মধুবালা পর্ব ১৬

মধুবালা পর্ব ১৬
ফারজানা আক্তার

বাতাসে খেলা করছে পানির ঢেউ। রিনিঝিনি শব্দ আলিফ লিলির কর্ণকুহর হলেও কারো এতে কোনো ধ্যান নেই। চারপাশের সবুজ পাতা বাতাসে দুলছে। গাছের পাতা যেনো অদ্ভুত শব্দ করছে লিলির মনে হচ্ছে।
“সম্পর্কের পর এই প্রথম আমাদের দেখা হলো। এর আগে কখনোও আমাদের আর ভিডিও কলেও কথা হয়নি। তবুও তোমায় দেখে আমি একটুও অবাক হয়নি। তোমার কী একটুও মাথায় আসেনি যে আমি ছোঁয়াকে ভালোবাসলে তোমাকে দেখে আমি অবাক হলাম না কেনো?”

“তাহলে কী?”
“হুম তাহলে আমি দুইদিন আগেই জেনেছি আলিয়ার থেকে।
আমার প্রথম দেখায় ছোঁয়া কে ভালো লেগেছিলো। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি আমি সেদিন ছোঁয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম মুগ্ধ নয়নে। পরে আমি খোঁজ নিয়ে দেখি তোমার চাচাতো বোন লামিয়া আমার বোন আলিয়ার সাথে পড়ে তারপর আলিয়াকে বুঝিয়ে বলে ওকে দিয়ে তোমার নাম্বার সংগ্রহ করলাম যদিও আমি ছোঁয়ার নাম্বার চেয়েছিলাম কিন্তু আলিয়া ভুল করে তোমার নাম্বার নিয়ে এসেছিলো। তারপর থেকে তোমার সাথে কথা বলা শুরু করলাম কিন্তু মনে মনে ছোঁয়ার ছবি আঁকতাম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বিশ্বাস করো মনে ছোঁয়ার ছবি আঁকলেও আমি তোমাকেই ভালোবেসে ফেলেছি। যার সাথে কথা বলেছি তার প্রতিই দূর্বল হয়েছি। ছোঁয়াকে শুধু দুই একবার দেখেছি আর তোমার সাথে এতগুলো দিন এতো এতো মুহুর্ত কাটিয়েছি। শেষ পর্যন্ত তোমাকে ভালোবাাতে বাধ্য হয়েছি আমি।

তোমার কথাগুলো মুগ্ধ করছে আমায়, এতোটা মুগ্ধ আমি ছোঁয়াকে দেখেও হয়নি।
আলিয়ার থেকে জানতে পেরে এই বিষয়টা আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছি সাথে বুকের বাঁ পাশে ব্যাথাও হয়েছিলো খানিকক্ষণ। তবে পরে মাথা ঠান্ডা করে ভেবেছি আমি। ভুল আমারই ছিলো। আমি আলিয়াকে নাম বলতে ভুল করেছিলাম।

কিন্তু একদিকে ভালোই হয়েছে। যদি সেদিন নামে ভুল না করতাম তাহলে তোমার মতো পাগলীকে পেতাম না কখনোই। হুম ছোঁয়াকে আমি মায়াবতী বলতাম ঠিকই কিন্তু এই মুহুর্তে আমার চোখে একটামাত্র তুমিই আমার মায়াবতী। ভালোবাসি তোমায়, স্বপ্নেও তোমায় ছেড়ে যাওয়ার কথা কল্পনা করবোনা আমি”

লিলি হা হয়ে শুনছে আলিফের সব কথা। লিলির সত্যিই খেয়াল ছিলোনা যে আলিফ ছোঁয়ার জায়গায় ওকে দেখে অবাক না হওয়ার বিষয়টা।
আলিফের কথা শোনে লিলির চোখে খুশির অশ্রু চিকচিক করছে আর ঠোঁট জোড়া থরথর করে কাঁপছে। লিলির মনে হচ্ছে এই মুহুর্ত টা ওর জীবনের সেরা মুহুর্ত।

এভাবে নিস্তব্ধ নীরবভাবে কেটে গেলো অনেকগুলো দিন। ছোঁয়া এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি কারো সাথে।
একদিন সন্ধ্যার দিকে জায়েদা বেগম ছোঁয়ার রুমে যায় কফি নিয়ে। সন্ধ্যায় কফি খাওয়া ছোঁয়ার একটা বদঅভ্যেসে পরিনত হয়েছে তবে সেলিনা পারভীনের মৃত্যুর পর থেকে ওকে সন্ধ্যায় কফি খেতে দেখা যায়নি আর।

জায়দো বেগমের প্রবেশ দেখে ছোঁয়া বেলকনিতে গিয়ে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। জায়েদা বেগম ডাকতে চেয়েও ডাকতে পারেনি, গলা ধরে এসেছে উনার। তাই চোখের কোণে জমা জল নিয়ে চলে গেলেন উনি। ছোঁয়ার কেমন জানি ভীষণ লজ্জা লাগছে এই মহিলার সামনে যেতে আজ। ছোট থেকে যাকে চাচিম্মু জেনে এসেছে সে কিনা তার সৎমা, মানতে পারছেনা ছোঁয়া। গাল বেয়ে অশ্রুকণা ঝড়তে থাকে তার।

লামিয়া সানিয়া সোহা লিলি সবাই এসে ছোঁয়ার সাথে আড্ডা দিচ্ছে। উদ্দেশ্য ছোঁয়ার মন ভালো করা। সোহার মন টাও অনেকটা খারাপ তাই সে চুপচাপ হয়ে আছে। সোহা একা একা বসে খাতায় আঁকিবুঁকি করছিলো মন খারাপ করে। তাই লিলি ওকে জোর করে নিয়ে এসেছে। সবার হাতে কফির মগ। কিন্তু ছোঁয়া হাতে কফি মগ নেয়নি।

সন্ধ্যার কফিটা ওকে সবসময়ই সেলিনা পারভীন করে দিতো, কফির মগ হাতে নিলেই গলা জড়িয়ে কান্না চলে আসে ছোঁয়ার।
সোহার মন খারাপের প্রধান কারণ হলো মা নেই আর সবে জানতে পেরেছে ছোঁয়া তার আপন বড় বোন নয় তাই সে মনমরা হয়ে আছে। যদি ছোঁয়া আর আগেরমতো আদর না করে সে ভয়ে। মায়ের পরে যে একমাত্র বড় বোনকেই মা’য়ের স্থানে বসানো যায়।

ছোঁয়ার অবস্থা দেখে লিলি সানিয়া আর লামিয়াকে ইশারা করলো সোহাকে নিয়ে অন্যকোথাও যাওয়ার জন্য। তারা চলে গেলে লিলি ছোঁয়ার বাহু জরিয়ে ধরে বলে “এই শুভ্র ভাইয়ের মধুবালা এবার তো একটু স্বাভাবিক হ। আর কত এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকবি। যে যাওয়ার সে তো চলে যাবেই, আমরা সবাই-ই একদিন এভাবে চলে যাবো না ফেরার দেশে।

বাঁচা ম’রা আমাদের হাতে কিছুই নেই ছোঁয়া বুঝার চেষ্টা কর। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকেনা বোন। এবার একটু নিজেকে সামলা। তুই কি জানিস তোর এমন অবস্থা দেখে সোহার অবস্থা কতটা খারাপের দিকে যাচ্ছে? মেয়েটা সবেমাত্র মা হারিয়েছে, বয়স খুব অল্প। মায়ের পর তুই ওর মা। তুই যদি এভাবে মনমরা হয়ে থাকিস সারাক্ষণ তবে কিভাবে হবে? সোহাকে কে সামলাবে? মেয়েটা যে তোর আদর পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।

তুই কি জানিস তুই সোহার আপন বোন না জেনেও সোহা তোকে না পেয়ে সেদিনরাতে কত পাগলামি করেছে? ওকে অনেক কষ্টে ঘুমের ঔষুধ খাইয়ে ঘুম নেওয়া হয়েছিলো।”
লিলির কথা শোনে ছোঁয়া কি করবে বুঝতে পারছেনা। সবকিছু যে ওর এই মুহুর্তে বি’ষা’ক্ত লাগছে। লিলি চলে গেলে ছোঁয়া চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে ওর বলা প্রতিটি কথা। লিলি তো ভুল কিছু বলেনি। সোহার বয়স অল্প, এই বয়সে মা হারিয়ে মেয়েটা সত্যিই ভে’ঙে পরেছে খুব কিন্তু বাহির থেকে দেখে তা বুঝা মুসকিল।

সোহা হলরুমে সবার সাথে বসেছিলো। ছোঁয়া দৌড়ে এসে সোহাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে সবার সামনে। সোহাও নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে চোখের জল ছেড়ে দেয়।
সেলিনা পারভীন মা’রা যাওয়ার পর এই প্রথম দুই বোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। এর আগে যে যার মতো শোক পালন করেছে। কারো দিকে কারো কোনো লক্ষ ছিলোনা।

ছোঁয়া পাগলের মতো সোহাকে কপালে গালে থুঁতনিতে চুমু দিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে বোনকে। আর প্রমিজ করে আজ থেকে সে মায়ের সব দায়িত্ব পালন করবে। সোহার বুকের শূন্যতা যেনো মিলিয়ে যায় মুহুর্তে।
দূর থেকে দুই মেয়েকে দেখে অশ্রু চোখে একটা মুচকি হাসি দেয় মান্নান মির্জা।

রাত ১১টা ৩০ ছুঁই ছুঁই। সবাই খেয়ে যার যার রুমে চলে গেলো। ছোঁয়া সোহার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। সোহাকে আজ সে নিজের কাছে রেখেছে, সোহা এমনিতে সানিয়ার সাথেই থাকে। হঠাৎ দরজায় কটকট শব্দ হলে ছোঁয়া গিয়ে দরজা খুলে দেখে শুভ্র দাঁড়িয়ে। আজ সারাদিন শুভ্রর দেখা পায়নি ছোঁয়া। হঠাৎ এভাবে দরজায় শুভ্রকে দেখে ছোঁয়া অবাকই হয়েছে বটে। তবুও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ছোঁয়া বললো “সারাদিন কোথায় ছিলে শুভ্র ভাই?”

“ভাই ডাকলে বলবোনা কোথায় ছিলাম।”
“আচ্ছা বলতে হবেনা। কেনো এসেছো বলো।”
“তোর সাথে একটু সময় কাটাতাম। কিন্তু আজ নাকি সোহা তোর সাথে ঘুমাবে।
চল বেলকনিতে যায়। একটু প্রাণভরে দেখে অশান্ত মনটাকে শান্তি করি।”
ছোঁয়া একটু লজ্জা পায়। শুভ্র মুচকি হেঁসে রুমে প্রবেশ করে বেলকনির দিকে যেতেই ছোঁয়া বলে “সোহা জেগে আছে, ওকে ঘুম পাড়িয়ে তারপর আসি?”

শুভ্র কিছু বলার আগেই সোহা বলে “আমি একা ঘুমাতে পারবো আপা। তুমি যাও শুভ্র ভাইয়ার সাথে। না হয় পরে দেখা যাবে আমার আগে তোমারই ঘুম পেয়ে যাবে।”
শুভ্র কুটকুট করে হেঁসে দিলো। ছোঁয়া আরো বেশিই লজ্জা পেলো যেনো।
এবার শুভ্র ছোঁয়ার হাত ধরেই বেলকনিতে নিয়ে যায়। ওরা বেলকনিতে গেলে সোহা উঠে ধীর পায়ে বাহিরে চলে যায়।

“এই মধুবালা কবে হবি তুই আমার?
বুকটা যে শুন্য হয়ে আছে তোর শূন্যতায়।”
“আমার হাতে কি কিছু আছে বলো? বড় আব্বু আর দাদি কিছুতেই রাজি হবেনা এই বিয়ের জন্য।”
“ধর তারা রাজি তারপর তুই কি সাজবি আমার বধু?”
“হুম”

মুচকি হাসির সাথে কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলে ছোঁয়া।
ঘড়ির কাঁ’টা’য় ১১টা ৫৫। ১২টা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট। শুভ্র ছোঁয়াকে বললো “চল ছাঁদে যাবো।”
“এতো রাতে?”
“সমস্যা কি? আমি আছি তো আমার পাগলী মধুবালা।”
“নাহ আজকে নাহ। ঘুম আসে আমার।”

“জানি তো তুই ঘুম পাগলী তাইতো এতোক্ষণ গল্প করলাম যাতে ঘুম চোখে বাসা বাঁধতে না পারে।”
“এ্যাঁ?”
“হ্যাঁ। চল তো”

মধুবালা পর্ব ১৫

এটা বলেই শুভ্র ছোঁয়ার চোখ বেঁ’ধে দেয় একটা সাদা রুমাল দিয়ে। ছোঁয়া অবাক হয় ভীষণ। শুভ্র ছোঁয়ার হাত ধরে খুব সাবধানে ছাঁদে নিয়ে যায় ওকে। ছাঁদে গিয়ে শুভ্র ছোঁয়াকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড় করিয়েে চোখের বাঁধন খুলে দেয়।
পুরো ছাঁদ খুব সুন্দর করে সাঁজানো হয়েছে। প্রত্যকেটা ফুল ছোঁয়ার পছন্দের। ছোঁয়ার মনের মতো করে সাজানো হয়েছে আজ ছাঁদের প্রতিটি কোণা। হঠাৎ ছোঁয়ার কানে ভেসে আসলো ছাঁদের দরজা থেকে_____

মধুবালা পর্ব ১৭