অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৭

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৭
ইফা আমহৃদ

বর্ষার মেঘমালা। চারদিকে বৃষ্টির ধাঁচে সবকিছুই স্পষ্ট। গাড়ির গ্লাসে বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। তারুণ্য তা মুছে নিজের গন্তব্যে ছুটেছে। তার চোখের পর্দা ঘুমে ঢুলু ঢুলু। ভারী ভারী ঠেকছে। মাঝে মাঝে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘুম দূর করতে দেখা যাচ্ছে তাকে। তার পাশে বসে আছে অরিশ ভাইয়া। তিনি কানে ইয়ারফোন গুঁজে বসে আছেন।

হাতে তার ললিপপ। ললিপপে অধর জোড়া কমলা হয়ে গেছে। এই নিয়ে আট টা ললিপপ খেয়েছে। আজ আমরা ফুফুর বাড়িতে যাচ্ছি। টুরে যাওয়ার পূর্বে ফুফুজান এসে দাওয়াত করে গেছিলো। রাফি ভাইয়ার বিয়ে। আমরা সেই উদ্দেশ্যে যাচ্ছি। এতো দিনের ঝামেলার মাঝে ভাইয়ার বিয়ের কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। মামুনি ভালো হয়ে গেছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমাকে আগের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তারুণ্য ভাইয়া আমার কথায় মাস্তানি ছেড়ে দিয়েছে। এখন আমরা একসাথে মামুনিদের সাথে থাকি। দিদাও কেমন স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। হঠাৎ করে সেদিন থেকে হুট করেই জীবনের রং ফিরে এলো। তবে আরশি স্বাভাবিক হয়নি। তারুণ্য ভাইয়ার সাথে কথা বলেনি। সর্বদা তাকে এড়িয়ে চলেছে।
হুট করে ব্রেক করাতে ভাবনার ছেদ ঘটল আমার। বেশ খানিকটা সামনে ঝুঁকে পড়লাম। তারুণ্য ভাইয়া চোখ ঢলছে। বোতলের ছিপি খুলে হাতে পানি নিল। গ্লাস খুলে পরপর কয়েকটা ঝাপটা দিয়ে বন্ধ করে রাখল। পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দিতে চাইলে বাঁধ সাধল অরিশ ভাইয়া। বললেন,

-” যা! অপু তুই পেছনে যা। এই অবস্থায় ড্রাইভ করা ঠিক নয়!”
-” আমি তোর বড় অরি। তাই আমাকে জ্ঞান দিস না। কতো চালিয়েছি..
তারুণ্য ভাইয়ার কথা থামিয়ে দিয়ে অরিশ ভাইয়া। বললেন,-” তখন তোর পরিবার ছিলো না, বোন ছিলো না। এখন আছে। তাই ওদের নিয়ে কোনো রিক্স তুই নিবি না।”

তারুণ্য আর কিছু বললো। অরিশের জায়গায় বসতে চাইলে সেখানেও নিষেধাজ্ঞা জারি করলো অরিশ। তার এক কথা, তারুণ্য ভাইয়া পেছনে বসবে। তাই তার কথা মতো তারুণ্য ভাইয়া পেছনে বসলো আর আমাকে বসতে হলো ফন্ট সিটে। অরিশ ভাইয়ার মুখে তখন দুষ্টু হাসি। একবার আমার দিকে চেয়ে ড্রাইভ করতে মন দিলো। গাড়ির আয়না আমার দিকে ঘুড়িয়ে দিলেন। ড্রাইভের ফাঁকে ফাঁকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আমি চোখ মারতেই ফট করে চাইলেন আমার সমীপে। আমার হাত টেনে নিজের বাহুতে নিয়ে নিলেন। নিজের সাথে দৃঢ় করে মুড়িয়ে নিলেন। আঙুলের ভাঁজে আঙুল ঢুকিয়ে রাখলেন। ড্রাইভ করতে করতে বললেন,-” ঘুমিয়ে পড় ডিঙিরানী। নাহলে এই বর্ষায় তোকে ডিঙির মতো চালিয়ে চালিয়ে নিজের গন্তব্যে পৌঁছে যাবো।”

আরশি সিটের একদম কোণ ঘেঁষে বসে আছে। দুজনের মাঝখানে রাজ্যের ব্যবধান। এতোক্ষণ তরীর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিল। তারুণ্য আরশির ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে বলল,
-” আরু, তুই চাইলে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে পারিস।”
আরশি নাক ফুলিয়ে চাইলো তারুণ্যের দিকে। তার গলা আরশি ছাড়া কেউ শুনে নি। আরশি দ্বিগুণ তেজ নিয়ে ধীরে ধীরে টেনে টেনে বলল,

-” কোন পরপুরুষ কিংবা পর নারীর প্রেমিকের কাঁধে মাথা রেখে আরু ঘুমায় না। তাদের থেকে মেপে মেপে একশত হাত দূরে দূরে থাকে‌।”
তারুণ্য আকাশ থেকে পড়ে খেজুর গাছে আঁটকে গেছে এমন ভাব করলো। কিছুদিন আগে তার বুকের সাথে লেপ্টে ছিলো। এক ঘরে থেকেছিলো, তখন কি নিজের পুরুষ ছিল। মাথা চুলকে ইনোসেন্স ফেইস করে বলল,

-” আ’ম সিউর। আমাদের মাঝে দুই ফুট ডিস্টেন্ড নেই। এক ফুট দূরত্ব আছে কিনা সন্দেহ।”
আরশি তেজ নিয়ে তাকাতেই তারুণ্য অন্যদিকে ফিরে গেল। কাঁচ টানা জানালার ভেতর থেকে প্রকৃতি দেখার জন্য উঁকি ঝুঁকি দিলো সে। সিটে পুরোপুরি গাঁ হেলিয়ে দিলো। দুহাত বুকে গুজে নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে নিল। ধীরে ধীরে পাতা ভারী হয়ে রাজ্যের ঘুমেরা এসে ধরা দিলো তার গ্ৰথণ করা চোখে। পাড়ি জমালো ঘুমের রঙিন দেশে।

প্রত্যুর্ষের সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে। বর্ষন শেষে অন্তরিক্ষে দেখা মিললো রবির। সেই আলোর এক চিলতে রোদ এসে পড়লো আরশির মুখশ্রীর উপর। আরশি নড়ে চড়ে উঠলো। হালকা হয়ে গেছে তার নিদ্রা। ধীরে ধীরে চোখ মেলতেই দৃষ্টি গোচর হলো কারো ফর্সা চিবুক। উঠতেই চাইলেই আঘাত প্রাপ্ত হলো মস্তিস্ক। পুনরায় নেতিয়ে গেল সে। বুকের ভেতরে সেই অনুভূতি কড়া নেড়ে যাচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে মানুষটিকে দেখার জন্য এক নজর চাইলো। দৃষ্টি গোচর হলো সেই অতি পরিচিত মুখ। অজান্তেই তার মুখে হাসির দেখা মিললো। তারুণ্য ভ্রু নাচিয়ে বলল,

-” তো ম্যাম! ঘুম ভাঙল। তখন তো দিব্যি বলেছিলেন, কোনো পরপুরুষের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমান না। রাতে তো দিব্যি ঘুমিয়েছেন। বলি, রাতে কি পরপুরুষ প্রেমিক পুরুষ হয়ে গেছে?”
আরশি আমতা আমতা করে ঢোক গিলে। কোনো রকম বলে,-” মোটেও না! আমি আপনার কাছে যাইনি। বরং আপনি জেতার জন্য আমাকে আপনার বুকে টেনে নিয়েছিলেন।”

-” ধরা পরার পর সবারই একই কথা।”
আরশি কথা বাড়ালো না। সে জানে, ঘুমের সময় তার হুঁশ থাকে না। কি করে জানা নেই। তাছাড়া কালকে রাতে অসুস্থ ছিলো। আরশি লম্বা একটা হাই তুলে আশে পাশে চাইলো। কাউকে গাড়িতে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে গেল কোথায় তারা। চোখ ঢলতে ঢলতে বলে,

-” বাকিরা কোথায় গেছে?”
-” যেখানে আসার জন্য এতোপথ অতিক্রম করেছি, সেখানে।” তারুণ্যের তেড়া উত্তর।
-” মানে!” না বোঝার স্বরে।
-” তুই তো ঘুম কাতুরের মতো ঘুমিয়ে ছিলি। সবাই তোর জন্য অপেক্ষা না করে চলে গেছে। আমি গাড়ি পার্ক করে বসে আছি তোর ঘুম ভাঙার অপেক্ষায়।”

আরশির অস্বস্তি হলো। কি হতো একদিন না ঘুমালে। “চলো” বলে নামতে নিলে হাত টেনে ধরলো তারুণ্য। নিচ থেকে সিল্কের ওরনা তুললো। দরজা খুলে বাইরে ঝেড়ে দিয়ে আরশির কাঁধে তুলে দিল। আরশির মুখে লজ্জার্ত রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। একহাত দিয়ে ওরনা পেঁচিয়ে নিচের দিকে চেয়ে রইল। তারুণ্য আরশির অস্বস্তি অনুভব করতে পারলো। অগোচরে শব্দ করে হাসলো সে। বাঁকা হেসে বলল,

-” এখন কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি? আমি যাচ্ছি। তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ি পাহারা দে.
বলেই হাঁটা দিলো তারুণ্য। আরশি দৌড়ে এসে দাঁড়ালো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,-” একটু আস্তে হাঁটুন না।” তারুণ্য হাঁটার গতি কমিয়ে দিলো। তবুও হাত ধরলো আরশি। ছোট ছোট পা ফেলে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগল। এখনো অনেকটাই পথ বাকি। একেই মাটির রাস্তা তার উপরে উপরে বৃষ্টি হয়ে কাঁদাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। গাড়ি কাঁদায় মাখো মাখো হয়ে যাবে। তাই আর গাড়ি সামনে এগুলো না।

কাঁদার ভেতরে লাফালাফি করছি আমি। অরিশ ভাইয়া দূরে দাঁড়িয়ে এটা ওটা বলে চলেছে আর সামনের দিকে হাঁটছে। আমাকে না দেখে পেছনে চাইলো সে। কয়েকপা এগিয়ে এসে দিলো রাম ধমক। ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,
-” তরী! কি হচ্ছে এইসব? চল! আমাদের যেতে হবে। অনেকটা পথ পরে আছে।”
লাফাতে লাফাতে বললাম,

-” ঐ গাছের ডালে কদম ফুল আছে। যদি এনে দিতে পারো, তবেই যাবো। ডান!”
-” তরী, আগে বাড়িতে চল। পরে সময় করে কদম এনে দিবো।”
-” তাহলে পরে সময় করে আমিও বাড়িতে যাবো। তুমি বরং এখানে এসে লাফাও। দেখো, অনেক ভালো লাগবে!”
অরিশ ভাইয়া এগিয়ে এলেন কাঁদার মাঝে। আমার হাত ধরে টানতে লাগলেন। একটু অসাবধানতায় ধপাস করে কাঁদার ভেতরে দুইজনে। আমি নিচে তিনি উপরে। কাঁদায় মাখো মাখো দুইজনে। চোখাচোখি হলো বেশ কিয়ৎক্ষণ। তিনি উঠে বসলেন। আমিও তার পাশে বসে বললাম,

-” দেখেছ তুমি? ছোটদের কথা না শুনলে কি হয়! তাই বড়দের কথার মাঝে ছোটদের দু একটা কথা শুনলে দোষের কিছু হয় না। বরং কিছু না কিছু শেখা যায়।”
ভ্রু কুঁচকে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন,-“সত্যি!” আমিও মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৬

হুট করে মৃদু ঝুঁকে কোলে তুলে নিলেন আমায়। দৃঢ় বাঁধনে আবৃত করে নিলেন। নড়াচড়ার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। কাঁদা সমেত পা নিয়ে ধীরে ধীরে সাবধানতা অবলম্বন করে সামনের দিকে অগ্রসর হলেন। ত্রুব্ধ কন্ঠে বললেন,
-” ছোটদের কথা না শুনলে কি কি হয় দেখলাম। এবার বড়দের কথা না শুনলে কি কি হয় সেটাই দেখার বাকি আছে। নাউ স্টার্ট..

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৮