অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৭

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৭
তাশরিন মোহেরা

রাস্তায় আমার পাশে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়েছে মাহদী। আর সামনেই এগিয়ে যাচ্ছে তানজীব, রাদিফ আর সরব। কিছুদূর যেতেই তানজীবের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল। মাহদীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে চলে গেল ডানপাশে!
রাস্তায় এখন চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছি আমরা চারজন। সুনশান নিরবতা ভাঙতেই মাহদী হঠাৎ আমায় বলে উঠলো,

‘তিথিয়া, রাইট?’
আমি হালকা হেসে মাথা দুলালাম। সে বললো,
‘তুমি করে বলতে পারি?’
আমি প্রত্যুত্তরে বললাম,
‘হ্যাঁ, অবশ্যই ভাইয়া!’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাহদী আমার বড় হিসেবে তাকে ভাইয়া ডাকাটা স্বাভাবিক। মাহদী এবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘মুখরের সাথে তোমার সম্পর্কটা কতোদিনের?’
আমি একটু ভেবে বললাম,
‘এই যে ধরুন, প্রায় সাত-আট মাস তো হবেই!’

মাহদী খানিকক্ষণ চুপ থাকলো। রাদিফ আর সরব আমাদের সামনেই হাঁটছে। রাদিফ কিছুক্ষণ পর পর পিছু ফিরে আমার দিকে চাইছে বারবার। আমি নিজেকে বারবার বলে যাচ্ছি, এসব নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার! কেননা মুখরের বন্ধুদের পূর্বপরিচিত আমি নই। নতুন কাউকে দেখে তাদের আগ্রহ জন্মানোটা আসলেই স্বাভাবিক ব্যাপার!
হঠাৎই মাহদী বেশ উৎসুক হয়ে উঠলো। মনভোলানো এক হাসি হেসে বললো,

‘আমি কখনো দেখিনি মুখর কোনো মেয়েকে এতোটা প্রায়োরিটি দিচ্ছে!’
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘মানে?’
সেও প্রত্যুত্তরে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘তার মানে মুখরের কাছে তুমি অনেক স্পেশাল। আমাদের স্যার কিন্তু কোনো মেয়েকেই তার পাশ ঘেঁষতে দেয় না এতো সহজে!’

মাহদীর কথা শুনে চমকালাম আমি। সাথে শরীর জুড়ে ছেয়ে গেল অন্যরকম কিছু। মাহদীর দিকে আড়চোখে তাকাতেই দেখলাম সে রাদিফের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে! রাদিফও সরবের কাঁধে হাত দিয়ে ইশারায় হাসলো মনে হলো। কিন্তু আমার মন মেজাজ এখন অন্যদিকে। কানে বাজছে বারবার এটাই, ‘মুখরের কাছে তুমি অনেক স্পেশাল।’

আমিও খেয়াল করেছি আজ, মুখর কথা বলার মাঝে অধিকাংশ সময়েই আমার দিকে আড়চোখে চেয়েছে, হেসেছে! তাকে অনেকদিন পর দেখেছি বলে চোখ সরাতে পারছিলাম না আমি। এতোদিনে মুখরকে দেখার তৃষ্ণাটা তরতর করে বেড়েছে বৈকি! তাই যতবারই মুখর আমার দিকে তাকিয়েছে ঠিক ততবারই তার সাথে চোখাচোখি হয়েছে আমার! তবে ব্যাপারটাকে অতোটা গুরুত্ব দেইনি। নিজে নিজেই কোনো কিছু আশা করাটা বোকামি, তাও মুখরের কাছ থেকে, যা অসম্ভব! কেননা এর আগেও অনেকবার ধোঁকা দিয়েছে এ ছেলে আমায়!

কিন্তু এখন মাহদীর কথা শুনে মনে কিছুটা আশার সঞ্চার হলো। খুশিতে মনটা নেচে উঠলো! মন মাঝারে বললাম, ‘আপনার উদ্দেশ্যটা কি, সাহেব?’
পরক্ষণেই আবার রূপন্তীর কথাটা মাথায় খেলে গেল। রূপন্তীকেও মুখর প্রায়োরিটি দিয়েছে খুব! প্রথমদিকে তো আমি একপ্রকার ভেবেই নিয়েছি যে, এই মেয়ে-ই ছেলেটার প্রেমিকা। তাই মাহদীকে একরাশ অভিমানী সুরে বললাম,

