মধুবালা পর্ব ২২

মধুবালা পর্ব ২২
ফারজানা আক্তার

আনজুমা খাতুন মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। মা মেয়ে দু’জনেই কাঁদছেন বোবা কান্না। মেয়েকে পেয়ে আনজুমা খাতুন যে মহা খুশি তা সবাই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ধীরে ধীরে সবার সাথেই ফ্রী হয়ে গেলেন সুলতানা মির্জা শুধু বেলাল মির্জা ছাড়া। আলিয়া আর আলিফকেও সবাই খুব আদর স্নেহ করলো। বাড়ির ছোটরা সবাই অবাক। যেনো এক ঘোরের মধ্যে আছে তারা। লিলি ছোঁয়া শুভ্র হঠাৎ একসাথে বলে উঠলো “আমাদের ফুফি আছেন অথচ কেউ আমাদেরকে এই বিষয়ে বলা প্রয়োজন মনে করেনি কখনো, কেনো?”

আনজুমা খাতুন কিছু না ভেবেই বলে উঠলেন “সব তোর বাবার জন্য হয়েছে। তোর বাবা চাইনি এই ঘরে আমার মেয়ের নাম কেউ উচ্চারণ করুক তাই। বড় ছেলে কিনা তোর বাবা এই ঘরের তাই তোর বাবার কথা-ই তো চলে বেশি।”
“তাহলে তো আমি এই বংশের একমাত্র বংশধর এই মুহুর্তে তাহলে আমার কথাও সবার শোনা উচিৎ। ”
“আরে দাদুভাই তোর আবার কি কথা। যাকে চেয়েছিস তাকে তো দিয়েই দিলাম তোর হাতে তুলে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোমরা তুলে না দিলেও আমার মধুবালাকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারতোনা। এই মধুবালার জন্য কতো কী করেছি তা তো শুধু আমিই জানি।

যাইহোক আমি বলতে চাচ্ছিলাম এতোগুলো বছর পর আমরা জানতে পেরেছি আমাদের একটা ফুফি আছেন, ফুফাতো ভাই বোন আছে তাই আমি চাই আমার ফুফিরা আজ থেকে আমাদের সাথেই থাকবেন। আমাদের পরিবার আবারও পূর্ণ হবে এই বাড়ির মেয়ের আগমনে। আমরা এক পরিবার হবো। আমি চাই আমার এই সিদ্ধান্ত কে সবাই সম্মান করুক।”
শেষের কথাটা শুভ্র নিজের বাবা মায়ের দিকে তাকিয়েই বলে।

“যে আমার সাথে কথা বলা তো দূর আমার দিকে একবারও তাকানো প্রয়োজন মনে করেনি তার ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দিবোনা কখনো।”
কথাটা বলেই বেলাল মির্জা নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই শুভ্র বলে উঠে “আপনার মেয়ের বড় ভাই এখনো জীবিত আছে, আমিও দেখবো আমার বোনের বিয়ে কেউ কিভাবে আটকায়।”

বেলাল মির্জা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের রুমে চলে গেলেন।
সুলতানা মির্জা হালকা মুচকি হাসেন। তারপর মাকে জিজ্ঞেস করেন বাবার কথা তখন-ই আনজুমা খাতুন কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ দেন মেয়েকে।

সুলতানা মির্জার কান্না দেখে আলিয়া আর আলিফও ভে’ঙে পরেন খুব।
ছোঁয়া গিয়ে আলিয়াকে জড়িয়ে ধরে। আলিয়া মুচকি হাসে। আলিয়া আলিফ ভীষণ খুশি কারণ ছোট থেকে কোনো আত্মীয় স্বজন তারা দেখেননি চোখে। আলিফের বাবা ছিলেন একজন এতিম আর সুলতানা মির্জার সবাই থেকেও ছিলোনা। আলিফ আলিয়া এতোদিন মনে করতো হয়তো সুলতানা মির্জাও এতিম কিন্তু আজ ওদের ভাবনা টা ভুল প্রমানিত হয়েছে। আলিফের চোখে খুশির জল চিকচিক করছে। সুলতানা মির্জাকে আজকের আগে প্রাণখুলে কাঁদতে বা হাসতে সে দেখেনি তার বয়সে।

দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। সবাই খেতে বসেছে। খাওয়া শুরু করার আগে সুলতানা মির্জা বেলাল মির্জার রুমে গিয়ে ভাইয়ের সাথে সব রাগ অভিমান মিটিয়ে এসেছেন আর সাথে খেতে বসেছেন। আনজুমা খাতুন মনে মনে বলেন “আজ আমার মৃত্যু হলেও আর কোনো আফসোস থাকবেনা আমার।”

খেতে খেতেই সুলতানা মির্জা বলেন “মা আজ আমার খুব ইচ্ছে করছে সেলিনা ভাবীর হাতের পায়েশ খেতে। উনার মতো পায়েশ এই পৃথিবীতে আর কেউই পারেননা বানাতে। কিন্তু সেলিনা ভাবী কোথায়? বেড়াতে গেছেন নাকি কোথাও গেছেন দরকারে? দেখছিনা যে উনাকে।”

সুলতানা মির্জার কথা শেষ হতে না হতেই ছোঁয়া বসা থেকে উঠে নিজের রুমে ছুটে যায়। সুলতানা মির্জা বুঝতে পারেননা বিষয়টা। জায়েদা বেগম ছোঁয়ার পিছু যেতে চাইলে শুভ্র উনাকে আঁটকিয়ে নিজে যায়। শুভ্র যাওয়ার পর বেলাল মির্জা সব খুলে বলেন সুলতানা মির্জাকে। মান্নান মির্জা মাথা নিচু করে বসে আছেন, উনার চোখেও যে জল তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। সোহা নেই, সোহা আর সানিয়া নিজের রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে তারা আগেই খেয়ে নিয়েছিলো। নয়তো সোহাকে সামলাতে লাগতো আরেকজন।

সুলতানা মির্জা কিছু বলছেননা, উনার চোখ বেয়ে আপনা আপনিই জল গড়িয়ে পরছে। আলিফের বাবার সাথে সুলতানা মির্জার সম্পর্কের কথা বাসায় কেউ জানতোনা শুধুমাত্র সেলিনা পারভীন ছাড়া। সেলিনা পারভীন সবাইকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু বেলাল মির্জাকে কেউ বুঝাতে পারেননি সেদিন। সুলতানা মির্জার চোখে ভাসছে যেদিন তিনি ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন সেদিনও সেলিনা পারভীন উনাকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। আজ পর্যন্ত কেউ এই কথা জানেনা সুলতানা মির্জা ছাড়া। এমন মানুষকে এভাবে হারিয়ে ফেলবেন জীবন থেকে তা বিশ্বাস হচ্ছে না সুলতানা মির্জার।

“এই মধুবালা থাম নাহ এবার, আর কত কাঁদবি? দেখ এবার কিন্তু রেগে যাচ্ছি আমি।
তুই কী শুনবিনা আমার কথা? তোর চোখে জল সহ্য হয়না আমার জানিসনা তুই?”
“প্লিজ শুভ্র ভাই একটু একা থাকতে দাও কিছু সময় আমায়।”

“আবার ভাই বললি তুই আমায়। এবার আর ছাড়বোনা তোকে। কাঁচা চিবিয়ে খাবো।”
“আমি কিন্তু আমার আব্বুদের বলে বিয়ে ভে’ঙে দিবো। আমার কিন্তু এখন দুটো আব্বু আছে।”
হেঁচকি তুলে নাক টানতে টানতে কথাটি বলে ছোঁয়া।”
শুভ্র হেঁসে ফেলে তারপর বলে “ওলে আমাল বাবুসোনা ড্রামাকুইন। চল ছাঁদে যাবো।”

“এই ভরদুপুরে?”
“হুম চল।”
ছোঁয়া বসা থেকে উঠেনা। শুভ্র একটা রুমাল ভিজিয়ে এনে ছোঁয়ার মুখটা ভালো করে মুছে দেয়। ছোঁয়া কিছু বলেনা। শুভ্র কয়েকবার বললো ছাঁদে যাওয়ার কথা কিন্তু ছোঁয়া শুনলোনা। হঠাৎ করেই খুব মন খারাপ হয়ে যায় ছোঁয়ার। সেলিনা পারভীনকে মনে পরে ভীষণ।

শুভ্র আর কিছু না বলে ছোঁয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। ছোঁয়া খাটে আধশোয়া হয়ে বসে ছিলো। শুভ্র ছোঁয়ার কোলে মাথা রাখতেই ছোঁয়া ওর চুলে বিলি কাটতে থাকে। এভাবে অনেকক্ষণ থাকার পর দু’জনেই ঘুমে তলিয়ে যায়। সুলতানা মির্জা আর বাড়ির বড় রা সবাই এসে দেখে শুভ্র ছোঁয়ার কোলে মাথা রেখেই ঘুম আর ছোঁয়া আধশোয়া হয়ে বসে ঘুমিয়ে গেছে। তাই সবাই বেরিয়ে যায়। শুভ্র যে ছোঁয়াকে সামলাতে পেরেছে এটাই অনেক সবার জন্য।

“ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে তুমি আমার মামাতো বউ হলে তবে। এবার তো আর স্যার ডাকা চলবেনা ম্যাডাম।”
“জানেন স্যার আমার যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না। এভাবে সব ঠিকটাক হয়ে যাবে। আর আপনার মা আমার ফুফি হবে, সব যেনো ঘোরের মধ্যে যাচ্ছে। ”
“আবারও স্যার বললে কিন্তু। ”

“আহ্ রেগে যাচ্ছেন কেনো? ভালোই লাগে স্যার ডাকতে। আমাদের বিয়ের তিন বছর পর যদি আমাদের একটা ফুটফুটে কিউট বেবি হয় তার নাম ধরে ওমুকের আব্বু তমুকের আব্বু ডাকবো, কেমন?”
আলিফ কুটকুট করে হেঁসে ফেলে লিলির কথায়।হাসতে হাসতেই আলিফ বলে “তিন বছর কেনো? অমুকের আব্বু তমুকের আব্বু ডাক শোনার জন্য এতো বছর অপেক্ষা করতে পারবোনা ম্যাডাম আমি। আমাদের বিয়ের এক বছরের মধ্যে আমার বেবি পৃথিবীর আলো দেখবে দেখে নিও।”

“ইস্ বললেই হলো নাকি। আচ্ছা আমাদের বিয়ের আর মাত্র আছে ৩দিন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই তিনদিন আমার জন্য তিন বছরের সমান।
ভালোবাসা এমন কেনো বলেন তো।”
“জানিনা। শুধু জানি ভালোবাসি ভীষণ। ”

ছোঁয়ার ঘুম ভা’ঙে সন্ধ্যায়। ঘুম থেকে জেগে ছোঁয়া নিজেকে বিছানায় শোয়া আবিষ্কার করলো অথচ ছোঁয়ার মনে আছে সে আধশোয়া হয়েই ঘুমিয়েছিলো। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে শুভ্র কোথাও নেই। বেলকনির দিকে চোখ যেতেই দেখে বাহিরে অন্ধকার হয়ে এসেছে, চট করে দ্রুত উঠে বসে ছোঁয়া। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে ছোঁয়া হলরুমের দিকে পা বাড়ায়।
পুরো ঘর সাজানোর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছি দেখে ছোঁয়া অবাক।

শুভ্র একপাশে বসে হিসেব করছে। ছোঁয়া রান্না ঘরের দিকে পা দিতেই জায়েদা বেগম এসে ওর হাতে কফির মগ দিয়ে বলেন “সকাল থেকে অনেক কাজ হয়ে গিয়েছে এখন আর রান্নঘরের কাছেও যেনো না দেখি। দুইদিন পর বিয়ে, ত্বকের যত্ন নে।”

ছোঁয়া মুচকি হাসে। জায়েদা বেগম এখন ছোঁয়াকে তুই করে বলেন আগে তুমি বলতো। ছোঁয়ার বেশ ভালো লাগে। জায়েদা বেগমের মাঝে সেলিনা পারভীন কে খুঁজে পাই ছোঁয়া।
ছোঁয়া কফিতে চুমুক দিতে দিতে শুভ্রর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। শুভ্র ছোঁয়ার উপস্থিতি টের পেয়ে হালকা কেঁশে বলে “তাহলে অবশেষে ম্যাডামের ঘুম ভা’ঙ’লো। তা নিজে খাচ্ছো আর আমারটা কই কফি?”

“এমা তুমি কিছু খাওনি বুঝি এতোসময়?”
“একটু আগেই ঘুম ভা’ঙ’লো। আর উঠে আসতেই কাজে লাগিয়ে দিলো।”
“আচ্ছা এই নাও আমরটা খাও কফি, আমি কিছু নাস্তার ব্যবস্থা করছি।”

মধুবালা পর্ব ২১

ছোঁয়া শুভ্রর হাতে কফি দিয়ে যেতে নিতেই শুভ্র ছোঁয়ার হাত টেনে ধরে কানে কানে ফিসফিস করে বলে “খিদে লেগেছে যে অন্যকিছুর মধুবালা। তুই কেনো বুঝেও না বুঝার মতো হয়ে থাকিস? বুকটা জুড়ে যে ভীষণ পিঁপাসা।”

মধুবালা পর্ব ২৩