অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৮

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৮
ইফা আমহৃদ

বাড়ির উঠানে বসে আছে সকলে। বিয়ের বাড়ির মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে। তার মাঝখানে কোলে করে নিয়ে এসেছে অরিশ ভাইয়া। গায়ে কাঁদায় মাখো মাখো। খালা জান এগিয়ে এলেন। আমাদের এবারে দেখে বিচলিত হয়ে গেলেন। অগোছালো স্বরে বললেন,

-” অরিশ, তরীর কি হয়েছে? কোলে করে কেন এনেছিস?”
-” শুধু তোমার তরীকে কোলে করে এনেছি সেটাই দেখছো। এদিকে আমাকে সমেত তরী যে কাঁদায় পড়ে গেছে সেটা দেখছো না। তোমার বোন ঝি রাস্তার মাঝখানে কাঁদায় লাফালাফি করছিলো। আমি বারণ করেছি বলে আমাকে ফেলে এই অবস্থা করেছে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি কখন তাকে ফেলে দিলাম। তিনি অসাবধানতাবশত পড়ে গেছেন। আমাকেও ফেলে দিয়েছে। খালাজানের দিকে তাকিয়ে বললাম,-” বিশ্বাস করো, আমি কিছু করি নি!”
আমাকে আর কিছু বলতে দিলেন না। কোল থেকে না নামিমেই হাঁটা দিলেন। একদম পুকুরের কাছে এলেন। আমাকে সমেত ঝাঁপ দিলেন পানিতে। সেকেন্ড দশেকের মধ্যে ভেসে উঠলাম আমরা।

সিঁড়িতে পা রেখে দাঁড়ালেন তিনি। আমার কোমর জড়িয়ে ধরে রইলেন। আমি ভাঁজ করে রাখা পা দিয়ে অরিশ ভাইয়া পা আওড়াতে আওড়াতে নিচে পা রাখলাম। পানির স্রোতে কাঁদা মাটি ভেসে গেছে। অরিশ ভাইয়ার আমাকে ছেড়ে উঠে গেলেন। আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ওরনা পানির স্রোতে ভেসে গেছে। সাঁতার জানা নেই যে, ওরনা তুলে আনবো। আবার সবার সামনে দিয়ে এই অবস্থায় যাওয়া সম্ভব নয়।

অরিশ ভাইয়া উঠে গেলেন উপরে। ঈষৎ কুঁচকালেন ভ্রু। বললেন,
-“তুই কি হাঁসের বাচ্চার মতো ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি?”
মাথা নিচু করে বললাম, -” আমি সবার সামনে দিয়ে..

আর বলতে হলো না। ধপাধপ পা ফেলে নেমে এলেন পানিতে। পানিতে লাল রঙের ওরনাটা ভাসতে দেখা যাচ্ছে। অরিশ ভাইয়া সাঁতার কেটে তুলে আনলেন। আমার শরীরে পেঁচিয়ে দিলেন। অতঃপর আবার কোলে তুলে নিলেন। সবার সামনে দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। অস্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
-” তোকে অস্বস্তিতে ফেলার দায়িত্ব যেমন আমার, তেমনি অস্বস্তি কাটিয়ে তোলার দায়িত্বও আমার।”

ভোরে আলো ফুটেছে। চারদিকে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ। টিনের কালে শিশির পড়াতে শব্দ হচ্ছিলো। ঘাসের উপর শিশির বিন্দু গুলো মুক্তার মতো আকর্ষণ করছে। আরশি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তাদের ফুফুর বাড়ি অনেক বড়। বাড়ি এবং আশে পাশের জায়গা গুলো দেখতে দেখতেই দুটো দিন কেটে গেছে। বলা যেত পারে গ্ৰাম প্রধান। তিনি অহেতুক কারো সাথে কথা বলে না। শৌখিন মানুষ।

প্রবেশদ্বার খোলা। তার পাশের ছোট ঘরটায় দাড়োয়ান থাকে। এখন দরজার উপর দিয়ে ছিটকিনি টানা। বাড়িতে গেছেন ঘুমাতে। মূলত তার কাজ রাতে। রাত জেগে বাড়ি পাহারা দেয়। এতোক্ষণ এই সুযোগ টার অপেক্ষা ছিলো সে। দাড়োয়ান চলে গেলে হাঁটতে বের হবে। গ্ৰামের রাস্তা দিয়ে সকালে হাঁটার আনন্দই আলাদা। আরশি সন্তর্পনে পা ফেলে সামনের দিকে অগ্ৰসর হলো। দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে অতি সাবধানে দরজা ভিড়িয়ে রাখলো। পেছন থেকে সামনের দিকে ফিরতে গেলেই কোনো এক মস্তিষ্কের সাথে ধাক্কা খেল। আরশি দ্রুত হাত দিল। চিৎকার করতে গিয়েও করলো না। বাড়ির কেউ যদি উঠে যায়। হাতের ভাজে রাখা মুঠোফোন বের করে টর্চ জ্বেলে নিল। দৃষ্টিগোচর হলো পরিচিত একজন মানুষের। অসন্তুষ্ট হয়ে এলো চোখ মুখ। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ হতেই আটকে দাঁড়ালো পথ। মাথা না তুলেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

-” কি চাই আপনার? বারবার আমার পথ আটকাচ্ছেন কেন? হুয়াই!”
স্যামি টেনে টেনে বলল,
-” আই ডোন্ট ফিল কমফর্টেবল এট হোম, নোবডি সেস মি ইন দিস হোম। আই ডাজেন্ট ফিল গুড টু বি এলন। লেটস ওয়ার্ক।
আরশি তেঁতে উঠলো। তেজ দেখিয়ে বলল,
-” আমার একা লাগছে না। আপনি যান!”

তৃতীয় ব্যাক্তির প্রবেশ ঘটলো। বাইরে থেকে বাড়িতে অন্তর্ভাগে প্রবেশ করতে গিয়েও থেমে গেল। সন্দিহান চোখে আরশি দিকে চেয়ে বলল,
-” তুই এখানে কি করছিস। যা বাড়িতে যা!
আর তুমি এখানে কেন?”
আরশির মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। একহাত দিয়ে স্যামির হাত ধরে সৌজন্য হাঁসি দিয়ে বলল,
-” আসলে আমরা একটু রাস্তায় হাঁটতে যাবো। চলো স্যামি!”

বলে হাঁটা দিলো। অপূর্বের ইগোতে লাগলো। আরশির সাথে এই ছেলেটাকে সহ্য হলো না। পেছন থেকে আরশির হাত টেনে ধরলো।-” আমিও যাবো।”
আরশির সায় দিলো। তবে আরশি আর স্যামি হাত ধরে আগে আগে হাঁটছে অপুর্ব পেছনে পেছনে। অপূর্বের রাগ আকাশ ছুঁয়ে গেল। বন্দুক হাতের নাগালে থাকলে এই ছেলেটাকে মেরে গুম করে দিতো। নয়ন গ্ৰথণ করে শ্বাস নিলো। প্যাকেট থেকে মুঠো ফোন বের করে কললিস্ট ঘেঁটে ফোন করলো অরিশের নাম্বারে। রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে বলল,

-” আমরা নদীর ধারে রাস্তায় দিয়ে উত্তর দিকে যাচ্ছি। সময় দুই মিনিট। এর ভেতরে চলে আয়।”
ওপাশ থেকে কিছু বলার পূর্বেই ফোন কেটে দিলো অপূর্ব। স্যামিকে মাঝে রেখে কাঁধে হাত দিয়ে এটা ওটা বলছে। তদানীং প্রবেশ ঘটলো চতুর্থ ব্যক্তির। পেছন থেকে অপু বলে ডাক দেওয়াতে ফিরলো সে। সাথে সাথে স্যামি আরশির হাতের বাঁধন খুলে একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেল। দূরত্ব এসে পঞ্চম ব্যক্তির জায়গা নিলো। থেমে গেল পায়ের গতি। স্তব্ধ হয়ে গেল হাঁটার শব্দ।

তখন পূর্ব আকাশে দিনের সূর্য উদিত হয়েছে। গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে এক চিলতে রোদ দেখা যাচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে এসে উপস্থিত হলো অরিশ। অরিশের চোখ ফোলা ফোলা। ঠোঁট ফুলে উঠেছে। নাকের ডগায় লাল হয়ে আছে। মুখের উপর তেলতেলে ভাব বিরাজ করছে। রোদের সোনালী আভা তার মুখে পড়তেই কুঁচকে এলো তার চোখ। বাঁধা দিলো চোখে। সাথে সাথে গ্ৰথণ হয়ে এলো নয়ন জোড়া। একদম ঘুমন্ত শিশুর মতো। বেশ কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর চোখ মেলে তাকালো অরিশ। হাঁটুতে ভর করে শ্বাস নিতে নিতে বলল,

-” এই ভোর রাতে কি হয়েছে তোর সা’লা। এমন ভাবে বললি মনে হলো বন্যায় তোর চৌদ্দ বউকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।”
” তা তো নিয়েছেই। তবে চৌদ্দ বউকে না। একটা মাত্র নাবালক বউ। তাকে একটা বিদেশি কু’কু’র নিয়ে যাচ্ছে।” মনে মনে কথা গুলো বলল। অতঃপর শব্দ করে বলল,

-” আসলে সকালে হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তাই এই কু’ন্মক’র্মা টাকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে এসেছি হাঁটাতে। সাথে তোকেও ডেকে নিলাম। আর স্যামির সাথেও বাড়িতে দেখা হলো। ভাবলাম ওকেও নিয়ে যাই!”
ঘুমঘুম স্বর অরিশের -” তাহলে তরীকেও ডেকে নিতি। সা’লা আমার বোন আর আমাকে ডেকে নিয়েছিস। তোর বোনটাকে নিলে আরো ভালো হতো!”

-” বারবার সা’লা বলে আমার বোনকে বিয়ে করতে চাইছিস। এটা প্রামাণ করতে চাইছিস। সমস্যা নেই, আমার বোনকে দিয়ে দিলাম।”

অরিশ কান টেনে ধরলো অপূর্বের। অপূর্ব কোনো রকম কান ছাড়িয়ে নদী দেখিয়ে মুখ ধুতে বলল। অরিশ স্যামিকে সাথে নিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে গেল। অরিশ আর স্যামি ঝোপ- ঝাড়ের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেলে আরশির কোমর চেপে ধরলো অপূর্ব। গাছের পাতার সাথে লেগে থাকা শিশিরের সাথে আরশির হাত ঘষে ঘষে লাল করে ফেললো। আরশির হাতে আল আল ঠেকছে। তবুও কিছু বলছে না। তার ভালো লাগছে অপূর্বের এমন ব্যবহার। অপূর্বের মতো ভাব নিয়ে বলল,-” আর ইউ জেলাস মিঃ অপূর্ব আহসান!”

ফট করে হাত ছেড়ে দিলো অপূর্ব। আরশির মুখশ্রীর দিকে অবলোকন করলো। সে অপূর্বের উত্তর শোনার জন্য চাতক পাখির ন্যায় হাপিত্যেশ করে রয়েছে। নাক ফুলিয়ে বলল,-” নো!”
-” ইয়েস! ইউ আর জেলাস।”

-” নো! আই সে নো! তুই অরিশের বোন। আমারো বোন। আমি তোর ভালোর জন্য বলেছি।”
আরশি ভেংচি কাটলো। বিরবির করে বলল,-” জানা আছে!”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৭

অপূর্ব শুনলো তার কথা। কদাচিৎ ফাঁক করে কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু অদৃশ্য শিকড়ে তার জিভ টেনে ধরলো। দলা পাকিয়ে ভেতরের কথাগুলো আঁটকে গেল মুখে। অরিশ আর স্যামি ঝোপ- ঝাড়ের মাঝে থেকে বেরিয়ে এলো। অপূর্ব সময় নিলো না। হুট করে আরশির হাত টেনে উল্টো পিঠে অধর ছুয়ে দিলো। অতঃপর সড়ে গেল অদূরে। না জানার ভান ধরে বসে রইল।
আরশি ধ্যানের মধ্যে রয়েছে। তার শরীর লোহায় পরিনত হয়েছে। আপনাআপনি হাত চলে গেছে অন্যহাতের পিঠে।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৯