল আমাকে। বাচ্চাসুলভ টানা টানা নেত্রযুগল দ্বারা চেয়ে রইলাম প্রফেসরের দিকে। ইতোমধ্যে মাথায় দু’টো ঝুঁকি বেঁধে দিয়েছেন তিনি। নির্বিকার দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ এবং আমার দৃষ্টি মাটির দিকে। পুরো ক্লাসের দৃষ্টি আমাদের দিকে স্থির। হাতের করতলের সাহায্যের টেবিলের আঘাত করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
“ক্লাসে এসে মন কোথায় থাকে তোমার? ক্লাসরুম এটা কোনো ক্যান্টিন নয়। তাহলে এখানে কেন খাচ্ছ?এইসব কী খাবার? ফাস্ট ফুড খাওয়ার অপকারিতা সম্পর্কে জানো না?
আর তুমি ললিপপ খাচ্ছ, স্টুপিড?
বেরিয়ে যা। আউট!”
আমি নিশ্চুপ। কেঁপে উঠলাম। মাথা নত করে বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করতেই নতুন প্রফেসর থামিয়ে দিলেন। পরক্ষণেই দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বললেন,

“কোথায় যাচ্ছ তুমি? আমার অনুমতি না নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? বসো, স্টুপিড। যদি ক্লাস করতেই না চাও, তাহলে কেন আসো।”
প্রথমবার জড়তা কাটিয়ে সোজাসাপটা বললাম,
“আপনাই তো যেতে বললেন।”
“আমি তোমার কর্মকাণ্ড দেখে যেতে বলেছি, তাই বলে তুমি বেহা’য়ার মত চলে যাবে। ফাস্ট ক্লাস তাই কিছু বললাম না, বসো।”
ভ্রু কুচকালাম। গিরগিটির ফুফাতো ভাই গিরিগিটি। এর বলছে বেরিয়ে যাও আমার এই বলছে যেও না। ঢং। “তোর কপালে বউ জুটবে না!” ললিপপ মুখে পুড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে কাঠিটা ব্যাগের ভেতরে রাখলাম। অতঃপর নিজের সিটে বসতেই স্যার রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, “একদম পেছনের সিটে গিয়ে বস। গো ফাস্ট।”
মনে মনে স্যারের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে পেছনের দিকে অগ্রসর হলাম। তিনি সাইলেন্ট বলে টেবিলের আঘাত করলেন। অতঃপর পুনরায় বলতে শুরু করলেন।
“আমি ধ্রুব। ইরফান মাহতাব ধ্রুব। তোমরা আমাকে ধ্রুব স্যার বলেই ডাকতে পারো। এটাই ভার্সিটির প্রথম ক্লাস এবং প্রথম দিন। তোমাদের ক্লাসটা না-কি সবচেয়ে শান্তশিষ্ট, তাই প্রিন্সিপাল স্যার প্রথম এই ক্লাসে পাঠিয়েছে। শান্তশিষ্ট ক্লাসই এটা তাহলে ডেঞ্জারাস ক্লাস কোনটা ভাবছি। এটাই হয়ত, তোমাদের সাথে প্রথম এবং শেষ ক্লাস। এসে যা দেখেছি। মনে হয়েছিল, আমি ভুলে ক্যান্টিনে চলে এসেছি। ক্যান্টিনে তো আর ক্লাস করা যায় না, তাই ভাবছি তোমাদের ক্লাসটা আমি নিবো না। অন্য কোনো প্রফেসরের সাথে চেঞ্জ করে নিবো।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ধ্রুবের স্যারের কথা শুনে সবার মুখ ছোট হয়ে গেল। ক্লাসের সবচেয়ে স্মার্ট মেয়ে মাহি উঠে বলে,
“না স্যার, আপনি প্লীজ এভাবে বলবেন না। এত হ্যান্ডসাম, স্মার্ট স্যার আমাদের ক্লাস নিবে না। এটা হতেই পারে না।
পুরো ভার্সিটির মেয়েরা বলাবলি করছে আপনার কথা। চড়ুই ভুল করেছে, তার শাস্তি আমরা কেন পাবো স্যার?”
ধ্রুব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আমি যেহুতু বলেছি নিবো না, তো নিবো না। ইটস্ ফাইনাল। নো এক্সকিউজ।
আর চড়ুইটা কে?”
সবাই আঙুল তুলে আমাকে ইশারা করল। স্যার পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। থেমে থেমে বললেন,
” হা! হা! হা! তোমার নাম চড়ুই পাখি? চড়ুই একটা বিশেষ ভাবনা জানো? যার জন্য তাকে আকাশ ঠেকানোর লাঠি বলা হয়!”
সবাই উতলা। মনোনিবেশ করল ধ্রুব স্যারের কথায়। থেমে গেল। বেল বাজল। এক পলক বাইরের দিকে অবলোকন করলেন বিরক্তকর চোখে। ধ্রুবের ফুটফুটে ললাটে সরু ভাঁজ পড়ল। ওষ্ঠদ্বয় কামড়ালেন। নিঃস্পৃহ স্বরে বললেন, “বেল বেজে গেছে। আজ আর বলা হলো না। অন্য একদিন বলব। আজ আসি।”

সবাই তাল মিলিয়ে বলে উঠল,
“না স্যার। বলুন। প্লীজ, প্লীজ, প্লীজ।”
মুহুর্তেই চারিদিকে চ্যাঁচামেচির সূচনা হয়ে গেল। ধ্রুব স্যার তা সামাল দিতে বললেন।
“সাইলেন্ট, কিপ সাইলেন্ট এভরেবডি। বলছি
চড়ুই পাখির ধারনা, সে ঘুমালে আকাশ ভেঙ্গে পড়বে। আকাশ ভেঙ্গে পড়ার আগেই চড়ুই পাখি যাতে ধরতে পারে, তাই চিতল মাছের মত চিত হয়ে ঘুমায়।”
মুহুর্তেই ক্লাসে অবস্থানরত সকলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। রাগে পিত্ত জ্বলে গেল আমার। দাঁতে দাঁত চেপে মাটির দিকে চেয়ে আছি। ধ্রুব সাইলেন্ট বলে প্রস্থান করল। তবে হাসির শব্দ কমল না। এখানে আর এক মুহুর্ত থাকলেই কটু করা শুরু করে দিবে। সামনের অগোছালো চুলগুলো ঠিক করে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

আমি চড়ুই। চড়ুই পাখি নই। আমার নামই চড়ুই। ছোটবেলায় মামা ভালোবেসে চড়ুই পাখি ডাকত। বাবা মায়ের মৃত্যুর পরে মামার সংসারেই বড় হওয়া। তাই চড়ুই নামেই পরিচিত। আমার মামনি কিন্তু আর পাঁচটা গল্পের মত ভিলেন কিংবা ডেঞ্জারাজ নয়। একদম ভদ্র, শান্তশিষ্ট। আমাকে নিজের মেয়ে আলফির মত ভালোবাসে। আলফি আমার থেকে একটু ছোট, তবে বেশি নয়। আমরা দু’জনেই পড়াশোনায় পারদর্শী। পড়াশোনা ছাড়া দুটো জিনিস আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের ললিপপ আর বন্ধুমহল। ললিপপের জন্যই এতবড় অপমান করে গেল। এইত একটু আগের কথা..
নিত্যদিনের মত আজকেও ভার্সিটিতে এসেছি। ঘুম ভাঙতে দেরি হওয়ার ফলস্বরুপ ভার্সিটিতে পৌঁছাতেই দেরি হয়। দ্রুত ক্লাসে এসে ব্যাগ বেঞ্চিতে রাখতেই চেইন খুলে গেল। ললিপপগুলো এলোমেলো হয়ে নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। তাড়াহুড়োয় সবকিছু উল্টো গেঁটে গেল। হাঁটু মুড়ে বেঞ্চির নিচে বসে ললিপপগুলো তুলার উদ্যেগ নিলাম। তৎক্ষণাৎ প্রবেশ ঘটল নতুন অরুপে ধ্রুব স্যারের। দেখতে মনে হয় না, ইনি প্রফেসর। একটু বেশি হ্যান্ডসাম বৈকি। তাই স্টুডেন্ট মনে করে পাত্তা না দিয়েই বেঞ্চির নিচ থেকে ললিপপ তুলতে লাগলাম। এতেই যা হওয়ার হয়ে গেল। তিনি চঞ্চল পায়ে এগিয়ে এলেন। আমার সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
“স্ট্যান্ড আপ। আই সেইড, স্ট্যান্ড আপ।”

ললিপপ গুলো তুলে উঠে দাঁড়ালাম। না বোঝার স্বরে বললাম, “ওয়াট?”
ললিপপগুলো উদ্দেশ্য করে বলেন, “এগুলো কী? ক্লাসের ভেতরে এগুলো কী? আমাকে দাও!”
“আপনি খাবেন? নিন!”
দু’টো ললিপপ এগিয়ে দিয়ে নির্বিকার কণ্ঠে বললাম। তখনও জানতাম না, ইনি নতুন স্যার। এতেই যেন ধ্রুব স্যার প্রবল ক্ষিপ্ত হলেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “ওয়াট ইজ দিস?”
“ললিপপ!”
ধ্রুব স্যার কিয়ৎক্ষণ গ্ৰথণ করে রাখলেন নেত্রযুগল। অতঃপর পিছিয়ে গেলেন। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “চুলে লাগায় না, কী জানো বলে ওটাকে?
হেয়ার ব্যান্ড। কারো কাছে হেয়ার ব্যান্ড আছে?”
মেয়েরা হ্যাঁ-বোধক বুঝিয়ে ব্যাগ থেকে হেয়ার ব্যান্ড বের করে দিতেই ধ্রুব দু’টো ব্যান্ড নিয়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমার বেনুনী বাঁধা চুলগুলো অনায়াসেই খুলে ফেললেন। দুপাশে উঁচু করে ঝুঁকি বেঁধে দিলেন। আমার দৃষ্টি তার মুখশ্রীতে নিবদ্ধ।
“কী করছেন?”

প্রত্যুত্তর না দিয়েই খপ করে ললিপপ নিয়ে র‍্যাপার পেপার খুলে মুখে পুড়ে দিলেন। আপনাআপনি হাত দিয়ে ঠেকলো ওষ্ঠদ্বয়ে। তার কর্মকাণ্ডের মানে বুঝতে ব্যর্থ হলাম। তর্জনীর সহায়তায় চিবুকে স্লাইড করে বললেন, “নাউ ইউ আর লুকিং সো পারফেক্ট।”
পরক্ষণেই নিজের মুঠোফোন বের করে পরপর কয়েকটা ছবি তুলে নিলেন। আমি পূর্বের ন্যায় চেয়ে আছি, পলকহীন। ক্লাসে অবস্থানরত সকলেই আমার মত। ধ্যান ফিরতেই দ্রুত বললাম, “আপনি আমার ছবি কেন তুললেন?”
“পোস্ট করব, সোশ্যাল মিডিয়া আপলোড করব। ক্যাপশনে লিখব, প্রাপ্ত বয়স্ক ভার্সিটি পড়ুয়া একজন তরুণীর বাচ্চাসুলভ আচরণ। হ্যাব্বি না।”
“আশ্চর্য তো! আমি কিন্তু স্যারের কাছে বিচার দিবো।”
“দাও না, দাও। যাও..
শিক্ষক ক্লাসে এলে তাকে সম্মান না জানিয়ে ললিপপ না ললিপোক নিয়ে বসে আছো। দেখি স্যার কী বিচার করেন।”
তৎক্ষণাৎ বোধগম্য হল তার এই আচরণের মানে‌। তারপরে তো আপনারা জানেনই।

মোটা ফ্রেমের চশমায় চোখ ঢাকা। বই দ্বারা মুখ গুঁজে ক্যান্টিনে বসে পড়ছি। ওষ্ঠদ্বয় কমলা বর্ণ হয়েছে ললিপপে। কেউ বই ছিনিয়ে নিতেই মনযোগে বিঘ্ন ঘটল‌। আমার বন্ধমহল হাজির। প্রিয়া, আঁখি, নিরব, তারিফ। আঁখি বিচলিত হয়ে বলল,
“তুই এখানে বসে পড়ছিস আর আমরা তোকে সব জায়গায় খুঁজে এসেছি। কিন্তু পাইনি।”
“আমি খুঁজতে বলেছি কী?” একরোখা জবাব আমার।
বিচলিত কণ্ঠে প্রিয়া বলে, “খুঁজতে বলিস্ নি ঠিকই, তাই বলে আমরা খুঁজব না।
আর মাথার ঝুঁটি এখন খুলিস নি কেন?”
“আয়নায় দেখেছি, হেব্বি লাগছে। তাই খুলিনি।”
“ফাজলামো করছিস?” বিরক্তিকর কণ্ঠে নিরব।
“ফাজলামো কেন করব ডিয়ার? রিয়েলটাই বলছি।”
“কীসের ফাজলামোর কথা হচ্ছে মাই ডিয়ার প্রিন্সেস।”

প্রিন্সিপাল স্যারের আগমন। আমরা বিনা বাক্যয় উঠে দাঁড়ালাম। স্যার নিজের মেয়ের মত ভালোবাসে আমাদের। স্পেশালই আমায়। আমরা যথেষ্ট সম্মান করি। হাসিমুখে বললাম, ” আমরা আমরাই একটু আধটু ফাজলামো করছি, স্যার।”
“তা নতুন স্যারের ক্লাস কেমন করলে। বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে, বুঝতেই পারছ?”
হ্যাঁ! হ্যাঁ! হ্যাঁ। বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে বলেই তো বাঁদর হয়েছে, ধলা বাঁদর।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২