অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪০

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪০
ইফা আমহৃদ

অনিতা জানালার পাশে বসে আছে। তার অবাধ্য নেত্র জোড়া অশ্রু ধারায় পরিপূর্ণ। মুছে ফেলার চেষ্টা করছে না। আশ্রমের সব ছেলে মেয়েরা তার মুখের দিকে চাতক পাখির নিমিত্তে তাকিয়ে আছে। পরের কথাগুলো শুনবে বলে। অনিতা বললেন না। নিজের পাপের কথাগুলো বাচ্চাদের কাছে কিভাবে বলবে। সকলের অগোচরে মুছে নিল অশ্রুটুকু। অতি সাধারণ স্বরে বললেন,

-” কালকে তোমাদের স্কুল আছে না। অনেক রাত হয়ে গেছে। যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। কালকে আবার বাকিটা বলবো।”
বাচ্চারা কিছুতেই যাবে না। অনিতাও চুপ করে রইলাম। অনেক কষ্টে রাজি করালেন সকলকে। সকলে শুয়ে পড়লেন। অনিতা নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ছোট ঘরে গিয়ে বসলো। আলো জ্বালিয়ে দিলো। এখন তার কাছে আলো আঁধার দুটোই সমান। দিন রাতের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। ডান পাশে তাকালো। অরিশ আর তরীর হাসৌজ্জ্বল দুই মুখ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অরিশ তরীর চুল টেনে ধরেছে। তরী পেঁচা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে‌। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। হাত বুলিয়ে নিলেন ছবিতে। ধুলো জমে গেছে ফ্লেমে। গাঁদা ফুলের মালা টা শুকিয়ে গেছে। অনিতা খুলে রাখলেন। পাঁচ বছর ধরে এই ছবিটা বুকে আগলে রেখেছেন। তার প্রিয় বলতে কেউ নেই। তার ভুলের জন্য অরিশ তরী কেবল স্মৃতি। মরে গেছে তারা। শুধু অরিশ তরী মেরে যায়নি, একটা ফুটফুটে ছোট বাচ্চা, তাদের বাবা মায়ের সাথে চলে গেছে। “তুর”!

ছোট নাম অথচ হৃদয় স্পর্শ করে ফেলেছে। অপূর্ব আরশি এখন অচেনা, অজানা কোনো দেশে থাকে। তার বাবা ছায়ার মতো ঢাল হয়ে আছে। তার মা। অরিশের দিদাও মরে গেছে। অঘটন টা ঘটার পরে পুরো বাড়ি স্তব্ধ হয়ে গেছিলো। অরিশের বাবা কথা বলা বন্ধ করে দেয় সকলের সাথে। অনিতার মা দিন দশের পর মৃগী রোগের কারণে আগুনে পুড়ে মারা যায়। যখন তিনি জ্ঞানশক্তি হারিয়েছে, তখন নিস্তেজ হয়ে কিচেনে পড়ে যায়।

তার শাড়ির আঁচলের এক প্রান্ত আগুনে ছিল। শাড়ির আগুন লেগে মারা যায় সে। তার কিছুদিন পর সকল সম্পত্তি তার নামে লিখে দেয়। সাথে চিঠি লিখে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় তার স্বামী মোতাহার হোসেন। তার মেয়ের কাছে আছে।
অনিমা সবকিছু দান করে অপূর্বের প্রতিষ্ঠা করা এতিম খানায় থাকছে। নিজের সন্তানদের হারিয়ে তাদের যত্নে নিজের জীবন অতিবাহিত করছে। আর মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনছে।

অপূর্ব সবে বাড়িতে ফিরেছে। বৃষ্টির ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। শীতকাল হলেও বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। আশেপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিজের রুমে গেল। সেখানেও আরশি নেই। মেয়েটা কোথায় গেছে। আশে পাশে আছে ভেবে জামা কাপড় সমেত ওয়াশরুমে গেল। মিনিট বিশেক পর বেরিয়ে এলো। বেলকেনিতে ভেজা জামা কাপড় গুলো মেলে দিলো। আরশি আরশি বলে বেশ কয়েকবার ডাকল। সারা পেল না। বিনিময়ে আয়া এলো। আরশির দায়িত্বের জন্য আয়ান রাখা হয়েছে। মাথা নিচু করে বলল,

-” স্যার ম্যাম বাইরে গেছিলো। কবরের কাছে। এখনো আসে নি, আমি তাকে নিয়ে আসতে গেছিলাম। সে আমাকে ধমকে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
আরশির ইদানিং কি হচ্ছে, সে বুঝতে পারছে না।অপূর্ব ঘরে এসে ছাতা নিলো। ভেজা রাস্তা দিয়ে সচেতনতা অবলম্বন করে সেদিকে এগিয়ে গেল। আরশি কবরের পাশে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। আট মাসের ভারী পেট টা দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব আতংকে উঠলো। কতোক্ষণ ভিজেছে তার হিসেব নেই। তার শরীরের চামড়া সাদা হয়ে গেছে। যেখানে একটু ঠান্ডা লাগলেই ক্ষতি। সেখানে বৃষ্টিতে কিভাবে। অপূর্ব ছাতা আরশির মাথায় ধরলো। আরশির পাশে বসে বলল,

-” আরু, কি করছো তুমি? তুমি জানো না, বেবীর ক্ষতি হবে? তাহলে..
আরশি তাচ্ছিল্যের হাসলো। হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি গেল। বলতে লাগলো,
-” আর বেবী। ও তো আগের বারের মতো আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আমার পুড়া ভাগ্য দেখো। তোমার বোন। তোমার বোন আমার সন্তানকে কেড়ে নিচ্ছে। কেন কেড়ে নিচ্ছে? আমার মা ওদের বাঁচতে দেয়নি তাই।”
অপূর্ব জবাবে কি বলা উচিত ভুলে গেছে। ছাতাটা সার্ভেন্টের হাতে দিলো। আরশির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। চোখে পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,

-” আমার খুকি যে, আরুকে অনেক ভালোবাসত। সে কিভাবে তার আরুর ক্ষতি করবে?”
আরশি অপূর্বের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কাঁতরাতে কাঁতরাতে বলল,
-” তাহলে আমার মায়ের কুকর্মের অভিশাপ আমার উপরে পড়েছে।”

এই নিয়ে পাঁচ বার কনসেভ করেছে আরশি। পাঁচ ছয় মাস পরেই মিসক্যারেজ হয়েছে। আরশি ধারণা, তার মায়ের কাজের ফল সে ভোগ করছে। গ্ৰামের বৃদ্ধ, বৃদ্ধাদের কথা বিশ্বাস করে। তাই মৃত অরিশ আর প্রেগন্যান্ট তরীর কবরের কাছে এসেছে। অপূর্ব বিরাগী হয়ে গেল। হুট করেই আরশিকে কোলে তুলে নিলো। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা হওয়াতে আরশির ওজন স্বাভাবিক নেই। দেহের ওজন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কপালের মাঝের রগটা ফুলে উঠেছে। অপূর্ব ছোট ছোট পা ফেলে অতিশয় সাবধানতা অবলম্বন করে বাড়ির অন্তর্ভাগে প্রবেশ করল। পেছন পেছন আয়া মেয়েটা ছাতা ধরে রাখল‌।

আরশিকে বেডের উপর বসিয়ে দিয়েছে। পড়নের ঢিলেঢালা ফ্রক টা লেপ্টে আছে শরীরে। অপূর্বও ভিজে গেছে অনেকটা। এক টান দিয়ে গাঁ থেকে টি শার্ট টা খুলে এক কোণে রেখে দিলো। কাবার্ড থেকে লাল রঙের একটা ফ্রক বের করে বেডের উপর রাখল। আয়া মেয়েটাকে পড়িয়ে দিতে বলে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে হাত ধরল আরশি। অনুরোধ করে,-” তুমি পড়িয়ে দাও না?”

অপূর্ব জবার দেয় না। আরশি আঙুল ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে,-” কি হয়েছে কথা বলবে না?”
এবারও জবার দেয় না অপূর্ব। আরশি ব্যাথা কাতর কন্ঠে বলে,
-” আমার কথার কোনো মূল্যে নেই তোমার কাছে?”
-” আমার কথার কোনো মূল্য কি আদোও তোমার কাছে আছে? আরশি! নেই। দুটো মৃত মানুষের কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কি সব সমাধান হয়ে যাবে। তাহলে আমি রোজ গিয়ে আমার খুকিকে চাইতাম। আমার খুকির খুকি কে চাইতাম। তার বাবাকে চাইতাম।

এইসব করে তুমি আমার সন্তানের কাল ডেকে আনছো? মিসক্যারেজ হলে আরে আগেই হতো, অলরেডি আট মাস চলছে।”
আরশির নিজের কাজে অনুতপ্ত হলো। হাঁচি কাশিতে মুখ ভেঙ্গে আসছে। অপূর্ব বেরিয়ে গেল। ডাক্তার কে কল করে জানাতে হবে ব্যাপার টা।
নিচে এসে দেখা পেল মামার অর্থাৎ আরশির বাবা মোতাহার হোসেন। অপূর্বকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-” কি হয়েছে আরশির?”
-” মামা, কি করবো এই মেয়েকে নিয়ে আমি। আমার একটাও কথা শুনছে..
কারো চিৎকারের আওয়াজ ভেসে এলো অপূর্বের কানে। সবকিছু ফেলে দৌড়ে চলে এলো উপরে। আরশি মেঝেতে পড়ে আছে। পেটে হাত দিয়ে চাপা আর্তনাদ করছে। চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। আয়া মেয়েটি আরশিকে ডাকছে। অপূর্ব ধরলো আরশিকে। ডাক দিলো তাকে, আরশি কষ্টে কাতর হয়ে গেছে। তার পেটের মাঝে ছোট ছোট পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব নিজেকে সামলে বলল,

-” আরুর কি হয়েছে? এমন করছে কেন?”
-” ম্যাম আমার কথা না শুনে আপনাকে ডাকতে যাচ্ছিলো। তখন পা পিছলে..
অপূর্ব আরশিকে কোলে তুলে নিলো। ছুটতে ছুটতে গাড়ির কাছে এসে থামলো। আরশিকে পেছনের সিটে তার বাবার কাছে রেখে সে ড্রাইভ করতে লাগলো।

ডাক্তার ইমিডিয়েট ভেলিভারি করতে বলেছে। আরশি বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছে। অপূর্ব ঘাবড়ে গেছে। তাকে মোতাহার হোসেন সান্ত্বনা দিচ্ছে। ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে তার। অপূর্ণ মনে হচ্ছে। আরশিকে তৈরি করে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে নেওয়া হবে। আরশি অপূর্বের হাতটা ধরে দূর্বল স্বরে বলল,

-” আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি কিন্তু অরিশ ভাইয়ার মতো করবে না। আমাদের পুঁচকু টাকে মানুষ করবে। আমি আমার ভাই ভাবীর আর তুরের কাছে ভালো থাকবো। আর আমরা দুজনেই চলে গেলে, তুমি ভেঙ্গে পড়বে না। নতুন একটা লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসবে।”
অপূর্ব নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো। আরশি গালে চড় বসিয়ে দিল। আরশির থেকে দূরে গিয়ে নার্সদের উদ্দেশ্য করে বলল,

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৯

-” ওকে এখান থেকে নিয়ে যান।”
আরশিকে ভেতরে নিয়ে গেল। অপূর্বের চোখে জল। ডাক্তার হয়ে ভয় পাচ্ছে। নিজের বোনটাকে আগলে রাখতে পারে নি। এবার অন্যের বোনটাকে সে আগলে রাখবে। টুলের উপর বসে পড়লো। হারিয়ে গেল ধোঁয়াশায় পূর্ণ স্মৃতির পাতায়।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪১