অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৮

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৮
তাশরিন মোহেরা

‘কাল থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ তোর! মনে রাখিস!’
আব্বার এ প্রশ্নে ভীষণ চমকে উঠলাম আমি। বাইশ বৎসরের এক যুবতী মেয়েকে কিনা ইনি বলছেন বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ! এমনিতেই ক্লান্তিতে শরীরটা নুইয়ে এসেছে, তার উপর মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার মতো একটা কথা বলে দিলেন আব্বা। রাগে ফেটে পড়ে বললাম,

‘আপনার কি বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে, আব্বা? এসব কি আবোল তাবোল বলছেন? পাগল হয়ে গেছেন আপনি?’
আমার কথায় আব্বা দ্বিগুণ ফেটে পড়ে বললেন,
‘হ্যাঁ, আমি তো পাগলই! বুদ্ধিসুদ্ধি শুধু তোর আর তোর মায়েরই আছে। তাই তো তোর মা আমার মতো পাগলকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আর তুই? তুইও তোর মায়ের পথে চলছিস, তাই না? তাই তো, এখন রাত বিরেতে ঘরে ফেরা হয় তোর! একা মানুষটার প্রতি কোনো খেয়ালই নেই তোর। পাগল বলেই আজ এসব করছিস!’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আব্বার কথায় হঠাৎ ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলাম আমি। যা আমি কখনো ভেবেই দেখিনি আব্বা তা নিয়ে আমায় কথা শোনাচ্ছেন। হ্যাঁ, মাঝে মধ্যেই আমার আব্বার কাছ থেকে পালিয়ে যেতে মন চায়। কিন্তু কখনোই তো পালায়নি তাই না? সবসময়ই একটা পিছুটান কাজ করেছে আব্বার জন্যে! তারপরও আব্বা এমন কথা কি করে বললেন?

আব্বা বকবক করতে করতে আমার রুম ছাড়লেন। নিজের রুমে আজ বেশ খানিকক্ষণই বকবক করবেন তিনি। আমি দরজার কাছেই বসে পড়ি। আব্বার কাছে এমন খারাপ কবে হলাম আমি? কিই বা এমন করলাম যার কারণে লোকটা আমায় এভাবে কথা শোনাচ্ছে? মুখরকে ভালোবেসেছি বলে, আব্বার পরে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে তাকে ঠাঁই দিয়েছি বলে আব্বা আমায় এতো কিছু বললেন? এই হিংসে নিয়ে আব্বা বাঁচবেন কি করে দুনিয়ায়? আমিই বা পাগলের মতো কি করে ভাবছি মুখরকে নিজের জীবনসঙ্গী বানানোর?

কান্নার মাঝপথে ফোনটা হঠাৎ শব্দ করে বেজে উঠলো। ফোনের রিংটোনে বাজছে মুগ্ধের কচি আওয়াজ! সে আদো আদো কণ্ঠে বলছে ‘আতা গাছে তোতাপাখি’ কবিতাটি। চার বছর বয়সে মুগ্ধের কবিতা বলাটা রেকর্ড করে রাখে মুখর। আমার রেকর্ডিংটা খুবই পছন্দ হওয়ায় মুখরের কাছ থেকে তা নিয়ে রিংটোনে লাগিয়ে দেই।

কান্নার মাঝেও মুগ্ধের আদুরে সুরটা শুনে আমার কিছুটা হাসি পেয়ে গেল। ফোনটা বিছানার উপর থেকে তুলতেই দেখি মুখর ফোন দিয়েছে। ভেজা চোখে স্ত্রিনটা ঝাপসা লাগছে। তাই ভুল দেখেছি কি না তা নিশ্চিত হতে চোখের পানিগুলো মুছে নিলাম। ভালো করে তাকাতেই দেখলাম আসলেই মুখর ফোন দিয়েছে। মুখরের কথা-ই মনে মনে ভাবছিলাম বলে, ফোনের স্ত্রিনে মুখরের নামটা ভেসে উঠায় আবারো ডুকরে কান্না পেয়ে গেল আমার।

কিন্তু ফোনটা রিসিভ করলেই কান্নামাখা ভাঙা স্বরটা শুনতে মুখরের মোটেও ভালো লাগবে না। এই ভেবে ঢোক গিলে কান্নাটুকু থামালাম। গলাটা খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নিলাম কিছুটা। পরপর নিজে নিজে ‘হ্যালো, হ্যালো’ বলে দেখলাম গলাটা পরিষ্কার হয়েছে কিনা! মুখরের সাথে কথা বলার এতো আয়োজনের মাঝে রিং আসাটা বন্ধ হয়ে গেল। মিসড কল হয়ে গিয়েছে!

দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। মুখরের সাথে যখন কথাটাই বলা হলো না তখন এতো আয়োজন করেই বা কি হবে? বালিশে মুখ গুঁজে আরেক দফা কান্নাকাটি করার প্রস্তুতি নিতেই দেখলাম আবারো রিং হচ্ছে ফোনে। তড়িৎ ফোন তুলেই দেখলাম মুখর আবারো ফোন করছে! উত্তেজনার বসে সাথে সাথেই ফোন রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে ভরাট কণ্ঠে মুখর বলে উঠলো,

‘হ্যালো, মিস.তিথিয়া?’
আওয়াজটুকু শুনেই আমার মনটা ভরে উঠলো কিছুটা। জর্জরিত ঠোঁটে ক্ষীণ এক হাসি ফুটলো। আমিও প্রত্যুত্তরে তাকে বললাম,
‘হ্যালো, মুখর সাহেব!’

কিন্তু মুহুর্তেই লজ্জায় পড়তে হলো। গলাটা ফাটল ধরে ভীষণ কর্কশ শোনালো। ঠিক কাকের মতোই! যে ভয়টা পাচ্ছিলাম ঠিক তা-ই হতে হলো। ফোনটা সাথে সাথে লজ্জায় চেপে ধরলাম বুকে।
আবারো কানে দিয়ে দেখলাম মুখর বলছে,
‘কি হলো, মিস.তিথিয়া? আপনি ঠিক আছেন? কণ্ঠটা এমন শোনালো কেন?’

আমি চোখ খিঁচে বসে রইলাম চুপচাপ। গলাটা বসেছে ভীষণ! কান্নাও পাচ্ছে হালকা। এ মুহুর্তে কোনো শব্দ বের কর‍তে গেলেই গলাটা বাঁশের মতো শোনাবে। ওপাশেও কিছুক্ষণ নিরবতা চললো। কিছু সময় পর, মুখর বলে উঠলো,
‘আপনি শুনছেন তো, মিস.তিথিয়া? কাল থেকে মুগ্ধকে নিয়মিত পড়াতে আসতে পারবেন। সামনেই তো বার্ষিক পরীক্ষা! কাল থেকে আসবেন, কেমন?’

আমার হঠাৎ কি হলো বুঝলাম না! ডুকরে কেঁদে উঠলাম। কান্নার মাঝেই হেঁচকি তুলে মুখরকে বললাম,
‘মুখর সাহেব, আমাকে আব্বা বাসা থেকে বেরোতে দিচ্ছেন না।’
এই বলে ভ্যাঁ করে আবারো কেঁদে দিলাম। কান্নার ঝাপটায় কথা বেরোচ্ছে না তবুও গুঙিয়ে বললাম। মুখর কোনোরকমে বুঝলো কি বলেছি। সে বেশ অবাক হয়েছে! এরপর বললো,

‘সত্যিই বেরোতে দিচ্ছে না?’
আমি কান্নার মাঝেই বললাম,
‘হ্যাঁ, আমি কি আপনাকে মিথ্যা বলবো?’
মুখর বললো,
‘আচ্ছা, আচ্ছা বুঝেছি! থাক চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

এটুকু বলেই মুখর ফোনটা কেটে দিলো। এভাবে মুখের উপর ফোনটা কেটে দিলো মুখর? কান্নাটাও ঠিকভাবে করা হয়নি আমার! এমন ধারা অপমানটা করতে পারলো মুখর? সব ঠিক হয়ে যাবে না ছাঁই! কি ঠিক হবে? আব্বা আমাকে বেরোতে দেবে না মানে দেবেই না! এটাই তার শেষ কথা! আমাকেও শেষমেশ তিনি মায়ের মতো আটকে রাখবেন। এর মাঝে কি ঠিক হবে?

