মধুবালা পর্ব ১৭

মধুবালা পর্ব ১৭
ফারজানা আক্তার

ছোঁয়ার কানে হালকা গরম হাওয়া লাগতেই সে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে। চোখ বন্ধ করে ছোঁয়া শুভ্রর অস্তিত্ব অনুভব করে। শুভ্র ছোঁয়ার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে “শুভ জন্মদিন মধুবালা।”
সাথে সাথেই দরজা থেকে পুরো পরিবারের গলার স্বর ভেসে আসে “শুভ জন্মদিন ছোঁয়া।”

সবার আগে দাঁড়ানো বেলাল মির্জা আর আনজুমা খাতুন। এদের দুজনকে হাসিমুখে দেখে অনেকটা অবাক হয় ছোঁয়া। থমথমে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া। আনজুমা খাতুন এসে ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চান। ছোঁয়া আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বেলাল মির্জা ছোঁয়াকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে উনার ছেলের বউ হওয়ার প্রস্তাব রাখেন। আনজুমা খাতুন ইশারায় ছোঁয়াকে বলেন প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য। ছোঁয়া একবার মান্নান মির্জার দিকে তাকিয়ে অনুমতি চাইলো ইশারায়। মান্নান মির্জা হ্যাঁ সূচক ইশারা করতেই ছোঁয়াও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে ছোঁয়া অথচ কয়েকমাস আগেও ভয়ে নিচু হয়ে থাকতো ছোঁয়ার মাথা কিন্তু আজ ভিন্ন। ভাগ্য বড্ড বেশি জাদুকর। মুহুর্তেই মানুষের দিন বদলে দিতে ভাগ্য সক্ষম।

সবাইকে নিয়েই হৈ হুল্লোড় করে কেক কাটা হলো। সবার আগে শুভ্র কেক খাওয়ালো ছোঁয়াকে। তারপর একে একে সবাই খাইয়েছে ছোঁয়াকে কেক। সবার শেষে জীবন মির্জা আর জায়েদা বেগম আসলেন কেক খাওয়ানোর জন্য। উনারা দুজন ছোঁয়ার সামনে আসতেই ছোঁয়া মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে হেঁটে চলে যেতে নিলে তখনই শুভ্র এসে ছোঁয়ার হাত ধরে থামায় ওকে।

“দেখ ছোঁয়া যা হয়েছে ভুলে যা এবার। অনেক তো দিন কাটলো, একটু স্বাভাবিক কর নিজেকে এবার। এসবের মধ্যে তো চাচিম্মুর কোনো দোষ নেই তাহলে উনাকে কেনো কষ্ট দিচ্ছিস তুই? তুই কি জানিস তুই উনার সতীনের মেয়ে জেনেও উনি তোকে কতটা ভালোবাসে এখনো। তোকে এখন আগের থেকেও বেশি মায়া করেন উনি। কবে বুঝবি তোর প্রতি উনার একটা আলাদা মায়া আছে টান আছে, যা আমাদের কারোর প্রতি নেই। উনার সাথে তোর রক্তের সম্পর্ক না হলেও উনি তোকে চোখে হারায়।”

“কিন্তু শুভ্র ভাই আমার যে ভীষণ লজ্জা লাগে উনার চোখে চোখ রাখতে।”
“দেখো পাগলী মেয়ের কান্ড। লজ্জার কি আছে? আজ থেকে চাচিম্মু নয় মা বলে ডাকবে আমায় বুঝেছো। মেজু ভাবি মা’রা যাওয়ার কয়েকদিন আগে আমায় বলেছিলেন উনার যেমন অধিকার আছে তোমার উপর তেমন অধিকার আমারও আছে কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি উনি সত্যি সত্যিই আমার হাতে তোমাকে রেখে চলে যাবেন দূর অজানায়।
ডাকবে তো আমায় মা বলে?

