মধুবালা পর্ব ২৪

মধুবালা পর্ব ২৪
ফারজানা আক্তার

এই মধুবালা আরেকবার ভাই ডাকলে বালা পাবিনা বলে দিলাম। তোর বালা এখন আমার কাছে বন্দি। বালা পেতে হলে ভাই ডাকা ছাড়তে হবে কথা দে।”

শুভ্র কথাটা বলতেই বাত্বি জ্ব’লে উঠে রুমের। ছোঁয়া ঘরের সাজসজ্জা দেখে বিস্মিত। পুরো ঘর কাঁচা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে তাও ছোয়ার পছন্দের ফুল কাঠগোলাপ দিয়ে। বিছানায় লাভ আকৃতি করে হলুদ কাঠগোলাপ দিয়ে মাঝখানে লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো হয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পুরো রুমে ছোট ছোট রঙ্গিন লাইট জ্বা’লা’নো হয়েছে। ছোঁয়া এক পা সামনে এগুতেই ওর মাথার উপরে অসংখ্য গাঁধা ফুল আর কামিনী ফুলের পাপড়ি বৃষ্টির ন্যায় ঝড়ে পরে। শুভ্র বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে বিছানার পাশে মুখে মৃদু হাসি নিয়ে। ছোঁয়া অপলকে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। শুভ্রর মুখে রহস্যময় হাসি।
ছোঁয়া কে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুভ্র আবারো বলে “কী এমন করে কি দেখছিস মধুবালা? বালা জোড়া কী লাগবেনা?”

ছোঁয়ার চোখ বেয়ে হঠাৎ গড়িয়ে পরে নোনাজল। শুভ্র তো ছোঁয়ার চোখে জল দেখে একটু এগিয়ে এসে ছোঁয়াকে বিছানার একপাশে বসিয়ে ছোঁয়ার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোই ভরে বললো “কি হয়েছে মধুবালা? সারাদিন তোর সাথে কথা বলিনি বলে অভিমান করেছিস?

তোকে সারপ্রাইজ দিবো বলেই তো সারাদিন রেগে থাকার অভিনয় করেছি, সারাদিন যদি আমি তোর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতাম তবে তুই নিজেই ছুটে ছুটে আমার রুমে চলে আসতি বারংবার আর আমার সাজানো গুছানো হতোনা। তাই তো সারাদিন তোকে ইগ্নোর করেছি, যাতে তুই আমার রুমে না আসিস, আর এখন তো তোকে বালা চু’রি’র মিথ্যা নাটক করেই আনতে হয়েছে আমার রুমে, তুই যে ভীষণ জেদি সেটা কি আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে? তুই যে শুধু আমার মধুবালা। আমি ছাড়া তোর সবটা আর কে বা জানতে পারে বল?”

“এতোকিছু করেছো আমার জন্য অথচ এখনো অব্ধি ভালোবাসি কথাটা একবারো বললেনা। থাক বলতে হবেনা আমার বালা কোথায়? বালা দাও বলছি নয়তো সবাইকে বলে দিবো তুমি ঘুমের ঘোরে নাক ডাকো।”
“এ্যাঁ? কবে ঘুমে আমি নাক ডাকছি? আর ভালোবাসি বলতে হবে কেনো? বুঝে নিতে পারিসনা?”
“আমি কী বলছি তুমি নাক ডাকো? আমি তো বলছি বালা না দিলে সবাইকে এটা বলে মজা নিবো।”
“ছি ছি মধুবালা তুই তো দেখছি নিজের মানসম্মান নিজেই মাটিতে মিশাতে যাচ্ছিস।”

ছোঁয়া ভ্যাবাছ্যকা খেয়ে যায়। শুভ্র ছোঁয়ার অবস্থা বুঝতে পেরে বলে “কিরে কি ভাবছিস? আরে গাঁধি এখন আমরা স্বামী স্ত্রী। তাই আমার সম্মান হানি মানেই তো তোর সম্মানও নষ্ট হওয়া। তাই এখন থেকে আমার সম্মান নিয়ে টানাটানি করলে তোকে ভাবতে হবে আগে নিজের সম্মানের কথা, বুঝেছিস গাঁধি? ”

“দেখো গাঁধি বলবেনা। আমি বুঝিনা তোমার কথার আগামাথা। আমার বালা দাও বলছি।”
“ইস্ বুঝেনা কথার আগামাথা, অনার্স পাশ করা একটা মেয়েকে এতো ন্যাকামিতে মানাই না, শোন এখন স্কুলের মেয়েরাও তোর থেকে ভালো বুঝে এসব।
বাদ দে।

আগে প্রমিজ কর আজকের পর আর ভাই ডাকবিনা তবেই বালা পাবি। নয়তো জীবনেও আর বালা চোখে দেখবিনা।”
“আচ্ছা আচ্ছা কথা দিচ্ছি আর এই জীবনে বেঁচে থাকতে কখনো বলবোনা শুভ্র ভাই। এবার দাও না আমাকে আমার বালা জোড়া। আর যে তর সইছেনা। ”

শুভ্র ছোঁয়ার হাত থেকে আলতো ছোঁয়ায় এক এক করে সব চুড়ি খুলে নেয়। ছোঁয়া কিছু বলেনা। শুধু দেখে শুভ্র কি করতে চাই। চুড়ি সব খোলা শেষ হলেই শুভ্র একটা ড্রয়ার থেকে বালা দু’টি নিয়ে ছোঁয়ার হাতে পরিয়ে দেয়।
ছোঁয়া অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে নিজের হাতে জড়িয়ে থাকা বালাজোড়ার দিকে তারপর নাক টেনে কান্না জুড়ে দেয়। এটা যে খুশির কান্না শুভ্র ঠিক বুঝতে পেরেছে।

ছোঁয়া কিছু না ভেবেই হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পরে শুভ্রর বুকে। শুভ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে নিজের সাথে আরো শক্ত করে জড়িয়ে নেয় ছোঁয়াকে। শুভ্র আস্তে করে বলে “এই মধুবালা কাঁদছিস কেনো? তোর চোখে সুখের অশ্রুও আমার কাছে অসহ্য লাগে যে। ভীষণ ভালোবাসি তোকে মধুবালা। তুই আমার প্রথম স্বপ্ন দোষের কারণ মধুবালা তাইতো তোর প্রতি না চাইতেও দূর্বল হয়ে পরি। তুই আমার প্রথম অনুভূতি, আমার প্রথম হৃদয়ে ফুটা সদ্য ফুল।”

ছোঁয়া কিছু বলেনা শুধু নাক টেনে টেনে কান্না করে। শুভ্র একটু হেঁসেই আবারো বলে “এই শীতে আমার শেরওয়ানি ভিজিয়ে দিচ্ছিস কেনো ন্যাকা কান্না করতে করতে? শীত শীত লাগে তো।”
“চুপ করবে তুমি?”

এটা বলেই ছোঁয়া চুপ হয়ে আাবরও শুভ্রর বুকের উষ্ণতা অনুভব করতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
এভাবেই কেটে গেলো অনেক সময়। রাত প্রায়ই ২টা ৩০মিনিট ছুঁই ছুঁই। ছোঁয়া শুভ্রর বুক থেকে মাথা তুলে বলে “চলোনা একটু ছাঁদে যায়। আজ পূর্ণিমা, চাঁদ টা অনেক সুন্দর।”
শুভ্র একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে ছোঁয়া কে কোলে তুলে নেয়। শুভ্ররও ইচ্ছে ছিলো বাসর রাতে ছাঁদে বউয়ের কোলে মাথা রেখে চাঁদ দেখার। ছোঁয়া অজান্তেই তা পূরণ করার সুযোগ দিচ্ছে তাই শুভ্র আর দেরি না করে ছোঁয়াকে কোলে নিয়ে হাঁটা শুরু করে ছাঁদের দিকে।

“তোকে মধুবালা কেনো ডাকি আমি তুই জানিস?”
ছোঁয়া শুভ্রর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে “উঁহু, বলো তুমি।”

“মধু তো মিষ্টি খুব মিষ্টি, কিন্তু আমার কাছে মধুর চেয়েও দামী তোর মুখের এই মিষ্টি হাসি। আর তুই পাগল খান্দানী বালার জন্য। তাই তোকে মধুবালা ডাকতে ভীষণ ভালো লাগে আমার। আমি আমার বয়ঃসন্ধিকালেই বুঝতে পেরেছি তোর প্রতি আমি দূর্বল ভীষণ দূর্বল। কিন্তু কখনো কাউকে বুঝতে দেয়নি আমি কিছু।

জানিস খুব কষ্ট হতো নিজের অনুভূতি গুলো লুকাতে তবুও লুকিয়ে রেখেছিলাম এতগুলো বছর। তুই বালার জন্য বারবার আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিস তবুও আমি নিজের অনুভূতি গুলোকে কন্ট্রোল করে রেখেছিলাম তোর পড়ালেখার জন্য। আমি চেয়েছি তুই শুধু বালা নয় আমার জন্যও কিছু অনুভব কর কিন্তু নাহ তুই সবসময়ই আমার থেকে বালাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিস তাই রাগ হতো আমার খুব। যেদিন লিলি আমায় বলেছিলো তুই আমাকে ভালোবাসিস সেদিন আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম তোকে বলে বুঝাতে পারবোনা রে মধুবালা।

তোর চোখের নেশায় শতবছর আমি মাতাল হয়ে থাকতে চাই মধুবালা। তোর চোখ দুটো মদ্যপানীয়র চেয়েও বেশি নেশালো রে। আর এই নেশারঝোঁক নিয়ে আমি বাঁচতে চাই অনন্তকাল তোকে বুকে রেখে। থাকবি তো আমার বুকে লুকিয়ে দেহে প্রাণ থাকা অব্দি?”

ছোঁয়া মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলে। শুভ্র কুটকুট করে হেঁসে বলে উঠে “এই চাঁদ দেখ, তোর পূর্নিমার আলোর চেয়েও বেশি স্নিগ্ধ আমার মধুবালা। আমার ভালোবাসা। ”
ছোঁয়া বেশ লজ্জা পাই। আজ প্রথম শুভ্রর চোখের দিকে তাকাতে ছোঁয়ার লজ্জা লাগছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। শিহরণ জাগছে পুরো শরীর মন জুড়ে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। চোখের পাপড়ি কাঁপছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
শুভ্র বলে “চল বাগানে যাবো।” ছোঁয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে সাই দিলো।

বাগানে এসে একটা বেলি ফুল ছিঁড়ে শুভ্র ছোঁয়ার কানে গুঁজে দিলো। ছোঁয়া চটপট করে দ্রুত বলে “এটা কি করলে? রাতে গাছের পাতা ফুল ছেঁড়া নাকি ভালো না। দাদি বলেন।”
“আমার বোকা মধুবালা রাতেও ছেঁড়া যায় কিন্তু চেয়ে নিতে হয়। আমিও চেয়ে নিয়েছি গাছের রানী থেকে আমার পরির জন্য। ”

ছোঁয়া আবারও মাথা নিচু করে নেয় লজ্জায়। শুভ্র মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার মধুবালার লজ্জায় লজ্জিত মুখশ্রী।
দুজন হাঁটছে হাতধরে। কোয়াশায় ঘিরে আছে পৃথিবী। শুভ্র শক্ত করে ছোঁয়ার হাত ধরে রেখেছে। ছোঁয়ার ভীষণ ভালো লাগছে শুভ্রর হাত ধরে এভাবে হাঁটতে।

ছোঁয়া হাঁটছে আর বারংবার নজর দিচ্ছে হাতে জড়িয়ে থাকা বালা জোড়ার দিকে। শুভ্র খেয়াল করে বিষয়টা। শুভ্র মুচকি হেঁসে বলে “জানিস মেজু আম্মু মা’রা যাওয়ার আগের রাতে আমায় বলেছে আমি যেনো তোকে সবসময়ই আগলে রাখি আর তোর এই বালাজোড়া যেনো তোর হাতে ছাড়া আর কারো হাতে যেতে না দেয়। জানিস আজ আমার খুব ভালো লাগছে। মেজু আম্মুকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পেরেছি।”

“আম্মুকে কী আর কখনো ফিরে পাবোনা আমি? আম্মু কী আর কখনো ফিরে আসবেনা আমার কাছে। জানো আমার চুলগুলো একটু একটু করে লম্বা হচ্ছে, ছোট চাচিম্মু হেয়ার প্যাক লাগিয়ে দেয় সবসময়। আম্মু কী আসবেনা আর কখনো আমার চুলে তেল লাগিয়ে বেনি করে দেওয়ার জন্য? আমি যে সবকিছুতে আম্মুকে প্রচন্ডভাবে মিস করি। আজ আমার হাতে এই বংশের খান্দানী বালা অথচ আম্মু তা দেখছেনা। জানো কত কষ্ট হচ্ছে আমার।”

শুভ্র ইমোশনাল হয়ে যায় ছোঁয়ার কথায়। হাঁটতে হাঁটতে দুজন বাড়ির পেঁছনের দিকে চলে এসেছে। শুভ্র বুঝতে পারছেনা কি বলে সে তার মধুবালাকে সান্তনা দিবে। ছোঁয়া ক্লান্ত হয়ে বলে “চলো রুমে যায়। বড্ড বেশি ঘুম পাচ্ছে আমার।”
শুভ্র কিছু না বলে আবারো ছোঁয়াকে কোলে তুলে নেয়। ছোঁয়া বারণ করে কিন্তু কে শোনে কার কথা। বাড়িতে যে বড় রা আছে শুভ্রর তা খেয়াল নেই মোটেও। শুধু জানে তার মধুবালা আজ থেকে তার, সম্পূর্ণ তার।
রুমে এসে শুভ্র ছোঁয়াকে ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড় করিয়ে বলে “যা চেঞ্জ করে আয়।”

“কাপড় তো সব আমার রুমে।”
শুভ্র দ্রুত গিয়ে ছোঁয়ার রুম থেকে ওর কাপড়চোপড় এনে হাতে দিয়ে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দেয়। ছোঁয়া ওয়াশরুমে যেতেই শুভ্রও শেরওয়ানি চেঞ্জ করে একটা নিভু ব্লু টিশার্ট আর লুঙ্গি পরে নেয়।
প্রায়ই ৪০মিনিট পর একটা নীল রংয়ের প্লাজু আর সবুজ রঙের টি-শার্ট পরে ছোঁয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়।
“কিরে এতক্ষণ লাগলো কেনো তোর? নাকি এই শীতে গোসল করেছিস আবার,দেখি চুল।
চুল তো শুকনো তবে এতক্ষণ কি করছিলি?”

“এতো অস্থির কেনো হচ্ছো তুমি, আমার মেক-আপ তুলতে একটু সময় লেগেছে। এর আগে কখনো তো আর এতো ভারি মেকআপ করিনি তাই অভ্যাসও নেই যার কারণে দেরি হয়েছে। ”
শুভ্র আর কিছু না বলে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়। ছোঁয়া হাতমুখ মুছে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।

শুভ্র ওয়াশরুম থেকে এসে দেখে ছোঁয়া ফুলের পাপড়ি দিয়ে খেলছে। বিছানায় যে লাভ করা ছিলো ফুল দিয়ে সেটার সব ফুল ছোঁয়া হাতের মুঠোই পুরে রেখেছে। শুভ্র গামছা দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতে ছোঁয়ার পাশে বসে বললো “বালা গুলো খুলে ঘুমাস নয়তো ঘুমের মধ্যে ব্যাথা পাবি।”
“ব্যাথা পেলে পাবো তবুও খুলবোনা।”

শুভ্র মুচকি হাসি দিয়ে ছোঁয়ার পাশে শুয়ে ছোঁয়ার এক হাত নিজের বুকে চেপে ধরে বলে “এতো বালা পাগলী কেনো রে তুই মধুবালা।”
“উঁহু, আমি শুধু বালা পাগলী নয়। সত্যি হলো আমি এই বালার প্রতি যতটা দূর্বল তার থেকে হাজার গুন বেশি দূর্বল তোমার প্রতি। আমি কখনো প্রকাশ করিনি এটা কারণ আমি ভাবতাম তুমি আমায় পছন্দ করোনা, যদি তুমি আমার দূর্বলতার কথা জেনে আমাকে আ’ঘা’ত করো সেটা ভেবেই আমি শুধু বালার পেঁছনে ছুটতাম কারণ তোমাকে পেলে বালা আমার আর বালা পেলেও তুমি আমার, সম্পূর্ণ আমার।

একটু নয় অনেক বেশিই ভালোবাসি তোমায় শুভ্র ভাই।”
“দে বালা গুলো দে বলছি। তুই আবারো ভাই বলছিস। এবার আর ক্ষমা করা হবেনা তোকে। ফেরত দে বলছি আমার বালা।”

মধুবালা পর্ব ২৩

“আচ্ছা আচ্ছা আর কখনো ডাকবোনা ভাই। এবার একবার ডাকো আমায় মধুবালা বলে।”
“মধুবালা তুই আমার, শুধু আমার মধুবালা।”

মধুবালা শেষ পর্ব