মুখরের উপর মনে মনে ভীষণ রাগ হলো। রাগের চাপে আরো শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছি! জীবনে কেউ আপন নয়! সবার কাছ থেকে শুনেছি জীবনের সবচেয়ে আপনজন হলেন মা-বাবা। আমার তো মা-ই নেই আর বাবা? বাবা তো থেকেও নেই! কি দূর্ভাগা কপাল নিয়ে জন্মালাম আমি!

সকালবেলা আজ একটু দেরিতে উঠেছি। ভার্সিটি না থাকলে সচারাচর আব্বা-ই আমায় ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। কিন্তু কাল রাতের ঘটনার জন্য তিনি আমায় আজ ডাকলেন না। আজ তো মুগ্ধকে পড়াতেও যেতে পারলাম না। আব্বার কথার অমান্য করলে আমার শাস্তি আরো বাড়বে।

আড়মোড়া ভেঙে আয়নার সামনে নিজেকে দেখলাম। চোখ দুটো ফুলে ডিমের মতো হয়ে গেছে। কি বাজেই না দেখাচ্ছে আমায়! এমন রাতভর শেষ কবে কেঁদেছি মনে নেই! মনটা একটু হালকা লাগছে যদিও। ফোনে টাইম দেখে অবাক হলাম। দশটা বেজে পনেরো মিনিট! এতো দেরিতে উঠেছি আজ? আব্বাকে নাস্তা দেওয়ার সময়ও তো পার হয়ে গেছে। লোকটা তবে ক্ষুধার্ত থেকেছে এতোক্ষণ?
দৌঁড়ে রান্নাঘরে ছুটলাম। দেখলাম সুমি এসে পড়েছে। আব্বা পেপার খুলে রেখে টিভি দেখছেন। সুমি আমাকে দেখে বললো,

‘আফামনি, উঠছেন নি? আপনে বহেন, আমি টেবিলে নাস্তা দিতাছি।’
সুমির কথায় আব্বা আমার দিকে আড়চোখে দেখলেন, আমিও দেখলাম। আব্বার আমাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। অতঃপর সুমির দিকে তাকাতেই সে আমার চাহনি বুঝলো। বললো,
‘আপনার আব্বায় নাস্তা খাইছে। আমি দিছি নাস্তা!’

বুকে পানি পড়লো আমার। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ফ্রেশ হতে ভেতরে গেলাম।
ভাবছি আমি কেনই বা আব্বার জন্য এতো চিন্তা করছি? আব্বা তো ঠিকই আমায় ফেলে নাস্তা খেয়ে ফেলেছেন। এমন কোনো ছুটির দিন নেই যেদিন তিনি আমায় ছাড়া নাস্তা খেয়েছেন। কিন্তু আজ? উল্টো আমার উপর রাগ দেখিয়ে মুখও ফিরিয়ে নিয়েছেন। যাক! কেন শুধু শুধু আমি নিজের আত্মসম্মানটা খোয়াচ্ছি? আর চিন্তা করবো না কখনো আব্বার জন্য! কখনো না!

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৭

ব্রাশ করার এক ফাঁকে খেয়াল করলাম কলিংবেল বাজছে। কয়েকবার বেল বাজার পর আব্বা দরজা খুললেন। এই সময়ে আবার কে এলো? কৌতুহলটা মাথায় চাপতেই ব্রাশ নিয়ে রুমের বাইরে উঁকি দিলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে সাথে সাথেই আঁতকে উঠলাম আমি। অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটাও আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত নাড়িয়ে আমায় ‘হাই’ জানালো। বুকটা লাফিয়ে উঠলো প্রচণ্ড! পেস্টে ভরা মুখেই অস্ফুটে বলে উঠলাম,
‘মুখর সাহেব?’

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৯