অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩১

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩১
তাশরিন মোহেরা

হাসপাতালের করিডোরে পায়চারি করার এক ফাঁকে ডাক্তার এসে বললো,
‘আপনারা পেশেন্টের কি হোন?’
আমি কান্নারত অবস্থায় বললাম,
‘আমি- আমি উনার মেয়ে।’
ডাক্তার সাহেব শান্ত গলায় বললেন,
‘আমি এখন যা বলবো, তা শুনে ভেঙে পড়বেন না। আসলে আপনার বাবার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। তাই…’

ডাক্তার সাহেব একবার আমার উৎসুক চোখের দিকে তাকালেন। এরপর চোখ নামিয়ে আবারো বললেন,
‘তাই তিনি কোমায় চলে গেছেন। আপাতত আইসিইউতে রেখে তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’
আব্বা কোমায় চলে গেছে শুনে আমার মস্তিষ্ক থেমে গেল হঠাৎ। হাত-পা কাঁপা-কাঁপিও বন্ধ হয়ে গেল যেন। চারিদিকে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। বুকের লাফালাফিও বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একজন মেয়ের কাছে তার বাবা কোমায় চলে যাওয়ার খবরটা ঠিক কেমন শোনায়? ঠিক কেমন অনুভূতি হয় তখন? কিন্তু আমি তো কোনো অনুভূতিই টের পাচ্ছি না নিজের ভেতর! অনুভূতিহীন জড় কাঠে পরিণত হয়ে গেছি যেন! এই আব্বাটা-ই আমাকে নিজের কাছ থেকে আড়াল করতে ভয় পেতেন। আমাকে আশেপাশে না দেখলে হাঁসফাঁস করতেন যন্ত্রণায়। একাকিত্বে দেয়ালে মাথা ঠুকে মরতেন! কিন্তু আজ? এ কেমন নিষ্ঠুরতা তার? নিজের মেয়েটাকেই পেছন ফেলে মৃত্যুর দুয়ারে চলে গেলেন!

আমি ঢুলতে ঢুলতে মাটিতে পড়ে যেতে নিলাম। মুখর পেছনে আমার পিঠে হাত ঠেকিয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরলো। আমি তার দিকে করুণ চোখে চেয়ে ডুকরে বলে উঠলাম,
‘আব্বা কেন আমায় এতো কষ্ট দিচ্ছেন, মুখর সাহেব? কেন আমার সাথে এমন মজা করছেন? আমার কষ্টটা তিনি দেখছেন না? আমি পারছি না যে!’

এই বলে অঝোরে কাঁদতে বসে পড়লাম। মনের সব ব্যাথা উজাড় করে শব্দ করে কাঁদছি। এই কষ্ট আমি চেপে রাখতে পারছি না! পারছি না আব্বার এমন অসুস্থতা দেখতে!
মুখর আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আমাকে বারবার সান্ত্বনা দিয়েই যাচ্ছেন,
‘কাঁদবেন না, মিস.তিথিয়া! আপনার আব্বা সুস্থ হয়ে উঠবেন জলদি।’

আমি জানি মুখরের কোনো সান্ত্বনা-ই সত্য নয়। আমরা কেউ-ই নিশ্চিত নই, আব্বা কবে কোমা থেকে ফিরে আসবেন। এমনকি মাঝপথে আব্বা এ দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলেও যেতে পারেন। তাই মুখরের এমন মিথ্যে সান্ত্বনায় কান্নার বেগ আরো বেড়েছে আমার! ভাবছি এ মুহুর্তেই যদি আল্লাহ আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতেন! আব্বার আগে যদি আমার মরণ হতো! তবে আব্বাকে এমন অবস্থায় দেখতে হতো না কভু!

হাসপাতালের বেঞ্চিতে বসে আরো খানিকক্ষণ কাঁদলাম হাঁটু গেড়ে। মুখটা হাঁটুর মাঝে লুকিয়ে ফুঁপিয়েই যাচ্ছি! আম্মাকে খুব মনে পড়ছে আমার! আবার খুব রাগও হচ্ছে উনার উপর। কেন এমন পরিস্থিতিতে আমি একা? কেন একা আব্বা-ই এতো কষ্ট ভোগ করছেন? জীবনে কি এমন ভুল করেছি আমি? এ অবস্থায় আম্মার আদরের পরশের যোগ্য কি আমি নই?
তখনই কে যেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

ভেজা চোখ দুটো মেলে তাকালাম মানুষটার দিকে। দেখি আন্টি চোখ বুজে আমাকে শান্ত হওয়ার জন্য বলছেন। তার এই পরশটাই তো আমি চাইছিলাম! আন্টিকে ঠিক এখন আমার মায়ের মতো মনে হলো! আন্টি আমার পাশে বসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত হাতে। চুমু খেলেন আমার মাথায়। আমি চুপচাপ সেই আদরটুকু গ্রহণ করে তার বুকে মাথা দিয়ে রইলাম। নিঃশব্দে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরলো বৈকি! নিজেকে হঠাৎ করেই কেমন ভাগ্যবান মনে হলো!

হাসপাতালে দু’দিন থাকার পর ডাক্তার আমায় বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। আব্বাকে নিয়ে তারা অনিশ্চয়তায় আছেন। আর হাসপাতালে থাকতেও আমার কষ্ট হচ্ছে! ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না হওয়ায় বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছি। তাই অযথা হাসপাতালে থেকে আমায় অসুস্থ হতে দেখতে পারছে না কেউ-ই। এ দু’দিন আন্টিও আমার সাথে থেকেছেন। তাকেও আর কষ্টে রাখতে ইচ্ছে হলো না আমার।

কাচের দেয়ালের ওপারে দাঁড়িয়ে আব্বার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলাম। প্রতিদিন এসে দু’বার দেখে যাবো আব্বাকে। কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছে না কিছুতেই! যেন এখনি আব্বা জেগে উঠে আমায় খুঁজবেন। আর আমি দৌঁড়ে তার কাছে গিয়ে তাকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরবো।

নাকে অক্সিজেন মাস্ক পড়ে নির্লিপ্ত ভাবে শুয়ে আছেন আব্বা। একটুকুও নড়চড় নেই তার! নিথর দেহটা দেখে বুকটা আমার ভেঙে যাচ্ছে। আব্বাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে আমার মোটেও ভালো লাগছে না! দু ফোঁটা অশ্রু নাকের ডগায় আসতেই তা মুছে আব্বার উদ্দেশ্যে বললাম,

‘আর কত বিশ্রাম নেবেন, আব্বা? এখন তো অন্তত উঠে পড়ুন। দেখুন, আপনাকে একা ফেলে চলে যাচ্ছি আমি! আমায় আটকাবেন না? বলবেন না, আমায় একা ফেলে কোথাও যেতে পারবি না তুই?’
কিন্তু ওপাশের মানুষটার কোনো সাড়া নেই। একজন মৃত মানুষের সাথে কথা বলাটা বোধহয় এর চাইতেও বেশি সুখের! আমার অন্তত তা-ই মনে হলো!
আব্বাকে দেখে আবারো বললাম,

‘আমি এ জীবনে কাউকেই ভালোবাসবো না আর, আব্বা। মুখরকেও বিয়ে করবো না। সবসময় আপনার কথা শুনবো! দয়া করে আমার কাছে ফিরে আসুন। আপনার কি মনে নেই আপনার একটা মাত্র মেয়ে আপনার ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছে? আর ঘুমাবেন না, আর স্বপ্ন দেখবেন না, উঠে আপনার তিথিকে দেখুন! প্লিজ!’

কান্নার বেগ বেড়েছে আমার। আন্টি আমাকে আব্বার কাছ থেকে সরিয়ে সামনের বেঞ্চিটাতে বসালেন। কান্না থামানোর অনেক চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। গত দু’দিন ধরে একটানা কাঁদার ফলে আমার গলাটাও বসে গেছে। চোখ দুটো ফুলে টমেটো হয়ে গেছে! আন্টিও বোধকরি আমার কান্নায় অতিষ্ঠ। নাক টেনে কান্নাটা কোনোরকম গিললাম। আমার কান্না থেমেছে দেখে আন্টি আমার মুখটা তুলে ধরলেন। আদর নিয়ে বললেন,

‘তোমার বাসায় তো কেউ নেই, তাই না?’
আমি দু’দিকে মাথা দুলালাম। আন্টি এবার বললেন,
‘তাহলে ক’টা দিন আমাদের বাসায় থেকো, মা! তোমাকে একা রাখতে আমার মন সায় দিচ্ছে না।’
আমি বসে যাওয়া গলায় বললাম,
‘চিন্তা করবেন না, আন্টি! আমি একা থাকতে পারবো!’

কিন্তু আন্টি তার কথায় অনড়। অনেক বলে কয়েও লাভ হলো না। তাই ঠিক হলো আমি তার বাসায় কয়েকদিন থাকবো। তাই আব্বাকে আজকের মতো বিদায় জানিয়ে চলে এলাম মুখরদের বাড়ি।
মুগ্ধ আমাকে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হলো। তার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যেমূলক হাসলাম খানিক।
মুখরদের বাসাটায় তিনটে বেডরুম আছে। বাগানের দিকের রুমটা আগে প্রায় সময়ই বন্ধ থাকতো! তবে এখন আমার জন্য তা খুলে দেওয়া হয়েছে। রুমটাতে ঢুকেই দেখলাম তা বেশ পরিপাটি হয়ে আছে। আন্টি বোধহয় আগে থেকেই আমাকে এখানে আনার প্ল্যান করে রেখেছিলেন।

তিনদিন ধরে এক কাপড়ে হাসপাতালে থেকে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে আমার! গা থেকেও কেমন হাসপাতাল হাসপাতাল গন্ধ! জলদি ফ্রেশ হওয়া দরকার। তবে বিপত্তি বেঁধেছে একটা বিষয়ে। এক ঘরে মোট দুটো বাথরুম। একটা আন্টি আর মুগ্ধের রুমের সাথে সংযুক্ত, যেই রুমটায় আগে মুখর আর মুগ্ধ থাকতো। আর বাকিটা মুখরের রুমের সামনেই। যাকে সচারাচর উন্মুক্ত বাথরুম বলি আমি! সব ঘরেই এমন একটা উন্মুক্ত বাথরুম আছেই! তবে আমি মেয়ে হয়ে দু’দুটো ছেলের ব্যবহৃত উন্মুক্ত বাথরুমে ফ্রেশ হবো তা কখনোই হয় না! মেয়ে হিসেবে একটা প্রাইভেসি তো আছেই, তাই না?

আন্টিকে বলে আন্টির রুমের বাথরুমটায় ফ্রেশ হতে ঢুকলাম। নিজের বাথরুমটা ব্যবহার করতে করতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে বলেই আজও রুমের মেইন দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসেছি আমি! প্রায় এক ঘণ্টা সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে লম্বা এক শাওয়ার দিয়ে বেরোলাম। সাদা তোয়ালেটা মাথার সাথে পেঁচিয়ে ধোয়া কাপড়গুলো নিয়ে বাগানের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। বাগানে একটা লম্বা রশি টানানো আছে বলে কাপড় শুকাতে বেশ সুবিধে হয়।

ধোয়া কাপড় শুকোতে দিয়ে মাথায় পেঁচানো তোয়ালেটা খুলে চুলগুলো আরেকবার মুছে নিলাম সময় নিয়ে! ভেঁজা চুলগুলো মুছতে মুছতেই বাগানটা ঘুরে দেখলাম। মনে পাহাড়সম কষ্ট থাকলেও বাগানটা দেখে কষ্ট কিছুটা কমলো। বুকের বোঝাটা হালকা লাগছে কিছুটা! তোয়ালেটা শুকোতে দিয়ে পেছন ফিরলাম। পেছনে ফিরেই চমকে উঠলাম। মুখর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বুকে হালকা থু মেরে অপ্রস্তুত হাসলাম।

মুখর কবে এসেছে তা-ই তো টের পেলাম না। মুখর হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে আসে। দু’হাত পেছনে গুটিয়ে রেখেছে সে। আমার কিছুটা কাছাকাছি এসে সে তার হাত বের করে আমার সামনে তুলে ধরে। তাতে একগুচ্ছ বেলিফুল শোভা পাচ্ছে। ফুলগুলোর দিকে তাকিয়েই আমার চোখটা চিকচিক করে উঠলো। আমি তা নিয়ে আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলাম। মুখর আমাকে বললো,

‘বেলি আপনার পছন্দ, তাই এনেছি আপনার জন্য।’
আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। বললাম,
‘আপনি কি করে জানলেন?’
মুখর উত্তর না দিয়ে বাঁকা হাসলো।

আমার ঠোঁটে বেশ একটা সময় পর প্রাকৃতিক হাসি ফুটলো! ঠোঁট দুটো চওড়া করে মুখরের দিকে চেয়ে বললাম,
‘ধন্যবাদ, অসংখ্য ধন্যবাদ, মুখর সাহেব।’
আমার জ্বলজ্বল করা দৃষ্টিতে চোখ রেখেই মুখর ঘাবড়ে গেল। আমায় হাত দেখিয়ে বললো,
‘এভাবে হাসবেন না, মিস.তিথিয়া!’
আমি বললাম, ‘কেন?’

কিন্তু মুখর আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই প্রস্থান করলো। অপমানবোধ করলাম আমি! এভাবে ‘হাসবেন না’ বলে কেউ চলে যায়? একটা মেয়ের কাছে কতটা অসম্মানের এ ব্যাপার তা কি আপনি জানেন, মুখর সাহেব?
আচ্ছা? আমি কি তবে খুব বাজেভাবে হেসেছি? মুখর কি বিরক্ত হয়ে চলে গেলো তবে?

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩০

তড়িৎ আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আগের মতো হাসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এমন জোর করে হাসতে গিয়ে আরো বাজে দেখালো আমায়! তার মানে আমি নিশ্চয়ই খুব বিশ্রীভাবেই হেসেছি! যার কারণে মুখরের তা পছন্দ হয়নি, সে আমার এ হাসি দেখেই পালিয়েছে নির্ঘাত! মনটা ছোট হয়ে গেল ক্ষণিকেই!

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩২