অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৬ শেষ অংশ

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৬ শেষ অংশ
তাশরিন মোহেরা

মুখরকে দেখে আবেগে কেঁদই দিলো মুগ্ধ। দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো ভাইয়াকে। মুখরও তার ‘মিনি ডেভিল’ কে কোলে তুলে নিলো। তার গালে অজস্র চুমু এঁকে দিলো মুখর। কান্না জড়ানো কণ্ঠেই মুগ্ধ বলে উঠলো,

‘কোথায় ছিলে ভাইয়া তুমি? তোমাকে কত্ত মিস করেছি আমি জানো?’
মুখর মুগ্ধের চুলগুলো এলোমেলো করে বললো,
‘একটা কাজে শহরের বাইরে ছিলাম। আর তুই এই ক’দিনে এতো শুকিয়েছিস কেন বল তো?’
মুগ্ধ গাল ফুলিয়ে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘তুমি মিথ্যা বলছো, ভাইয়া! কাজের জন্য শহরের বাইরে গেলে একটা কল করতে পারলে না? আর আম্মু মাঝরাতে তোমার জন্য কাঁদতোই বা কেন বলো তো? আর ম্যাম, ম্যাম ও কেঁদেছে অনেকবার।’
মুগ্ধের কথায় মুখর আড়চোখে আমার দিকে একবার দেখলো। বাঁকা হেসে বললো,
‘তাই নাকি? ম্যাম ও কেঁদেছে?’

লজ্জায় আমার মাথাটা কাঁটা গেল! মুগ্ধের কাছ থেকে এতো লুকিয়ে কাঁদার পরও ছেলেটা টের পেয়ে গেল? চোখ খিঁচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কাঁদিনি এ কথায়ও স্বীকার করা যাচ্ছে না!
মুখর মুচকি হেসে সবাইকে নিয়ে সোফায় বসলো। আন্টি আর মুগ্ধের কৌতুহলে সবটা খুলে বলছে মুখর।

মুখরের সাথে যে চারজন আজ উপস্থিত হয়েছে তারা হলো রাদিফ, তানজীব, সরব আর মাহদী! এর মধ্যে সরব আর রাদিফ মুখরের দু’বছরের ছোট অর্থাৎ রূপক ভাইয়ের সমবয়সী। তানজীব আর মাহদী মুখরের সহপাঠী থেকে একসময় কাছের বন্ধু হয়ে যায়।

এদের একটু ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলাম রাদিফ ছেলেটা দেখতে বেশ লম্বা তবে মেদহীন। শরীরের বেশ কয়েক জায়াগার হাড় দৃশ্যমান, কোথায়ও মাংসের ছিটেফোঁটা নেই। চুলগুলো আর্মিদের মতো ছোট ছোট করে ছাটা। দেখতেও বেশ চুপচাপ ধরনের। বেশ ভদ্রই লাগলো ছেলেটাকে।

তানজীব ছেলেটা দাম্ভিকতায় ভরা মনে হলো আমার। ঝাকড়া চুলের বাহারে তার একটা অন্যরকম ভাব ফুটে উঠেছে চোখমুখ জুড়ে। ফর্সা চামড়ার ছেলেটার মুখে ছোপ ছোপ দাঁড়ি গজানোতে তাকে বেশ সুদর্শন বলা চলে।
তানজীবের পাশে বসে থাকা চশমা এঁটে রাখা ছেলেটি হলো মাহদী। হাবভাব বেশ বিজ্ঞের মতোই। হাসিখুশি ছেলেটার গায়ের রঙ একটু চাপা। চুলগুলো তার ঘাড় অবধি নেমেছে, তা দেখতে অতোটাও খারাপ দেখাচ্ছে না। সামনে চলে আসা চুলগুলো বারবার হাত দিয়ে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে সে। মুখে হাসি ধরে রেখেছে সেই প্রথম থেকেই। এই হাসিতেই বোধকরি অনেকেই কুপোকাত হওয়ার উপক্রম।

শেষমেশ আসি সরবের কথায়। এ ছেলেটাই গায়ে মুখরের পারফিউম মেখে ঘুরে বেড়ায় চারদিকে। গম্ভীরমুখো ছেলেটা যে প্রায়ই মুখরকে অনুসরণ করে তা তাকে দেখলেই বোঝা যায়। সুঠামদেহী শরীর নিয়ে রক্তচক্ষু দিয়ে সবাইকে দেখছে সে। সবসময়ই বোধহয় এমন চাহনি নিয়ে থাকে সে। ছোটখাটো বলে দেখতে একটু ভয়ংকরই লাগছে তাকে।
মুখর কোথায় ছিল তা জানতে চাইলে সে বললো,

মুখরের বাবা হাসিবুল্লাহ্ মারা যাওয়ার পর প্রায় তিনটে বছর মুখরের জীবন বেশ দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। বাবার ব্যবহৃত কোনোকিছুই তার সামনে এলে সে আত্নগ্লানিতে ভুগতো। নিজেকে বারবার দোষারোপ করতো যে সে-ই তার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। চোখের সামনে দিনদিন মায়ের ভেঙে পড়াটাও দেখতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে একুশ বছরের যুবকটিকে!

ঠিক তখনই দেবদূতের মতো মুখরের জীবনে আসেন সুলেমান শাহ্। বাবার পর তিনিই অনেকটা অভিভাবকের মতো অবদান রাখেন মুখরের জীবনে। সুলেমান শাহ্ একটা সিক্রেট এজেন্সির হেড ছিলেন। জর্জরিত মুখরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে তিনি মুখরকে একাকিত্ব থেকে বের করে নিয়ে আসেন। মুখরের দিকে তাকাতেই খেয়াল করলাম সুলেমান শাহ্ এর কথা বলতেই মুখরের চোখ চিকচিক করে উঠে।

মুখর হঠাৎ মলিন হয়ে বলে উঠে,
‘কিন্তু মানুষটা আর আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। যে প্রতিশোধটা মনে মনে দীর্ঘদিন যাবৎ পুষে রেখেছেন, তা আর শেষমেশ পূরণ করে যেতে পারেননি।’
আন্টি জিজ্ঞেস করলেন,
‘কিসের প্রতিশোধ?’
মুখর প্রত্যুত্তরে বললো,

‘এরশাদ মুত্তাকীর সাথে আঙ্কেলের ব্যক্তিগত কিছু শত্রুতা ছিলো। যার জের ধরেই তার এ এজেন্সিটা খোলা। কিন্তু এরশাদ ধরা পড়ার আগেই মৃত্যু হয় আঙ্কেলের। আর তার অবর্তমানে এজেন্সির হেড হিসেবে আপাতত আমিই নিয়োজিত আছি!’
মুখর এজেন্সির হেড এ কথা শুনেই আমার ওষ্ঠাধর একে অপর হতে আলাদা হয়ে যায়। চোখ বড় করে আন্টির দিকে তাকাই। দেখি সেও আমার মতো বিস্মিত হয়ে গেছেন। কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘এজেন্সিটা কেমন, মুখর সাহেব? এমন কোনো সিক্রেট এজেন্সির কথা তো কখনো শুনিনি!’
আমার কথার উত্তর দিয়ে উপহাস করে তানজীব বলে উঠলো,
‘বিসিটি’ এর নাম কি কখনোই শুনেননি? বাংলাদেশে থেকেও এদেশের খবর রাখেননা? আপনাকে তো দেশদ্রোহীতার জন্যে জেলে পাঠানো উচিৎ!’

তানজীবের কথায় কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। আসলেই কি দেশদ্রোহী হিসেবে আমায় দেশচ্যুত করবে এরা? মুখরের দিকে অনিশ্চিত চোখে তাকালাম। সে মুচকি হেসে আমাকে আশ্বাস দিলো, এসব কিছুই হবে না। এরপর বর্ণনা করলো,
‘বিসিটি’ এর পূর্ণরূপ বাংলাদেশ ক্রাইম ট্রাইবুনালস। এটা মূলত একটি সিক্রেট এজেন্সি। দেশের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা দূর্নীতিবাজদের লুকিয়ে পর্যবেক্ষণ করাটাই এই এজেন্সির মূল উদ্দেশ্য। ঠিক যেমনটা আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি এরশাদ মুত্তাকীকে।’

মুগ্ধ এতোটা সময় ধরে চুপচাপ সবার কথা শুনছিলো। কিন্তু বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে না পেরে বলে উঠলো,
‘তার মানে তুমি ঐ এজেন্সিটার প্রধান শিক্ষক, তাই না ভাইয়া?’
মুগ্ধের কথায় হো হো করে হেসে উঠলো সবাই। আমারও খুব হাসি পেয়ে গেল। সবাইকে হাসতে দেখে মুগ্ধ বোকা বনে গেল তৎক্ষণাৎ।

তখনই আব্বার ফোন আসায় বুঝতে পারলাম বেশিক্ষণ আর এ বাসায় থাকা হবে না। আন্টি থাকার জন্য অনেক অনুরোধ করার পরও থাকতে পারলাম না। আব্বার ইদানীং প্রেশারটা বেড়েছে খুব! তারউপর অনিশ্চিতভাবে আমাকে রূপক ভাইয়ের ভরসায় ছেড়েছেন। কিন্তু রূপক ভাইকেও অযথা কষ্ট দিতে ইচ্ছে হলো না, তাই তাকে থানা থেকেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন যদি বাসায় গিয়ে না পৌঁছি তবে কেয়ামত হয়ে যাবে আজ! দরজার কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখলাম মুখর সাহেব এগিয়ে এলো আমার কাছে। কোমল কণ্ঠে বললো,

‘আরেকটু পর গেলে কি হয় না, মিস.তিথিয়া?’
আমি মুচকি হেসে বললাম,
‘ইতোমধ্যেই অনেক দেরি করে ফেলেছি! আজ আর থাকা যাবে না, মুখর সাহেব।’
‘তাহলে চলুন, আমি এগিয়ে দেই।’

‘না না, অযথা কষ্ট করবেন না। এতো ঝড়-ঝঞ্ঝা পাড় করে এসেছেন, কিছু সময় বিশ্রাম নিন!’
‘তাই বলে আমি যে আপনাকে একা ছেড়ে দেবো তা তো হয় না, মিস তিথিয়া!’
‘আপনি শুধু শুধুই ভাবছেন। আমি তো ছোট বাচ্চা না, তাই না?’
‘না তা নন। কিন্তু মাঝেমধ্যে তো মুগ্ধ থেকেও বাচ্চা হয়ে যান। নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনেন।’

‘মজা করছেন, মুখর সাহেব?’
‘আমি তবে এগিয়ে দেই?’
‘দরকার নেই, বললাম তো!’
‘দরকার আছে, বললাম তো!’
‘জেদ করবেন না, মুখর সাহেব।’

‘জেদের এখনো দেখলেনই বা কি, মিস.তিথিয়া! আমার জেদের কাছে আপনি নিতান্তই কচি খুকী!’
আমাদের দীর্ঘ এক কথোপকথনে বিরক্ত হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তানজীব বলে উঠলো,
‘দরজার কাছে দাঁড়িয়েই কি আজকের দিনটা পার করার ইচ্ছে আছে নাকি তোর, মুখর?’

তানজীবের দিকে তাকাতেই দেখলাম সে খুবই বিরক্ত আর বাকি তিনজন মিটিমিটি হাসছে। ঈষৎ লজ্জা পেলাম। সামান্য এগিয়ে দেওয়া নিয়ে এতো বকবক করে ফেললাম আমি। তখনই আন্টি এ সমস্যার সমাধান দিলেন। বললেন,
‘মুখর আব্বা! তুই এখন রেস্ট নে। তানজীবরা না হয় তিথিয়া মা’কে এগিয়ে দেবে।’
তন্মধ্যে মাহদী হাসিমুখে বলে উঠলো,

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ! এটুকু ভরসা তো করতেই পারিস আমাদের উপর, ব্রো।’
আন্টির কথা-ই শেষমেশ রইলো। চার বন্ধু আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। পিছু ফিরে মুখরকে একবার দেখলাম আমি। তখনই দেখলাম সেও আমার দিকে চেয়ে আছে। এই ক’দিনে মুখরের মুখে খোঁচা দাঁড়িরা হালকা গজানোর সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু তাতে আগের সৌন্দর্য একটুখানিও কমেনি মুখরের।

বরং দাঁড়িতে ছেলেদের অসম্ভব সুন্দর দেখায় তারই নিদর্শন দেখিয়ে দিয়েছে সে আমায়। আমাদের চোখাচোখি হওয়াতে মুখর আমার দিকে সেকেন্ড খানেক তাকিয়েই হঠাৎ চোখ টিপ মারলো। সাথে সাথেই চমকে উঠলাম আমি। আর মুখর তার এই লজ্জাটুকু ঢাকতে না পেরে ঠোঁটে হাত দিয়ে পালালো।

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৬ 

পেছনে ফেলে গেল একঝাঁক অস্বস্তি! কিন্তু এই অস্বস্তিটা আমার মোটেও খারাপ লাগছে না! বরং লজ্জায় ছেয়ে গেছে আমার পুরো শরীর। ভালোবাসার মানুষের প্রতিটা পদক্ষেপেই যেন প্রেমের আভাস পাওয়া যায়। আর ধীরে ধীরে এই প্রেমটা যেন আরও গাঢ়তর হতে থাকে।

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৭