মধুবালা পর্ব ১৫

মধুবালা পর্ব ১৫
ফারজানা আক্তার

শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে ছোঁয়া। শুভ্র বাঁধা দিচ্ছেনা। কাঁদুক, কাঁদলে যদি বুকটা হালকা হয় তবে কাঁদুক। শুভ্র ছোঁয়াকে খোঁজে পেয়েছে এটাই অনেক এই মুহুর্তে ওর জন্য। শুভ্র নিজেও কাঁদতেছে। বুকটা যে শূন্য হয়ে গিয়েছিলো ছোঁয়াকে হারিয়ে।

রাত প্রায়ই ১২টা ছুঁই ছুঁই। পাগলের মতো খুঁজেছে শুভ্র ছোঁয়াকে বিকাল থেকে। ছোঁয়া যে যে জায়গা গুলোই যেতে পারে সব জায়গায় খুঁজেছে শুভ্র ওকে কিন্তু কোথাও খোঁজে পায়নি। একটু আগেই শুভ্র ট্রেন স্টেশনে এসেছিলো ছোঁয়াকে খোঁজার ছলে তবে শুভ্রর একটুও ভাবনা ছিলোনা যে এখানেই সে তার ছোঁয়ার দেখা পাবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছোঁয়া কাপড় চোপড় গুছিয়ে চলে যাচ্ছিলো কিন্তু গন্তব্য জানা ছিলোনা তাই এতসময় ধরে এই স্টেশনেই বসে বসে অ’শ্রু বি’স’র্জ’ন দিচ্ছিলো। মুহুর্তে যেনো পৃথিবীটা ধোঁয়াসা হয়ে গেলো ছোঁয়ার এমন মনে হচ্ছে। শুভ্র ছোঁয়ার পাশে এসে বসতেই প্রথমে ছোঁয়া পালিয়ে যেতে চাইছিলো কিন্তু শুভ্র তা হতে দেয়নি। খপ করে ছোঁয়ার হাত শক্ত করে ধরে ওর পাশে বসিয়ে বকাও দিয়েছে হালকা। আর সাথে সাথেই ছোঁয়া ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।

রাত এখন ২টা ছুঁই ছুঁই। এখনো ছোঁয়া শুভ্রর কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। তবে কান্নার বেগ কমেছে অনেকটা। থেকে থেকে হেঁচকি তুলছে শুধু। শুভ্র বাক প্রতিবন্ধীর মতো বসে আছে। শুভ্রর যে জানা নেই ছোঁয়াকে এই মুহুর্তে কোন ভাষায় সে সান্তনা দিবে। মেয়েটা যে ভেতর থেকে ভে’ঙে গেছে পুরোটা। শুভ্রর সহ্য হচ্ছেনা ছোঁয়ার কষ্ট। এর মাঝেই শুভ্র মিনমিন করে কয়েকবার বলেছে ছোঁয়াকে বাসায় যাওয়ার কথা কিন্তু ছোঁয়ার কোনো সাড়াশব্দ সে পায়নি। ছোঁয়া বাসায় যাওয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত না। ভীষণ লজ্জা করছে ওর।

কেনো এতোগুলা বছর আমাকে বলেননি আপনি কিছু? কেনো? আপনি যদি আমাকে আগে বলতেন স্বাভাবিক ভাবে তবে আজ অস্বাভাবিকভাবে জানতে হতোনা আমাকে। কেনো এতো বড় মিথ্যা? কেনো এতো বড় ধোঁ’কা করলেন আপনি আমার সাথে?
আজ বুঝতে পারছি আপনি এই কারণেই ছোঁয়ার প্রতি দূর্বল অথচ আমি ভাবতাম..…..

আপনি কি ভাবতে পারছেন এতো বড় সত্যি টা জানার পর মেয়েটার অবস্থা কি হয়েছে? কোথায় আছে মেয়েটা? একটু কী চিন্তা হচ্ছে না মেয়ের জন্য বাবা হয়ে?
আপনি কী জানেন আজকের পর থেকে ছোঁয়া আপনাকে কতটা ঘৃণার নজরে দেখবে? আপনার জন্য মেয়েটার মনে পাহাড়সমান ঘৃণা জন্মেছে।

কিভাবে পারলেন বিয়ে করে স্ত্রী সন্তানকে অস্বীকার করতে আপনি? শুধু মাত্র আপনার পাপের ফলে আজ আমি মাতৃশুন্য। আপনার পাপের শাস্তি খোদা আমাকে দিচ্ছে। আমি বিয়ের এতোগুলো বছর হয়ে গেলেও মা ডাক শুনতে পারিনি শুধুমাত্র আপনার করা পাপের ফলের জন্য। আপনি খারাপ, খুব খারাপ, শুনছেন?”

কথাগুলো বলতে বলতেই খুব ক্লান্ত হয়ে বসে পরেন জায়েদা বেগম। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন জীবন মির্জা। তখনই রুমে প্রবেশ করেন মান্নান মির্জা আর জীবন মির্জার উদ্দেশ্যে বলেন “আমি চাইনি কখনো তোর এই রহস্য সবার সামনে আসুক তবুও ওই যে বলেনা সত্য কখনো গোপন থাকেনা। ঠিক তা-ই হলো। এতোগুলা বছর পর তোকে দাঁড়াতে হলো কাঠগড়ায়।

যাইহোক আমি বলতে এসেছিলাম আমার ছোঁয়া আমার মেয়েই থাকবে। হোক সব জানাজানি এতে আমার কোনো কিছু যায় আসেনা। আমার মেয়ের প্রতি কখনোই তুই অধিকার দেখাতে আসবিনা। আমি চাইনা বিষয়টি ঘরের বাহিরে যাক।
আর হ্যাঁ শুভ্র আরো দুই ঘন্টা আগেই ছোঁয়াকে পেয়েছে। শুভ্র কোনোমতে বুঝিয়ে ওকে বাসায় নিয়ে আসবে। চিন্তা করা লাগবেনা কাউকে আর আমার মেয়ের জন্য। ”

জীবন মির্জার চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো। মান্নান মির্জা কথাগুলো বলেই চলে গেলেন।
জায়েদা বেগমের চোখের জল যেনো আজ অবাধ্য।

অনেক রাত হয়েছে বাসায় চল।”
“কিছুতেই যাবোনা।”
“দেখ ছোঁয়া এবার কিন্তু থা’প্প’ড় খাবি।”
“দাও।”
কান্নাজড়িতো নরম কন্ঠে বলে ছোঁয়া। শুভ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে নিজের ঠোঁট জোড়া ছোঁয়ার কপালে বসিয়ে দিলো। ভালোবাসারর প্রথম স্পর্শ। ছোঁয়া হালকা কেঁপে উঠে।
“দিলাম এবার চল।”

“বললাম তো যাবোনা ওই বাসায় আমি আর। বড় আব্বু আর দাদি এখন থেকে আরো বেশি করে কথা শুনাবে আমাকে। ”
“কেউ তোকে কোনো কথা শুনাবেনা আর, বিশ্বাস রাখ আমার উপর।
আচ্ছা তুই শুধু নিজের কথায়-ই ভাবছিস, একবারো কী চিন্তা এসেছে তোর মাথায় ছোট আম্মুর? ছোট আম্মুও তো তোর মতো আজ জানতে পেরেছে সবটা। তুই উনার স্বামীর আগের স্ত্রীর সন্তান এটা জানার পর তার অবস্থার কথা একবারও এসেছে কী তোর মাথায়?

উনিও ভালো নেই। চল বাসায় চল। উনি এতোকিছু জানার পর বাসায় থাকতে পারলে তুই কেনো পারবিনা?
আর কোনো কথা শুনতে চাইনা, বাসায় চল নয়তো কিন্তু সত্যিই মা’র’তে মা’র’তে নিয়ে যাবো।”
ছোঁয়া আর কোনো কথা বলেনি কারণ সে জানে শুভ্র ওকে বাসায় না নিয়ে এক পা-ও নাড়াবে না এখান থেকে। শুভ্রর জেদ সম্পর্কে যে ছোঁয়ার থেকে বেশি ধারণা আর কারো নেই। ছোঁয়া বাধ্য মেয়ের মতোই গাড়িতে এসে বসলো।

শেষ রাতের দিকে দুজন বাসায় ফিরলো। বেলাল মির্জা আনজুমা খাতুন সবাই-ই আজ জেগে ছোঁয়ার জন্য। হলরুমে বসে আছে সবাই। আনজুমা খাতুন আজ ছোঁয়াকে মন থেকে মেনে নিয়েছে ছোঁয়ার জন্ম বৈধ জেনে কিন্তু উনি এটা ছোঁয়াকে জানানোর সাহস পাচ্ছেননা, ভীষণ লজ্জা লাগছে উনার।

শুভ্র হাত ধরে ছোঁয়াকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেন। ছোঁয়ার ব্যাগ শুভ্রর কাঁধে। ছোঁয়া সবাইকে এড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। শুভ্র সবাইকে বলে ছোঁয়াকে এখন বিরক্ত না করার জন্য আর একা থাকতে দেওয়ার জন্য। সবাইকে ঘুমাতে যেতে বলে শুভ্র এগিয়ে গেলো ছোঁয়ার রুমের দিকে। রুমে গিয়ে দেখে ছোঁয়া রুমে নেই, ওয়াশরুম থেকে ঝুম ঝুম শব্দ ভেসে আসছে পানির। ছোঁয়ার ব্যাগ বিছানার উপর রেখে শুভ্র চলে যায় নিজের রুমে।

ছোঁয়া ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসতেই ফজরের আজানের সুর ভাসছে প্রকৃতি জুড়ে। সকাল হয়ে গেছে। আজান শেষ হতেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ছোঁয়া নামাজ পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। মনের সাথে শরীরের সম্পর্ক ওতপ্রোত ভাবে জড়িতো। মন ভালো না থাকলে শরীরটাও নেতিয়ে পরে।

লিলি প্রায়ই সকাল ১০টাই জেগেছে তাও আলিফ কল করে জাগিয়েছে ওকে। আজ আলিফের কল পেয়ে খুশির চেয়ে কষ্ট হচ্ছে বেশি লিলির। লিলি আজ আলিফকে এমন একটা সত্যি বলবে যা বলার পর তাদের সম্পর্ক হয়তো আর থাকবেনা স্বাভাবিক। বুকটা ছিঁ’ড়ে যেনো প্রাণপাখি উড়ে যাচ্ছে লিলির।

একটুখানি কথা বলে লিলি কল রেখে দেয় আজ। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিংয়ে যায়। পুরো ঘরে আজ পিনপতন নীরবতা। টেবিলের উপর কলা পাউরুটি আর কিছু ফল রাখা আছে। একটা কলা আর পাউরুটি নিয়ে ছাঁদের দিকে এগিয়ে গেলো লিলি। ছাঁদে গিয়ে ছোঁয়ার ফুলগাছের ফুলগুলো ছুঁয়ে একটা শুকনো হাসি দিলো। মনটা ভীষণ আনচান করছে আজ লিলির।

এই সকালেই রোদের তাপ ভীষণ প্রখর। লিলির মনে হচ্ছে ওর শরীর যেনো রোদের তাপে ঝ’ল’ছে যাচ্ছে।
লিলি আর থাকতে পারলোনা ছাঁদে। দ্রুত পায়ে নেমে গেলো সিড়ি দিয়ে।
নিজের রুমে প্রবেশ করে লিলি ফোন হাতে মেসেজ অপশনে গিয়ে লিখলো “কখনোও যদি মা’রা’ত্ম’ক কোনো সত্যি জানতে পারেন আমার ব্যাপারে তবে ছেড়ে চলে যাবে আমায় নাকি বুকে টেনে নিবেন স্যার?”
এতটুকু লিখেই আলিফের নাম্বারে সেন্ড করলো লিলি।

আলিফ মেসেজটা পেয়ে তেমন কোনো রিয়াকশন না করে রিপ্লাই দেয় “অবশ্যই যাবোনা ছেড়ে কভু। আমি তোমাকে ভালোবাসি, প্রচন্ড রকম ভালোবেসে ফেলেছি। প্রথম দেখা শুধু ভালো লাগা ছিলো তবে কথা বলতে বলতে এতোটাই কাছের হয়ে গিয়েছো যে ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা হয়ে বুকের গভীরে মিশে গেছো।
আজ বিকালে দেখা করিও।”

বিকালে আলিফ বসে আছে লেকের পাড়ে। একা একা বসে থাকতে কেমন জানি বিরক্তি লাগছে আলিফের।
একটু পরেই লিলি আসলে সব বিরক্তি মিশে যায় প্রকৃতির সাথে আলিফের।
লিলির মন খারাপ আজ। পাশাপাশি বসে আছে দুজন। কেউ কোনো কথা বলছেনা।
নীরবতা কা’টি’য়ে আলিফ বলে “বলো এবার সেই মা’রা’ত্ম’ক সত্যটি। শুনতে ইচ্ছুক আমি।”

মুহুর্তেই লিলির বুকের ধুকপুক প্রচন্ড রকম বেড়ে গেলো। শ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে লিলির।
আলিফ এরমাঝেই আরো কয়েকবার বললো বলতে। লিলি ঘামছে প্রচুর। লিলির অবস্থা দেখে আলিফ ভয় পেয়ে যায়।
কি এমন সত্যি যার জন্য লিলির অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে?
ভাবছে আলিফ।
আলিফ গিয়ে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার কিনে এনে লিলিকে খাইয়ে দিলো।

প্রায়ই অনেকক্ষণ পর লিলি ধীর কন্ঠে বলা শুরু করলো “আমি লিলি স্যার। বিশ্বাস করুন আমি মোটেও জানতাম না যে আপনি ছোঁয়া ভেবে আমায় মেসেজ দিয়েছিলেন যদি জানতাম তবে কখনোই আপনার সাথে এতোটা গভীরে যেতাম না। আমি যখন জানতে পারি তখন অনেক দেরি হয়ে যায় আর আমাদের বাসায় পারিবারিক ঝামেলা চলছিলো কয়েকদিন ধরে তারমাঝে ছোঁয়ার মা মা’রা গেলেন, এতোকিছুর মাঝে সত্যি টা বলতে যেয়েও পিছিয়ে গিয়েছিলাম আমি বারংবার। প্লিজ স্যার ক্ষমা করে দিন, অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে আমার।

কিভাবে বলবো স্যার লজ্জার কথা, প্রথম দেখায় আপনার প্রতি একটু দূর্বল হয়ে পরেছিলাম তাই আপনার মেসেজ পেয়ে কিছু না ভেবেই কথা বলা শুরু করেছি। কিন্তু ধীরে ধীরে আপনার কথার ভাঁজে বুঝতে পারি আপনি আমাকে নয় বরং ছোঁয়াকে পছন্দ করেন। কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি স্যার, বড্ড বেশিই ভালোবাসি।
আপনাকে হারানোর ভয় আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে স্যার।”

মধুবালা পর্ব ১৪

সব বলে দিয়েছি এবার সিদ্ধান্ত আপনার হাতে, এই সম্পর্ক অধরা থাকবে নাকি পূর্ণতা পাবে তা আপনার উপরই ছেড়ে দিলাম।”
সব শুনে আলিফ কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কিছু বলার মতো খুঁজে পাছেনা সে। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে লিলি। আলিফ চোখ ঘুরিয়ে তাকায় লিলির দিকে, লিলি ঢুক গিলে।

মধুবালা পর্ব ১৬