অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৬

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৬ 
তাশরিন মোহেরা

পড়নের ওভারকোটটা হালকা সরিয়ে মুখর চেয়ার টেনে বসলো অফিসারের সামনে। তার হাতে থাকা ফাইলগুলো টেবিলের উপর ছুঁড়ে মারলো। অফিসারের চেহারাটা তখন দেখার মতো! ভয়ে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মাঝে এক কনস্টেবল এসে মুখরকে জিজ্ঞেস করলো,
‘স্যার, কিছু আনবো? চা কিংবা কফি?’

মুখর ইশারায় বললো কিছু লাগবে না। ছেলেটা তারপরও একগাল হেসে মুখরকে এক কাপ কফি এনে দিলো। মুখরকে ‘স্যার’ ডাকা আর তাকে এমন তোষামোদ করাটা আমার ঠিক হজম হলো না।
এরশাদ সাহেব পাছেই দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘এই ছেলেটা-ই আমার ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগিয়েছে! একে এক্ষুণি জেলে ভরুন অফিসার।’
মুখর তার থুতনিতে হাত বুলাতে বুলাতে বাঁকা হাসলো। কপালটা খানিক চুলকে অফিসারের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
‘এজেন্সির পক্ষ থেকে আপনাকে কি বলা হয়েছিলো মি.মুজিব?’
অফিসারটা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে জবাব দিলেন,

‘ন্যায়ের সাথে ভিকটিমদের কেস সামলে নেওয়া, স্যার!’
মুখর এবার চোখমুখ কঠিন করে অফিসারের দিকে চেয়ে বললো,
‘তাহলে এই লোকটা থেকে টাকা নিয়ে একপাক্ষিক বিচারের কারণ কি?’

তার একহাত এরশাদ মুত্তাকীর দিকে তাক করা। অফিসার এবার তার কপালের ঘাম মুছে আমতা আমতা করতে লাগলো। তার দূর্নীতি ধরা পড়ে যাওয়ায় এভাবে ভয় পাচ্ছে নাকি মুখরের অগ্নিদৃষ্টিতে সে এমন করছে তা বুঝতে পারলাম না। তবে মুখরের দৃষ্টি আজ অন্যরকম দেখালো আমার কাছে। মনে মনে অঙ্ক কষলাম, মুখর এখানে ঠিক কি পরিচয়ে এসেছে? কেনই বা সবাই তাকে মান্য করছে কিংবা তাকে ‘স্যার স্যার’ বলে ডাকছে। আন্টির দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলাম তিনিও হতভম্বের মতো সবটা অবলোকন করছেন। নিজের ছেলেকে যেন তিনি নিজেই চিনতে পারছেন না।
মুখর টেবিলে ছুঁড়ে দেওয়া ফাইলগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,

‘এই ফাইলে এরশাদ মুত্তাকীর দূর্নীতির সকল প্রমাণ আছে। এখানে তিনি কিভাবে কে ও মিলস এন্ড ফ্যাক্টরিজ কোম্পানিটির মাধ্যমে ব্ল্যাক মানি আয় করছেন তার পুরো প্রমাণ আছে।’
এরশাদ সাহেব এবার ক্ষিপ্ত হয়ে মুখরের দিকে তেড়ে আসতে থাকে। কিন্তু পেছনে মুখরের বন্ধুদের জন্য তা পারা গেল না। অফিসারও তার দিকে দেখে চোখ পাকিয়ে শান্ত হতে বলেন। এরশাদ সাহেব চোখমুখ শক্ত করে বলে উঠে,

‘মুখর, তুমি কিন্তু মোটেও ভালো করছো না! আমি তোমার সাথে ঠিক কি কি করতে পারি তার হিসেব নেই তোমার!’
মুখর হঠাৎ করেই হো হো করে হেসে উঠলো। গগনবিদারী হাসিটা দেখেই অফিসার আর এরশাদ সাহেবের মুখটা পাংশুটে আকার ধারণ করলো। মুখর হাসি থামিয়ে বলে উঠলো,
‘খুব হাসলাম, আঙ্কেল!’

মুখর এরশাদ সাহেবের চেয়ারের দিকে এগিয়ে তার দিকে ঝুঁকে চোখমুখ কঠিন করে বলে উঠলো,
‘আপনার যতদিন ক্ষমতা ছিলো আপনি অন্যের উপর জুলুম করতে পেরেছেন। কিন্তু এখন? এখন আপনার কোনো ক্ষমতা নেই! সবটা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছি। আপনার কোম্পানিটা গুড়িয়ে দিয়েছি আমি! এখন কিসের বদৌলতে আপনি আমার ক্ষতি করবেন, মি.এরশাদ?’

এরশাদ সাহেবের মুখটা ভয়ে নীলবর্ণ ধারণ করেছে। উপস্থিত সবাই মুখরের এ কথায় শিউরে উঠে, শিউরে উঠলাম আমিও। কি যেন ছিলো তার কথায়!
মুখর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফাইলগুলো দেখে এরশাদ সাহেবকে বললো,
‘এই ফাইলগুলো একবার আদালতে গেলেই আপনার জীবন শেষ হয়ে যাবে, মুত্তাকী সাহেব। এখন টাকা দিয়েও কিছু করতে পারবেন না আপনি।’

এরশাদ সাহেবের মুখভঙ্গি এবার বদলায়। মুখরের কাছ এসে হঠাৎ করুণ সুরে বলতে থাকে,
‘কি চাও তুমি, মুখর? এবারের জন্য আমায় ছেড়ে দাও। তুমি যা বলবে আমি তাই করবো, ভাই!’
মুখর আবারো একটা অট্টহাসি দিলো। এরশাদ সাহেবের কান্ড দেখে আমার এবার বিরক্ত লাগলো। মানুষটা এখন ক্ষমতা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন দেখে করুণা নিচ্ছেন। অদ্ভুত বে’হা’য়া তো!

আন্টিও ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নেয়। মুখর ফিসফিস করে এরশাদ সাহেবকে বলে,
‘আমার বাবার খুনি আমার কাছে এসেই করুণা চাইছে। ব্যাপারটা একটু বেশিই হাস্যকর হয়ে গেল না?’
এরশাদ সাহেব মাথা নিচু করে ক্ষমা চেয়েই যাচ্ছেন মুখর থেকে। মুখরের চোখে মুখে ঘৃণার আভাস দেখা গেল। আজ তার জন্যই মুখরকে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হয়েছে, মা আর ভাই থেকে আলাদা থাকতে হয়েছে এতো মাস!
মুখর চেয়ার টেনে আয়শ করে বসলো। হাত ভাঁজ করে বিজ্ঞের মতো বললো,

‘চলুন, মি.এরশাদ! একটা ডিল করা যাক তবে। আপনিও আজীবন জেল খাটা থেকে বেঁচে গেলেন আর আমারও বাবার খুনের প্রতিশোধ নেওয়াটা হলো।’
আমিসহ উপস্থিত সবাই অবাক হলাম মুখরের কথায়। এরশাদ সাহেব জেল খাটা থেকে বাঁচবেন মানে? কি চাইছে মুখর? তন্মধ্যে মুখরের মতো একই পারফিউম দেওয়া ছেলেটা বলে উঠলো,

‘কি বলছেন ভাই? লোকটাকে জেলে পাঠানোর এতো প্ল্যানের কি হবে?’
মুখর ছেলেটাকে ইশারায় শান্ত হতে বললো। আমিও মনোযোগ দিয়ে দেখছি মুখর আসলে কি চায়! তাকে আজ সম্পূর্ণ অন্যরকম দেখাচ্ছে। খুবই রহস্যময় একজন!
মুখর এরশাদ সাহেবকে কাছে ডেকে বলেন,
‘আমি যা বলবো তা-ই করবেন তো, মুত্তাকী সাহেব?’

এরশাদ সাহেব দুদিকে মাথা দুলিয়ে বোঝালেন তিনি রাজি। মুখর বাঁকা হেসে বললো,
‘কোম্পানিটা আমার নামে লিখে দিন, এরশাদ মুত্তাকী!’
এরশাদ সাহেব সাথে সাথে আঁতকে উঠে ভীষণভাবে। অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি আমরা সবাই। মুখরের সিদ্ধান্তে বেশ জমে উঠেছে পরিবেশ! ফাটাফাটি একটা চুক্তি করেছে এরশাদ সাহেবের সাথে। কোম্পানি হারিয়ে লোকটা এবার পথে বসবেন। কিছু বলার কিংবা কিছু করার সাধ্যি থাকবে না আর তার!

এরশাদ সাহেব হতবুদ্ধির মতো বসে আছেন। তার মাথায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে এ মুহুর্তে। ভাবার সময়টুকু নেই তার হাতে। মুখর যেন এরশাদ সাহেবের এই ভঙ্গিমাটা-ই দেখতে চেয়েছে। তার মুখটা দেখে খুশি-খুশি মনে হলো। সে এরশাদ সাহেবকে আরও অপ্রস্তুত দেখতে বললো,

‘ভেবে দেখুন, মি.এরশাদ! এতো নামীদামী কোম্পানির হেড জেলে গেলে সম্মানটা ঠিক কোথায় যাবে? তার চাইতে কোম্পানিটা আমার নামে লিখে দেওয়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?’
এরশাদ সাহেব বেকায়দায় পড়লেন এবার। দুই নৌকায় পা দেওয়াটাও সম্ভব নয়। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বললেন তিনি,

‘সেদিনই তোমাকে মেরে ফেলা উচিৎ ছিলো, মুখর! সেদিন তোমার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে গেলে আজ এদিন আমার দেখতে হতো না।’
মুখরের বাঁকা হাসিটা যেন থামছেই না। তার এ হাসি দেখে মনে মনে আমার ভীষণ স্বস্তি লাগলো। মনের উপর থেকে ভারী একটা বোঝা নেমে গেল যেন!
‘কোম্পানিটা লিখে দাও, পাপা! এর বাইরে আর কিছু করার নেই।’

পেছন হতে মেয়েলি এক স্বর ভেসে এলো। তা অনুসরণ করে তাকাতেই দেখলাম রূপন্তী দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। কাছে এগিয়ে এসে কোম্পানির দলিলটা এগিয়ে দিলো এরশাদ সাহেবের হাতে। রূপন্তীর মুখটা মলিন হয়ে আছে ভীষণ রকমের। চোখের নিচেও কালি জমেছে হালকা। চোখ দুটো ফুলে আছে, বোধহয় কান্না করে এসেছে!
শেষমেশ মুখরের নামেই লিখে দেওয়া হলো কে ও মিলস এন্ড ফ্যাক্টরিজ কোম্পানিটি। মুখর দলিলটা নিয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। রূপন্তী মুখরের দিকে চেয়ে অভিমান নিয়ে বললো,

‘পাপাকে নিয়ে চলে যাচ্ছি অস্ট্রেলিয়ায়। আশা করি, তোমায় খুশি করতে পেরেছি।’
এই বলে রূপন্তী ভেঙে পড়া এরশাদ মুত্তাকীকে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়লো থানা হতে। মুখরের চারজন বন্ধুরা এগিয়ে এসে একসাথেই বলে উঠলো,

‘এই লোকটাকে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হয়েছে?’
মুখর হেসে বলে উঠলো,
‘চিন্তা করিস না তোরা! অবশেষে আপদটার ছাড়া পেলাম এটাই অনেক!’

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৬ শেষ অংশ