মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৭

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৭
আবরার আহমেদ শুভ্র

গোধূলিলগ্নের অন্তিম প্রহর বিরাজমান গগনে! আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে লালাভ আভা। ঝাপসা হয়ে উদিত হয়েছে একফালি হলুদাভ চন্দ্রের! কুয়াশার আড়ালে ঢাকা পড়তে শুরু করেছে বিশালকৃতির দানবীয় দালান গুলো। নিরব প্রকৃতিতে পাখিদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ চারপাশে প্রতিফলিত হচ্ছে সুমধুর মিষ্টারূপে৷ মিষ্টি, সতেজ অনিলের বিচরণ মেদিনীতে জুড়ে! রক্তিম বিকেলের শেষ অংশ অন্তিম হয়ে ধীর পদে নামছে আঁধারের পাল্লা। অন্তরীক্ষে সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করে জানান দিচ্ছে সায়াহ্নের আগমন ঘটবে কিয়ংদশ বাদেই।

নিস্তব্ধ কক্ষ! বাহিরে অবশিষ্ট আলোর ছিটেফোঁটা অব্দিও নেই। নিঃশব্দতা বিচরণ করা সারা কক্ষ জুড়ে। থেমে থেমে কারো গুমোট কান্নার শব্দধ্বনি কর্ণপাত হচ্ছে করুন রূপে হাসপাতালের করিডোর থেকে। কষ্ট আর বুক চিঁড়ে বেড়িয়ে আসা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের পাল্লা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দ্বিগুণ হচ্ছে। ঘন্টা দুয়েক আগে তানজিমের ওটি সম্পন্ন হয়েছে! তাতেও লাভ হলো বলে মনে হলো না ফুয়াদের। ভীতসন্ত্রস্ত আর অসহায়ত্ব বারংবার গ্রাস করছে তার সারা মস্তিষ্ক জুড়ে। একজন ওটি স্পেশালিষ্টের এমন করুন রূপ মোটেও বোধগম্য হলো না ধ্রুবের। বিরক্ত চিত্তে তাকিয়ে রইলো সে ফুয়াদের পানে। নিস্প্রভ আর নিস্প্রাণ হয়ে রয়েছে কঠিন মনের মানুষটি! পাশে গিয়ে কাঁধে হাত রাখলো হালকা করে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–এভাবে ভেঙে পড়লে কি হবে ফুয়াদ? যেখানে তোর নিজেকে শক্ত করা উচিত তুই সেখানেই বারবার নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করছিস? এমন হলে তো কাজের কাজ কিছুই হবে না ভাই? শক্ত করতে হবে নিজেকে। ট্রাস্ট মি, সবকিছু সম্মুখে আসবে!

মলিন হেসে ধ্রুবের দিকে তাকালো সে। পাথরের ন্যায় সে স্তব্ধ এই মুহুর্তে, নিষ্পাপ নেত্রযুগল কাঁপছে ঘনঘন! শুষ্ক অধর জোড়া একবার ভিজিয়ে নিলো সে, জ্বলজ্বল করা আঁখি দু’টো বলে দিচ্ছে সে আজ প্রকৃতির কাছে কতোটা অসহায়।
–আমি কি করবো তুই বল ভাই! এই চঞ্চল মেয়েটির এমন বেহাল অবস্থার জন্য আমিই দায়ী ভাই, আমিই দায়ী।
বলে বাচ্চাদের মতোন কেঁদে উঠলো ফুয়াদ। তার প্রেয়সীর এই অবস্থা তাকে যতোটা না পীড়ন দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি পীড়া দিচ্ছে ফুয়াদকে। নিভু নিভু চোখে ধ্রুবের কাঁধে মাথাটা রাখলো সে। অন্তঃকরণে বার বার মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে তার সাথে।

প্রায় ৫৩ ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো তানজিমের। যেখানে তার জ্ঞান ফেরার কোনো লক্ষণও ডাক্তাররা বলতে পারলো না সেখানে তানজিমের জ্ঞান ফেরাটাকে অবিশ্বাস ঠেকছে ফুয়াদের কাছে। ডাক্তারের ওটির পর সে আবারও করতে চেয়েছিলো কিন্তু পরপর দুটি ওটি তানজিমের জীবনঝুকি থাকবে বলে আর করতে এগোয় নি সে। ডাক্তারের দেয়া পরামর্শই ফলো করেছে তারা। ডাক্তারের দল স্পষ্টত বলেছিলো তানজিমের জ্ঞান নাও ফিরতে পারে। হয়তো সে লংটাইম কোমায় চলে যেতে পারে। হয়তো এতে তার মৃত্যুও নিশ্চিত।

কিন্তু এখন! সবটাই ঘোলাটে লাগছে ফুয়াদের কাছে। অবাক ধ্রুব আর তানিমও। ফুয়াদের মনে চলছে অন্যকিছু। কেবিনে তনয়া আর তানভিনকে বসিয়ে সে দ্রুত ডাক্তারটির চেম্বারে চলে গেলো। পিছনে ধ্রুব আর তানিমও এগিয়ে গেলো। কিন্তু চেম্বারের ভেতর গিয়েই হতবাক সে, সাথে ধ্রুব আর তানিমও! ডাক্তারটির লাশ ঝুলছে সিলিং’র সাথে! থমকে যায় মুহুর্তেই তারা! তানিম উদ্বিগ্ন হয়ে ফুয়াদকে জিজ্ঞেস করেই বসল,

–কি হচ্ছে এসব? আমার তো কিছুই মাথায় আসছে না।
খানিকটা চিন্তিত সুরে ফুয়াদ বলে উঠলো,
–তাহলে আমার ধারণায় ঠিক ছিলো ভাইয়া। সীট ম্যান! এও তাদের লোক ভাইয়া।
ফুয়াদের কথা বেশ অনেকটাই অবাক করলো দুজনকে। সেটা তাদের চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ধ্রুব ফট করে বলে উঠলো,

–কিন্তু সে তো অনেক আগেই মারা গেছে! তাহলে মৃত মানুষ জীবিত হয় কেমন করে ফুয়াদ? কেমন লাগাম বিহীন কথা বলছিস তুই?
ফুয়াদ এবার ধ্রুবের কথার প্রতিত্তোরে শান্ত স্বরে ব’লে,
–মৃত মানুষ অবশ্যই জীবিত হয় না। কিন্তু বহুরূপী তো জীবিত থাকবেই! এম আই রাইট? তুই ফাস্ট ছোট মামার কাছে যা। ওনার জীবন হুমকির মুখে! গো ফাস্ট ধ্রুব।
দ্রুত বেড়িয়ে গেলো ধ্রুব। কিন্তু হ্যাবলার মতোন তাকিয়ে রইলো তানিম, উদ্বিগ্ন হয়ে ফুয়াদকে জিজ্ঞেস করে,

–কিসের কথা বলছিস ফুয়াদ? আর এতে ছোটাচ্ছুর জীবন কেন হুমকির মুখে? ক্লিয়ারলি একটু বলবি প্লীজ?
থমকায় ফুয়াদ, এখন সে কোনো মতেই গোপন কথা সবার সামনে আনতে চাচ্ছে না। কিন্তু তানিম তো বেশ নাছোড়বান্দা, তাকে কি করে বুঝাবে সে? কোনো মতে বলে উঠলো সে,

–ভাইয়া অপরাধী নিশ্চয়ই ধরা পরবে! আর আমি ছোট মামার জীবন হুমকির মুখে বলছি কারণ, তানজুকে প্রায় একটা ছেলে ডিস্টার্ব করতো। আর সে ওই দিন ছেলেটাকে লোক সম্মুখে চড় মেরেছিলো। কি আর বলবে সে? কিছু করতে না পেরে তানজুকে থ্রেট দিয়েছিল সে তার আর ছোট মামার ক্ষতি করবে।

আর ছোট মামা এখন তানজিমের ভার্সিটিতেই গেছে তাদের ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে কথা বলতে! তাই আমার মনে হয় সে হয়তো মামারও বড় কোনো ক্ষতি করে দিতে পারে। এইজন্যই ধ্রুবকে ফাস্ট সেখানে পাঠিয়েছি্। দ্যাটস ইট!
দুপাশে মাথা দুলালো তানিম। মানে সে বুঝতে পারছে ফুয়াদের পুরো ব্যাপারটার সারমর্ম। ফুয়াদও কোনোমতে সেখান থেকে চলে গেলো তানজিমের কেবিনে।

তানজিম আঁখি যুগল খুলে চারপাশে একবার তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো এখন কোথায় আছে সে। পাশে তনয়া আর তানভিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো আর তার পাশের ছোফায় ফুয়াদ এক ধ্যানে তার পানে তাকিয়ে আছে! পরক্ষণেই বুঝতে অসুবিধে হলো না সে এখন কোথায় আসে সেটা। কিছু চিন্তা করতেই কাতর গলায় ‘আহহ্’ করে উঠে সে। সাথে সাথে হতদন্ত হয়ে ফুয়াদ আগলে নেই তাকে। উপস্থিত সকলে অবাক হলো ফুয়াদের এহেন আচরণে! কিন্তু কোনো ভাবান্তর নেই তার।

–তানজু? ঠিক আছিস তুই?
কন্ঠে তার আর্তনাদ স্পষ্ট! তানজিমের আঁখি জোড়া টলমলে। শুষ্ক উষ্ঠধর কাঁপছে ঘনঘন! মুখশ্রী অনেকটা পাংশুটে ভাব ধারণ করেছে ব্যথায়। তবুও মলিম হেসে ফুয়াদের কথায় চোখ জোড়া উপর নিচ করলো সে, মানে সে ব্যথা পাচ্ছে।
–আর একটু সয়ে নে প্লীজ। এখন ড্রেসিং করে দিলে নিশ্চয়ই ব্যথা অনেকটা কমে যাবে।

মুহুর্তে রুমে প্রবেশ করলো তানজিমের বাবা নাবিল আরমান। ফুয়াদ তানজিমকে ছেড়ে একপাশে দাড়ালো। কাছে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ফুফিয়ে কেঁদে উঠলেন নাবিল। কি অবস্থা হয়েছে তার আদুরে মেয়েটার। স্নেহময় কণ্ঠে বলে উঠলেন,
–মা, অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না? এই দেখো না আব্বু এসে গেছি, দেখবা কোনো কষ্ট হবে না। আমি না ব্যর্থ বাবা, মা! ব্যর্থ আমি! একটুখানি নিরাপত্তা দিতে পারলাম না তোমায়। বল মা কে তোর এমন ক্ষতি করতে চেয়েছিলো? বল মা, বল আমায়!

তানজিম কোনোক্রমেই কথা বলতে পারছে না। বলতে চেয়েও পারছে না সে। গলা ভেতর দলা পাকিয়ে যাচ্ছে শব্দগুচ্ছ। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছুই বের করতে পারছে না। ফুয়াদ থামায় নাবিল আরমানকে।
–মামা, আপনি একটু শান্ত হোন। সবে মাত্র জ্ঞান ফিরেছে তানজুর। তাছাড়া ওর ভোকাল কর্ডের ইনজুরি হয়েছে পঁচিশ শতাংশ! তাই সে এখন কথা বলতে পারবে না। এক্ষেত্রে সুস্থ হতে তাকে অন্তত এক দেড়মাস রেস্টে থাকতে হবে। আর আপনি যদি জোড় দেন তাহলে হয়তো ব্যাপারটা হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।

এটুকু বলে থামে সে। থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে কেবিনে। কারো মুখে কোনো কথা নেয়। সকলে যেন নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। শায়লা বেগম মেয়েকে আলতো করে শুইয়ে দিলেন বেডে। পুরো মাথা বেন্ডেজ করা। নিভু নিভু চোখে ফুয়াদের দিকে তাকালো তানজিম। ক্ষনিকের জন্যে কেঁপে উঠল সে। চেহারার লাবণ্যতা বিলীন হয়ে গেছে এই কয়েকদিনে। চুলগুলো উসকো কুশকো হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে। যেন কতকাল ঘুমোয় নি সে? অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলো তানজিমের জ্ঞান ফেরার!

–স্যার, আমি যতটুকু সম্ভব খবর নিয়ে জানতে পারলাম। সে আপনার ভাবা লোকটি নয়। সে আসলেই মৃত!
অবাক হলো ধ্রুব আর ফুয়াদ। উষ্ঠোধর বড় করে ‘চ’ আকৃতির করে উঠলো ফুয়াদের। নীলের দিকে তাকালো ফুয়াদ। চিন্তিত হয়ে বলে উঠলো,

–তাহলে কে সে? নিশ্চয়ই ভুল ইনফরমেশন নিয়ে এসেছো তুমি! আমি এতটুকুই তো শিউর তার মারা স্টাইল ফুরোই একই রকম ছিলো। যেমনটা সে মেজো মামা আর মামিকে খু*ন করেছিলো।
–আমি অনেক চেষ্টা করে এই ইনফরমেশন নিয়েই আপনার কাছে আসলাম স্যার। তবে আজ রাতের মাঝেই ডিটেইলসে সবটা আপনাকে জানিয়ে দেবো স্যার। আসি!
বলে ধপাধপ কদম ফেলে চলে গেলো নীল। সে ধ্রুবের সরকারি। এবার ধ্রুব ফুয়াদের দিকে তাকালো,

–ফুয়াদ তুই জানিস আমি একজন সিআইডি অফিসার। আর সে আমার জানামতে সবচেয়ে ভালো একজন ক্রু সো আর এইসব ক্লো বের করা চারটে খানি কথা নয়। যদিও ইনফরমেশন সঠিক হয় তো এক সাথে তোর মেজো মামা আর মেজো মামির খু*নের বিচারের জন্য ফাঁ*শি হবে তার।
মুহুর্তেই ফুয়াদের অধরের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো,

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৬

–খেলা তো আবি বাকি হ্যাই! এসব চুনোপুঁটিসহ সবাইকে একসাথে মারবো আমি। বাস্টার্ডের দল!

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৮