মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৬

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৬
আবরার আহমেদ শুভ্র

মধ্যরজনীর অন্তিমলগ্ন পেরিয়েছে ক্ষনিক আগেই। মেদিনীতে প্রভাতের আগমন ঘটেছে কিয়ংদশ পূর্বে।কুয়াশাচ্ছন্ন প্রভাত! মাঘ মাসের শেষাংশ চলছে অথচ শীতের প্রকোপ কমার কোনো নাম গন্ধই নেই। বরঞ্চ শীত যেনো হুরহুর করে বেড়েই চলেছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। শৈতপ্রবাহের তান্ডব চলছে উত্তরাঞ্চলে।

যার ফলস্বরূপ, শীতের উপস্থিতি এখনো প্রকৃতিতে রয়ে গেছে বেশ অনেকটাই। শব্দহীন প্রভাতে চট্রগ্রামের ব্যাস্ত সড়কে চলাচলকৃত যানবাহনের শব্দ কর্ণপাতের দরুন ধ্যান ভাঙলো ফুয়াদের। ফুয়াদের দৃষ্টি এতোক্ষণ নিবদ্ধ ছিলো তানজিমের মুখশ্রীর মাঝে! আজ যেন অদ্ভুত মায়া ছড়িয়ে পড়েছে এই মুখশ্রীটিতে। টলটলে চক্ষুজোড়া! গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সে তানজিমকে। গতরাতের কথা মনে পরতেই অস্বস্তি লাগছে তার। কিন্তু তানজিমের দিক থেকে পজেটিভ সাইন পেয়ে নিশ্চিত হলো যে এই, তানজিমও তাকে পছন্দ করে। কিয়ৎ হাসলো সে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তানজিম তার দিকে ফুয়াদকে একচিত্তে তাকিয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তি ফিল করছে। অন্য দিকে তাকালো সে! তার অধরে কিঞ্চিত হাসির রেখা খেলে গেলো। তবুও কোথাও যেন শূন্যতা অনুভব হচ্ছে তার। কিন্তু কেন সে তার টাহর করতে পারলো না মোটেই! কিয়দংশ পরই গাড়ি এসে থামলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টের একটু আগে। আজ ফুয়াদ নিজেই এসেছে তানজিমকে তার ভার্সিটিব্দি পৌঁছে দিতে। কিন্তু তানজিমকে অন্য দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে দেখে ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত হয়ে এলো। বেশ কয়েবার ডাকার পরও কোনো হেলদোল নেই তানজিমের। জোরেশোরে একটা ধমক দিলো ফুয়াদ,

— এই মেয়ে সারাদিন কি গাড়িতে বসে থাকার প্লান করেছিস নাকি আজ? না নেমে এতো কি ভাবছিস? মনে কি লাড্ডু ফুটছে?
চমকালো তানজিম। চক্ষু ছোট ছোট করে তাকালো সে ফুয়াদের দিকে। সাথে অকপটে জবাবও দিলো তানজিম,
— তা হতে যাবে কেন? এসেছেন ভালো কথা একটু নরম কন্ঠে বললে তো হয়! এমন ঝাঁজ নিয়ে বলার কি আছে?
মুখে রক্তিম আভা ফুটে উঠলো ফুয়াদের। তাতেও ভয় কোনো ভাবান্তর হলো না তানজিমের। নিরস কন্ঠে বলে উঠলো,
— কয়েকশো বার ডেকেও কোনো লাভ হয়েছে? সেই আগের ন্যায় বসে আছিস! এখন তর্ক করা থামাবি নাকি সপাটে একটা চড় গিফট দেবো? স্টুপিড!

গাল ফুলিয়ে অন্য পাশে চেয়ে রইল সে। আজব তো এমন করে ধমক দেয়ার কি আছে! একটু অন্যমনস্ক ছিলো বলে এটাই কি তার দোষ? নিজের করা ব্যবহারেও অবাক হলো সে। যে মেয়ে গতকাল অব্দি ফুয়াদের সামনে যেতে অব্দি ভয় পেতো সেই মেয়েই আজ তার প্রতিটি কথায় অকপটে জবাব দিলো! মনে মনে নিজেকে সাব্বাশ জানালো সে। পরক্ষণেই আবারও ঝাঁজালো কন্ঠের ধমক শোনে কিয়ৎ কেঁপে উঠল সে,

— এই মেয়ে আজ কি সব ভাবনা চিন্তার ঢালাপালা নিয়ে বসেছিস? ক্লাসে তো যাবি না মনে হয়! নাকি এখানে বসে অন্যের কাছ থেকে আরও কিছু ভাবনা চিন্তা ভিক্ষা নিবি?
ফুয়াদের দিকে চক্ষু গরম করে তাকালো তানজিম। এতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না ফুয়াদের অবস্থার। দুহাত গুঁজে তানজিমের দিকে তাকিয়ে রইল তার উত্তরের আশায়। কিন্তু ফুয়াদের কথার কোনো উত্তর না দিয়েই নিজের ক্লাসের দিকে ছুটে চলে গেলো সে। সে জানে ফুয়াদের সাথে সে কখনও কথায় পারবে না।

তাই তো নিশ্চুপ বিদায় নিলো উইট আউট এনি পারমিশন। ফুয়াদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তানজিমের গমন পথে। মুহুর্তেই তার মনে প্রশান্তির ছাপ খেলে গেলো। কারণ, তানজিম তার ক্লাসে প্রবেশের আগ-মুহুর্তেই ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো।

কিন্তু ফুয়াদের ভালো লাগলেও সেটা সে কোনমতেই প্রকাশ করলো না উল্টো চেহারায় কাঠিন্য ভাব বজায় রেখে তার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তা দেখে মলিন হলো তানজিমের মুখশ্রী। সে ভেবেছিলো ফুয়াদ হয়তো তার হাসির প্রতুত্তরে হাসি দিবে কিন্তু তার কাঠিন্য মনোভাব দেখে তপ্তশ্বাস ফেলে আপন মনে ক্লাসে প্রবেশ করলো সে। ফুয়াদ দাঁতে দাত চেপে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

— অকপটে যে জবাবগুলো দিয়েছো তার পানিশমেন্ট পেতে বেশিক্ষণ আর অপেক্ষা করতে হবে না তোমার। মিস. কেশবতী! সো, বি রেডি ফর এভরিথিং!’

আজ সারাহ আসে নি ভার্সিটিতে। তাই আজ একাই ক্লাস করতে হয়েছে তাকে বিষন্ন মন নিয়ে। যাকে বলে একদমই নিরামিষ ক্লাস! তানজিম ক্লাস শেষে ভার্সিটির বাইরে এসে দেখলো ফুয়াদ দাড়িয়ে আছে। গাড়ির সাথে হেলে দাঁড়িয়ে ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ চোখজোড়া তার। আশ্চর্য হলো তানজিম নিজেই। আপনমনে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
— এই লোক এতোক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে কি করছে? হসপিটালে যায় নি নাকি? আজ তার নাকি কি জরুরী মিটিংও ছিলো। অথচ সে উনি এখানেই সারাদিন কাটিয়ে দিয়েছে। স্ট্রেঞ্জ!’

সে ফুয়াদের দিকে এগিয়ে যাবে এমন মূহুর্তেউ মাঝ পথে বাই রোডে ক্রস করে আসা কালো রঙের একটি গাড়ি তানজিমকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। মুহূর্তেই নিরব নিস্তব্ধ হয়ে গেলো চারপাশ। আঁখি যুগল স্থির হয়ে এলো তানজিমের। একপাশ হয়ে রাস্তায় হেলে পড়লো সে। রক্তের রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে তার সাদা চুরিদারটি। ফুয়াদ সেদিকে তাকিয়ে বাকহীন হয়ে গেলো। তার কাছে মনে হলো সে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে।

ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্ন! খানিক বাদে ঘুম ভাঙলে হয়তো সে আবারও সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে পাবে। কিন্তু না, তার ভাবনা মিথ্যে প্রমানিত হলো একটা ছেলের ধাক্কায়। প্রচন্ডরকম ঘামছে সে! তার চোখের সামনে তার প্রেয়সী রাস্তায় রক্তে রঞ্জিত শরীর নিয়ে স্থির হয়ে পড়ে আছে। সে দৌড়ে চলে গেলো তানজিমের কাছে। তানজিমের মাথা কোলে নিয়ে স্বশদে চিৎকার দিলো। মাথার পুরোটাই ফাঁকা হয়ে গেছে তার। দ্রুত তার নার্ভ চেক করলো সে। না দ্রুতই চলছে!

একটু ধাতস্থ হলো সে। দ্রুত পাঁজা কোলে করে নিয়ে গাড়ীর সীটে বসিয়ে দিলো তাকে। মাথার ফেটে যাওয়া অংশে ওড়নাটা শক্ত করে পেচিয়ে দিলো সে। তারপরে দ্রুতবেগে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ছুটলো হাসপাতালের উদ্দেশ্য। আর বিড়বিড় করে বলছে,

–তানজু, আমার কেশবতী! কিচ্ছু হবে না তোমার! এই তো আমি আছি। কিছু হতে দিবো না তোমার!
বলছে আর চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবাধ্য জলধারা। বারংবার নিজেকে দোষারোপ করছে সে। নিজের বেখাপ্পার কারণে আজ তার প্রেয়সীর এই অবস্থা।

আধঘন্টা হয়েছে তানজিমকে হাসপাতালে এডমিট করা হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে এখনও সেন্স ফিরেনি তার। এখনও ওটি চলছে তার! তবে তার আঘাতটা বেশ মারাত্মক ভাবেই লেগেছে সেটা সে নিজেই পরখ করে নিয়েছিলো। কেবিনের দড়জার দিকে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে রইল সে।

এমন পরিবেশ তার অন্তঃকরণ কাঁপিয়ে তুলছে বারংবার। অস্থিরতা আর ভয় উভয়ই বিরাজমান তার অন্তর্মহলে। কি জবাব দিবে সে তার মামা-মামিকে? বলবে তার সামনেই তাদের আদুরে মেয়ে এক্সিডেন্ট করেছে? মাথার পুরোটাই ফাঁকা হয়ে গেছে তার। গুণে গুণে দেড় ঘন্টা পর ওটি করে বেরিয়ে এলো ডাক্তাররা। মুখে তাদের দুশ্চিন্তার ছাপ ছড়িয়ে রয়েছে। ডাক্তারের এমন বিষন্ন মুখ দেখে বুক ধক করে উঠলো তার। সেই মুহুর্তেই হাসপাতালে প্রবেশ করলো তার তানজিমের মা বাবা, তানিম, অথৈ সাথে আরও অনেকে। ফুয়াদের অস্থিরতা আরও বাড়ছে ক্রমান্বয়ে! ফুয়াদের কাছে এসে ডাক্তার বলে উঠলো,

–ডা. ফুয়াদ আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবটাই আমাদের হাতের বাইরে। রিপোর্ট আপনি দেখলে অবশ্যই বুঝতে পারবেন! তবুও বলছি, ওনার মাথার গোড়ায় বেশ অনেকটা এবং বেশ গভীরে ক্ষত হয়েছে। ওনি শুধু গাড়ির এক্সিডেন্টে আহত নন, ওনাকে ভারি কিছু জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছে মেইবি একই সময়ে।

অবাক হলো উপস্থিত সকলে। তানজিমের সাথে কার এতো শত্রুতা থাকতে পারে? তানজিমের বাবা নির্বাক হয়ে গেলেন মেয়ের এমন করুণ অবস্থার কথা শোনে। ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। তানিম উদ্বিগ্ন হয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,
–তাহলে এখন কি করতে পারি ডাক্তার সাহেব? যেকোনে মূল্যেই আপনি তানজুকে সুস্থ করে তুলুন প্লীজ, এট এনি কস্ট। এর জন্য যতো টাকা লাগে, ডোন্ট টেন্স এবাউট দিইস।

ডাক্তার এবার তানিমের কথা শুনে ফিকে হাসলো। ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,
— আপনি নিশ্চয়ই জানেন এই ব্যপারে, সরাসরি মাথায় আঘাতের জন্য যে ক্ষতি হয়, তা হলো প্রাইমারি ইনজুরি।মাথায় আঘাতের পর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে পরবর্তী সময়ে মস্তিষ্ক ঝুলে নেমে আসে (হার্নিয়েশন) বা পানি জমে ফুলে যায় (ইডিমা)। এটাকে তখন সেকেন্ডারি ইনজুরি বলা হয়। তীব্রতা অনুসারে মস্তিষ্কে আঘাত সামান্য, মাঝারি ও মারাত্মকও হতে পারে। আর মিস তানজিমের আঘাতটা এখনও সিউর হয়ে বলা যাচ্ছে না। আপাততো, পরবর্তী রিপোর্ট আসলে তা সিউর বলা যাবে। এখন আসি!

বলে চলে গেলো ডাক্তারের দল। ধপ করে বসে পড়ল ফুয়াদ। ক্লান্ত দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইলো তানিম। আজ তাকে বড্ড অসহায় লাগছে। এবার উঠে দাঁড়াল ফুয়াদ। কারো দিকে না তাকিয়েই লম্বা লম্বা কদম ফেলে ডাক্তারের রুমের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সে। আর বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৫

–ওর ওটি আমিই করবো। দেখি কতটুকু সফল আল্লাহ আজ আমাকে করে। তোকে সুস্থ করতে পারলেই আমার ডাক্তার হওয়ার সফলতা আরও একধাপ এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ, তোর কিচ্ছু হবে না কেশবতী।

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১৭