অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩০

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩০
তাশরিন মোহেরা

মুখররা চলে গেলেই সোজা পায়ে আব্বার কাছে এলাম। তিনি মাত্র সোফায় বসেছেন। মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আমার! আব্বা আমাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় পাশে বসতে বললেন। আমিও বসলাম।
ভয়ে ভয়ে ডাকলাম,

‘আব্বা?’
আব্বাকে ভীষণ চিন্তিত দেখালো। চেহারাটা কেমন মলিন হয়ে আছে। আমার দিকে চেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আব্বা। সাহস কিছুটা বাড়লো আমার! আব্বার রাগটা একটু বেশিই! এ কারণেই আব্বাকে একটু ভয় পাই আমি। আমার দৃষ্টি বুঝতে পেরে তিনি বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আমি জানি মা, তোর মনে এখন অনেক প্রশ্ন জমেছে! হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেল।’
আমি আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আব্বা, আপনি কি আগে থেকেই মুখরকে চেনেন?’
আব্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

‘তুই যখন প্রথম আমাকে মুখর শিকদারের কথা বলেছিলি, আমি তখনই চিনেছি!’
আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। আব্বা তবে এতোদিন মুখরকে না চেনার ভান করেছিলেন! কিন্তু কেন? তাকে চেনেন বললেই হতো! এই বিষয়টা লুকিয়ে রাখার কি হলো?
আব্বার মুখে এখন আগের মতো রাগত্ব ভাবটা নেই। বরং সে চেহারাটায় ফুটে উঠেছে একঝাঁক অনিশ্চয়তা। জর্জরিত মুখশ্রীটার দিকে চেয়ে থাকতেই আব্বা আমাকে বললেন,

‘তিথি মা, প্রতিটা মেয়েরই তো বিয়ে করতে হয়। তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি একা কি করে থাকবো রে?’
কণ্ঠটা বেশ শীতল আব্বার। তাই কথাটা বেশিই আঘাত হানলো আমার বুকে। আসলেই তো! কখনো যদি আমার বিয়ে হয়ে যায়, এই বাসায় আব্বা একা কি করে থাকবে?

চিন্তাটা আমার মাথায় প্রায়সময় এলেও আমি তা আগে পাত্তা দেইনি কখনো। কেননা আমি ভেবেছি আমার জীবনে কোনো ছেলের প্রয়োজন নেই। আর যদি কখনো কোনো ছেলের প্রয়োজন হয়, তবে আব্বার খাতিরে তাও বিসর্জন দিয়ে দেবো। কিন্তু বলা যতটা সহজ, করা তার চাইতে হাজারগুণ কঠিন। মুখরের দিক থেকে চিন্তা করতে গেলে এ কাজটা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে আমার ক্ষেত্রে। কেননা আমি চাই আমার প্রিয় মানুষটার সাথে আজীবনই কাটাতে!

আব্বা আবারো বললেন,
‘মুখর ছেলেটাকে তুই ভালোবাসিস, তাই না?’
আব্বার কথায় সম্বিৎ ফিরে পাই। তবে আব্বার প্রশ্নে কিছুটা নুইয়ে পড়ি। কারণ আব্বাকে বারবার ‘মুখরকে ভালোবাসি’ বলতে গিয়ে মুখে বিঁধছে আমার। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ বলে আমি চুপ করে বসে থাকি। আব্বা এবার তা বুঝতে পেরে বললেন,

‘কিন্তু মুখরও কি তোকে ভালোবাসে?’
আমি ভীষণ রকম চমকালাম। মুখর আমাকে ভালোবাসে কিনা তার উত্তর সত্যি বলতে আমার কাছে নেই! মাঝেমধ্যেই আমার মনে হয় মুখর আমায় ঘৃণা করে আবার মাঝেমধ্যেই ভাবি সে আমার প্রতি দূর্বল। কিন্তু সঠিক উত্তরটা আসলে কি তা আমি জানি না! আর আমি কিনা সঠিক উত্তরটা না জেনেই তাকে বিয়ে করার কথা চিন্তা করে রাখছি! ছিঃ!
মুখর যদি আমায় ভালোই না বাসে তবে আমার একপাক্ষিক ভালোবাসাটায় লাভটা কি?

আব্বা আমার এমন চুপ হয়ে যাওয়াটা ধরতে পেরে বললেন,
‘একপাক্ষিক ভালোবাসা বড্ড খারাপ রে, মা! তোকে খুব কাঁদাবে। কাঁদাতে কাঁদাতেই তোকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে ছাড়বে।’
আব্বার প্রতিটা কথা আমার বুকে ভীষণ আঘাত করছে। আসলেই কি আমার ভালোবাসাটা একপাক্ষিক? কিন্তু আমি তো কখনোই একপাক্ষিক ভালোবাসাটা চাইনি!

আব্বা বসা থেকে উঠে বলে উঠলো,
‘মনে মনে যদি বিয়ে করার প্ল্যান করে থাকিস, তবে তা বাদ দিয়ে দে! আমি তোর বিয়ের অনুমতি তোকে কখনোই দেবো না। এক্ষেত্রে আমায় স্বার্থপর বলতে পারিস!’

রাত তিনটে ত্রিশ! আমার চোখে ঘুম নেই। আব্বার বলা প্রতিটা কথা আমার বারবার মনে পড়ছে। আর বারবারই চোখ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। মুখর আমায় ভালোবাসে কিনা তা জিজ্ঞেস করার সাহস আমি সঞ্চার করতে পারছি না! আর আব্বা তো বলেই দিয়েছেন, তিনি আমার বিয়েটা হতে দেবেন না। তা হোক মুখরের সাথে কিংবা অন্য কারো সাথে। আম্মার মতো আজীবন ধুকে ধুকে মরতে হবে আমায়!

হঠাৎ দরজায় হালকা ঠকঠক আওয়াজ হলো। প্রথমে চমকে উঠলেও পরে স্পষ্ট শুনতে পেলাম আব্বা ডাকছে। এতো রাতে আব্বা আমায় ডাকছেন কেন? জলদি পায়ে দরজা খুললাম। দেখি আব্বা দরজার ধারেই বসে আছেন। তার পুরো শরীর ঘামে জবজবে হয়ে আছে। আমি এ দৃশ্যে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। হাত পা ঠান্ডা হয়ে কাঁপছে আমার! তড়িৎ আব্বাকে ধরে দেখি তিনিও কাঁপছেন। আমায় ক্ষীণ স্বরে অস্পষ্ট ভাষায় বলছেন,

‘বুকটা ব্যাথা করছে, তিথি!’
আমি কি বলবো বা কি করবো বুঝে উঠছি না। হঠাৎ আব্বাকে এই অবস্থায় দেখে আমার পুরো শরীরটাই অবশ হয়ে গেছে। তাও বললাম,
‘আব্বা, কিছু হবে না, আব্বা! একটু শক্ত থাকুন।’
আমি আব্বাকে কাঁধে ভর দিয়ে কোনোরকমে সোফায় বসালাম। তিনি অনবরত বলে যাচ্ছেন,
‘আমার ভালো লাগছে না রে, মা! তিথি! তিথি রে!’

আব্বার এমন গোঙানি শুনে আমার কাঁপুনি আরো বেড়ে গেল। কপালে ঘাম জমছে! তা মুছে তড়িৎ ফোনটা নিলাম। কাকে ফোন করবো ভেবে না পেয়ে শেষমেশ মুখরকে কল করলাম। সে ফোন না ধরায় দু’বার মিসড কল হলো। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মুখর ছাড়া আমি কাকেই বা ভরসা করবো এ মুহুর্তে। রূপক ভাইকে কল করলে সেও ফোন ধরলো না। রাত তিনটায় কাউকে আশা করাটাও বোকামি হবে আমার! মুখরকে শেষবারের মতো একবার ফোন করলাম। বেশ খানিকক্ষণ রিং হতেই ফোন রিসিভ হলো। ওপাশ হতে ঘুমঘুম শব্দে মুখর হ্যালো বললে আমি তৎক্ষণাৎ তাকে বলে,

‘মুখর সাহেব, আব্বার বুকে ব্যাথা উঠেছে। তাকে এখনি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। সাহায্য করুন!’
কথাটুকু বলার মাঝপথেই আমি ডুকরে কেঁদে দেই। এই কান্নাটা অনেকক্ষণ যাবৎই আটকে রাখতে চেয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি! মুখর আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
‘আমি এক্ষুণি আসছি, মিস.তিথিয়া! কাঁদবেন না। এক্ষুণি আসছি আমি!’

তার সান্ত্বনায় কিছুটা কাজ হলো বোধহয়। সাহসটা বাড়লো আমার। মুখর আসার অপেক্ষা করতেই আব্বার পাশে বসলাম। আব্বাকে পানি দিলাম। তিনি এক চুমুক পান করে আবারো বলছেন,
‘আমাকে মাফ করে দে, মা। একটা ভালো বাবা হতে পারিনি আমি! আর এখন তোকে ছেড়েই চলে যাচ্ছি।’
আব্বার কথা শুনে কান্নারা ঝাপটে চলে আসতে চাইলো। আমি ধমকে আব্বাকে বললাম,
‘অযথা এসব কি বলছেন, আব্বা?’

মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম বারকয়েক। বুকের দিকটায় খানিকক্ষণ ঢলে দিলাম। তখনি দেখলাম মুখর এলো। তার সাহায্যে কাছের একটা হাসপাতালে আব্বাকে ভর্তি করানো হলো।

হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি অনবরত কেঁদেই চলেছি। অতিরিক্ত কান্নার ফলে হেঁচকি উঠেছে আমার! হেঁচকির মাঝেও কান্না থামছে না। আশেপাশে সবকিছুই অন্ধকার দেখছি আমি। অনেকবার চেয়েছি, আব্বা নামক মানুষটার কাছ থেকে দূরে চলে যেতে। চেয়েছি আম্মার মতো আব্বাকে ফেলে হারিয়ে যেতে। কিন্তু এই মুহুর্তে এসে আব্বাকে হারানোর ভয়টা আমার গলা টিপে ধরেছে যেন! মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়েছে, হাত-পা নাড়ানোর শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি আমি। মনে মনে বারবার বলছি,

‘আব্বা, আমাকে একা ফেলে যাবেন না, প্লিজ!’
পাশে এসে দাঁড়ালো মুখর। অশ্রুভরা টলমল চোখে তার দিকে দেখলাম। সেও পীড়িত চোখে আমাকে দেখলো। চোখ বন্ধ করে আমায় শান্ত হতে বললো।

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২৯

কিন্তু এতে যেন আমার কান্না দ্বিগুণ বেড়েছে। আমি ওড়না চেপে কাঁদছি তো কাঁদছিই! মুখর এবার হেচকা টেনে আমায় তার বুকের মাঝে ঝাপটে ধরলো। মাথাটা তার বুকের সাথে চেপে ধরে হাত বুলিয়ে দিলো খানিক। তার ছোঁয়ায় আরো শব্দ করে কাঁদলাম। সে বললো,
‘কিচ্ছু হবে না আপনার আব্বার! এতো ভেঙে পড়বেন না, মিস.তিথিয়া। আমি আছি তো!’

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩১