অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩৬

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩৬
তাশরিন মোহেরা

আব্বার কথাটা শুনে মনটা কেমন যেন ছোট হয়ে গেল। আমার প্রতি মুখরের দূর্বলতাটা আমিও খেয়াল করেছি বেশ আগে। তবে আব্বার অসুস্থতার কারণে এ নিয়ে বেশি কিছু ভাবা হয়নি। তবে মুখর বিষয়টাকে সরাসরি বিয়ে পর্যন্ত এগিয়ে নিয়েছে, যা আমাকে বেশ অবাক করলো। সাথে আব্বার এমন কথায় মনটা ভেঙে গেল। ভেবেছি কোমার পর হয়তো আব্বার মানসিকতা কিছুটা হলেও বদলাবে। আমার মনটা কিছুটা হলেও বুঝবেন তিনি! তবে আমিই ভুল ছিলাম। আব্বা কখনোই তার স্বভাবকে বদলাতে পারবেন না। উল্টো আমাকেই চার দেয়ালে বন্দীর মতো জীবন কাটাতে হবে।

রুমে এসে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনটা নিয়ে ভাবছি। ভাগ্যটা আমার বড্ড খারাপ! আর এই পোড়া কপাল নিয়ে আমি কিনা সুখী থাকার আশা করছিলাম। আশা করছিলাম যাকে চেয়েছি তাকেই পাবো! হাহ্! তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে মন চাইছে। আমি কি কখনোই যা আশা করেছি তা পেয়েছি? তবে মুখরকে নিয়ে কেন মন মাঝে এতো আশা আমার? কেন তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছেটা এমন পেয়ে বসেছে আমায়?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পর্দাটা টেনে ঘর আঁধার করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ফোনটা হঠাৎ আলোকিত হয়ে উঠলো। দেখলাম মুখর ফোন দিয়েছে। ফোনটা ধরলাম না আমি। ছেলেটাকে অযথা নিজের জীবনে জড়িয়ে লাভ নেই। তার চাইতে বরং দূরে থেকে আমায় ভুলে যাওয়াটাই অধিক শ্রেয় তার জন্য!

সে পরপর দু’বার ফোন দেয়। রিসিভ করিনি। মুখরের অযথা বারবার ফোন দেওয়ার অভ্যাস নেই। ফোন রিসিভ না করলে সে টেক্সট করে জিজ্ঞেস করে আমি ব্যস্ত আছি কিনা! এখনো টেক্সট করেছে। তবে টেক্সটটা উপর থেকে দেখেই ফোনটা অফ করে দিলাম। তার সাথে কথা বলতে খুব মন চাইছে, ইচ্ছে করছে সবটা ছেড়ে ছুটে যাই তার কাছে। দুজনে কোনো অচিনপুরে হারিয়ে যাই। তবে আমার এমন অবান্তর ইচ্ছেদের কোনো ঠাঁই নেই। আব্বার বেড়াজালে বন্দী আমি!

মনটা কেমন যেন আনচান করে উঠলো। বুকে প্রবল রক্তক্ষরণ হচ্ছে যেন! ব্যাথায় অসহ্য হয়ে উঠেছে শরীর। মনের ব্যাথা বোধহয় এমনি। অশ্রুগুলোও বাধ মানলো না। অঝোরে গড়িয়ে পড়লো বালিশময়। বালিশটা তক্ষুণি ভিজে গেল আমার নোনাজলে। মুখটা বালিশের মাঝেই চেপে খানিক আর্তনাদ করার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ কান্নার পর চোখ দুটো বুজে এলো। কান্না করতে গিয়ে দূর্বল হয়ে গেছি। ঘুমিয়ে পড়লাম তৎক্ষণাৎ।

ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রেডি হয়ে খাবার টেবিলে বসেছি। আব্বা তার রুটিটা ছিঁড়ে মুখে পুরতেই বললেন,
‘কাল অনেক ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
মনটা তেতো হয়ে গেছে কেমন যেন। তাই আব্বার কথাতে তেমন একটা সাড়া দিলাম না। নিজের জন্য একটা পাউরুটি নিয়ে তাতে জেলি লাগিয়ে আনমনে খেতে লাগলাম। আব্বার দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখতেও মন চাইছে না আমার।
আব্বা নিজে নিজেই বললেন,

‘যেহেতু মেয়ে হিসেবে জন্মেছিস, তোকে তো সারাটাজীবন আমার সাথে রেখে দিতে পারি না। সমাজেও নানান ধরনের কানাঘুঁষা শুনতে হবে না হয়।’
আমি ভ্রু কুঁচকে পাউরুটির দিকে চেয়ে আছি। তবে কানটা আব্বার কথার দিকে। হঠাৎ এসব কি বলছেন আব্বা? আব্বার মুখে কখনো সমাজের কথা শুনতে দেখা যায়নি। তবে আজ এসব কি বলছেন তিনি হুট করেই? কিছু না বলে চুপচাপ শুনলাম। আব্বা আবারো বললেন,

‘তাই ভেবেছি তোকে একটা বিয়ে দেবো।’
চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আমার সাথে সাথে। বড় বড় চোখ নিয়ে আব্বার দিকে তাকালাম। বিশ্বাস হতে চাইলো না কিছুই! আব্বা বলছেন তাও আবার আমার বিয়ের কথা? মানে কি? আব্বা আমার হা হয়ে যাওয়া মুখটা একবার দেখলেন। তারপর বললেন,

‘হ্যাঁ, তোকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। যতই কষ্ট হোক, তোকে তো আর নিজের কাছে রেখে দিতে পারি না। সব বাবাদেরই এই পরিস্থিতির জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হয়।’

বিয়ের কথা শুনে চোখেমুখে আচমকা একটা মুখই ভেসে উঠলো আমার। মনটা খারাপের দিকে থেকে উলটে ভালোতে রূপ নিয়েছে। আব্বা কি তবে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছেন? মুখরকে কি তবে আব্বা আমার জন্য উপযুক্ত মনে করছেন? তা হলে কি আমার আশাটাই শেষমেশ পুরণ হতে চলেছে? আব্বার দিকে গদগদ হয়ে তাকিয়ে আছি।
তবে, আমার আশায় পানি ঢেলে বলে উঠলেন,

‘তবে পাত্র মুখর শিকদার নয়। আমেনার ছেলেকে আমি তোর স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবো না তা আগেই বলেছি, তিথি!’
সঙ্গে সঙ্গে মনটা মিইয়ে গেল। সারা মুখজুড়ে ঘন অন্ধকার নেমে এলো আমার। পাত্র মুখর নয় মানে? কেন নয়? কি দোষ আছে ছেলেটায়? আব্বার দিকে রাগত্ব দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকতে দেখে আব্বা চোখ নামিয়ে বললেন,

‘তোর রানা চাচার কথা মনে আছে? তার একটা ছেলে আছে শোয়েব। রানা তার পরিবার নিয়ে এখনো কুমিল্লায়ই থাকে। তোর দাদাবাড়ির পাশেই।’
আমি ভেঙে পড়া মন নিয়ে বসে আছি। খাওয়ার রুচিও চলে গেল মুহুর্তেই। আব্বার কোনো কথা-ই কানে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কেন আব্বা বারবার আমার সাথে এমন করছে? বারবার আমার মন ভেঙে কি লাভটা হয় আব্বার?
আব্বা আমার মন খারাপটা দেখেও না দেখার ভান করলো। বললো,

‘ঐ শোয়েব ছেলেটার সাথেই তোর বিয়ে দেবো ভেবেছি। আর আমিও তোর সাথে কুমিল্লায় নিজের বাড়ি চলে যাবো। এক ঢিলে দুইপাখিও মারা যাবে।’
আমি নিজের কষ্ট আর ধরে রাখতে পারলাম না। কান্নারা ছিটকে চলে এলো চোখ বেয়ে। অঝোরে অশ্রুধারা পতন হতে লাগলো। রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। টেবিলে সশব্দে আঘাত করে বললাম,

‘আপনি বারবার এমন করছেন কেন, আব্বা? আমার ইচ্ছের কি কোনো দাম নেই আপনার কাছে? আমি কি আপনার মেয়ে না আব্বা?’
আব্বা শান্তভাবটা বিদ্যমান রেখে বললেন,
‘এখানে তোর মেয়ে হওয়া না হওয়া নিয়ে কথা উঠছে কেন, তিথি? তোর ইচ্ছেটা সঠিক নয়।’
আমি চোখ মুছে চিৎকার করে বললাম,

‘কি সঠিক নয়? মুখরকে ভালোবাসাটা সঠিক নয়? মুখর আমাকে বিয়ে করতে চাইছে এটা সঠিক নয়? কেন আব্বা? মুখরকে কেন আপনার সঠিক মনে হয় না? কেন আপনি মুখরকে মেনে নিতে পারবেন না? আমাকে বলুন!’
আব্বা চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমে যেতে যেতে বললেন,
‘এসব বলতে আমি ইচ্ছুক নই, তিথি।’

আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। আব্বার সবকিছুই আমার অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। আব্বা আমাকে বিয়ে দিতে চাইছেন এমন একজনের সাথে যাকে কিনা আমি কখনো দেখিইনি। তার চাইতে বড় বিষয়, ছেলেটাকে আমি ভালোবাসি না।
আমি বিয়ে করতে চাইনা। মুখরকে ছাড়া আমি কাউকে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নেবো কি করে?

চেয়ারে বসে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। কিছুই ভালো লাগছে না আমার! ভার্সিটি যাওয়ার ইচ্ছেটাও মরে গেছে। আব্বার এসব আমি আর সইতে পারছি না। তন্মধ্যে মুখর আবারো কল দিলো ফোনে। তার ফোন এসেছে দেখে কান্নার বেগ আরো বাড়লো। ছেলেটাকে আমি কষ্ট দিতে চাই না। আমি তাকে ছেড়ে যেতে চাইনা অন্য কোনো সংসারে। অন্য কেউ আমাকে ভালোবাসুক আমি তাও চাই না। আমার শুধু মুখরকেই চাই! কি করবো আমি এই পরিস্থিতিতে? হে সৃষ্টিকর্তা! আপনি আমার সাথে বারংবার এমন খেলা কেন খেলছেন?

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩৫

(গত পর্বে, আপনারা কিছু ভুল দেখিয়ে দিয়েছেন আমায়। তার জন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে ভুলগুলো শুধরানোর সময় পাচ্ছি না শুধু। আজ পর্বটাও ছোট হয়ে গেল। যারা আমার গল্পটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে আমার ভুলটা দেখিয়ে দিয়েছেন তাদের বলছি, আমি খুবই খুবই দুঃখিত। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই। প্রথম কোনো গল্প লিখছি তাই সবদিক সামলাতে পারছি না। আবারো অনেক ধন্যবাদ।🖤)

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩৭