অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৯

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৯
তাশরিন মোহেরা

মুখর সাহেব ইশারা করে তার মুখের দিকে হাত নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
‘ব্রাশ করছেন?’
তার নড়তে থাকা ঠোঁট দেখে বুঝলাম সে কি বলছে। এরপরই নিজের অবস্থা বোধগম্য হলো আমার। সাথে সাথেই লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলাম। মাথায় হাত দিয়ে দেখি ওড়নাটা মাথায় আছে কিনা! নাহ, ওড়নাটা মাথায় দিয়েই এসেছিলাম! সাথে সাথে রুমে গিয়ে ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম চটজলদি।

মুখর হুট করে আমার বাসায় এসে পড়লো কেন? কাল তো খুব ভাব করে আমার পুরো কথা না শুনেই ফোনটা কেটে দিলো। আজ কি হলো তার?
মুখে অনেক কিছুই বলছি তবে মনে মনে আমি খুব খুশি। আলমিরা থেকে জামা বের করলাম। সে প্রথমবার বাসায় এসেছে বলে কথা! নতুন একটা জামা না পড়লে হয় নাকি!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাই সাদার মধ্যে হলুদ ফুলের একটা থ্রি-পিস পড়লাম, গায়ে কাপড়টার হলুদ ওড়নাটা ভালোমতো জড়িয়ে নিলাম। মাথায়ও টেনেছি হালকা! মুখর সাহেবের সামনে যতবারই গিয়েছি, মাথায় আমার হিজাব ছিল বলে মাথায় ওড়না না টেনে যেতে ইচ্ছে হলো না।

ফিটফাট হয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখি মুখর আব্বার ঠিক মুখোমুখি বসে আছে। ছেলেটার সাহস আছে বলতে হয়! আর আব্বা তার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছেন। বেশ তীক্ষ্ণভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন বোঝাই যায়! আমাকে দেখে মুখর অমায়িক হাসলো। আর সেই হাসিতেই কুপোকাত হয়ে গেলাম আমি! মনে মনে হাজারো প্রজাপতি উড়াউড়ি করছে। কেননা কিছুক্ষণ আগ অবধিও আমি ভেবেছি মুখরের সাথে আমার বোধহয় আর কখনো দেখা-ই হবে না! কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল!

মুখর দু’প্যাকেট মিষ্টি এনেছে। ভাবছি আব্বা কিনা মিষ্টি দেখেও খুশি হননি? আব্বার তো মিষ্টি খুবই পছন্দের। আব্বার দিকে তাকাতেই দেখলাম তিনিও আমার দিকে রাগান্বিত চোখে চেয়ে আছেন। বেশ খানিকক্ষণ এমন চোখাচোখি চললো। বুঝতে পারলাম না এ মুহুর্তে আমার কিছু বলাটা আদৌও মানানসই হবে কিনা! এ রেষারেষিতেই দেখলাম মুখর গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো,

‘আসলে আঙ্কেল, আমার ছোট ভাই, ইয়ে মানে মিস.তিথিয়ার ছাত্র মুগ্ধের ঠিক এক মাস পরেই বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে। তাই বলছি, মিস.তিথিয়া যদি মুগ্ধকে এই একটা মাস পড়ায় তবে বেশ ভালো হতো আরকি!’
মুখরের কথা শুনে আশাহত হলাম। আমি কিনা মন মাঝে ভেবে চলেছি মুখর আমায় একপলক দেখার আশায় বাসা এসে পড়েছে সাতসকালে। কিন্তু এখন যেন কাহিনী সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। সে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকেই আব্বার কাছ থেকে আমার বাইরে যাওয়ার অনুমতি নিতে এসেছে।

এদিকে আমি হাত কচলেই যাচ্ছি! আব্বার ভাবভঙ্গি দেখার সাহস আমার নেই। আব্বা হয়তো ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন যে তার সামনে বসা ব্যক্তিটিই মুখর শিকদার। সেই মুখর শিকদার যাকে ভালোবাসার কথা আমি আব্বাকে জানিয়েছিলাম। আর তখনই আব্বা আমার গালে কষে এক চড় লাগিয়েছিলেন।
আব্বা হালকা কেশে বললো,