‘আমি কখনোই মুখর সাহেবের কাছে স্পেশাল ছিলাম না। রূপন্তী মেয়েটাকেও তিনি একইভাবে ট্রিট করতেন, হু!’
এ কথায় তড়িৎ ফিরলো তিনজনই। যেন এরা কিংকর্তব্যবিমুঢ় আমায় কথায়! আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে, একে অপরের সাথে ইশারায় কিছু বললো। তারপরই হো হো করে হেসে উঠলো মাহদী আর রাদিফ। সরবও মিটিমিটি হাসছে। আমি তাদের হাসি দেখে বোকা বনে গেলাম মুহূর্তেই। এদের অট্টহাসিতে কেমন অপমান বোধ করলাম। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই রাদিফ হাসি থামিয়ে বললো,

‘আরে! এ তো সবটা নাটক ছিল। রূপন্তীর বাবা যাতে মুখরকে সন্দেহ না করে এজন্যেই মুখর ঐ পেইনফুল মেয়েটাকে সহ্য করেছে!’
কথাটা আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই বারবার বাজলো কানে। কি শুনছি আমি? মুখর নাটক করেছে মানে? রূপন্তীর সাথে অভিনয় করেছে মানে? সত্যি? উত্তেজনায় দেহটা গরম হয়ে উঠেছে। উত্তেজনাটুকু ঢাকতে না পেরে অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে বললাম,
‘সত্যিই?’

আমার চোখ দুটো টলমল করছে খুশিতে। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো খুশির খবর শুনলে বোধহয় এমনি হয়। ঠিক তখনি হঠাৎ নিরবতা নামিয়ে মাহদী বলে উঠে,
‘এই বাবা-মেয়ে খুব জ্বালিয়েছে মুখরকে। ছেলেটা তিলতিল করে গড়ে তুলেছে এরশাদ মুত্তাকীর বিরুদ্ধে হাতিয়ার! আর এজন্য তাকে কতো কি সইতে হয়েছে। আজ অনেকদিন পর তোমার দিকে তাকিয়ে মুখরকে হাসতে দেখলাম, তিথিয়া। সত্যিই খুব খুশি হয়েছি আমরা!’

মাহদীর কথায় আমার মুখরের জন্য বুকটা মুচড়ে উঠলো। ছেলেটা আসলেই নিজেকে শক্ত খোলসে বন্দী করে রেখেছিল এতোদিন। কাউকেই জানতে দেয়নি তার কষ্টের কথা! মানুষটা এমন কেন?

যেতে যেতে অনেক কিছুই বললো মাহদী আমায়। যা আমি কখনোই মুখরের কাছ থেকে জানতে পারতাম না। এই যেমন,
সুলেমান শাহ্ এর সাথে মুখরের কাটানো সব মুহূর্তই মুখরকে আবারো নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। লোকটার সাথে মিশে সে নিজের বাবা হারানোর কষ্টটা দমাতে পেরেছে।

সুলেমান শাহ্ও একসময় এরশাদ মুত্তাকীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। তার একমাত্র মেয়েকে এভাবেই এরশাদ মুত্তাকীর হাতে মরতে দেখেছিলেন তিনি। এ বেদনায় ব্যাথাতুর হয়েই তিনি মুখরের সাথে প্রতিশোধের অনলে জ্বলে উঠেন আবার! মুখরের মাঝে এরশাদ মুত্তাকীর জন্য তীব্র রাগই সুলেমান শাহ্কে প্রেরণা জুগিয়েছে উল্টো! মুখরের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জোরেই এরশাদ মুত্তাকীর দূর্বলতাগুলো খুঁজে পেয়েছিলো এজেন্সির সবাই। আর এই দূর্বলতার একটি হলো তার মেয়ে, রূপন্তী। তাই-ই মুখরকে রূপন্তীর ভালোলাগাটার সুযোগ নিয়ে তার সাথে অভিনয় চালিয়ে যেতে হয়েছে।

আর আমি কিনা ভেবেছি রূপন্তীর সাথে.. ছিঃ ছিঃ! কি ভুলটাই না বুঝলাম ছেলেটাকে আমি! নিজের উপরই ভীষণ রাগ হলো।
চলতে চলতে একসময় বাসার কাছে এসে পড়লাম। বাসার গলিতে ঢুকতে গেলেই ডাক পড়লো আমার। সরব ডেকেছে! আমি তার সামনে এলেই সে আমতা আমতা করতে থাকে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলছে না সে! আমার অবাক লাগলো। এমন গম্ভীর ছেলেটার আমার সাথেই বা কি কথা আছে! অনেকক্ষণ পর সে মাথাটা তুললো। আমায় খানিক ইতস্তত করে বললো,

‘আমি খুবই দুঃখিত, তিথিয়া! সেদিন আপনার পিছু দৌঁড়ানোর জন্য।’
আমি তার কথায় কিছুক্ষণ ভাবলাম। এই ছেলে কি বলছে এসব? কখনই বা সে আমার পিছু দৌঁড়ালো। আমি মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘বুঝতে পারিনি!’

সে আমায় পুরো ঘটনা খুলে বলার পর আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেন। আমি এতোদিন যেটাকে স্বপ্ন বলে চালিয়ে দিয়েছিলাম তা আসলে সত্যি! মুখরের পিছু নেওয়ার জন্য এরশাদ সাহেব একজন গুপ্তচর লাগিয়ে দিয়েছিলো, যাকে মারতেই সরবের সেদিন ঐ চিপা গলিটায় ঢোকা! আর আমি তার পিছু নিতে গিয়ে দিগবিদিক হারিয়ে দৌঁড়াতে থাকলে মুখর আমায় বাঁচায়। অজ্ঞান আমাকে কোলে নিয়ে সে ভার্সিটি দিয়ে আসে।

রূপক ভাইকেও সবটা খুলে বলে মুখর! সেখান থেকেই রূপক ভাইয়ের মুখরকে চেনা! আমি হতভম্ব হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। নিজের স্বপ্ন বলে সবার কথাকেই আমি এড়িয়ে গিয়েছি। কিন্তু তখনি ভাবলাম, মুখর যে আমায় কোলো নিলো, তা নিশ্চয়ই কোনো হিরো-হিরোইনের মতো নেয়নি! কেননা এর আগে মুগ্ধের মুখে মুখরের আমায় কোলে নেওয়ার সংজ্ঞা শুনে অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে আমার!
সরবকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আচ্ছা? মুখর সাহেব আমায় কিভাবে কোলে নিয়েছে?’
সরব, রাদিফ আর মাহদী তিনজনই এ প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে চেয়ে আছে! যেন মহাপাপের কিছু বলে ফেলেছি আমি! সরব আমার দিকে চেয়ে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো,
‘একটা ছেলে একটা মেয়েকে নরমালি কিভাবে কোলে নেয়? এইভাবেই তো?’

সে ইশারায় পাজাকোলে নেওয়ার মতো করেই বোঝালো আমায়। কিন্তু আমার তা বিশ্বাস হলো না! মুখর সাহেব কিছুতেই আমাকে সিনেমার নায়িকাদের মতো কোলে নিতে পারেন না। তিনি নিশ্চয়ই আমাকে সিনেমার ভিলেনদের মতো কোলে তুলেছে! ঠিক যেমনটা মুগ্ধ বলেছিলো!

প্রচুর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে বাড়ি পৌঁছালাম আমি। নিজেকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছি না আসলে মুখর আমাকে ঠিকভাবে কোলে নিয়েছে। এতো ভাবাভাবিতে কাহিল হয়ে পড়লাম। রুমে ব্যাগটা রেখে কোনোমতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি, এমন সময় বাবা দরজা ধাক্কালো। দরজা খুলেই বিরক্ত হয়ে বললাম,

‘সবেমাত্র এলাম, আব্বা! একটু রেস্ট দরকার।’
আব্বার উল্টো রাগ নিয়ে বললো,
‘তুই এখন এসেছিস? ক’টা বাজে?’
ক্লান্ত ঠোঁটটা কোনোরকম নাড়িয়ে বললাম,
‘কাজ ছিলো তো, আব্বা!’

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৬ শেষ অংশ

আব্বা দরজায় সজোরে আঘাত করে ফেটে পড়লো হঠাৎ। চিৎকার করে বললো,
‘কি এমন কাজ ছিল যে তোর এতোক্ষণে বাড়ি ফিরতে হলো, হ্যাঁ? আমায় চিন্তায় রেখে খুব শান্তি পাস তুই, তাই না?’
আব্বার এমন অতিরিক্ত চিন্তা দেখে মেজাজটাই বিগড়ে উঠলো। কিন্তু কিছু বললাম না! কেননা মানুষটাকে এখন কিছু বললেই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আব্বা এবার অনেকটা শান্ত অথচ গম্ভীর স্বরে বললেন,
‘কাল থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ তোর! মনে রাখিস!’

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৮