মধুবালা পর্ব ২০

মধুবালা পর্ব ২০
ফারজানা আক্তার

আমরা দুজন একই ক্লাসে পড়তাম একই সাথে পরিক্ষা দিয়েছি আর একই সাথে ভালো মার্কেও পাস করেছি তাই বিয়ে হলেও এক সাথেই হবে। নয়তো আমি বিয়ে করবোনা।”

ছোঁয়ার কথা শোনে যেনো পুরো পরিবার থ মে’রে গেছে। হঠাৎ লিলির বিয়ের জন্য ছোঁয়া এমন করছে কেনো কেউ বুঝতে পারেনা। লিলি ভয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে। ছোঁয়ার মনে যেনো কোনো ভয় নেই। শুভ্রর উপর ভরসা রেখেই ছোঁয়া কথাটা বলে দিয়েছে। আনজুমা খাতুন কিছু বলতে যাবে তার আগেই বেলাল মির্জা বলেন “কিন্তু এই ৪/৫ দিনে ভালো পাত্র পাবো কোথায়? সমান্য কারণে কী তোদের বিয়েটা পেছানো ঠিক হবে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“নাহ বড় আব্বু আমি বিয়ে পেছানোর কথা বলছিনা। বিয়েটা একসাথে হোক এটাই বলছি। বাকিটা আপনার ছেলে বলবে।”

সবাই এবার শুভ্রর দিকে কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকায়। শুভ্র কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝতেছেনা। তবুও ছোঁয়ার চোখ রাঙানো দেখে শুভ্র বলা শুরু করলো “আসলে গতকাল ছোঁয়ার বান্ধবী তানহার বিয়ে শেষে সবাই মিলে ওদের কলেজে গিয়েছিলাম। লিলিও গিয়েছিলো।

যখন লিলি আর ছোঁয়ার রেজাল্ট আসলো তখন রেজাল্ট ভালো দেখে ওরা আমার কাছে ট্রিট চাই। আমিও সাদামনে ওদের কে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম। কিন্তু রেস্টুরেন্টে আমরা খাওয়া শুরু করার আগেই একটা ছেলে আসে। ফর্সা চেহারার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির লম্বা একটা ছেলে। দেখতে মাশাআল্লাহ। ছেলেটা এসেই আমায় সালাম দিলো, আমিও সালাম নিলাম। তারপর ছোঁয়া ছেলেটাকে স্যার ডেকে বসতে বললো। ছেলেটাও বসলো। তারপর আমি পরিচয় চাইলে বলে একটা সরকারি কলেজের শিক্ষক পদে আছেন ছেলেটা। যতটুকু ছেলেটাকে দেখেছি ভদ্র ঘরের মনে হয়েছে আমার।

তারপর হুট করে ছোঁয়া আমায় আমার হাত ধরে ছেলেটার থেকে একটু দূরে নিয়ে গেলো। লিলি মাথা নিচু করে বসে ছিলো। তখনও আমি জানিনা সত্যি টা। ছোঁয়া আমায় ধীর কণ্ঠে বলে ছেলেটার নাম আলিফ আর লিলিকে সে ভালোবাসে। লিলিও ছেলেটাকে ভালোবাসে আর তারা দুজন বিয়ে করতে চাই। লিলি বলতে পারছিলোনা তাই ছোঁয়া বলে আমায়।”

তারপর একে একে শুরু থেকে সব খুলে বলে ছোঁয়া। কারণ শুভ্রকে গতকাল সব খুলে বলার সময় পাইনি সে। মধ্যবিত্ত পরিবার শুনে বেলাল মির্জা একটু অমত প্রকাশ করলো তখনই শুভ্র বললো “পরিবার যেহেতু হালকা সেহেতু একবার তাদের সাথে কথা বলে নেওয়া উচিত, লিলির কোনো সমস্যা না হলে আমাদের সমস্যা হওয়ার কথা না। সংসার যেহেতু লিলি করবে ওর পছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত আমাদের।”

ছোঁয়া আনজুমা খাতুন কে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে রাজি করেন। আনজুমা খাতুন রাজি মানে পুরো পরিবার রাজি।
লিলিকে বলা হলো আলিফকে ওর পরিবার নিয়ে আগামীকাল সকালে আসার জন্য বলতে।

রাত প্রায়ই ১১টা ছুঁই ছুঁই। শীতের রাতে ছোঁয়া তেমন একটা জেগে থাকেনা। কিন্তু আজ কেনো জানি ছোঁয়ার ঘুম আসছেনা। আয়নার সামনে বসে ছোঁয়া চুল আঁচড়াচ্ছে আর ভাবছে চুল গুলো কবে আগের মতো হবে যদিও এখন একটু লম্বা হয়েছে। ছোঁয়া আনমনা হয়ে বসে ছিলো আয়ানর দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ পেঁছন থেকে শুভ্রর কন্ঠ শোনে ছোঁয়া চমকে উঠে।

“আমায় ছেড়ে চুল নিয়ে বেশি চিন্তা করলে আবারও কে’টে একদম ঘাড়ে তুলে দিবো।”
“তুমি কিভাবে আসলে? আমি তো দরজা লক করেছিলাম আর দরজা এখনো লক করা আছে।”
“কেনো? সবসময় যেখান দিয়ে আসি সেখান দিয়েই আসছি সোনা, বেলকনি দিয়ে।”
“তুমি এমন কেনো গো? আমার শখের চুলগুলো এখন আর কোমরে নামেনা।”

“এতো মন খারাপ করার কি আছে এতে? আমার হিংসা হতো কলেজে গেলে ছেলেরা তোর চুলের দিকে তাকিয়ে থাকতো দেখে তাই এমনটা করেছিলাম। আমার মধুবালার সৌন্দর্য দেখার অধিকার শুধু আমারই আছে, আর কোনো দ্বিতীয় পুরুষের নেই। আমি যদি চুল কাটতে বাধ্য না করতাম তোকে তাহলে তুই কখনোই হিজাব করে বাহিরে বের হতিনা আর হিজাবে তোকে অনিন্দ্য সুন্দর লাগে।”

“আমায় বললেই তো হতো আমি হিজাব পরে যেতাম কলেজে কিন্তু তুমি তো চুলই কে’টে দিলে।”
“আরে এতে ন্যাকা কান্নার কি আছে? তখন বললে কী তুই শুনতি আমার কথা? তখন তো আমাদের সম্পর্ক টম এন্ড জেরির মতো ছিলো।”
“আর এখন?”

“এখন কেমন সেটা এখনই দেখাবো নাকি বিয়ের পরের জন্য জমা রাখবো?”
শুভ্র কিছুটা ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে বলে কথাটা। ছোঁয়া একটু পিছিয়ে যায়। বেশ লজ্জা পাচ্ছে ছোঁয়া। লজ্জা পেলে যেনো একদম লজ্জাবতী গাছের মতো নুইয়ে যায় ছোঁয়া আর তা শুভ্রকে মুগ্ধ করে সবসময়ই।

ছোঁয়া লজ্জা পাচ্ছে আর শুভ্র এক ধ্যানে ছোঁয়ার লজ্জায় লাল হওয়া মুখশ্রীতে আঁটকে গিয়েছে। মুহুর্ত টা ভীষণ সুন্দর লাগছে। ছোঁয়ার কেমন জানি এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে শুভ্রর এভাবে তাকানোতে। হুট করে শুভ্র আবারও বলে উঠে “লজ্জা পেলে তোকে এতোটা সুন্দর লাগে যে ইচ্ছে করে আরেকটু লজ্জা দিতে। বিয়েটা কবে হবে মধুবালা? ধৈর্য যে হচ্ছে না আর। শুন্য বুক তোকে খুব করে ডাকে যে।”

বেলাল মির্জা আনজুমা খাতুনের কাছে যায়। এতোরাতে ছেলেকে নিজের রুমে দেখে মোটেও অবাক হয়নি আনজুমা খাতুন। বেলাল মির্জার এই মুহুর্তে এই রুমে আসার কারণ যে তার অজানা নয়।
“আচ্ছা মা আমরা ঠিক করছি তো এমন মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিয়ে। আমার একটাই মেয়ে, চিন্তা হচ্ছে খুব। এমন বিলাশিতায় বড় হওয়া মেয়ে আমার মানিয়ে নিতে পারবে তো মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন?”

“দেখ এসব চিন্তা করে আমরা এই পরিবারের একমাত্র মেয়েকে হারিয়েছিলাম বহুবছর আগে। আরেকটা মেয়েকে আমরা হারাতে চাইনা তাই রাজি হয়ে গেলাম। আর যেখানে মেয়ে নিজেই পছন্দ করেছে সব জেনে সেখানে আমরা মেনে না নিলে হতে পারে বহু বছর আগে যেটা ঘটেছে সেটার পুনরাবৃত্তি আবারও। তারচেয়ে ভালো চুপচাপ মেয়ের খুশিতে নিজেকে খুশি কর।

আমার মেয়েটা বেঁচে আছে কিনা তা পর্যন্ত জানিনা। এতো অভিমান আমার মেয়েটার যে বাবার মৃত্যুতেও একটু আসেনি আমাদের দেখতে।”

মায়ের সাথে কথা বলে জীবন মির্জা নিজের রুমে চলে যান। মনটা কেমন জানি অদ্ভুত রকমের হয়ে আছে। আগামীকাল ছেলে পক্ষ আসলে কী হবে সেটা ভেবেই জীবন মির্জার মনটা ছ’ট’প’ট করছে খুব। নাজমা বেগম বলেন “শুধু শুধু চিন্তা করে কেনো নিজেকে অসুস্থ করে তুলছেন? এমনিতেই আপনাদের সব ভাইয়ের লো প্রেশারের সমস্যা আছে তারউপর আবার চিন্তায় থাকেন সবসময়ই। এতো চিন্তা করবেন না তো, যা হবে ভালোই হবে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।”

বেলাল মির্জা কিছু বললেননা। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বুঁজে নেন। নাজমা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

সকাল ১০টা। মির্জা বাড়িতে আজ ভীষণ হৈচৈ। রান্না ঘরে চলছে মেহমানের জন্য বিভিন্ন আইটেম বানানোর ছুটাছুটি। আজ ছোঁয়াও রান্নায় সবাইকে সাহায্য করতেছে যদিও জায়েদা বেগম বারংবার ছোঁয়াকে নিষেধাজ্ঞা করছেন।

ছোঁয়ার একটাই কথা “আজ আমার বোন+বেস্টফ্রেন্ড+ননদের শ্বশুড়বাড়ি থেকে প্রথম মেহমান আসতেছে তাকে দেখতে তাহলে কেনো কাজ করবোনা আমি। আমার সম্পূর্ণ দায়িত্ব এবং অধিকার আছে।”
ছোঁয়ার এই লজিক শুনে সবাই হেঁসে ফেলে কুটকুট করে।
লিলিকে লামিয়া সানিয়া আর ছোঁয়া মিলে তৈরি করতেছে।

বাড়ির গেটে পা রাখতেই আলিফের মা সুলতানা মির্জার পা থমকে যায়। তিনি আর সামনে এগুতে পারছেননা। বহু বছর আগে আলিফের বাবার হাত ধরে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তিনি আর আজ এই বাড়িতে আসতে হবে তা কখনোই কল্পনা করতে পারেননি সুলতানা মির্জা।

আলিফের বাবার সাথে বিয়ে হওয়ার পর নিজের নামের থেকে মির্জা নামটা মুছে দেন চিরকালের জন্য। আর আজ এই বাড়ির গেটে নিজের ছেলের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেকে কি জবাব দিবে তা জানা নাই সুলতানা মির্জার কিন্তু এই বাড়িতে প্রবেশ করার সাহস সুলতানা মির্জার নেই।

এই বাড়ির কারো চোখে চোখ রাখার মতো যে সাহস সুলতানা মির্জার হবেনা, তিনি যে ভুল করেছেন বহু বছর আগে তারজন্য যে তার পরিবারকে অনেক অপমানিত হতে হয়েছিলো সমাজের সামনে। কিভাবে সেই বাপ ভাই মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন সেই সাহস তিনি পাচ্ছেননা।

মধুবালা পর্ব ১৯

আলিফ কিছুদূর সামনে এগিয়ে আবার পেঁছনে এসে মাকে উদ্দেশ্য করে বলে “কি হয়েছে আম্মু আসো ভেতরে।”
পাশ থেকেই আলিফের বোন আলিয়া বলে উঠে “দেখনা ভাই আম্মু এখানে এসে কেমন দাঁড়িয়ে থ মে’রে গেছে। আম্মু পাও নাড়াচ্ছেননা। আম্মুর শরীর অসুস্থ লাগছে মনে হয়।”

মধুবালা পর্ব ২১