‘তোমাকে আমার কিছু বলার নেই। যা বলার আমি আমার মেয়েকে বলেছি! আর এটাই শেষ কথা।’
আমি ক্ষীণ স্বরে আব্বাকে বললাম,
‘আব্বা, মুগ্ধের যে পরী…’
আব্বা আমার দিকে কড়া দৃষ্টিতে চাইলেন। যেন এক্ষুণি গিলে খাবেন আমায়! মনটা সাথে সাথেই মিইয়ে গেল। আব্বা এমন কেন করছেন আমার সাথে? ছলছল চোখে মুখরের দিকে আড়চোখে চাইলাম। তার চোখমুখের ভাব স্পষ্ট নয়। সে কিছুক্ষণ ভাবুক হয়ে আব্বাকে বললো,

‘তার মানে আপনি বলছেন মিস.তিথিয়াকে আপনি বের হতে দেবেন না কিছুতেই, তাই তো?’
আব্বা হাত ভাঁজ করে বসে আছেন চোয়াল শক্ত করে। তিনি যে মারাত্মক রেগেছেন তা চোখ দেখেই বুঝতে পারছি আমি! মনে মনে বললাম, ‘অযথা চেষ্টা করে লাভ নেই, মুখর সাহেব। আব্বা মানবেন না!’

মুখর আমাকে তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে চোখ বুজে আশ্বস্ত করলো। কিন্তু এই আশ্বাসে আমার মন মানলো না! আব্বা কিছুতেই রাজি হবেন না! মুখর সাহেব এমন সময় কাকে যেন ফোন করলো। আমি আহত দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছি! মুখর-মুগ্ধের সাথে পথচলা বোধহয় এখানেই শেষ আমার!

ওপাশ হতে ফোন রিসিভ হতেই মুখর আব্বার দিকে আড়চোখে চেয়ে বললো,
‘হ্যালো, মা! হ্যাঁ, হ্যাঁ! ভেতরে এসো!’
আমি অবাক হলাম অনেক। মুখর ‘মা’ বলছে মানে আন্টিকে ফোন করেছে সে? আর আন্টিকে ভেতরেই বা আসতে বলছে কেন?
মস্তিষ্কে জট পাঁকতে নিলেই দরজা ঠেলে ভেতরে এলো আন্টি আর মুগ্ধ। মুগ্ধ আমাকে দেখেই দৌঁড়ে ঝাপটে ধরলো আমায়। আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ম্যাম, আপনি কি আর আসবেন না আমাকে পড়াতে? আমি আপনি ছাড়া আর কারো কাছেই পড়বো না কিন্তু!’
আমার কি অবাক হওয়া উচিৎ তা ভেবে পেলাম না। তবে মনে মনে ভীষণ গর্ববোধ হলো। আন্টিকে দেখেই মাথা নেড়ে সালাম জানালাম। বিস্মিত চোখে মুখরের দিকে দেখলাম। সে মুচকি হাসছে! ছেলেটা কি গোল পাঁকাচ্ছে আসলে? তার মুচকি হাসিটা ভীষণ সন্দেহজনক!

আন্টি হুট করে আব্বার পাশে এসে বসলেন। এরপর অভিযোগ করে বললেন,
‘আরে, জহির ভাই! আমাকে তো একদম ভুলেই গেলেন দেখছি!’
আব্বা আন্টি দেখে হঠাৎ চমকে উঠলো। এরপর একগাল হেসে আন্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
‘আমেনা, তুই? কেমন আছিস রে?’
আন্টি এবার বললো,

‘আল্লাহ ভালো রেখেছে, আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো আছি! আপনাকে দেখেও খুব একটা খারাপ আছেন বলে মনে হয় না, হাহা!’
আন্টি এবার মুখর আর মুগ্ধের দিকে চেয়ে বললো,
‘এই যে আমার দুই ছেলে, মুখর আর মুগ্ধ! মুখরকে শেষ যখন দেখেছিলেন, সে বেশ ছোট ছিল!’
আব্বা আন্টির সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠলো,
‘আচ্ছা! বাহ, তোর ছেলেটা তো দেখি বেশ বড় হয়ে গেছে।’

আন্টি উঠে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘এটা তো আপনারই মেয়ে, তাই না জহির ভাই?’
আমি এতোটা সময় হতবুদ্ধির মতো সবটা গিলেছি! আব্বা আর আন্টির কথোপকথনের মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝিনি। বিস্ময়ের শেষ চূড়ায় পৌঁছে অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম হয়েছে আমার! আন্টির দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকাতেই তিনি হেসে উঠলেন। আমার থুতনিতে তার হাত ছুঁইয়ে আদরমাখা কণ্ঠে বললেন,

