বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ২৭

বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ২৭
দিশা মনি

আলো বসে আছে বেলকনিতে। জোনাকি-বর্ণর মৃত্যুর পর এক দিন পেরিয়ে গেছে। গোটা বাড়িতে এখনো শোকের আমেজ বিদ্যমান। আসাদুল করীম, মালেকা বেগম কাল এসেছিলেন। আলো নিজে তাদের খবর দিয়েছিল। আসাদুল করিম চেয়েছিলাম গ্রামে নিয়ে গিয়ে জোনাকিকে কবর দিতে কিন্তু বর্ণর শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্য সেটা আর সম্ভব হয়নি। সুমনা অনুরোধ করে বলেছিল যেন জোনাকিকে বর্ণর পাশেই কবর দেওয়া হয়। এক সন্তানহারা মায়ের আকুল আবেদন ফেলতে পারেননি তিনি।

‘আলো চল আমাদের তো ফিরে যেতে হবে।’
মালেকা বেগমের ডাক শুনে আলো বেলকনি থেকে চলে আসে রুমে। গেস্টরুমটায় ভালোভাবে চোখ বুলিয়ে নেয়। জোনাকির সাথে এতগুলো দিন তো এই গেস্টরুম টাতেই ছিল। সুখে দুঃখে জোনাকিকেই পাশে পেয়েছিল সে। আলোর মনে পড়ে যায় জোনাকির বলা একটা কথা।
জোনাকি একদিন বলেছিল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘মন খারাপ করিস না আলো। দেখবি একদিন তুই এই পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ হবি। সেদিন আমি থাকব কিনা জানি না। কিন্তু তোর সুখ দেখে আমিও সুখী হবো।’
আলোর মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটে ওঠে পুরাতন কথা ভেবে৷ আদৌ কি সে কখনো সুখী হবে? সুখ কি তার কপালে লেখা আছে? আলোর মনে হয় তার জীবনটায় বিবর্ণ আলোকবর্ষ পারি দেওয়া ছাড়া আর কিছু লেখা নেই। এতদিন তবু জোনাকিকে পাশে পেয়ে সাহস ছিল, ভরসা ছিল এখন সেটাও নেই।

আলো মালেকাকে বলে,
‘চলো আম্মু।’
মালেকা আলোকে বুকে টেনে নেয়।
‘সবকিছু কিভাবে এলোমেলো হয়ে গেল তাইনা আলো? সব বুঝি আমারই দো’ষ। সেদিন যদি তোদের এখানে আসতে না দিতাম তাহলে এতকিছু হতোই না। চল এখন আমরা ফিরে যাই।’

মালেকার সাথে আসে। আসাদুল করীম সুমনার সাথে কথা বলছিল।
‘আলোকে এভাবে নিয়ে যাবেন না। ও এখানে থাকুক। এখানে তো আলো পড়াশোনা করছে।’
‘আমরা কোন ভরসায় আলোকে এখানে রেখে যাব?’

‘আমার ভরসায় রেখে যান। আলো জ্যোতির মেয়ে, আমার বোন জ্যোতির। জ্যোতির এক মেয়েকে আমি আগলে রাখতে পারিনি। আলোকে অন্তত আগলে রাখতে চাই। আলোর মধ্যে যে আমি জ্যোতিকে দেখতে পাই।’
‘কিন্তু আমার মেয়েটা এখানে কি পরিচয়ে থাকবে?’

‘আমার মেয়ের পরিচয়ে থাকবে। আলোকে আমি নিজের মেয়ের মতোই রাখব। এতদিন ও আশ্রিতা ছিল, কিন্তু এখন থেকে আমার মেয়ে হয়ে থাকবে। আমি আমার এক ছেলেকে হারিয়েছি। আলো নাহয় এখন থেকে আমার মেয়ে হয়ে থাকবে।’
‘আমি সবকিছু আলোর উপর ছেড়ে দিলাম। আলো যদি এখানে থাকতে চায় থাকুক। আমাদের সাথে যেতে চাইলে চলুক।’

আলো এগিয়ে আসে।
‘আমি এখানে থাকতে চাই আব্বু।’
আসাদুল করীম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মালেকাও অবাক হয়ে যান আলোর কথা শুনে।
‘তাহলে আমরা চলে যাই আলো থাকুক এখানে। ও যদি যেতে না চায় তাহলে জোর করবোনা।’
‘আপনারা কয়েকদিন থেকে যান।’

‘না আমাদের যেতে হবে। বাড়িতে মেয়েটাকে একা রেখে এসেছি, মালেকা চলো।’
মালেকা আলোর দিকে তাকায়। তিনি বোধহয় বুঝতে পারছেন আলো এখানে কেন থাকতে চায়। কাল রাতে আলোর সাথেই ঘুমিয়েছিল মালেকা। আলো বারবার বলছিল,

‘আপু যার জন্য তুই এভাবে চলে গেলি তাদের আমি ছাড়ব না। সবাইকে শাস্তি দেব।’
মালেকা যাওয়ার আগে আলোকে বলে যায়,
‘ নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে কোন কাজ করিস না আলো।’

আলো বিকেলে বাগানে এসে বসেছিল। বাগানে কত রঙ বেরঙের ফুল। আচমকা কারো উপস্থিতি বুঝতে পারে আলো। বুঝতে বেশিক্ষণ সময় নেয় না কে এসেছে।
‘বর্ষ স্যার আপনি!’
‘হ্যা আমি। তুমি ঠিক আছো তো আলো।’
‘একদম ঠিক আছি। নিজেকে সামলে নিয়েছি।’
‘না তুমি ঠিক নেই। আমি কতবার করে বললাম ওদের বিরুদ্ধে মামলা করতে কিন্তু তুমি করলে না। কেন করলে না আলো?’

‘মামলা করে কি কোন লাভ হবে? এই দেশে গরীবেরা কবে সুবিচার পেয়েছে? ওরা ক্ষমতাশালী। টাকা আছে। টাকা দিয়ে বের হয়ে আসবে।’
‘আমারও ক্ষমতা আছে। আমি লড়ব তোমার হয়ে।’
‘তাতেও কোন লাভ হবে না। ওরা ঠিকই একসময় বেরিয়ে আসবে।’
‘তাহলে তুমি কি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে?’
‘হ্যা।’

‘তুমি চুপ করে থাকতে পারো আলো কিন্তু আমি না। আমার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্যেও পরোক্ষভাবে ওরা দায়ী। তাই আমি ওদের ছাড়ব না।’
‘আল্লাহকে বিশ্বাস করেন?’
‘হ্যা করি।’
‘তাহলে বিচারের দায়িত্ব আল্লাহর উপর ছেড়ে দিন।’
বর্ষ আর কিছু বলতে পারে না। আলো রহস্যময় হাসি হাসে।

আলো ভার্সিটিতে এসেছে। আজ অনেকদিন পর ভার্সিটিতে এসেছে সে। তাও আবার বর্ষর গাড়িতে করে। এ বিষয়টায় সবাই বেশ অবাক হয়েছে। রুহি,লতা সবাই জেনে গেছে আলোর সাথে কি হয়েছে। আলোকে দেখে তারা সমবেদনা জানায়। কিন্তু আলো কিছু বলে না।

আলো অন্য ভাবনায় বুদ হয়ে আছে। ক্লাসেও আলো আজ বেশ অমনোযোগী ছিল। আলোর এসব লক্ষণ লতা,রুহি খেয়াল করে। বর্ষও ব্যাপারটা খেয়াল করে।
ক্লাস শেষে আলো একা চুপচাপ বসে ছিল। আলোকে একা বসে থাকতে দেখে রুহি তার পাশে এসে বসে।
‘ঘুরতে যাবে আলো? চলো ঐদিকে আমরা ঘুরতে যাই।’

‘আমি ঘুরতে যাবো। তবে তোমার সাথে না বর্ষ স্যারের সাথে। যাও ওনাকে গিয়ে বলো।’
রুহি দৌড়ে বর্ষকে গিয়ে কথাটা বলে। বর্ষ খুবই চমকিত হয় কথাটা শুনে। আলোর কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি সত্যি আমার সাথে ঘুরতে যেতে চাও আলো?’
‘হ্যা চাই। আপনি আমায় নিয়ে যেতে চান না?’
বর্ষ শুকনো ঢোক গিলে বলে,
‘চলো।’

পুরো রাস্তায় আলো নিশ্চুপ ছিল। বর্ষ আগ বাড়িয়ে কিছু বলে না। আলোকে নিয়ে একটি পার্কে চলে আসে। গাড়ি থেকে নেমে আলো কথা বলে।
‘আমি চলে যেতে চাই। আপনি ভালো থাকবেন স্যার।’
‘এসব কি বলছ কোথায় যাবে তুমি?’
‘জানি না। আমি শুধু জানি আমি যাবো।’

আলো দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বর্ষ তাকে ধরে নেয়। আলোকে কাছে টেনে বলে,
‘আমি তোমাকে যেতে দেবোনা। তোমাকে সবসময় নিজের কাছে রাখতে চাই আলো।’
‘ভালোবাসেন আমায়?’
বর্ষ বুকে সাহসের সঞ্চার করে বলে,
‘হ্যা বাসি।’
‘কবে থেকে?’

‘জানি কখন, কিভাবে, কেন ভালোবেসেছি। শুধু এটুকু জানি ভালোবাসি তোমায়। বর্ণ আর জোনাকিকে আলাদা হতে দেখে আমার বুকে ভয় জমেছে যে আমরাও না আলাদা হয়ে যাই। বিশ্বাস করো আলো খুব ভালোবাসি তোমায়। তোমার থেকে আলাদা হতে হলে আমিও বর্ণর মতো,,,’
আলো বর্ষর মুখ চেপে ধরে।

‘সব গল্পের এক পরিণতি হয় না, সবার জীবন আলাদা। অপূর্ণতা যেমন সত্য তেমন পূর্ণতাও সত্য। আমাদের সম্পর্ক পূর্ণতা পাবে।’
‘কিভাবে আলো?’
‘বিয়ে করবেন আমায়?’
‘আলো,,’
‘করবেন?’
‘হ্যা।’

বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ২৬

‘আপনি সুমনা আন্টির সাথে এই ব্যাপারে কথা বলুন। আমিও আব্বু আম্মুকে বলব। আমিও আপনাকে পছন্দ করি বর্ষ স্যার।’

বিবর্ণ আলোকবর্ষ পর্ব ২৮