অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৪

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৪
ইফা আমহৃদ

-” তরী! তোমাদের বিয়ে হয়েছে মাস দুই পেরিয়ে গেছে। তাহলে তুই এখন নববধূর মতো লজ্জা পাচ্ছিস কেন? তুই কি জানিস, তোর লজ্জা পাওয়া মুখটা দেখতে কতোটা হেল্পলেস লাগে?”

বুকে হাত রেখে মাথা উঁচু করে ভাইয়ার দিকে অবলোকন করলাম। তিনি পলকহীন চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে। ধীরে ধীরে নিজের বন্ধনে আবদ্ধ রাখা হাতটা সরিয়ে নিলেন। সন্ধর্পনে হাতটা রাখলেন আমার বুকের বাম পাশের ক্ষত স্থানটায়। আয়াসে চোখ খিঁচে গ্ৰথণ করে নিলাম। তিনি অসহায় স্বরে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” বেশি ব্যাথা করছে তরী রানী? আ’ম স্যরি! আমি আমার তরীকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারি নি।”
দুই অধর নাড়িয়ে শব্দ উচ্চারণ করার পূর্বেই অধরে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিল অরিশ ভাইয়া। বাঁধ সাধলেন। মাথা নাড়িয়ে বললেন,

-” কথা বলার দরকার নেই। টান পড়ে রক্ত বের হবে। ক্ষতটা আরো জোড়ালো হবে।”
আমি তবুও অধর জোড়া নাড়িয়ে উচ্চারন করার চেষ্টা করলাম। শব্দ বের হচ্ছে না। কিছুক্ষণ নির্বিকার ভাবে কথা বলার চেষ্টা করে গলা চেপে ধরলাম। শব্দহীন স্বরে আওড়াতে লাগলাম,-” আমি কথা বলতে পারছি না।”
পুনরায় কথা বলার চেষ্টা করতেই ধমকে উঠলেন অরিশ ভাইয়া। আঙুল তুলে বললেন,

-” চুপ! একদম চুপ! আরেকবার নড়াচড়া করলে রাস্তায় ফেলে আসবো।”
বলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। আমি নিশ্চুপ হয়ে আধ শোয়া হয়ে আছি। মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই ডাক্তার সমেত প্রবেশ করলেন অরিশ ভাইয়া। আমাকে চেক করতে শুরু করলেন। একসময় বললেন,
-” ধীরে ধীরে কথা বলার চেষ্টা করো তো?”

অসহায় চোখে অরিশ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তিনি সায় দিতেই গলা ধরে শব্দ উচ্চারণ করার চেষ্টা করলাম। বরাবরের মতো এবারও ব্যর্থ হলাম। অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। ডাক্তার মিথিলা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-” কেঁদো না! আমি যা ধারণা করেছিলাম তাই হয়েছে। জ্ঞান থাকাকালীন সময়ে বেশ কয়েকদিন তুমি কথা বলো নি। নির্বাক হয়ে ছিলে। তারপরে তোমার গুলি লেগেছে। নির্বাক রাখলেও ভয় পেয়েছো। জ্ঞান ফেরার পর কথা বলার জন্য গলায় পেসার দিয়েছো। তাই সাময়িক সময়ের জন্য কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছো। চিন্তা করো না, ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে!”

ডাক্তার চলে গেল। আমি ঝাঁপসা চোখে চেয়ে আছি। আমার যতোদূর মনে আছে চারদিন সেখানে ছিলাম আর প্রতিদিন “ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও” বলে মিনতি করেছি। তাহলে কিভাবে সম্ভব।

গ্ৰীষ্মের কাঠফাঁটা রৌদ্রের খেলায় মেতে উঠেছে প্রকৃতি। এই আকাশ জুড়ে রোদের খেলা, এই মেঘের লুকোচুরি। রাত থাকার ফলে সূর্যের সোনালী আভার দেখা নেই। তবে ঝড়ো হাওয়া বইছে চারদিকে। রাস্তার ধুলো বালি উড়ছে। অরিশ গাড়ি থামিয়ে রাস্তার এক কিনারায় বসে আছে। এই সময়ে গাড়ি চালানোর ফলে এক্সিডেন্ট করার সম্ভাবনা থাকে।

জনশূন্য হতে চলেছে চারিদিক। অরিশ কাঁচ খুলে দিলো। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ভারী দীর্ঘ শ্বাস নিলো। এই হাওয়াতে তরীর শরীরের সেই মাতাল করা সুবাস ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে তার সন্নিকটে তরীর অবস্থান। কিন্তু তরী তো হসপিটালে। তার কেবিনের দরজা জানালা হয়তো এতোক্ষণে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

বাটন চেপে কাঁচ বন্ধ করতে চাইলে চোখ আটকে গেল অদূরে ফুল বিক্রেতা একটি ছেলের দিকে। অরিশ হাসলো মৃদু। দরজার লক খুলে বেরিয়ে এলো। ছেলেটির দিকে দৌড়ে গেল। এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ পড়ে আছে। অরিশ ফুল গুচ্ছ হাতে নিয়ে নিলো। সারাদিন রোদে থাকার ফলে শুকিয়ে গেছে। ছেলেটির অপর হাত থেকে চকলেটের প্যাকেট নিয়ে নিলো। দুটো এক হাতে নিয়ে প্যাকেট হাতরে একটা এক হাজার টাকার নোট বের করে ছেলেটির দিকে এগিয়ে দিল। ছেলেটি হাতে নিয়ে এপিঠ ওপিঠ করে মলিন কন্ঠে বলে,

-” সাহেব টাহা তো ভাঙতি নাই!”
-” আমি কি তোমার কাছে ভাঙতি চেয়েছি? হাওয়া বইছে, ঝড় উঠতে পারে। তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও..
ছেলেটি কদাচিৎ হাঁ হয়ে অরিশের মুখপানে চেয়ে আছে। ছেলেটির দিকে না চেয়ে নিজের গাড়িতে এসে বসলো অরিশ। বোতলের ছিপি খুলে হাতে পানি নিয়ে গোলাপের উপর ছিটিয়ে দিলো। ফুলের মিষ্টি সুবাস নিয়ে ফন্ট সিটের উপর রেখে দিলো। তর ডিঙিরানী ফুলগুলো দেখলে খুশিতে আত্মহারা না হয়ে গেলেই হয়। চকলেটের প্যাকেট থেকে তিন টা চকলেট বের করে শার্টের পকেটে রেখে দিলো। প্রথমে তরী কে এই চকলেট বের করে দিবে। তখন তরী মুখ ভার করে রাখবে। চিবিয়ে চিবিয়ে শব্দহীন স্বরে আওড়াবে,

-” অরিশ ভাইয়া! মাত্র তিনটা চকলেট। তুমি জানো না, আমি চকলেট ভালোবাসি। তাহলে! তুমি আমার মনের কথা পড়তে পারো না। তাই তো?”
বলেই তরী মুখ ফিরিয়ে বসে থাকবে। অরিশ তখন চুপটি করে চকলেটের প্যাকেট বের করে তরীর হাতে ধরিয়ে দিবে। ফুলিয়ে রাখা নরম কোমল গালগুলো আলতো হাতে টেনে দিয়ে বলবে,

-” আমার তরী রানীর কথা তার অরি কী কখনো ভুলতে পারে? আমার তরী রানীর কথা জানতে, তার মন পড়তে হয় না। আমার আর তরী রানীর হৃদয় তো একই। তাই সে কিছু চাইলে আমার হৃদয় তা জানিয়ে দেয়।”
তদানীং তরী খিলখিলিয়ে হেসে উঠবে‌। সেই হাসির শব্দ অরিশ মুগ্ধ নয়নে, নয়নের ভাঁজে বন্দী করবে।

ঝড়ো হাওয়া কমে এলেই অরিশ ফাস্ট ড্রাইভ করে হসপিটালের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে। কেবিনের সামনে আসতেই ফাঁকা এলোমেলো, অগোছালো, লন্ডভন্ড কেবিন নজরে এলো তারা। হয়তো ওয়াশরুমে গেছে, ভেবে কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করলো অরিশ। তরীকে ফিরতে না দেখে সেদিকে গেল। কিন্তু দেখা মিললো না তরীর। খাবার, ফুল আর চকলেটের প্যাকেট বেডের উপর রেখে খুঁজতে বের হলো সে। কোথাও দেখা পেল না তরীর। পুরো হসপিটালে এক চক্কর দিয়ে রিসেপশনে এসে থামলো। এদিক ওদিক আরো একবার পর্যবেক্ষণ করে ত্রুব্ধ কন্ঠে বলে,

-” তরী! তরী কোথায়?”
-” কোন কেবিনের পেশেন্ট স্যার?”
-” ৩৫৮!”
কিছু বলার বিনিময়ে ঘামতে দেখা গেল মেয়েটিকে। অরিশ নিজের উত্তর না পেয়ে বিচলিত হয়ে উঠলো। টেবিলের উপর আঘাত করলো। মেয়েটি অতিশয় ভীত হয়ে উঠলো। ম্যানেজার ছুটে এলো।

-” স্যার! থামুন! আমরা পেশেন্টকে খুঁজতে পাঠিয়েছি। এরা এক্ষুনি নিয়ে আসবে!”
রুদ্ধ কন্ঠে বলে,
-” এক্ষুনি নিয়ে আসবে মানে কী? কোথায় তরী?”
-” আসলে স্যার, পেশেন্ট ড্রাসের অভাবে পুরো হসপিটাল মাথায় তুলে ফেলেছে। আমরা কেউ তাকে সামলাতে পারিনি। সে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেছে। আমাদের নার্স, স্টার্ফরা তাকে ফিরিয়ে আনতে গেছে।”

-” ওয়ার্ট? আপনাদের হসপিটাল থেকে একজন অসুস্থ পেশেন্ট চলে গেল কিভাবে, আশ্চর্য? আমি..
অরিশ বাক্যের সমাপ্তি টানলো না। হসপিটালের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল। ছুটতে ছুটতে গিয়ে দেখা পেল তরীর। তরী আগে আগে ছুটছে আর বাকিরা পেছনে পেছনে ছুটছে। পাগলের মতো বিহেব করছে। কখনো কখনো মাথায় বেড়ে উঠা কৃষ্ণের ন্যায় কেশ সমূহ টেনে ধরছে। রক্তে ভিজে গেছে জামা কাপড়। অরিশ তরীকে দুই হাতে আগলে ধরলো। হাত দুটো পিছমোড়া করে ধরলো। বিনিময়ে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দিল অরিশকে।

ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। হাওয়া কমে গেছে। বৃষ্টিতে ভিজলে হিতে বিপরীত না হয়ে যায়। অরিশ দুই হাত সামনে এনে কাম ডাউন করলো। তরীর জন্য আলাদা করে রেখে দেওয়া চকলেট তিনটা বের করে এগিয়ে দিল তরীর নিকট। তরী ছুটে এসে ঝড়ের বেগে চকলেট নিয়ে খেতে লাগলো। বৃষ্টির পানিতে চুইসে চুইসে গলে পড়ছে চকলেট। গালের চারিপাশ গলিত চকলেটে মেখে গেছে।

সময় নষ্ট না করে তরীর বাহুতে ইনজেকশন পুশ করলো। মিনিট পাঁচেক পেরুবার আগেই নির্বোধ হয়ে গেল তরী। গাঁ হেলিয়ে পড়ে যেতে নিলে হাত পেঁচিয়ে ধরে ফেললো অরিশ। গলিত চকলেট গুলো ঘসে ঘসে তুললো সে। ততক্ষণে বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে সকলে। বৃষ্টিতে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে জামা কাপড়। স্টার্ফরা তখন নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তরীর দিকে। অরিশ তরীর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলে,

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৩

-” তাড়াতাড়ি গিয়ে কেবিন গুছিয়ে নিন। কুইক!”
ঝড়ের গতিতে প্রস্থান করলো সকলে। একহাতে তরীকে জড়িয়ে ধীরে ধীরে নিজের শার্টটা খুলে তরীর গায়ে পেঁচিয়ে দিলো। অরিশ দাঁড়িয়ে রইলো না। মৃদু ঝুঁকে জ্ঞানহীন তরীকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। গতিহীন স্থির পা জোড়া গতিশীল করে এগিয়ে গেল সামনে দিকে।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৫