অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৫

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৫
ইফা আমহৃদ

মাথার চুল থেকে চুইসে চুইসে পানি ঝরছে। পানিতে ফ্লোর ভিজে গেছে। আশে পাশে কোথাও টাওয়ালের চিহ্ন মাত্র দেখছি না। আমি যেদিন নিখোঁজ হয়ে গেছিলাম, সেদিনও সুন্দর করে বেলকেনিতে রোদে দিয়েছিলাম। আরো একবার বেলকেনির দিকে খুঁজতে যেতেই ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেলাম। এই নিয়ে তিনবার পড়েছি। ব্যাথায় কোমড়টায় জং ধরে গেছে। নিজের রাগ দমিয়ে রাখতে না পেরে পরপর দুটো চড় মারলাম মেঝেতে। উল্টো হাতের পিঠে আঘাত পেলাম।‌ ঠোঁট উল্টো পা ছড়িয়ে বসে রইলাম। জানালার গ্ৰিলে বসে থাকা ময়না পাখিটা আমার এই অবস্থায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। একদম অরিশ ভাইয়ার মতো হাঁসি। বিরাগী হয়ে বললাম,

-” যেমন বিলাতি ইঁদুর, তেমনি তার পাখি! দুটোই হাড় বজ্জাত।”
আমার কথা শুনেই তাল মেলাতে লাগলো পাখিটা। তবে পুরোটা মেলাতে পারলো না। শুধু বলল,
-” হাড় বজ্জাত! হাড় বজ্জাত!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি ফট করে উঠে দাঁড়ালাম। একে একে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা জিনিস পত্র গুলো একটা একটা করে ছুড়লাম। কিন্তু পাখিটা এক চুল পরিমানও নড়লো না। গ্ৰিলে লেগে সবগুলো নিচে পড়ে গেল।
আচম্বিতে আওয়াজ পেয়ে ছুটে এলো অরিশ ভাইয়া। দরজার দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বেই লাফ দিয়ে বেডের উপরে উঠে গেলাম। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম ভাঁজ করে রাখা ব্লাঙ্কেট টা মেলে নিলাম। সেটার ভেতরে একদম ঢুকে বসে রইলাম। ফাঁক দিয়ে চোখ বের করে ভাইয়ার কাজ কর্ম দেখলাম।
অরিশ ভাইয়া এসে সবগুলো জিনিস গুছিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলেন। পানি গুলো মুছলেন। সন্দিহান স্বরে বলল,

-” তরী! তোর রুমে পানি এলো কি করে?”
উত্তর দেওয়ার জন্য কদাচিৎ হাঁ করতেই খক খক করে কেশে উঠলাম। তবুও ব্লাঙ্কেট সরালাম না। কারন, অরিশ ভাইয়া বারবার গোসল করতে বারণ করেছে। কিন্তু আজ হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরেছি‌। শরীর থেকে মেডিসিনের গন্ধ আসছে। অরিশ ভাইয়া ধমকে বললেন,
-” তরী! মাথা তোল?”

তবুও তুললাম না। ধৈর্য হারা হয়ে অরিশ ভাইয়া নিজেই ব্লাঙ্কেট সরিয়ে দিলেন। চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছি। ততক্ষণে আমার জামা ভিজে ব্লাঙ্কেট, চাদর ভিজে গেছে। পুনরায় আবার ধমকে উঠলেন,
-” তোকে গোসল করতে বারণ করেছি না আমি? আমার কথা অমান্য করেছিস ঠিক আছে, চুল মুছিস নি কেন?
-” টাওয়াল কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না তো!” ঠোঁট উল্টে বললাম।

মুখ কালো হয়ে গেল আমার। অরিশ ভাইয়া নিরবে হাসলেন। কাবার্ড থেকে টাওয়াল বের করে চুল মুছে দিলো। অতঃপর হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে দিল। দুই গাল টেনে বলে,-” আমার ডিঙিরানী দিন-দিন ডিঙির মতো ফুলে ফুলে যাচ্ছে।”
-” তাই বুঝতে!
আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখল। কানের লতিতে কামড় দিয়ে বলে,
-” উম!”

অপূর্ব ভাইয়ার প্রবেশ ঘটলো। তার হাতে ফটো ফ্রেম। তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
-” তরীর সাথে আমার কথা আছে!”
অরিশ ভাইয়া উঠে যেতে চাইলে অপূর্ব ভাইয়া নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। ফ্রেম টা আমার হাতে দিলেন। চমকে উঠলাম ভিশন। আমি একনজর ছবির দিকে তাকিয়ে অপূর্ব ভাইয়ার দিকে চাইলাম। কৌতূহল নিয়ে বললাম,
-” এটা তো ভাইয়া আর আমার ছবি। ভাই যাওয়ার আগে সাথে নিয়ে গেছিলো। এটা তোমার কাছে কি করছে?”
-” কারণ আমিই তোর তারুণ্য ভাই!”

ফ্রেমটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে শব্দ হলো মৃদু। চোখের কার্নিশ গড়িয়ে জলকণা ঝড়লো। অরিশ ভাইয়ার দিকে জিজ্ঞাসু চাওনি দিলাম। সে হেঁসে সায় দিলেন আমায়। অবিকল সেই ছোটবেলার মতো দেখতে। ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। আওড়ালাম, “কেন এতো দিন আমার থেকে দূরে ছিলে ভাইয়া?” তারুণ্য ভাইয়া এতো দিন আমার কাছে ছিলো। কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারি নি। ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরলেন দৃঢ় করে। গালে হাত রেখে বললেন,

-” কাদিস না খুকি। তোর ভাইয়া তো চলে এসেছে! আর এই লুকোচুরি থাকবে না আমাদের মাঝে, আজ তোর সব প্রশ্নের উত্তর দিবো। ”
তারুণ্য ভাইয়া কিয়ৎক্ষণ চুপ করে রইলেন। আমার পাশে বসে বুকে জড়িয়ে নিলেন আমায়। মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে শুরু করলেন,

-” বাংলাদেশ ত্যাগ করে অন্যদেশে পাড়ি জমাই। মেডিকেলে ভর্তি হই। ভালোই চলছিলো পড়াশোনা। তবে সবকিছুর মাঝে তোদের কে খুব মিস্ করতাম। এমনি এমনি কেটে গেল কয়েক মাস। প্রায়ই মামা টাকা পাঠাতো। কিন্তু প্রতিবার টাকা চাইতে কেমন অস্বস্তি হতো। তাই একটা লাইব্রেরীতে কাজ নেই। পার্ট টাইম কাজ করতাম। এভাবেও কেটে গেল মাস দুই। হঠাৎ একদিন একটা মেয়ে এলো। ধাক্কা খেল আমার সাথে।

লাল জামা পরিহিতা। মেয়েটা বাংলাদেশী ছিলো। আমার দিকে দূর থেকে চেয়ে থাকতো। আমি কাজের ফাঁকে মেয়েটাকে খেয়াল করতে পারি নি। একবারও দেখি নি। এর পর থেকে প্রায়ই আসতো। প্রতিবার বই খুলে দূর থেকে চেয়ে থাকতো। আমাকে দেখা শেষ করে চলে যেত।
তারপর কিছুদিন মেয়েটা এলো না। আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুলের দিকে চেয়ে থাকতাম। কারণ তাই আমি মিস্ করতে শুরু করি।

দিনটা ছিল সোমবার। বর্ষণমুখর সন্ধ্যা। জনশূন্য হয়ে গেছে রাস্তা ঘাট। লাইব্রেরী বন্ধ করে হোস্টেলে ফিরব আমি। তখন দেখতে পেলাম মেয়েটি একটি টুলে বসে কাঁদছে। কেন জানি খুব কষ্ট হলো। হয়তো দেখতে দেখতে এমন হয়েছিল। এগিয়ে গেলাম মেয়েটির দিকে। কাঁধে হাত রাখতেই মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে কেঁদে দিয়েছিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, তার জীবনের কথা‌। তার নাম ছিল আভা। আভার মা ছোটবেলায় মারা গেছিলো। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলো। বছর ঘুরতেই তার বাবা মারা যায়। দেশে ছেড়ে বিদেশে চলে আসে। শুরু হয় আভার উপর অত্যাচার। সেদিন আভাকে প্রচুর মেরেছিল, তাই কাঁদছিল।

আমাদের বন্ধুত্ব হলো।
তারপর থেকে প্রতিদিন আভা আসতো। তার সব কষ্টগুলো আমার সাথে শেয়ার করতো। একসাথে বসে কথা বলতাম। ঘুরতে যেতাম। ওর মনের সব ইচ্ছে গুলো পূরণ করার চেষ্টা করতাম। আমাদের বন্ধুত্ব টা আর বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ রইল না। ভালোবাসায় পরিণত হলো।

১৪ই ফেব্রুয়ারি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। আভার জোড়াজুড়িতে ঘুরতে বের হই আমরা। কাছাকাছি একটা ছোট পাহাড়ে। বাসে করে রওনা দিলাম। ভালোবাসা দিন ছিল বিধায় ভালোবাসার জুটি ছিল শুধু। পাহাড়ের উঁচু উঁচু পথ বেয়ে পৌঁছাই। সারাদিন আভা আমার ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে ছিলো। প্রথমবার খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিল। এতোটাই উত্তেজিত ছিলো খুশিতে আমার এই ডান গালে..
কিন্তু বেশিক্ষণ সেই হাসি স্থায়ী রইলো না। ফেরার পথে..

আর বলতে পারলো না তারুণ্য। তার গলা থেমে থেমে যাচ্ছে। কাঁপছে। অরিশ ভাইয়া এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। তারুণ্য গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করলেন। ফাঁকা গ্লাসটা বেডের উপর রাখলেন। পুনরায় বলতে শুরু করলেন,
-” ফেরার পথে নারীপাচার কারীদের কবলে পড়ি আমরা। ছেলেরা তার গার্লফ্রেন্ডকে বাসে রেখে পালিয়ে যায়। তারা সব মেয়েদের নিয়ে যায়। কিন্তু আমি তো তেমন প্রেমিক নই। আভাকে ছাড়তে রাজি নই। জোরজোরির পর্যাযে তাদের চক্রের মেন লিডারের গায়ে হাত তুলি। এটাই ছিলো আমার দোষ। আমাকে আধমরা করে বেঁধে রাখে। আভাকে আমার সামনে ধর্ষ..

তারুণ্য কেঁদে উঠলো। শব্দহীন সেই কান্না। তবে তার ভেতর টা পুড়ে যাচ্ছে। অরিশ তাকে সামলাতে লাগলেন। আমি কাতর চোখে তাকিয়ে রইলাম। নত স্বরে বললাম,
-” আভা কোথায় এখন!”
-“নেই!”
-” বুঝলাম, কিন্তু কোথায় আছে?”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৪

নিজের পড়নের শার্টটা খুলে ফেললেন। দৃশ্যমান হলো পোড়া দাগ। পিঠের অবস্থা শোচনীয়। আগুনে পুড়লে এমন হয়।
-” আগুনে পুড়ে মারা গেছে আমার আভা।”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৬