অনুভুতির অন্তরালে শেষ পর্ব 

অনুভুতির অন্তরালে শেষ পর্ব 
ইফা আমহৃদ

অবহেলায় কেটে গেছিলো এক বছর। ময়না তদ’ন্তের পর জানতে পেরেছে, তরী প্রেগন্যান্ট ছিলো। ক্যান্সার হয়নি তার। আরশি যন্ত্রনা ছাড়া কিছুই পায় নি অপূর্বের থেকে। প্রতিদিন অপূর্ব এসে বিনা কারণেই তাকে আঘা’ত করত। কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলতো।

একদিন অপূর্ব বাড়ি ফিরলো। এমনিতেই তার মাথা গরম ছিলো। তার উপরে আরশিকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখলো। বিরাগী হয়ে সেদিন মারতে মারতে রক্তাক্ত করেছিলো আরশিকে। আরশি মাথা নিচু করে রয়েছিল শুধু। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলেছিল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” আপনার বোন আমাকে আপনার দায়িত্ব দিয়ে গেছিলো আর আপনি আমাকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ফেলেছেন। এই বোনকে ভালোবাসেন। মায়ের শাস্তি মেয়েকে দিচ্ছেন।
আমার ভাই আপনার বোনকে একা ছাড়বে না তাই নিজে চলে গেছে আর আপনি তার বোনকে আঘাত করছেন? এই তার প্রতিদান!”

অপূর্ব চুপ করে রয়েছিল। আরশি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। নিজের করা কাজের জন্য অনুতপ্ত হলো সে। আরশি তখন বেলকেনিতে বসে কাঁদছিল। অপূর্ব আরশির পায়ের কাছে বসে পড়লো। কানে হাত দিয়ে বলল,
-” স্যরি! আ’ম স্যরি আরু সোনা!”

আরশি তাকালো না। অপূর্ব আরশির অনামিকা আঙ্গুলে একটা রিং পড়িয়ে দিয়ে অধর ছুয়ে দিল। আরশি কেঁদে উঠলো। অপূর্বের বুকে মাথা গুঁজলো। অপূর্ব হাসলো। মেয়েটা এতোটা সহজ সরল।
সেদিনের পর থেকে শুরু হয় দুজনের সুন্দর গোছানো জীবন। চারবার কনসেভ করেছে। প্রতিবার মিসক্যারেজ হয়। এবার সে মা হবে।
বর্তমানে__

অপূর্ব দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো‌। আরশি ঘুমিয়ে আছে। তার মুখে এক চিলতে হাসি। গতিশীল পা জোড়া দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। মাথায় হাত রাখল আরশি। আরশি ফট করে চোখ মেলে চাইলো।আরশি একটু উঠে বসার চেষ্টা করল। অপূর্ব থামিয়ে দিল। মাথার অধর ছুয়ে দিল। আরশির চোখে আনন্দমাখা অশ্রু। বলে,
-” কিছু বলবে না? চুপ করে থাকবে?”
অপূর্ব বেরিয়ে আসতে চাইলে হাত ধরলো আরশি।আরশি বাচ্চাদের ন্যায় টেনে টেনে বলল,
-” তুমি আমার সাথে কথা বলবে না?

-” আমি কেন কথা বলবো? আমি তো আরেকটা লাল টুকটুকে বউ বিয়ে করবো।”
-” মানে! আমি তো তখন আবেগে বলেছিলাম। তাই বলে তুমি সত্যি? আমরা দুজনেই কিন্তু রাগ করব।”
অপূর্ব হাসলো। তার ছোট আরু আজ মা হয়েছে। তাকে বাবা বানিয়েছে। এরচেয়ে পৃথিবীতে আর কি সুখের আছে? -” কি দরকার ছিল তোর, এতো কষ্ট করার? আমি তোকে নিয়েই সুখি। প্রতিবার মিসক্যারেজ হওয়ার পর তোর কষ্টটা আমি সহ্য করতে পারতাম না। বাচ্চা কাচ্চা..

-” এভাবে বলো না তুমি! আমি দেখেছি, তরীর মৃত্যুর পর তুমি কতোটা অসহায় হয়ে পড়েছিলে। আমি তোমাকে একটা ফুটফুটে নবজাতক দিয়ে খুশি করতে চেয়েছিলাম। ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তুমি বাবা ডাক থেকে বঞ্চিত হবে, এটা মেনে নিতে পারছিলাম না। বাদ দাও,
আমাদের প্রিন্সেস হয়েছে। তুমি দেখেছো তাকে? সবাই বলছে, ও নাকি আমাদের মতো হয়নি!”
-” না দেখিনি। তোকে ছাড়া কিভাবে দেখি?”

দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো মোতাহার হোসেন। তার কোলে শুভ্র রঙের চাদরে মোড়ানো এক ছোট অবুঝ শিশু। মোতাহার হোসেনের পেছনে নার্স ঢুকল। মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে আরশির কাছে রাখল। বলল,
-” স্যার! আপনার মেয়ে হয়েছে‌। মিষ্টিমুখ করাবেন না?”
অপূর্ব নার্সের দিকে চেয়ে সৌজন্য হাসলো। অপূর্ব এই হসপিটালেরই সার্জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার।
-” প্রথমত, মেয়েটা আমার হয়নি। আমি বাবা হয়েছি। দ্বিতীয়ত, আমি ডাক্তার হিসেবে নয়। একজন বাবা হিসেবে, হসপিটালের প্রত্যেক কে মিষ্টিমুখ করাবো!”

মোতাহার হোসেন আর নার্সের প্রস্থান ঘটল। অপূর্ব ছোট শিশুটার দিকে চাইলো। থমকে গেল সে। অবিকল অরিশ তরীর মুখটা। আরশিও স্তব্ধ। তারমানে তাদের ঘরে ছোট তুরের আগমন ঘটেছে। আরশি চোখ গ্ৰথণ করে রইল। আনন্দে আত্মহারা সে। তবুও তার আকাশ সময় আনন্দ।
-” ও তো অরিশ তরীর মতো হয়েছে! আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখ দিয়েছিস তুই। আমি কৃতজ্ঞ থাকবো তোর নিকট!”

-” হ্যাঁ! ও ভাইয়া আর তরীর মতো হয়েছে। ওর নাম রাখবো তুর। একজন তুর ওদের কাছে, একজন আমাদের কাছে। আচ্ছা ওরা তিনজন কেমন আছে?”.
-” ওরা তো তিনজন নয়, চারজন। মা আছে ভুলে গেছিস। তুই দেখতে চাস, ওরা কেমন আছে? তাহলে তোর কল্পনায় ওদের সাজিয়ে নে। চোখ বন্ধ করে ভাব ওদের কথা।”

অপূর্বের কথায় নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে নিল আরশি। তার মেয়ে এখনো ঘুমাচ্ছে। অপূর্ব মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আরশি নিজে নিজে এক কল্পনার জগৎ সাজালো। নিজের পছন্দের রং দিয়ে সাজালো। হারিয়ে গেল সেই কল্পনায়।
” অরিশ ঘুমিয়ে আছে। তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে তরী। ঘরে কেউ নেই। রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেছে। অফ ডে তাই কারো কোন ভাবনা নেই। তুর তার দিদা অর্থাৎ তরীর পায়ের কাছে ঘুমিয়েছে আজ।
তুর ঘরে এলো। বাবার অপর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। আদো আদো স্বরে ডাকলো,
-” পাপা! ও পাপা! দিদা ঘুলতে যাত্তে। আমিও দিদাল তাতে দাই!”

অরিশ তরী চাইলো মেয়ের দিকে। দূরত্ব মাঝখানে ফাঁকা জায়গা করে দিলো। অন্যপাশে ফিরল তরী। অরিশ ক্লান্ত চোখে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তুরের বয়স চার বছর। এখনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। ঠোঁটের আগায় বাজে। তুর পুরোপুরি বাবার বুকে ভর দিয়ে বসল। বাবার পেটের উপর ঝাঁকুনি দিয়ে ভুম ভুম করে গাড়ি চালালো। অরিশ উঠে বসলো। মেয়ের জামা কাপড় খুলে অন্য একটা পড়িয়ে দিল। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে মেয়েকে দাঁড় করিয়ে ঘসে ঘসে পরিষ্কার করে দিল। ব্রাশ ধুয়ে দানিতে রাখল। কোলে তুলে বেসিনের সমান করে মুখ ধুয়ে দিল। মুখ মুছিয়ে দিয়ে বেবী লোশন মেখে দিলো। টুপি মাথায় দিয়ে বলল,

-” একদম দুষ্টুমি করবে না। দিদার হাত ছাড়বে না। দিদার কথা শুনবে কিন্তু!”
তুর তার বাবার পাগল। বাবা তার জান। একদম শব্দটা সহজে ব্যবহার করে না অরিশ। একবার ব্যবহার করলে না মানার উপায় নেই। আদো আদো কন্ঠে বাবার গলায় টেনে চুমু দিল গালে। বলল,
-” বাবা তুমি অলেক ভালো।”

অরিশ নিজেও একবার মেয়েকে চুমু খেল। বলল,
-” আমার তুরও অনেক ভালো।”
তুর ছুটে চলে গেল। অরিশ বেডের উপর গাঁ হেলিয়ে দিলো। চোখ গ্ৰথণ করার সাথে সাথেই ভারী কিছু বুকের উপর আবিষ্কার করলো। চোখ মেলেই হাসৌজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠলো তার কাছে। ভারী গলায় বলল,-” সমস্যা কি? নামো! বাচ্চাদের মতো কি করছো। বিরক্ত করো না, ঘুমাতে দাও তরী!”

-” আমি জানতার তুমি আমাকে বকবে! প্রতিবার তুমি আমাকে বকো। কই তুর বিরক্ত করলে তো বকো না।”
-” সেজন্যই তোকে বকছি। তুরকে তো বিচ্ছু বানিয়েছিস। তাই ওর ভাগের টাও তোর! সর..
অরিশ অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। তরীর অভিমান হলো। উঠে বেলকেনিতে গিয়ে বসলো। কিয়ৎক্ষণ পর অরিশ এসে তার পাশে বসলো। হাত টেনে কোলে তুলে নিল। তরী মুখ কালো করে বলল,-” সরেই তো গেছি। আবার কেন এসেছো?”

-” আমার পিচ্চির কাছে, আমি এসেছি! তোর কি?”
বলেই অরিশ ফট করে তরীর অধরে পরপর দুই বার অধর ছুয়ে দিলো। অরিশ হাসলো। তুরের আগমন ঘটল। বাবা মায়ের দিকে চেয়ে অভিমানী গলায় বলল,
-” পাপা থুমি মাম্মাকে দুতো চুমু খেয়তো। আমাকে একতা!”

অরিশ হাত ধরে মেয়েকে তরীর কোলে বসিয়ে দিল। একগালে তরী, অন্যগালে অরিশ চুমু দিল। তুরের খুশি দেখে কে? ফট করে নেমে গেল। আঙুল গুনে গুনে বলল,-” তিনতা হয়েতে। এখন আমি দিদাল কাতে গিয়ে আলো একতা নিয়ে আতবো। তালপলে বিতরি কলবো।”

তুর ছুটে চলে গেল। অরিশ আর তরী একে অপরের দিকে চেয়ে রইল। তরীর নাক টেনে বলল,-” একদম পিচ্চি তরী!”
এই পর্বে অরিশ তরীর কাহিনিটা কল্পনায়। আরশির কল্পনা। কিছু কথা, কিছু অনুভূতি, কিছু ভালোবাসা, কিছু সত্য চাপা পড়ে রয়েছে। রয়ে গেছে অন্তরালে। অনুভূতির অন্তরাল থেকে অনুভব করতে হয়।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪২

___________________অনুভূতির অন্তরালে ভালোবাসাটা তুই,
ইচ্ছে করে হাত বাড়িয়ে শুধু তোকে ছুঁই!
‌ -ইফা?
আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আপনারা? এখানেই শেষ হলো অনুভূতির অন্তরালে। ফিরে আসবো নতুন গল্প নিয়ে। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ ?