অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৬

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৬
ইফা আমহৃদ

-” আমার চোখের সামনে আমার আভা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে।‌ ঝলসানো ভয়ংকর ছিলো সেই মুখ।
আভার সতী’ত্ব কেড়ে নিয়ে ছুরির আঘাতে শিরা কেটে ফেলেছিলো। ফিকনি দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো।‌ অতঃপর বাসে আগুন দিয়েছিলো। আগুন সেই দিন আভাকে স্পর্শ করলেও আমাকে করতে পারি নি। কা’পুরুষের মত পালিয়ে এসেছি। ছেড়ে এসেছি তাকে। আভা আমাকে কসম দিয়ে বাধ্য করেছিলো। তারপরের দিন খবরের কাগজে সেই পুড়ে যাওয়া

বাসের খন্ডিত অংশ দেখেছিলাম। শুধু আভা পুড়ে যাইনি। আমার আর আভার বেঁচে থাকার প্রতিটা স্বপ্ন পুড়ে গেছিলো।”
তারুণ্য দূর্বল হাসলো। তার চোখের অশ্রু টলমল করছে। যা আমার চোখ থেকে এড়ালো না। আমি ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভাইয়ার শীতল গাল স্পর্শ করলেই তার নেত্র জোড়া গ্ৰথণ হয়ে এলো। পরমুহূর্তেই চোখের কার্নিশ গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। ভাইয়াকে দেখে আমিও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” আরে পাগলী তুই কাঁদছিস কেন? এতো কাঁদলে বাকিগুলো শুনবি কিভাবে?”
আমি অবাক চোখে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তাকে দেখে মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না, তবুও আমার জন্য সবকিছু বলছে।
-” আভার মৃত্যুর পর আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, ওর খুনি, ধ’র্ষ’ক’দের শাস্তি দেওয়া। ওর খুনিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য বদলে যাই আমি‌। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি গ্যাং স্টার অপূর্ব হয়ে উঠি। আর কোনো ভালোবাসার মানুষদের বিচ্ছেদ হয়ে দেই নি।

এই অপূর্ব নামটা আভা দিয়েছিল। আমাকে দেখার পরে না-কি আভার মুখ থেকে প্রথমে অপূর্ব শব্দ টা উচ্চারণ হয়েছিল।
যেই পাঁচার কারীদের কবলে তুই পড়েছিলি। তারাই আমার আভাকে মেরেছিলো। ঐ গ্ৰুপের সবাইকে আমি বিদেশেই মেরে ফেলেছি। যেই দুইজন বাকি ছিলো তাদেরও শেষ করেছি।
বাকি রইল, তোর কাছে কেন নিজের পরিচয় গোপন রেখেছি? আমি চাইনি আমার শক্রুরা তোর কথা জেনে যাক! তোর ক্ষতি করুক। তাই বাধ্য হয়ে ছিলাম।”

আরো কিছু বলতে চেয়েছিল তারুণ্য। তার আগেই তার দৃষ্টি গেল দরজার দিকে। সেখানে আরশি দাঁড়িয়ে আছে। চোখ জোড়া অস্বাভাবিক লাল হয়ে আছে‌। গম্ভীর তার মুখ। তারুণ্য দৃষ্টি লুকালো। আরশি তার বাড়িতে গিয়েছিল। আজকে ফেরার কথা ছিল না। বলেছিল কাল সকালে আসবে। তাই সে আজকে তরীকে সবটা জানাতে চেয়েছিল।
তারুণ্য ঠোঁট উঁচু করে কিছু বলতে চাইলে আরশি শুনলো না। তার পূর্বেই উল্টো পথ দিয়ে হাঁটা ধরলো।

চুপচুপ ছাদে দিয়ে দাঁড়ালো। আকাশ তখন মেঘের ভারে কষ্টগুলো ধামাচাপা দিতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। সে আরশির কষ্টের সাথে কাতর হয়ে উঠেছে। আরশি ছাদের এক কোনায় বসে আছে প্রানহীন জীবন্ত পুতুলের ন্যায়। স্তব্ধ তার চোখের চাওনি। বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। তারুণ্য দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলেন সেদিকে। জুতো বিহীন সমান পা জোড়া নিয়ে আরশির দিকে এগিয়ে গেল। বসলো তার পাশে। আদুরে গলায় ডাকলো তাকে,

-” আলু! আলু! এই পুঁচকু আলু?”
এই নামে ছোট বেলায় তারুণ্য তাকে ডাকতো। কিন্তু আজ সে অপূর্ব, অপূর্ব আহসান। তার ঝারু ভাইয়া নেই। চোখ বুজে অশ্রু কণা বিসর্জন দিলো। অধরে অধরে চেপে নিজেকে সংযত করে বলে,
-” অপূর্ব ভাইয়া, আপনি ভেতরে যান! আমাকে কিছুক্ষণ একা ছেড়ে দিন। প্লীজ!”

অপূর্ব নামটা বুকে এসে তীরের ন্যায় বিধল। নিজেকে কেমন অপরাধী, অপরাধী লাগছে তার। আজ আরশির কাঁধে দিতে গিয়েও দিতে ব্যর্থ হলো সে। নিজেদের মাঝখানে অদৃশ্য দেয়ালের আবাস পেল। মৃদু স্বরে বলল,
-” ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আয়। জ্বর আসবে।”
তারুণ্য চাতক পাখির নিমিত্তে অপেক্ষা করলো আরশির কথন শ্রবণ করার জন্য। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও ব্যর্থ হলো সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পানির মাঝে ছোপ ছোপ শব্দ করে প্রস্থান করলো সে।

রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটেছে। আরশি ছাদ থেকে ভেতরে এলো না। ভোর পেরিয়ে সকাল ছাড়িয়ে গেল। তবুও তার দেখা পাওয়া গেল না। বিরাগী হয়ে নিজেই আরশির খোঁজে নেমে পড়ি। ছাদে এসে কোথাও তাকে দেখতে পেলাম না। বৃষ্টি থেমে গেলেও পানির ধারায় পুরো ছাদ ভেজা। তবে আরশি যেখানে বসে ছিলো, সেই জায়গাটা শুকনো রয়েছে।
চিলেকোঠার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। হয়তো বৃষ্টির কারণে আরশি ওখানে আছে।

কিন্তু আমার ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে সেখানেও তার দেখা পাওয়া গেল না। হাঁফ ছাড়ল আমি। নিচে গিয়ে ভাইয়াদের সব জানালাম। পুরো বাড়ি, বাগান, সুইমিং পুল খুঁজেও মেলেনি তার আভাস। দাড়োয়ান চাচার কাছ থেকে জানতে পেরেছি, ভোরের দিকে আরশি চলে গেছে। দাড়োয়ান চাচা জিজ্ঞেস করেছিলো। তাকেও কিছু বলেনি। স্থির দৃষ্টিতে চলে গেছিলো।

অরিশ ভাইয়া উপায়হীন হয়ে বাড়িতে ফোন করলো। বেশ কয়েকবার করার পরেও কেউ রিসিভ করেনি। প্রায় মিনিট বিশেক পর ওপাশ থেকে ফোন এলো। রিসিভ করতেই অরিশ ভাইয়া বিচলিত হয়ে পড়লো। মামা ওপাশ থেকে বলছে, -“আরশি বৃষ্টিতে ভিজে বাড়িতে এসেছে। এসেই দরজা বন্ধ করে রেখেছে। আমরা মনে করেছি, জামা কাপড় ছেড়ে নিবে। কিন্তু সে ভিজেই বসে ছিলো। তোর মা একটু আগে ডাকতে গিয়ে দরজা বন্ধ পেয়েছে। ডাকার পরেও দরজা খোলে নি। দরজা ভাঙার চেষ্টা করছি। তাও পারছি না। ওবাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিয়েছিলাম। আরু একই পোশাকে ভেতরে শুয়ে আছে। কি হয়েছে ওর? কে জানে?”

আরশি এমন কথা শুনে অরিশ ভাইয়া আর তারুণ্য ভাইয়া বেরিয়ে গেলেন। তাদের পিছুপিছু আমি গেলাম। এটাই ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। মামনির ভালোবাসার মাঝে ভুলেই গিয়েছিলাম পেছনে কাটিয়ে আসা দিনগুলো।

অবশেষে দরজা ভাঙা হলো। আরশির গায়ে ধুম জ্বর।তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত ভেজার ফলে হাত- পা, চোখ- মুখ সাদা হয়ে গেছে। ভেজা জামা কাপড় শুকিয়ে গেছে। জামা কাপড় পাল্টে দেওয়া হয়েছে। মামুনি কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। দিদার গাল ভর্তি করে পান চিবুচ্ছে।
আরশির মাথায় পানি দিচ্ছে অরিশ ভাইয়া। মামুনি কাঁদছে। আমি হাত পায়ের তালুতে ঘষছি। তারুণ্য ভাইয়া ডাক্তার আনতে গেছে।

ডাক্তার দেখে মেডিসিন দিয়ে গেছে। ইনজেকশন পুশ করে রাখা হয়েছে। ডাক্তার চলে যাওয়া পর আমরা বেরিয়ে আসতে নিলাম। তৎক্ষণাৎ কেউ হাত টেনে ধরলেন। মামুনিকে দেখে মাথা নিচু করে রইলাম। হয়তো আজও কিছু বলবে, মারবে। তেমন কিছু করলেন না। হুট করেই আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
-” রেগে আছিস মামুনির উপর। একবারও ফোন করে জিজ্ঞেস করলি না, কেমন আছি? এতো রাগ কেন তোর? আমি তোর বড়। একটা চড়ও কি তোকে মারতে পারি না! সেই অধিকারও কি আমার নেই? তাই বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি!”
আমি আমার পূর্বের হারিয়ে যাওয়া মামুনিকে দেখতে পেলাম। শব্দহীন স্বরে আওড়ালাম,

-” মা-মু-নি!
মামুন মাথার অগ্ৰভাগে অধর ছুয়ে দিলেন।‌ হাত দুটি নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে রেখেছে। অশ্রু মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,

-” আমি তোর সাথে এতো কিছু করলাম আর তুই কিছু বললি না। তুই না চলে গেছিলি বলেই হয়তো আমি বুঝতে পেরেছি, দোষটা আমার ছিলো। আরু, অরি আমার সাথে কথা বলেনি। মা বলে ডাকে নি। কখন বাড়িতে এসেছে, কখন বেরিয়েছে। কিছু বলেনি। আমি কিছু বলতে গেলে, মাথা নাড়িয়ে হু, হা করেছে।”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৫

ফট করে অরিশ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তার ফেকাসে মুখের আড়ালেও মিষ্টি হাসি লুকিয়ে আছে। মাথা দিয়ে সায় দিলেন। আমিও হাসলাম মৃদু।
এই দিনটাই কাল হয়ে উঠলো একদিন। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো চারটে জীবন। ধোঁয়াশায় অস্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো বেঁচে থাকা।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৭