মধুবালা পর্ব ২১

মধুবালা পর্ব ২১
ফারজানা আক্তার

সুলতানা মির্জা ঘরের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। পুরো শরীর কাঁপছে তার। আলিফ কয়েকবার বলেছিলো আগে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য কিন্তু সুলতানা মির্জা যায়নি। উনার যে ডাক্তার দেখানোর মতো অসুস্থতা হয়নি। এটা যে মনের অসুস্থতা। গেট থেকে কোনোমতে ধরে ধরে ঘরের দরজা পর্যন্ত এনেছে আলিয়া মাকে। আলিয়ার খুব ভালো লাগছে বান্ধবীর সাথেও এই উছিলায় দেখা হয়ে যাবে ভেবে। আলিফ খুব নার্ভাস আজ। প্রথমবার প্রিয়তমার পরিবারের সাথে দেখা করতে এসেছে, বুকের ভেতর অদ্ভুত রকমের অনুভূতি কাজ করছে।

সুলতানা মির্জা বোরকা নিকাব পরে এসেছে। তাই কিছুটা নিশ্চিত আছে যে কেউ তাকে হয়তো চিনবেনা এতোগুলো বছর পর আর। ওর চোখগুলোও বেশ পরিবর্তন হয়েছে এখন বয়সের ছাপে। তবুও বুকটা দুরুদুরু করছে বেশ।
আলিফ একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে কলিং বেল চাপ দেয়।
বাড়ির কাজের মহিলা রহিমের মা এসে দরজা খুলে দিলেন। বাড়ির ভেতরের সৌন্দর্য দেখে আলিফ আলিয়া দুজনেই বেশ অবাক। আলিফ মনে মনে নিশ্চিত হয়ে গেছে এই ঘরের মেয়ে কখনোই তার পরিবার ওর হাতে তুলে দিবেনা। হঠাৎ বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করলো সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সুলতানা মির্জা চোখ বুলিয়ে পুরো ঘর একবার দেখে নেয়। বাড়ির দৃশ্য চেঞ্জ হয়েছে। আগের সেই সাদামাটা বাড়ি আর নেই, বেশ কালার ফুল হয়েছে হলরুম টা।
রহিমের মা চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো মেহমান চলে এসেছে বলে।
ছোঁয়ার সেজু চাচি জায়েদা বেগম নাজমা বেগম সবাই এসে স্বাগতম জানিয়ে তাদেরকে সোফায় এনে বসালো। সুলতানা মির্জা বুকটা এখনো ধুপধাপ করেই চলেছে। চোখদুটো খোঁজে চলেছে মা বাবাকে।

মান্নান মির্জা জীবন মির্জা এসে সুলতানা মির্জার সাথে কৌশলবিনিময় করে বসেছে। আলিফ সবাইকে সালাম দিলো আলিয়াও দিলো। সুলতানা মির্জা এই শীতের মাঝেও ঘামছে। থরথর করে কাঁপছে হাতদুটো। মনে মনে চিন্তা করছে হয়তো মা বাবা আর বেঁচে নেই। পর্দার আঁড়ালে দুই ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো কিন্তু কেউই দেখলোনা।
বেলাল মির্জা আনজুমা খাতুনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। মাকে দেখেই যেনো দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করলো সুলতানা মির্জার কিন্তু নিজের ইচ্ছে টাকে তিনি করব দিলেন। নিজের পরিচয় যে সুলতানা মির্জা দিতে চাইছেনা মনের ভয়ে।

কিন্তু বেলাল মির্জার দিকে চোখ তুলেও তাকানো প্রয়োজন করেনি সুলতানা মির্জা। বহুবছর আগে তার জেদের জন্যই মা বাবাকে ছাড়তে হয়েছিলো যে তাকে। বেলাল মির্জাই আলিফের বাবাকে মানতে নারাজ ছিলেন বলে মা বাবাও মেনে নেয়নি। আজও বড্ড অভিমান জমে আছে বেলাল মির্জার প্রতি সুলতানা মির্জার।
আলিফ আলিয়া তাদেরকেও সালাম করলো। সুলতানা মির্জা মায়ের সাথে কথা বলতে পারছেননা, কেমন জানি গলা ধরে আসছে তার। সবাই অবাক হচ্ছে সুলতানা মির্জার অবস্থা দেখে। আলিফ সরু কন্ঠে সবাইকে বললো তার মায়ের শরীর অসুস্থ কিছুটা।

সাথে সাথেই জায়েদা বেগম লেবুর শর্বত বানিয়ে এনে দিলেন। নিকাবের নিচে গ্লাস ঢুকিয়ে ঢকঢক করে সব খেয়ে নিলেন। কিন্তু জায়েদা বেগম কে চিনতে পারছেননা ঠিকমতো সুলতানা মির্জা। তার চোখ খোঁজে চলেছে সেলিনা পারভীন কে। সেলিনা পারভীনের সাথেই তার ভাব ছিলো বেশি। বান্ধবীর সম্পর্ক যাকে বলে।

সকাল ১১টা বাজলো। শুভ্রর ঘুম ভা’ঙ্গ’লো মাত্র। ঘুম ভা’ঙ্গ’তে’ই সময় দেখে শুভ্রর মাথা খারাপ হয়ে যায়। রাগ হয় ছোঁয়ার উপর। সে কী পারলোনা একবার ডেকে দিতে। শোয়া থেকে উঠে বেশ ক্ষো’ভ নিয়ে শুভ্র ছোঁয়াকে ডাকতে ডাকতে নিচে আসলো। ছোঁয়া রান্না ঘর থেকে শুভ্রর রাগি কন্ঠ শোনে ছুটে আসে। ছোঁয়ার পুরো শরীর ঘামে চুপচুপে হয়ে আছে। শীতের মাঝেও মেয়েটা ঘেমে-নেয়ে একাকার। প্রথমবার এতোকাজ করেছে বলে কথা।

ছোঁয়া শুভ্র দু’জনেই মেহমান দেখে অবাক। ছোঁয়া বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো এভাবে সবার সামনে এসে, আলিফ একটুখানি চেয়ে ছোঁয়ার দিকে চোখ সরিয়ে নেয় আবার ওর থেকে। শুভ্র থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে আছে বলে বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। সুলতানা মির্জা অবাক চোখে দেখছে ওদের দু’জনকে।
আনজুমা খাতুন কিছুটা হেঁসে বলে উঠলো “কি ব্যাপার আমার নাতিটা যে বিয়ের আগেই আমার নাতনিটার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।”

শুভ্র লজ্জা লজ্জা মুখ করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে “ধুর দাদুনি কী বলো এসব তুমি? আসলে একটু কাজ ছিলো আমার।
মধুবালা একটু আমার রুমে আয় তো।”
“যাবোনা, দেখো না তুমি ঘামে ভিজে গেলাম আমি? গোসল করবো।”
“আসবি কিনা সেটা বল।”

“সেটাই তো বললাম, যাবোনা আমি।”
“দেখ বাড়াবাড়ি করিসনা, ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে আমার।”
“তো তোমার কাজ তুমি করো, আমি কী করবো সেখানে।”

শুভ্র আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ছোঁয়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় নিজের রুমে। আনজুমা খাতুন হাসে। উপস্থিত সবাই-ই মুচকি মুচকি হাসে। শুধু আলিফের ভালো লাগেনি ব্যাপারটা, শত হলেও ছোঁয়া আলিফের প্রথম পছন্দ ছিলো।
আনজুমা খাতুন একটু হেঁসে সুলতানা মির্জাকে বলেন আসলে শুভ্র আমার বড় ছেলের ছেলে আর ছোঁয়া আমার মেজু ছেলের মেয়ে। তাদেরও বিয়ে ঠিক হয়েছে, একে অপরকে ভালোবাসে খুব। আর আজ আপনারা এখানে আসতে পেরেছেন তাও ছোঁয়ার জন্য, ওর জেদ ছিলো ওর আর লিলির বিয়ে একসাথেই হতে হবে।”

এসবের মধ্যে জীবন মির্জার মনটা খারাপ হয়ে যায় খুব। কিন্তু কেউ খেয়াল করেনি সেটা জায়েদা বেগম ছাড়া। নিজের মেয়েকে সমাজের সামনে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দিতে না পারা যে কতটা কষ্টের তা জীবন মির্জা ছাড়া আর কেউই অনুভব করতে পারবেনা হয়তো।

“আরে তুমি কী পাগল হলে? সবার সামনে থেকে এভাবে টেনে আনলে কেনো? কী ভাববে এখন লিলির শ্বশুড় বাড়ির লোকজনেরা।”
“কে কি ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। তুই আর নিচে যাবিনা যতক্ষণ নাহ ওরা চলে যায়।”
“কেনো কেনো? এমন কেনো? আমি যাবো, আমি শুনবো সবাই কি কথা বলে।”
“দেখ মধুবালা বাড়াবাড়ি করিসনা।”

“সমস্যা কী তোমার?”
“ওই আলিফ নামের ছেলেটা তোর দিকে কেমন জানি নজরে তাকায়, আমার ভালো লাগেনা।”
“বোকা একটা! আলিফ স্যার লিলির হবু বর। শুধু শুধু সন্দেহ করো। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি গোসল করবো।”
“চল একসাথে গোসল করবো আজ।”
“বলছি যে পাবনায় একটা সিট খালি আছে শুনছিলাম, ভাবছি তোমার ওই সিটটা প্রয়োজন। ”
“তবে রে….

শুভ্র এগিয়ে যেতেই ছোঁয়া এক ছুটে পালাই।
ছোঁয়াকে সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে দৌড়ে নামতে দেখে আনজুমা খাতুন বলেন ” কিরে কি হয়েছে আমার নাতির মধুবালার?”
“উফস্ দাদুনি তোমার নাতির মাথা গেছে পুরোটা। পাবনায় সিট বুকিং করতে যাচ্ছি। ”
নিজের রুমের দিকে ছুটতে ছুটতে ছোঁয়া বলে কথাটি। সবাই কুটকুট করে হেসে উঠে।
একটু পর লিলিকে এনে সবার সামনে বসানো হয়।

শুভ্রও এসে বসে। সুলতানা মির্জার বেশ পছন্দ হয় লিলিকে। কিন্তু বুক কাঁপনির জন্য তিনি কোনো কথায়-ই বলতে পারছেননা। তবুও দুই একটা কথা তো বলতেই হচ্ছে।
ছোঁয়া এসে শুভ্রর পাশে দাঁড়ায়। শুভ্র ছোঁয়ার কানে কানে বলে “তোকে তো কেউ দেখতে আসেনি, তবে কেনো এভাবে সেজেগুজে হাজির হলি তুই? নাকি আমাকে পাগল করার ধান্দা হু?

ভালোই ভালোই বলছি কিন্তু, আমার সামনে এভাবে সেজেগুজে আসবিনা, পুরোটা খেয়ে ফেলবো একদম।”
“ধুর তুমিওনা, সবার সামনেও লজ্জা দাও শুধু। ”
শুভ্র মুচকি হাসে ছোঁয়ার কথায়।
এদিকে লিলি আর আলিফের বিয়ের সব কথাবার্তা ঠিক হয়ে গেলো।

সুলতানা মির্জা হঠাৎ বলে উঠলেন “আপনারা এতো বড়লোক অথচ আমার কিছুই নাই। আমরা মধ্যবিত্ত। আমার স্বামীর পেনশনের টাকা আর আমার ছেলের সামান্য ইনকামেই আমাদের পরিবার টা চলে। বেলাল সাহেবের একমাত্র মেয়ের জন্ম হয়েছে সোনার চামচ মুখে নিয়ে, সে কি পারবে আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে?
আর বেলাল সাহেবের কী কোনো সমস্যা নেই এতো নিচু পরিবারের সাথে তার মেয়ে সম্পর্ক করতে যাচ্ছে? ”

সুলতানা মির্জার কথা শুনে সবাই অবাক। বেলাল মির্জা যে মন থেকে রাজি নেই সেটা সবাই-ই জানে। বেলাল মির্জা একটু গলা খাখারি দিয়ে বলেন “না বেয়াইন আমার কোনো সমস্যা নেই, আমার মেয়ের সুখটাই আমার কাছে সব।”
“বহুবছর আগে নিজের বোনের সুখ টা তো মেনে নিতে পারেননি তবে আজ নিজের মেয়ের বেলায় এমন চমৎকার কিভাবে হলো? বোনের কী কোনো অধিকার ছিলোনা নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার? সুখে থাকার? অথচ নিজের মেয়ের প্রেমকে ঠিকই মেনে নিচ্ছেন মধ্যবিত্ত পরিবার জেনেও। বাহ্ বেলাল মির্জা বাহ্।

মধুবালা পর্ব ২০

মুখের নিকাব তুলে কথাগুলো বলেন সুলতানা মির্জা।
আনজুমা খাতুন সহ পুরো পরিবার যেনো বিস্ময়ের মধ্যে চলে গেছে শুধু বাড়ির ছোট রা ছাড়া। আনজুমা খাতুন একদম সরু কন্ঠে বললেন “আমার ছোট্ট রাজকন্যা টা।”

মধুবালা পর্ব ২২