অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪১

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪১
ইফা আমহৃদ

গ্ৰামে থেকে আসার পর চার মাস পেরিয়ে গেছে। অরিশ এখন বিদেশে থাকে। দুমাস হয়েছে গেছে। তার চোখের সমস্যা তীব্র হয়েছে। আগে চশমা ছাড়া যথেষ্ট দেখতে পেত কিন্তু হঠাৎ করেই চশমা পরেও দেখতে পাচ্ছিল না। মাথা সারাদিন ধরে থাকত। তাই চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়। তাও দুই মাস। ডাক্তার তাকে বিদেশে যেতে বলে চিকিৎসা করাতে। তাই অরিশ মাস দুই হয়েছে বিদেশে গেছে, তার সাথে অপূর্বও গেছে।

তরী শুয়ে আছে। চারদিকে আয়ানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ইদানিং তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। বমি বমি পাচ্ছে। কিছু খেলে ঘন্টা খানেক পেটে থাকছে না। সারাদিন মাথা ঘুড়ায়। গাঁ গুলিয়ে উঠে। তলপেটে আগের চেয়ে ভারী ও বড় হয়ে গেছে। তরী পেটের উপর হাত রেখে বসে আছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আরশি হুরমুড়িয়ে ফোন নিয়ে ঢুকল ঘরে। সবে ঘুমের মতো পড়েছে তরী। তার ভেতরেই এমন আরশির প্রকট কন্ঠস্বর শুনে লাফিয়ে উঠলো। ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলল,-” কি হয়েছে আরু? চেচাচ্ছিস কেন?”
আরশি তাকালো একবার। নিভু নিভু কন্ঠে বলল,-” ভা, ভাইয়া ফোন করেছে। তোকে নাকি দুদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না।”
তরী একপলক চাইলো।

-” পরে কথা বলবো নে!”
আরশি চমকালো। হঠাৎ মেয়েটার কি এমন হয়েছে? দুপুরে খেয়ে ছিলো তো? খাবার টেবিলের উপর রাখা। -” তরী, তুই এখনো খাইনি কেন?”
ফোনের ওপাশে থেকে অরিশের কাতর কন্ঠস্বর ভেসে এলো,-” তরী তুই খাস নি।”

দুইজনেই ফোনের দিকে চাইলো। আরশি ফোন কেটে দিলো। খাবার নিয়ে মেখে জোর পূর্বক তরীর মুখে দিয়ে দিলো। আরশি মুখে হাত দিলো। দৌড়ে গেল ওয়াশরুমে। বেসিনের উপর মুখ রাখতেই বমি করে ভাসিয়ে দিলো। আরশি ছুটে এলো। তরীকে এই অবস্থায় দেখে ছুটে গেল মায়ের ঘরের দিকে। অসহায় হয়ে গেল। তরী ট্যাপ ছেড়ে কুলি করে বেরিয়ে এলো।

বালিশে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে রইল। অনিতাকে নিয়ে এসেছে আরশি। অনিতা তরীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরিক্ষা করলেন। তরীর সমস্যা গুলো জানলেন। অনিতা কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,-” তুই কি প্রেগন্যান্ট তরী?”
তরী চুপ করে রইলো। নির্বাক সে। তার হাত টা আপনাআপনি পেটের কাছে চলে গেল। চোখ থেকে আনন্দ মিশ্রিত পানি গড়িয়ে পড়লো। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,-” তুর!”

আরশি নাচছিল। তুর শুনে ভ্রু নাচালো। অভিমানী সুরে বলল,” তুই নাম ঠিক করে ফেললি?”
তরী তখনও নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার অরিশ ভাইয়াকে বলতে ইচ্ছে করছে, ভাইয়া তোমার পিচ্চি আরো একটা পিচ্চির জন্ম দিতে চলেছে। তুমি এবার কাকে সামলাবে?”
অনিতা অরিশকে জানাতে বারণ করলেন। ডাক্তারের রিপোর্ট দেখে আগে সিউর হতে বললো। পরের দিনই ডাক্তারের কাছে গেলেন। তরী চাতক পাখির নিমিত্তে অপেক্ষা করে রইলো রিপোর্টের প্রতিক্ষায়। ডাক্তার কিছু বলেনি, গম্ভীর মুখে কয়েকটা রিপোর্ট করাতে বলেছেন শুধু।

অরিশের দিদা ব্যাপার টা ভালো চোখে দেখলেন না। অনিমার কান ভাঙালেন। তরীকে কিডন্যাপ করার পরে অনেকদিন বন্ধ করে রাখা হয়েছিলো। মেয়েটাকে প’তি’তা হিসেবে উপস্থাপন করলেন অনিতার কাছে। বোঝাতে চাইলেন, এটা অরিশের সন্তান নয়।

পরের দিন রিপোর্টের আশায় বসে ছিলো তরী। অনিতা এলেন। তার মুখ ছিলো গম্ভীর। আরশি ছিলো সাথে। অসহায় কন্ঠে বলতে শুরু করলেন,

-” তোর টিউমার হয়েছে মা। ওভারিতে। ডাক্তার বলেছেন এটা বলের আকার। চার মাসে অনেকটা গভীর হয়ে গেছে। কোষ একত্রিত হয়ে টেরাটোমা টিউমার হয়েছে। ধারণা করেছেন, টিউমারের মধ্যে ক্যান্সার রয়েছে।
টিউমার দু’ধরনের হয়। এক ধরনের টিউমার শুধু এক জায়গাতে বৃদ্ধি পেয়ে এক জায়গাতেই বসে থাকে। এদের বলে বিনাইন টিউমার।

এরা তেমন ক্ষতিকারক নয়। আরেক প্রকার টিউমারের ভেতর থাকা অস্বাভাবিক কোষগুলো রক্ত কিংবা লিম্ফ্ নামক কিছু রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে শরীরের অন্য কোনো অংশে গিয়ে জমা হয়ে সেই অংশের স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটায়, নতুন কোনো টিউমার তৈরি করে সেখানে, তখন তাদের বলে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। এ ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকে অন্যভাবে বলে ক্যান্সারাস টিউমার। কাজের সুবিধায় সংক্ষেপে ক্যান্সার বলে। তোর শরীরে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার।”
তরীর সব আশা ভরসা কাঁচের মতো ভেঙ্গে গেল। দূর্বল হাসলো। সে বেঁচে থাকবে তো। শত বছর বাঁচার ইচ্ছেটা পূর্ণতা পাবে তো। আরশি বলল,

-” মা! আমরা তরীর পেট কেটে বের করে ফেলতে পারি।”
-” একবার রক্ত পরিক্ষা করলে ভালো হতো।”
তরী চুপটি করে বসে রইল। অনিতা আরশিকে বাইরে যেতে বললেন। রিপোর্ট পেপারের নিচ থেকে একটা পেপার বের করে তরীর সামনে রাখলেন। অস্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
-” তরী। আমার অরিকে মুক্তি দিবি।”

তরী মাথা তুলে পেপারের দিকে চেয়ে চমকে উঠলো। তার মামুনি ডিভোর্স পেপার নিয়ে হাজির হয়েছে। চোখজোড়া তার ঝাঁপসা। হাত বুলিয়ে দিল। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
-” মামুনি এটা কিভাবে সম্ভব? আমি তোর অনুমতি না নিয়ে.. । তাছাড়া আমি তাকে ছাড়তে পারি না। আমি যে তাকে দেনমোহর হিসাবে বিয়ে করেছি।”

-” তুই চাস না, অরিশ ভালো থাকুক। আমি তোর চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করে দিবো। তুই সুস্থ হলে আবার আমার ছেলের জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। প্লীজ..। তুই সুস্থ হয়ে গেলে তোকে আমি আবার আমার ছেলে বউ করে নিয়ে আসবো।”

অনিতা তরীর পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তরী ভাবল,” তার মামুনি আগের মতো নেই। বেঁচে থাকলে হয়তো আবার অরিশের সাথে ধুমধাম করে বিয়ে হবে। আর যদি রক্তে হিমোগ্লোবিনে ছড়িয়ে ব্লাড ক্যান্সার হয়। তখন না হয়, তার অগোচরেই পৃথিবী ত্যাগ করলো। তার জন্য ঘৃণা বরাদ্দ করে নাহয় চলে গেল।

ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে ডিভোর্স পেপার সাইন করে দিলো। অনিতা চলে গেল। তরী উঠানের শিমুল গাছের তলে গিয়ে বসলো। তার চোখের বাঁধ মানছে না। রাত পেরিয়ে গেল। ভোর হয়ে এলো। ভোর পেরিয়ে দুপুর হয়ে এলো। তরী উঠে বাড়ির অন্তর্ভাগে প্রবেশ করল। ভেতরটা সাজানো- গোছানো। কয়েকটা মেয়ে বসে আছে। তার মাঝে আরশির বসে আছে। একদম নিশ্চুপ সে। দুই হাত মেহেদীর রঙে রাঙানো।
তরী যেতেই টেনে নিয়ে মেহেদী পড়াতে লাগলো। তরীর কান্না মিশ্রিত ফোলা ফোলা চোখে সবকিছু দেখে আধো আধো কন্ঠে বলল,

-” মেহেদী পড়াচ্ছেন কেন?”
-” তোর যে বিয়ে!” অনিতা এসে বললেন।
-” বিয়ে! আমার! মানে!” অবাক হয়ে তরী।
-” শুধু তোর না। আরশি আর তোর দুজনের। নিভ্রান তোকে বিয়ে করতে রাজি আছে আর স্যামি, সামিরার ভাইয়ের সাথে আরশির।”

তরী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। তার বিয়ে অথচ সে জানে না। অনিতার সামনে দাঁড় বলল,-” কি বলছো তুমি মামুনি? আমি যে তোমার ছেলের বউ। হ্যাঁ আমাদের আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ে হয়নি। তাতে কি?”
-” তুই তো নিজেই ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছিস।”
-” কিন্তু অরিশ ভাইয়া তো সাইন করেনি। কার্যকর হতেও সময় আছে। তাছাড়া আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অরিশ ভাইয়ারই থাকবো।”

-” তুই কি ভেবেছিস তরী। তোমার মতো একজন প’তি’তা’কে আমার ছেলের বউ বানাবো? কতো ছেলে তোকে ভোগ করেছে তার হিসেব নেই।
এখন অরিশ তোকে ভালোবাসে, তাই তোকে মেনে নিয়েছে। যখন আরেকটু বয়স হবে তখন তোকে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও দুই বার ভাববে না। ”

তরী জ্ঞানহীন চেয়ে রইল। মেয়েরা জোর করে ঘরে নিয়ে গেল। পুতুলের ন্যায় বিয়ের কনের সাজে সজ্জিত করলো। তরীর কোনো রুপ বাঁধা দিলো না। তার মনের ভেতরে অনেক কথা ঘুরছে। সত্যিই কি সে তার অরিশ ভাইয়ার যোগ্য নেই।

যখন কিডন্যাপ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করেছে, কোনো উত্তর মেলে নি। তাহলে কি সবটা আড়াল করে রাখা হয়েছে। অনিতার কথাগুলোই সত্যি। কাবার্ডে যত্নে রাখা হসপিটাল থেকে দেওয়া গুলোতে চোখ বুলিয়ে নিল। এক লাইনে বারবার খুঁজতে লাগল। যেন কোনো অদৃশ্য গুপ্তধন লুকিয়ে আছে। অবশেষে খুঁজে পেল। হাত থেকে রিপোর্ট টা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তরী বসে পড়লো। চোখে পানিতে ভিজে গেল সাজ।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪০

সে আর তার অরিশের যোগ্য নেই। কিন্তু তার শরীরে সর্বশেষ চিহ্ন টা ছিল অরিশের। সে অরিশকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। বিয়ের ভারী সাজ নিয়ে জানালার কাছে গেল। ওরনা বেঁধে নিল গ্ৰিল বিহীন রেলিং এ। ধীরে ধীরে নিচে নেমে গেল। ছুটে চলল অদূরে। থাকবে না এই পৃথিবীতে।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪২