অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩২

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩২
তাশরিন মোহেরা

আব্বার সামনে চেয়ার টেনে বসে আছি। মানুষটা এখনো নির্বিকার। দু’মাস হতে চলেছে কোনো হেলদোল নেই তার। হবেই বা কেন? তিনি যে মৃত না হয়েও মৃত! দীর্ঘ একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। এখন শুধুই দীর্ঘশ্বাসের উপর দীর্ঘশ্বাসই বেরোয়। আর মনটার যে কি এক অবস্থা! কাউকে বলাও যায় না, আবার ভেতরে সবটুকু নিয়েও বসে থাকা যায় না।

বাড়ি অর্থাৎ মুখরের বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলাম। প্রায়শই আমি দরজা আটকে ভেতরে বসে থাকি। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বেরোই না। কারো মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করে না, কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করে না আজকাল। কোনো অনুভূতিই প্রকাশ করার সাহস পাই না। নিজেকে বড্ড ক্লান্ত আর শ্রান্ত মনে হয়। যেন বিশাল এক পাহাড় পাড়ি দিয়ে আমার শরীরটাই ভেঙে গেছে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দরজায় টোকা পড়ছে, কিন্তু ওপাশ নীরব। বুঝে গেছি মানুষটা মুখর। সেও আমার সাথে এখন প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। সে যে আমায় উপেক্ষা করছে তা নয়। সে আমায় নিজেকে সামলে নেওয়ার সময়টা দিচ্ছে! বিষয়টাতে আমি বেশ সন্তুষ্ট! কেননা কারো চোখে নিজের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ পাক, তা আমি চাই না।

মুখর দরজায় গুনে গুনে তিনটে টোকা দেয়। আমি বেরিয়ে সরাসরি ডাইনিং রুমে চলে যাই। কিন্তু স্পষ্ট টের পাচ্ছি, মুখর ঠিক আমার পিঠ বরাবর আমার সাথেই হাঁটছে। আমি নাস্তাটা নিয়ে আবারো পেছন ফিরে রুমের দিকে পা বাড়াই। তাতে একবার মুখরের সাথে ক্ষীণ ধাক্কা লাগে। আমি কিছুই বলিনি! চুপচাপ রুমে গিয়ে দরজা আটকাতে যাবো, এমন সময় মুখর আমার পিছু এসে খপ করে দরজাটা ধরে দাঁড়ায়। অনুনয়ের সুরে বলে,

‘আজ আমাদের সাথে নাস্তা খেলে হয় না, মিস.তিথিয়া?’
আমি তার চোখের দিকে তাকাইনি! আজকাল কারো চোখে চোখ রাখতেও ভীষণ অস্বস্তি হয় আমার। পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে চেয়ে বললাম,
‘অন্য একদিন!’
মুখর আবারো বললো,

‘অন্য একদিনটা কবে আসবে, মিস.তিথিয়া? এখনো কি সময় হয়নি?’
আমি দু’দিকে মাথা দুলিয়ে বোঝালাম সময়টা হয়নি। এরপরই দরজা আটকে দেই। অন্য একদিনটা বোধহয় আর কখনোই আসবে না। আমার সে সাহস নেই। কেন নেই তা আমি জানি না। তবে নিজেকে সবার আড়াল রাখতেই বেশ ভালো লাগে এখন! সে হোক না ভালোবাসার কেউ!

হাতে থাকা নাস্তাটার দিকে চেয়েই বুঝলাম খাবারের রুচি একেবারেই নেই আমার। জোর করে গিলতে গেলেও বমি করে সবটা উগড়ে দেবো। তার চাইতে বরং জানালার ওপাশে রেখে দেই। কাকেরা ঠুকরে খেয়ে নেবে। ঠিক যেমনটা দুঃখেরা ঠুকরে খেয়ে চলেছে আমার হৃদয়!

আজ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সরাসরি ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। সারাদিন ব্যস্ত থাকবো বলে সকালবেলা-ই চলে এলাম আব্বাকে দেখতে! নতুন বৎসরে পদার্পণ করেছি বলে প্রজেক্ট আর অ্যাসাইনমেন্টে ভরিয়ে রেখেছে।
নতুন বছর উপলক্ষে ভার্সিটিতে প্রোগ্রামের আয়োজন করেছে আমাদের ডিপার্টমেন্ট! সেখানে সবাই শাড়ি পড়ে আসার প্ল্যান করেছে। কিন্তু আমার এসবে মোটেও ইচ্ছে নেই।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আমিই বোধহয় প্রোগ্রাম নিয়ে বেশি লাফালাফি করতাম! তবে এখন আব্বার এমন অবস্থায় নিজেকে কিছুতেই বিনোদনে আকৃষ্ট করতে পারছি না। তবে ডিপার্টমেন্টে বলেও লাভ হলো না! ব্যাচমেটরা জোরদার, আমায় আসতেই হবে! কেউ যেন বাদ না যায়। কি আর করা! প্রথমে ভেবেছি, দেখা দেওয়ার জন্য ই শুধুমাত্র প্রোগ্রামে আসবো। শাড়ি কিংবা এতো সাজগোজের দরকার নেই।

কিন্তু কাছের বান্ধবীদের জন্য তাও হলো না! তারা শাড়ি পড়ে আসছে মানে আমায়ও পড়ে আসতে হবে। তাই ভাবলাম আজ একটু নিজের বাসায় গিয়ে শাড়ি জোগাড় করি। মা আমাদের ছেড়ে যাওয়ার সময় তার একটা কাপড়ও নিয়ে যাননি! কোনোরকমে এক কাপড়ে পালিয়েছেন। মায়ের ব্যবহৃত আলমিরাটাও ঠিক আগের মতোই রেখে দিয়েছেন আব্বা! আমি কৌতুহলী হয়ে দু একবার আলমিরাটা খুলেছিলাম। সেখানে দেখেছি মায়ের অনেক শাড়ি আছে। বেশিরভাগই আব্বার উপহার দেওয়া!

বাসায় এসে বেশ যত্ন করে আলমিরাটা খুললাম। তা হতে একেক করে তিনটে শাড়ি বের করলাম। একটা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, একটা সম্পূর্ণ কালো তবে তাতে খানিক চুমকি চিকচিক করছে আর বাকিটা হালকা জলপাই রঙের জাঁকজমকহীন একটা শাড়ি! শাড়িগুলো শুঁকে মায়ের শরীরের ঘ্রাণ নিতে চাইলাম। কিন্তু বেশ আগের হওয়ায় তা থেকে মায়ের শরীরের ঘ্রাণের বদলে আলমিরার কাঠের ঘ্রাণ পেলাম। অতি আদরে শাড়ি তিনটের গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। হঠাৎ চোখের সামনে মায়ের মুখশ্রীটা ভেসে উঠলো। তিনি কয়েক হাত দূরেই বিছানায় বসে আছেন। এতোদিনের জমে থাকা কান্নারা বেরিয়ে এসেছে দু ফোঁটা অশ্রু হয়ে। মা’কে সামনে দেখে অভিযোগ করে বললাম,

‘কেন আমায় একা ফেলে চলে গেলে, মা?’
আম্মা নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে হেসেই চলেছেন। তার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ভর করেছে! আমি আবারো বললাম,
‘আমার জন্য কি একটুও মায়া হয়না তোমার? একটুও ভাবো না তুমি আমায় নিয়ে? আমার মেয়েটা একা সব সামলাতে পারছে কিনা, ভালোমতো খাচ্ছে কিনা, ঘুমোচ্ছে কিনা, এসব জানতে কি মোটেও ইচ্ছা হয়না তোমার?’
মা ক্ষীণ হেসে জানালেন,

‘আমি তো জানি রে, আমার ছোট্ট তিথিয়া সবটা হাসিমুখে সামলে নেবে। সে পারবে, তার উপর আমার যে পূর্ণ আস্থা আছে!’
আমি কান্না মুছে কপট রাগ নিয়ে বললাম,
‘হ্যাঁ, আমি হাসিমুখে সব সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিদিন। রোজ ভালোমন্দ খাওয়ার, ভালোমতো ঘুমানোর চেষ্টা করি। দিনশেষে ভাবি, তোমার দরকার নেই। কিন্তু, কিন্তু কি করবো বলো? আমিও যে একটা মানুষ! আমারো যে দুঃখ আছে, বেদনা আছে!’

কিন্তু মা আমার অভিযোগ সম্পূর্ণ না শুনেই উধাও হলেন। আমার অভিমানরা ভরসা পেল। মায়ের শাড়ি আঁকড়ে বসে বসে কাঁদতে লাগলাম আমি! আমার সাথেই কেন সবটা খারাপ হয় বারবার? কি করেছি আমি? কি করেছি?
ফোনের ভাইব্রেশনে বিছানাটা চরম ভাবে কেঁপে উঠলো। কান্না থামিয়ে দেখলাম মুখর ফোন করেছে। গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। অশান্ত মনটা শান্ত করার চেষ্টা করে ফোনটা রিসিভ করলাম। মানুষটা চুপ করে আছে। আমি আগ বাড়িয়ে বললাম,

‘আমি একটা কাজে একটু বাসায় এসেছি, মুখর সাহেব!’
মুখর এটুকু শুনে শান্ত গলায় বললো,
‘ঠিক আছে! আমি আপনার বাসার সামনে আসছি, অপেক্ষা করুন।’
আমি বললাম,

‘দরকার নেই। আমি একা-ই যেতে পারবো।’
‘জেদ করবেন না। আসছি আমি!’
আমার খানিক রাগ হলো। হঠাৎ ধমকে বলে উঠলাম,
‘ক’দিন ধরে এমন পিছু নিচ্ছেন কেন আমার, বলুন তো? আমি কি বাচ্চা যে একা যেতে পারবো না? একটু একা থাকতে দিন আমায়, প্লিজ!’

কলটা কেটে দিলাম তৎক্ষণাৎ। কিন্তু কল কেটেই আঁতকে উঠলাম আবার। কি করলাম আমি এটা? এমন ধমকে উঠলাম কেন? মুখরের সাথে এতো রাগ দেখানোটা উচিৎ হয়েছে কি? হয়নি, মোটেও উচিৎ হয়নি। ছেলেটা তো আমায় নিয়ে দুশ্চিন্তা-ই করছে! এতে দোষের কি আছে? আর আমি কিনা!

ব্যাগে শাড়ি তিনটা পুরে বাসা ছেড়ে বেরোলাম। ইদানীং সবকিছুই গুলিয়ে ফেলছি আমি! অযথা রাগ লাগছে, অযথা অভিমান করছি! যারা আমায় নিয়ে চিন্তা করছেন তাদেরই বারবার কষ্ট দিয়ে ফেলছি!
মুখরকে এখন সরি বলাটাও সম্ভব নয়। তার মুখোমুখি আমি দাঁড়াতে পারবো না কিছুতেই! নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিঁড়তে মন চাইছে। কি বিচ্ছিরি রকমের একটা পরিস্থিতিতে আমি পড়লাম!

বাসের হর্নে সম্বিৎ ফিরে পাই। একি! আমি যে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি! ঠিক সামনের বাসটার মুখোমুখি। বাসটা, বাসটার সাথে আমার এই মুহুর্তে সংঘর্ষ হবে, আর! আর কিছুই ভাবতে পারছি না। সামনের বাসটা আমায় মাঝরাস্তায় দেখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। আর ক’টা সেকেন্ড! তারপরই আমি কবরে!

চোখ খিঁচে বসে পড়েছি! পা দুটো নড়ছে না কিছুতেই। এরা বোধহয় ধরেই নিয়েছে আমার মৃত্যু এখানেই! হঠাৎ হাতে হেঁচকা টান পড়লো। কারো বুকে লুটিয়ে পাশের ফুটপাতে পড়লাম। তরাক করে চোখটা খুলে দেখি সেই চিরচেনা মুখশ্রী!
ঠোঁট ভেঙে কেঁদে তার বুকে মাথা পেতে দিলাম। মুখর আমায় টান মারায় টাল সামলাতে না পেরে আমায় নিয়েই পাশে পড়ে গিয়েছে। আমার এমন আচমকা কান্নাতেই সেও স্তম্ভিত!

আমায় দু’হাতে আঁকড়ে দাঁড় করিয়ে মুখর জিজ্ঞেস করে,
‘কোথাও লেগেছে?’
আমি হেঁচকি তুলতে লাগলাম। কান্নার মাঝেই বললাম,
‘আমি দুঃখিত, মুখর সাহেব।’
মুখর জিজ্ঞেস করলো,
‘কেন, মিস.তিথিয়া?’

‘আপনার সাথে ঐ সময় এমন রাগ দেখানোর জন্য। আমি রাগ করতে চাইনি! আপনাআপনি হয়ে গেছে।’
মুখর হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো। আমি বুঝলাম না। প্রশ্নবোধক চিহ্ন মুখে এঁটে দাঁড়িয়ে আছি। সে হাসতে হাসতেই বললো,
‘আপনি অনেক মিষ্টি, মিস তিথিয়া!’

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩১

(আমার গল্প দেরিতে দেওয়ার কারণ অনেকেই জানেন। আবারো বলছি, ক’দিন পরই আমার পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। যার কারণে এক দিন পর পর গল্প দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সারাবছর পড়ার কাছে যাইনি, তবে এখন গল্প লিখাতে মনোযোগ কম দিয়ে পড়ায় মন দিচ্ছি! রাগ করবেন না আপনারা কেমন? ভালোবাসা নেবেন।)

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩৩+৩৪