মধুবালা শেষ পর্ব 

মধুবালা শেষ পর্ব 
ফারজানা আক্তার

কোয়াশা ঘেরা পৃথিবী। কনকনে শীতের আবাশ। পৃথিবী জোড়ে শীতল বাতাস। বেলকনির দরজা খোলা থাকায় হালকা হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে শুভ্রর চোখ ঠোঁট নাক। শিহরিত হচ্ছে পুরো শরীর মৃদু বাতাসে গায়ে লেপ থাকা সত্বেও। ছোঁয়া ইচ্ছে করেই বেলকনির দরজা খুলে রেখে ওয়াশরুমে যায় যাতে করে হাওয়া এসে শুভ্রকে বিরক্ত করে। ছোঁয়ার আফসোস হচ্ছে কেনো একটা জানালা নেই শুভ্রর রুমে।

ছোঁয়া গোসল করে এসে আয়নার সামনে বসে চুল মুছতেছিলো। ড্রেসিং টেবিল টা খাটের একদম পাশে হওয়ায় ছোঁয়া চুলে গামছা দিয়ে ঝাড়ি দিতেই পানির বিন্দুকনা শুভ্রর চোখের পাপড়িতে গিয়ে পরে। টিপটিপ করে চোখ খুলে শুভ্র মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে যেনো এই প্রথম সে ছোঁয়াকে দেখছে। ছোঁয়া লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নেয়। শুভ্র ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে “আজ থেকে আমার প্রতিটি সকাল তুই, আমার প্রতিটি মুহুর্তে নিঃশ্বাস নেওয়ার কারণ তুই, আমার বেঁচে থাকার অমূল্য রতন তুই মধুবলা। লজ্জা পেলে তোকে আরো বেশি করে কাছে পেতে ইচ্ছে করে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছোঁয়া একটা মুচকি হাসি দিয়ে চুল শুকাতে থাকে। নিজেকে বড্ড বেশি ভাগ্যবতী মনে হয় ছোঁয়ার।
“শোন তোর চুল যতই লম্বা হোক না কেনো আমি ছাড়া কোনো পুরুষের সামনে খোলা চুলে যাবিনা বলে দিলাম। আর আজ থেকে কোনো হেয়ার প্যাক দেওয়ার দরকার নেই, যেটুকু আছে চুল তাতেই তোকে স্নিগ্ধ মায়া লাগে।”
ছোঁয়া মুখ ভেং’চি কেটে বলে “ইস্ আমার আম্মুর শখ ছিলো আমার লম্বা চুল। আমার চুল আবারো লম্বা হবে। ছোট চাচিম্মু খুব যত্ন নেয়। দেখিও একদিন আগের থেকেও বেশি লম্বা হবে আমার চুল আর তুমি হিং’সা’ই জ্ব’ল’বে।”
শুভ্র হাসে। ছোঁয়াকে খুশি দেখে শুভ্রর মনটা বেশ ভালো লাগছে। শুভ্র কিছু না বলে হাসতে হাসতে চলে যায় ওয়াশরুমে।

লিলি বসে বসে নিজের রুমের বেলকনিতে কফি খাচ্ছিলো। আলিফ গোসল করে এসে চুল মুছতে মুছতে লিলির কাছে এসে বলে “একাই খেয়ে নিচ্ছো কফি?”
“সরি স্যার, শীত লাগছিলো খুব। আপনি জামাকাপড় পরে তৈরি হয়ে নিন আমি কফি করে আনছি।”
“নাহ কোথাও যাবেনা তুমি। আমি এই কফি-ই খাবো।”
“কিন্তু এটা তো আমি খেয়ে নিয়েছি অর্ধেক।”
“বাচ্চা মেয়ে বুঝবেনা। দাও খিদে লেগেছে।”

লিলি ভয়ে ভয়ে নিজের কফির মগ দিয়ে দিলো আলিফকে। এখনো লিলি আলিফকে কিছু কিছু ভয় পাই, স্যার বলে কথা।
আলিফ কফিতে চুমুক দিয়ে লিলিকে বলে “আচ্ছা ছোঁয়া শুভ্র ভাইকে ভালোবাসে নাকি শুধু বালাজোড়াকে?”
“সত্যি বলবো?”
“মিথ্যা বলার তো কোনো কারণ দেখছিনা।”

“তাহলে সত্যি টাই বলি। আসলে বালাজোড়া হলো বাহানা। ছোঁয়া সেই ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন থেকে পছন্দ করতো শুভ্র ভাইকে কিন্তু আবার ভীষণ ভয়ও পেতো কারণ শুভ্র ভাই তখন থেকেই সবার থেকে বেশি ছোঁয়াকে শাসন করতো। তাই ভয়ে ভালোবাসার কথা গোপন রেখে বালার বাহানায় শুভ্র ভাইয়ের পিছু লেগেছিলো।
সবচেয়ে মজার বিষয় কী জানেন স্যার?

শুভ্র ভাই। হ্যাঁ আমরা কেউই কখনো ধরতে পারিনি যে শুভ্র ভাই ছোঁয়াকে পছন্দ করতো, ভালোবাসতো। শুভ্র ভাই আর ছোঁয়ার সম্পর্ক ছিলো টম এন্ড জেরির মতো। এর মধ্যেই দু’জন দু’জনকে প্রচন্ড রকম ভালোবেসে পেলে যা সবার অজানা থেকে যায়। কিন্তু শুভ্র ভাইয়ের মনের খবর না জানলেও ছোঁয়ার প্রতিটি অনুভূতি শুভ্র ভাইয়ের প্রতি তা সবই আমি জানতাম।

জানেন আমার খালাতো বোন টিয়া শুভ্র ভাই আর ছোঁয়াকে আলাদা করতে চেয়েছিলো কিন্তু পারেনি। কারণ সত্যিকারের ভালোবাসা এমনই হয়। কেউ তাদের আলাদা করতে পারেনা যদি দু’জনের মনের মিল থাকে সীমাহীন।
জানেন স্যার আমার মনে হয় আমিও আপনাকে এতোটা ভালোবাসতে পারিনি যতটা ছোঁয়া আমার শুভ্র ভাইকে বাসে।

ভালোবাসা সত্যিই অনেক সুন্দর সদ্য ফোটা ফুলের মতো, হঠাৎ উঁকি দেওয়া রংধনুর মতো, শীতের সকালের এক মুঠো রোদ্দুরের মতো। ভালোবাসা সুন্দর। ”
“হুম। অবশেষে ছোঁয়ার ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো আর আমাদের ভালোবাসা তো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই পূর্ণতা পেয়ে গেলো। ভালোবাসার এতো শক্তি ভালো না বাসলে বুঝতামই না।
কথা দাও সারাজীবন এই অগোছালো মানুষটাকে আগলে রাখবে। ছেড়ে যাবেনা কখনো। কথা দাও মায়াবতী। ”
“কথা দিলাম দেহে প্রাণ থাকা অব্দি ছেড়ে যাবোনা কখনো।

আপনি শুধু এভাবেই ভালোবাসবেন আমায় স্যার আমার আর কোনো বিলাসিতা চাইনা।”
আলিফ লিলির এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করতে করতে বলে “একদিন তোমায় সব দিবো আমি। একটু কষ্ট করো। তোমার বাপের বাড়ির মতো বড় না হলেও মোটামুটি একটা ঘর ভালোবাসার মহল তোমায় বানিয়ে দিবো আমি।”

দেখতে দেখতে কেটে গেলো একটা বছর। ছোঁয়া ৯মাসের প্রেগন্যান্ট। শুভ্র আজকাল কিছুটা বিরক্ত ছোঁয়ার প্রতি কিন্তু ভালোবাসা কমেনি বিন্দুমাত্র বরং বেড়েছে বহুগুণ।
ছোঁয়া প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে শুভ্রকে একটু বেশি করে জ্বা’লা’য়। মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে বলে আইসক্রিম খাবে কখনো বা বলে ফুচকা খাবে আবার পিৎজা চিকেন পরোটা ইত্যাদি এসব খাওয়ার বাহানা করে।

শুভ্র প্রথম প্রথম ভালোবেসে এসব করলেও ইদানীং বিরক্তি অনুভব করে কারণ শুভ্র বুঝে কিছু কিছু বাহানা ছোঁয়া ইচ্ছে করেই করে তাকে জ্বা’লা’নো’র জন্য। একবার তো ছোঁয়া রাত তিনটাই বাদাম খাওয়ার বাহানা করে, শুভ্র পুরো কিচেনে অনেক খুঁজেও পাইনি বাদাম কিন্তু ছোঁয়া নাছোরবান্দা শুভ্র ওর কয়েকটা বন্ধুকে কল করে পরে এক বন্ধুর বাসায় ছিলো তারপর সেখান থেকে এনে ছোঁয়াকে দেয়। পরে বাদাম খেয়ে ছোঁয়া শান্ত হয়, কিন্তু শুভ্র জানেনা সেদিনও ছোঁয়া ইচ্ছে করেই এমনটা করেছিলো। মনে মনে ছোঁয়া বলেছিলো সেদিন “আরেকটু কষ্ট করো আমার একটামাত্র শুভ্র ভাই, অনেক অপেক্ষা করিয়েছো অনেক কষ্ট দিয়েছো সেক্ষেত্রে এসব তো কিছুইনা। এত্তো এত্তো ভালোবাসি শুভ্র ভাই।”

আজ হঠাৎ মাঝরাতে ছোঁয়ার ব্যাথা উঠে যায়। ডেলিভারি ডেট এর এখনো তিনদিন বাকি। তিনদিন আগেই ছোঁয়ার ব্যাথা উঠাই সে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। শুভ্রকে ডাকার শক্তি সে যেনো পাচ্ছে না। প্রচন্ড ব্যাথায় কেঁদে ফেলে ছোঁয়া। শুভ্র কে ধীর কন্ঠে কয়েকবার ডাকে কিন্তু শুভ্র উঠেনা, শুভ্র ভেবেছে আজও হয়তো কোনো বাহানা ধরবে কিন্তু ছোঁয়া যে অসহ্য ব্যাথায় কাতরাচ্ছে সেটা লক্ষ করেনি শুভ্র।

প্রায় ১০মিনিট পর ছোঁয়া আর সহ্য করতে না পেরে শব্দ করে কেঁদে দেয়। একটু শব্দ হতেই শুভ্র জেগে যায়। শুভ্র জেগেই পাগলের মতো করতে থাকে ছোঁয়ার অবস্থা দেখে। কি করবে না করবে সে বুঝতে পারছেনা। ছোঁয়া শুভ্রর পাগলামো দেখে প্রচন্ড ব্যাথার মধ্যেও মুচকি হেঁসে বলে চাচিম্মু সেজু আম্মু বড় আম্মু সবাইকে ডাকার জন্য।

একটা ফুটফুটে মেয়ে শিশু কোলে নিয়ে অশ্রুচোখে ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বসে আছে শুভ্র। ছোঁয়ার জ্ঞান ফিরতেই শুভ্রকে এভাবে দেখে ছোঁয়া একটা হাসি দেয় চোখ বেয়ে পরে দুই ফোটা নোনাজল। ছোঁয়া চোখ বুলিয়ে দেখলো পুরো ক্যাবিনে কেউ নেই। নরমালে বেবি হয়েছে ছোঁয়ার তবুও একটু সিরিয়াস কেস হওয়ায় ডেলিভারির পর ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিলো। ৩০মিনিট পর ছোঁয়ার জ্ঞান ফিরে।

শুভ্র চুপ হয়ে আছে। ছোঁয়া ভা’ঙা গলায় কাঁপা কাঁপা সুরে বলে “আমাদের মেয়ে বাবু হয়েছে তাইনা?”
“কিভাবে জানলে?”
“ঘ্রাণ পাচ্ছি।”
“আসলেই কী?”
“বোকা একটা। খুব তো আমায় গাঁধি বলতে এখন তো নিজেই গাঁধা প্রমাণ হলে। ডাক্তার সেদিন বলেছিলো মেয়ে হবে মনে নাই তোমার?”

শুভ্র হাসে। আসলেই সে ভুলে গেছে। মেয়ে হওয়ার খুশিতেই সে সব ভুলেছে। প্রথম সন্তান, ছোট ছোট হাত পা, অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হচ্ছে শুভ্রর। শুভ্র চিন্তায় মগ্ন বাচ্চাটা কবে তাকে বাবা বলে ডাকবে। শুভ্র ছোঁয়ার হাতের কাছে মেয়েকে রেখে বলে “দেখো আমার ছোট্ট মধুবালাকে। একদম পরী একটা। আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে আমার নিজেকে।”
ছোঁয়া শুভ্রর কথা শোনে মুচকি হাসে।

৮বছর পর।
ছোঁয়া প্রায়ই ক্লান্ত বালা জোড়া খুঁজতে খুঁজতে কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না। শুভ্র অফিস থেকে এসে ছোঁয়ার মুড অফ দেখে বলে “কি হয়েছে আমার স্নিগ্ধার আম্মুর?”
“আমার বালা জোড়া পাচ্ছিনা। এক ঘন্টা ধরে খুঁজতেছি। পুরো রুম খুঁজে খুঁজে আমি হয়রান।”

এতটুকু কথা বলেই ছোঁয়া কান্না করে দেয় শব্দ করে। শুভ্র ছোঁয়ার কান্না দেখে একটু অবাক হয়। বিয়ের এতোবছর পরেও বালাজোড়ার প্রতি ছোঁয়ার টান প্রবল। কেউ এতোটা বালা পাগলী হতে পারে শুভ্র ভাবতে পারছেনা। শুভ্রও খোঁজে কিন্তু পাচ্ছে না কোথাও।
শুভ্র এবার ক্লান্ত হয়ে বলে “আচ্ছা বাদ দাও, পরে পাবে বালাজোড়া। এখন বলো আমার ছোট্ট মধুবালা আমার স্নিগ্ধা মামনি কোথায়?”

ছোঁয়ার এতক্ষণে মনে পরলো মেয়ের কথা। প্রায়ই এক ঘন্টা ধরে ছোঁয়া বালার চিন্তায় মেয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলো। দু’জনে মিলে পুরো বাড়ি খোঁজে কোথাও পাইনা স্নিগ্ধাকে। ওদের সাথে সাথে বাড়ির সবাই খোঁজে কিন্তু কারো নজরে পরছেনা স্নিগ্ধা। এবার শুভ্র ছোঁয়াকে বলে “আমার স্নিগ্ধা মামনি ছাঁদে যায়নি তো?”
“হ্যাঁ আমার তো মাথায় ছিলোনা। ও তো সুযোগ পেলেই ছাঁদে চলে যায়।”

এটা বলেই দু’জনে ছাঁদের দিকে ছুটে যায়। ছাঁদে গিয়ে দেখে ছাঁদের এককোণে রেলিং ঘেঁষে বসে আছে তাদের ছোট্ট পরীটা। শুভ্র মেয়েকে দেখে শান্তির নিঃশ্বাস নিলেও ছোঁয়ার চোখে অ’গ্নি। কারণ স্নিগ্ধার হাতে ছোঁয়ার বালা জোড়া। ছোঁয়া বুঝতে পেরেছে এবার স্নিগ্ধা বালাজোড়া চু’রি করে এখানে এসে লুকিয়ে আছে।”

মধুবালা পর্ব ২৪

শুভ্র ছোঁয়ার কানে কানে বলে “যার মা চো’র ছিলো সে কি করে ভালো হয় বল তো? এই কারণেই বলতাম সময় হলে পাবি, বয়সের আগে মাতামাতি করিসনা বালাজোড়া নিয়ে। এবার বুঝ ঠেলা। সামলা মেয়েকে। আফসোস আমার ছোট্ট মধুবালার কোনো চাচাতো ভাই নেই কারণ আমার কোনো ভাই নেই, আহা।”
শুভ্রর কথা শোনে ছোঁয়া রাগান্বিত চোখে একবার শুভ্রর দিকে আর একবার মেয়ের দিকে তাকায়। শুভ্র ছোঁয়ার চোখ দেখে মেয়েকে কোলে নিয়ে দেয় এক দৌড়।
ছোঁয়া কুটকুট করে হেসে ফেলে।

সমাপ্তি