‘তিথিয়া মা তো কিছুই বুঝছে না।’
আব্বার দিকে দেখলাম, তিনি কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। খানিক আগের সেই বিধ্বংসী রূপ ধারণ করা মানুষটা মুহুর্তেই ভেজা বেড়াল হয়ে গেল, খুব ভাবালো আমায়!
আন্টি আমাকে হাত ধরে সোফায় বসালেন। সবটা বিস্তারিত খুলে বললেন।

আব্বা আর আন্টি ছোটবেলা থেকেই ঢাকায় একসাথে বড় হয়েছেন। আন্টির একজন অভিভাবক হিসেবে সর্বদা তার পাশে থেকেছিলেন আমার আব্বা। তবে দীর্ঘ বিশ বছর একত্রে পথ চলার মাঝপথে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু কারণে দু’পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেখান থেকেই তাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। আন্টি আন্টির পথে আর আব্বা আব্বার পথ একাই চলেছেন তখন থেকে। আর আজ মুখরের মাধ্যমেই তাদের পুণর্মিলন হয়।

কথার মাঝপথে আন্টি হঠাৎ বেশ আবেগী হয়ে পড়েন। টলমল করা চোখ দুটো বারবার মুছে যাচ্ছিলেন তিনি। আব্বাকেও অনেকটা নড়বড়ে দেখালো!
সাথে আমার মস্তিষ্কও সচল হয়ে উঠলো। মনে হাজারটা প্রশ্ন ভীড় করতে লাগলো। সেই প্রশ্নের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়ার আগেই সুমি ট্রে হাতে নাস্তা দিয়ে গেল টেবিলে।

এই যা! চমকের পিঠে চমক পেতে পেতে আন্টিদের নাস্তা দেওয়ার কথা-ই বেমালুম ভুলে গেলাম আমি। ইশারায় সুমিকে হালকা ধন্যবাদ জানালাম। মেয়েটা না থাকলে কি লজ্জায় না পড়তাম আজ!
অনেক বলে কয়েও আন্টিদের বেশিক্ষণ বসাতে পারলাম না। আরো কিছুক্ষণ থাকলে ভালো একটা সময় কাটতো আমার! আন্টি আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসে বলেন,

‘আব্বার কথা ভেবো না। কাল থেকে আমার ছেলেটাকে পড়াতে এসো প্রতিদিন, কেমন? সে যে তুমি ছাড়া আর কারো কাছেই পড়তে চায় না।’
আমি মুচকি হাসলাম। আন্টি আব্বার সাথে আরো মিনিট খানেক কথা বললেন। সেই সুযোগে মুখর আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। তাকে পাশে দাঁড়াতে দেখে ফিসফিস করলাম,

‘ভালোই তো সারপ্রাইজ দিলেন, মুখর সাহেব!’
মুখর ঠোঁট টিপে বললো,
‘সারপ্রাইজান্বিত হওয়ার জন্য আমি ধন্য।’
মুখরের এমন অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করা দেখে হাসি পেল ভীষণ। মুখর এবার দ্বিগুণ ফিসফিসিয়ে বললো,
‘কাল আরো অনেক সারপ্রাইজ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে, মিস.তিথিয়া!’
এই বলে সে সামনে চেয়ে রইলো। আমি কণ্ঠে খাদ নামিয়ে বললাম,

‘কি সারপ্রাইজ?’
মুখর রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বললো,
‘সারপ্রাইজ কি তা বলে দিলে সারপ্রাইজড হবেন কি করে, বলুন তো, মিস.তিথিয়া? অপেক্ষা করুন। অপেক্ষার ফল বেশ মিষ্টি হয়!’

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৮

এই বলে সে আড়চোখে আমার দিকে চেয়ে আরো একবার বাঁকা হাসলো। আন্টির পিছুপিছু গিয়ে দরজা ছাড়লো। এবারো ছেলেটা আমার ঘুম হারাম করে দেওয়ার মতো একটা কথা বলে চলে গেল! আমার মন নিয়ে খেলতে তার এতো ভালো লাগে কেন? মনে মনে যাতাকলে পিষে ফেললাম মুখরকে আমি! এরপরই সর্বাঙ্গে শিউরে উঠলো এই ভেবে যে কালকের সারপ্রাইজটা আসলে কি হতে পারে?

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩০