অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৯

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৯
ইফা আমহৃদ

বর্ষার সময় হলেও বর্ষা নেই। মাথা তুলে উপরের দিকে অবলোকন করলেই মেঘ শুন্য অন্তরিক্ষের দেখা মিলে। তারা রা আন্তরিক্ষের বুকে নিভু নিভু জ্বলছে। মাঝখানে পূর্নিমার চাঁদ। কিন্তু তা দেখার মত, আকাঙ্ক্ষা আমার মাঝে নেই। বরযাত্রী হয়ে গেছিলাম। সেখান থেকে ফেরার সময় কনে পক্ষের অনেকে এসেছে। তাই ছাদে ঘুমিয়েছি আমি আর আরশি। সারাদিনের ব্যস্ততার পর ঘুমে চোখ ঢুলু। আরশি ঘুমিয়ে আছে।

আমিও ঘুমে শায়িত হবো। হুট করে মনে হলো কোন পুরুষালী শক্তপোক্ত হাত আমার নরম কোমল কোমর জড়িয়ে ধরেছে। ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলাম আমি। একটু নড়ার চেষ্টা করতেই ব্যর্থ হলাম। মনে হলো কোন দুষ্টু জ্বীন ভর করেছে। যেই জ্বীন শরীরের সংস্পর্শে এলে কথা বলা যায় না, নড়াচড়া করার শক্তিও হারিয়ে যায়। কিন্তু আমি তো দোয়া পড়ে শুয়েছি। আজকে কি সূরায় ভুল হয়েছে। আমাকে এতো নড়াচড়া করতে দেখে অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল কেউ। সামনের অগোছালো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” কি হয়েছে ডিঙিরানী! এতো নড়াচড়া কেন করছো?”
স্তব্ধ হয়ে গেল সময়। শিরায় শিরায় জানান দিলো হিম শীতল হাওয়া। আঢ়চোখে পেছনে চেয়ে হুট করে অরিশ ভাইয়ার মুখ চেপে ধরলাম। টেনে মৃদু শব্দে বললাম,
-” হুস! আস্তে কথা বলো। আরশি আছে। উঠে গেলে কেলেংকারি হয়ে যাবে।”
হাতটা সরিয়ে আরো একটু কাছে এলো আমার। নাকের ডগায় নাক ঘসলেন। টেনে টেনে বললেন,

-” কেউ নেই। এখানে তুই আর আমি ছাড়া কেউ নেই।”
পাশ ফিরে তাকালাম। আরশি নেই। গেল কোথায় মেয়েটি। ঘুমে থাকলে স্বপ্ন মনে করতো সবকিছু। কিন্তু এখন তো নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে। অরিশ ভাইয়াকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম,-” প্লীজ! চলে যাও। আরশি ওয়াশরুমে গেছে। যখন তখন চলে আসবে।”
-” আসবে না।” একরোখা জবাব তার।
-“মানে?”

-” মানে ও আজকে রাতে নিচে ঘুমাবে আর আমি তোর সাথে। আমার যে, হুট করেই তোকে প্রয়োজন। আমি যে তরীর নেশায় আসক্ত হয়ে গেছি। আমি আমার সাথে চিরতরে লেপ্টে নিতে চাই।”
উঠে বসলাম আমি। শরীরের পশম গুলো দাঁড়িয়ে গেছে। অন্যরকম অনুভূতি ছড়িয়ে গেছে সর্বাঙ্গে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

-” প্লীজ নিচে যাও। আমার ভয় করছে।”
-” আমি থাকতে কিসের ভয় ডিঙিরানী? না-কি আমাকে ভয় পাচ্ছিস। ঠিক আছে, তোর অসম্মতিতে কিছু করবো না। শুয়ে পড়।”
করুনতা মাখানো তার কন্ঠ স্বর। কাতরতা ছড়ালো হৃদয়ে। অরিশ ভাইয়া উঠে চলে যাচ্ছিস। কি হলো জানা নেই, পেছন থেকে গিয়ে জরিয়ে ধরলাম তাকে। পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বললাম,

-” চলে যাচ্ছো কেন?”
-” কারণ তুই আমাকে চাস না। আমি নিজের ভেতরে নেই। যখন তখন তোর কিছু করে ফেলতে পারি।”
ছাড়ানোর চেষ্টা করলে আরো দৃঢ় করে পেঁচিয়ে নিলাম তাকে। বেশ কিছুদিন চেষ্টার পর আমাকে নিজের থেকে ছাড়াতে সক্ষম হলেন। আমার মাথা নিচু করে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। এতোক্ষণ বুঝতে না পারলেও এবার সক্ষম হলাম তিনি ডিঙ্ক করেছেন। ডান হাতের সাহায্যে থুতনিটা উঁচু করে বললেন,

-” তুই কি রাজি তরী?’
জরিয়ে ধরলাম তাকে। সম্মতি পেলেন তিনি। পাঁজাকোলা তুলে নিলেন আমায়। নেশালো মানুষের ন্যায় টেনে টেনে বললেন,
-” তাহলে তো তোকে ছাড়ছি না। একদম ছাড়ছি না।”
রাত গভীর হতে লাগল। ফুলিয়ে গেল সময়। আজ মিশে গেল এক আত্মা এক প্রাণ। ছড়িয়ে গেল ভালোবাসার রং। এটাই ছিলো সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। জীবনের পাতায় দিনটা একসময় অমর হয়ে রইল।

মাথা নিচু করে আছি আমি। গালে হাত। চোখের জল মাটিতে ঝরছে। অরিশ ভাইয়া আমার পাশে দাঁড়ানো। খালামণি চেয়ার বসে আছেন। গ্ৰামের লোকেরা চারপাশে ঘিরে রয়েছে। মামুনি একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। অপূর্ব ভাইয়া ইতিমধ্যে দুই চড় বসিয়ে দিয়েছেন। আজ সকালে ভোরের দিকে। আমাকে আর অরিশ ভাইয়াকে ছাদে পাওয়া যায়। আমি তখন নির্বিকার ভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম অরিশ ভাইয়ার বুকে। পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে যায় ব্যাপার টা। বিয়ে বাড়ি এমনিতেই মানুষে গিজগিজ করছে আবার খালামণি প্রভাবশালী মানুষ।

আমার ভাবনার ছেদ ঘটল কারো কথায়।
-” মা! আপনার আত্মীয় হোক আর যাই হোক। বিচার সবার জন্য সমান। যদি আপনার আত্মীয় বলে এদের বিচার না করেন। তাইলে আমরা কক্ষনো আপনার বিচার মানমু না।”
-” হ। ঠিক কইছোস। এই মাইয়া পোলাগো বেতের আঘাত দিয়ে জোতার মালা পড়াইয়া গ্ৰাম থেকে বাইর করতে হইবে।”
খালাজান মাথায় হাত দিলেন। কিভাবে নিজের বোনের মেয়ে আর ভাইয়ের ছেলেকে এই শাস্তি দিবে। রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

-” অরিশ আমি তোমার থেকে এমন কিছু আশা করি নি। তরী না হয় ছোট কিন্তু তুমি তো ছোট নয়। তুমি কিভাবে এই ভুলটা করতে পারো?”
-” আসলে ফুফু..
-” আমরা কোনো কথা হুনতে চাই না। এই পোলা মাইয়ার শাস্তি চাই।”

অরিশ ভাইয়া ক্ষিপ্ত হয়। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,-” তরী কাদিস না তুই। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
বলেই ফোন বের করলেন। কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ প্রচেষ্টা করে ফোন টা এগিয়ে দিলো খালামনি কাছে। সবার দিকে চেয়ে বললেন,

-” এখন হয়তো আপনাদের আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না।”
খালা মনি গলায় ঝুলন্ত চশমা টা চোখে দিয়ে বিরবির করে অধর নাড়িয়ে পড়লেন। অতঃপর আমাদের দিকে চেয়ে অবিশ্বাস্যের স্বরে বললেন,
-” তোমরা বিয়ে করেছো?”

শব্দটা বাতাসের মতো ছড়িয়ে গেল। মামুনি ছুটে এলেন। ফোনটা হাতে নিয়ে তিনিও পড়লেন। মৃদু রোদের মাঝেও তার মাথায় বজ্রপাত পড়লেন। ভাঙ্গা গলায় বললেন,
-” তোরা বিয়ে করেছিস? কবে বিয়ে করেছিস?”
-” টুরে গিয়েছিলাম তখন।” একরোখা জবাব তার।

-” আমি তোর মা অরি। দশ মাস তুই আমার গর্ভে ছিলি। আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলি না।”
অরিশ ভাইয়া মামুনিকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। মামুনি অসুস্থ হয়ে পড়ে যেতে নিলো। অরিশ ভাইয়া ধরে সামলে নিলেন। চেয়ারে বসালেন। পানির গ্লাস আনতে বললেন আরশিকে। সবার সামনে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বললেন,
-” আমি আর তরী বিবাহিত। আমরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারি। আর কোন প্রশ্ন আছে আপনাদের। না থাকলে যান।”

পায়ের শব্দ শোনা গেল। সকলে চলে গেলেন। অরিশ ভাইয়া হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। আরশি পানি নিয়ে এসেছে। আরশির থেকে পানি নিয়ে মামুনির মুখে ছিটিয়ে দিলেন। মাথা ধরে মুখের ভেতরে গলিয়ে দিলো পানির ধারা। মামুনি চোখ মেলে চাইলো। পুতুলের ন্যায় বসে রইলাম। অরিশ ভাইয়া হাঁটু গেড়ে বসলেন। অসহায় কন্ঠে বললেন,
-” বিশ্বাস করো মা। আমরা বিয়েটা করতে বাধ্য ছিলাম।

আমি কিংবা তরী কেউ এই বিয়েটাকে আগ্রহ দেখাই নি। এই বিয়েটাকে তেমন গুরুত্ব দেইনি। তাই তোমাকে জানাই নি। আমি চেয়েছিলাম, তরীর ফাইনাল ইয়ারের পরিক্ষা শেষ করে তোমাকে বলতে। কিন্তু কালকে রাতে ডিঙ্ক করে..
আ’ম স্যরি মা।”

মামুনি ইশারায় কাছে ডাকলেন আমায়। মাথার চুল গুলো দুহাতে সরিয়ে দিয়ে ললাটে অধর ছুয়ে দিলো। বললেন,
-” আমি আমার ইচ্ছে আবার তোদের বিয়ে দিবো। ধুমধাম করে বিয়ে দিবো বাড়ি ফিরে। তুই আমার আরেকটা মেয়ে, তোকে কিভাবে অযত্নে রাখি।”

-“আর আমার বিয়ে?” মুখ কালো করে আরশি এসে দাঁড়ালো।
মামুনি ওর কান টেনে ধরলেন।
-” বিয়ের কথা শুনে তোর বিয়ে করতে মন চাইছে। দাঁড়া, আগে যাই বাড়িতে। তারপরে বুড়ো দেখে তোর বিয়ে দিয়ে দিবো।”
-” মা..

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৮

মামুনি আরশিকে জরিয়ে ধরলেন। অপূর্ব ভাইয়াকে হাতের ইশারায় ডাকলেন। তার সম্মতি আছে কিনা জানতে চাইলেন। ভাইয়া শুধু আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। সেইদিন খুশিটা ছিলো আকাশ ছোঁয়া। মামুনি আবার আমাদের দিতে চাইছিলেন। কিন্তু সময় হয়ে উঠলো না। তার আগেই,

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৪০