ছোঁয়া জায়েদা বেগমের কথা শোনে অশ্রু চোখে মান্নান মির্জার দিকে তাকায়। উপস্থিত পুরো পরিবার শব্দহীন অনুভূতিতে দাঁড়িয়ে দেখছে সব। ছোঁয়ার সেজু চাচা চাচি সবসময়ই চুপচাপ এবং দূরে থাকে সবরকম ঝামেলা থেকে কিন্তু আজ তাদের চোখেও জল চিকচিক করছে।
মান্নান মির্জা মাথা নাড়িয়ে অনুমতি দিতেই ছোঁয়া ঝাপটে জড়িয়ে ধরে জায়েদা বেগমকে। মা মেয়ে দু’জনই কাঁদছে, বোবা কান্না।

পুরো পরিবারের চোখে জল টলমল করছে। লিলি সোহাকে জড়িয়ে ধরে অশ্রু চোখে হাসছে।
ছোঁয়া একবার কাঁপা কন্ঠে মা বলে ডাকে জায়েদা বেগমকে এতেই উনি যেনো স্বর্গ সুখ পেয়েছেন এমন ভাবে খুশি হয়েছেন।

হঠাৎ ছোঁয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে ” আমি একটা কথা ক্লিয়ার করে বলে দিচ্ছি জীবন মির্জার সাথে স্বাভাবিক হতে যেনো কেউ আমায় জোর না করে। নয়তো এবার এমন ভাবে যাবো ঘর ছেড়ে কেউ আর খোঁজে পাবেনা আমায়। এই মানুষটার জন্য আমি আমার জন্মদাত্রী মায়ের মুখটা পর্যন্ত দেখতে পারিনি, এই মানুষটার জন্য আমার গর্ভধারণী মা আমাকে গর্ভে নিয়ে দীর্ঘ নয়মাস কষ্ট করেছে।

কখনোই ক্ষমা করতে পারবোনা আমি এই মানুষটাকে। যে পুরুষ স্ত্রী সন্তানকে অস্বীকার করে আমার নজরে সে কাপুরুষের চেয়েও যদি কোনো নিচু স্থান থাকে তাহলে সে স্থানে উনি।
মা প্লিজ তুমিও কখনো জোর করিওনা আমায় নয়তো তোমাকেও দূরে করে দিতে বাধ্য হবো নিজের থেকে।”

ছোঁয়ার কথা বলা শেষ হতে না হতেই জীবন মির্জা চলে গেলেন সেখান থেকে। জীবন মির্জার চোখে আজ জলের স্রোত। নিজের মেয়ের মুখে এসব শোনার চেয়ে মৃত্যু অনেক ভালো। লজ্জায় ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে জীবন মির্জার। জীবন মির্জার জীবনে যে আরো একটি কঠিন সত্যি লুকিয়ে আছে এটা যে সবার অজানা। শুধুমাত্র ছোঁয়ার জন্য যে অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন সেটা যে আজও সবার থেকে লুকিয়ে রেখেছেন। ছোঁয়া কী জানতে পারবে এই নির্মম সত্যি টা? পারবে কী জীবন মির্জা কে ক্ষমা করে একবার বাবা বলে ডাকতে। জীবন মির্জার যে খুব ইচ্ছে করে একবার ছোঁয়ার মুখে বাবা ডাক শুনতে।

শুভ্র সবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে একটা স্বর্ণের আংটি ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে “হবি আমার বেডরুমের রাজ রানী? হবি কী আমার হৃদয়ের হৃদস্পন্দন? দিবি কী অধিকার তোকে প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসার? থাকবি সারাজীবন আমার মধুবালা হয়ে কথা দে।”

ছোঁয়া লজ্জামাখা মুখশ্রীতে একটু হাসি ফুটিয়ে বাম হাত এগিয়ে দেয় শুভ্রর দিকে। শুভ্র খুশি হয়ে দ্রুত ছোঁয়ার আঙ্গুলে আংটি টা পরিয়ে দিয়ে খুশিতে লাফাতে থাকে। শুভ্র তার সব প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হবে হয়তো ভাবতে পারেনি। শুভ্রর লাফানো দেখে পুরো পরিবার কুটকুট করে হেঁসে উঠে। ছোঁয়া ভীষণ লজ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে আছে। অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হচ্ছে ছোঁয়ার বুকজুড়ে।

শুভ্র হুট করে সবার সামনে ছোঁয়াকে বলে উঠে “এই মধুবালা শোন।”
“হু শুভ্র ভাই।”
“আর একবার যদি শুভ্র ভাই ডাকিস আমায় তবে মাথায় তুলে ছাঁদ থেকে টুপ করে ছেড়ে দিবো মনে রাখিস। হয় শুধু শুভ্র ডাকবি নয়তো কিছু ডাকার দরকার নাই। আসছে ভাই ডাকতে, চুল যা বাকি রেখেছিলাম গতবার সেগুলোও কেটে নেঁড়া করে দিবো একদম।”

শুভ্রর কথা শোনে সবাই কিছুক্ষণ হা হয়ে থেকে হু হু করে হেঁসে উঠে। ছোঁয়া এবার লজ্জা সামলাতে না পেরে এক ছুটে নিজের রুমে চলে গেলো।

সকালে আলিফের কল পেয়ে লিলি ঘুম থেকে জাগে।
আজ লিলি ছোঁয়ার রেজাল্ট দিবে। তাই লিলির মন খারাপ। আলিফ ওকে অনেকভাবে বুঝাচ্ছে।
আলিফের কল কেটে লিলি ছোঁয়ার কাছে গেলো। এমা এতো সকালে ছোঁয়া গেলো কই।

ছোঁয়াকে খুঁজতে খুঁজতে দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে দেখে লিলি জায়েদা বেগমের সাথে বসে কফি খাচ্ছে ছোঁয়া। লিলি ছুটে গিয়ে ছোঁয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে “আরে ওই মধুবালা তোর কী ডর ভয় কিছু নেই। আজ রেজাল্ট দিবে আর তুই এখানে বসে রিলাক্স হয়ে কফি খাচ্ছিস?”

“আরে কুল মাই ডিয়ার অনলি ওয়ান জামাইর বোন আমার ননদ।”
“এ্যাঁ!! হঠাৎ কী হলো রে তোর ছোঁয়া? জ্বর টর হয়নি তো?”
“আরে নারে। একটু আগেও ভয়ে ঘামছিলাম কিন্তু আমার মা আমাকে এখনই একটা কথা বলেছে আর আমার সব চিন্তা উড়াল দিয়ে পালিয়ে গেছে।”
“কী এমন বলেছে চাচিম্মু।”

মুখ গোমড়া করে লিলি বলে কথাটি। জায়েদা বেগম হাসতে হাসতে চলে যান সেখান থেকে। তারপর ছোঁয়া বলে “মা আমাকে বলেছেন ভাগ্যে যদি পাশ থাকে তবে অবশ্যই পাশ করবো আর ফেইল থাকলে ফেইল। আল্লাহর উপর ভরসা রাখলে তিনি আমাদের নিরাশ করবেননা কখনো। আর আমাদের পরিক্ষা তো আলহামদুলিল্লাহ ভালোই হয়েছে।
আর একটা গোপন সূত্র জানিস?

আমার মা আমাদের জন্য রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়েছেন।
আর মায়ের দোয়া কখনোই বিফলে যায়না। তাই নো চিন্তা ডু ফুর্তি। ”
লিলি কিছুক্ষণ থ মে’রে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে একটা হাসি দেয়। তারপর বলে “এই ছোঁয়া শোন।”
“বল শুনি।”

“আলিফ স্যার বলেছে রেজাল্ট দিলে ঘরে জানানোর জন্য আমাদের কথাটা কিন্তু আমার মনে হয় কেউ রাজি হবেনা। আলিফ স্যার রা একটু মধ্যবিত্ত। বিয়ে করার জন্য ঘর বাঁধতেছে ঠিক করে কিন্তু আমি যে ঘরে কিভাবে জানাবো ভেবে পাচ্ছিনা। ভয় লাগছে খুব, দাদি রাজি না হলে যে আব্বুও রাজি হবেনা কখনো।”

“আরে চিল মা’র বোন। সবাই মেনে নিবে দেখে নিস। আমাদের আলিফ স্যার কোনদিক দিয়ে খারাপ নাকি? সবদিক দিয়েই ঠিক আছে শুধু চোখ টা একটু টেরা আরকি।”
ছোঁয়া মজার ছলে কথাটি বলে, লিলি মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। অভিমান হয় লিলির।

মধুবালা পর্ব ১৬

“কে টেরা বললি? কার কথা হচ্ছে এখানে?”
শুভ্রকে দেখে চোখ বড় বড় করে ফেলে লিলি ছোঁয়া আর শুকনো ঢুক গিলে।

মধুবালা পর্ব ১৮