অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৩

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৩
ইফা আমহৃদ

তিন ঘন্টা ধরে বিরামহীন ভাবে অপারেশন থিয়েটারের উপরের লাল বাতি টা জ্বলছে। অরিশ মাথায় হাত রেখে হাঁটুতে মুখ গুঁজে হিম শীতল ফ্লোরে বসে আছে। সাদা শার্টে রক্তের ঝোপ ঝোপ দাগ। আরশি বেঞ্চির উপরে বসে আছে। চোখের পাতা ঘুমে ঢুলু ঢুলু। নিদ্রায় মাথা দেয়ালের সাথে হেলে পড়েছে। অপূর্ব দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। দু’পা এগিয়ে অরিশের পাশে বসলো। অপূর্বের কাঁধে হাত রাখলো। অন্যহাত দিয়ে অপূর্বের শার্টের রক্ত’গুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করলো। অপূর্ব হাত ধরে ফেললো অরিশ। একবার মাথা তুলে অপূর্বের পানে চাইলো। পুনরায় নিচের দিকে চাইলো। থমথমে মুখে বলল,

-” মুছিস না অপু! এটা যে আমার ডিঙিরানীর রক্ত। ও আমার কাছে না থাকলেও ওর রক্ত আমাকে ওর উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।”
অপূর্ব কাতরতার মাঝেও মনে মনে এক চিলতে হাসলো। এই ছেলেটি তার খুকি বোনটাকে পাগলের ন্যায় ভালোবাসে। একমাত্র এই ছেলেটি তার বোনের জন্য উপযুক্ত।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাথায় হাত দিয়ে বলে,-” আমি এখানে আছি অরি! তুই একবার বাড়িতে যা! আরশিকে রেখে, ফ্রেশ হয়ে আয়।”
অরিশ আরশির দিকে চাইলো এক নজর। বাড়িতে গেলে অনিতা তাকে ফিরতে দিবে না। আবার অপূর্বের বাড়িতে আরশিকে একা রেখে আসা সম্ভব নয়। উঠে দাঁড়ালো সে। শক্তি হীন অচল পা জোড়া টেনে টেনে আরশির সামনে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে ডাকল,

-” আরু, এই আরু! ঘুমিয়ে পড়েছিস? চল বাড়িতে দিয়ে আসি তোকে?”
আরু নিভু নিভু চোখে অবলোকন করলো অরিশকে। ভাইয়ের কাতর মুখের দিকে চেয়ে অপারেশন থিয়েটারের দরজার দিকে অবলোকন করলো। এখনো আলো জ্বলছে। সেঁটে গেল পেছনে। দেয়ালের কারণে কোনো রুপ লাভ হলো না। মাথা নত করে করে বলল,

-” ভাইয়া, আমি বাড়ি যাবো না।”
-” এখন চল কালকে আবার আসবি।”
ভাইয়ার কথার উপরে কথা বলার সাহস হয়ে উঠলো না আরশির। একবার অপূর্বের দিকে চেয়ে ডানে বামে মাথা নাড়া। অপূর্ব চোখের ইশারায় যেতে বলে। আরশি বাক্য খুঁজে পায় না‌। উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল সামনের দিকে। পেছনে অরিশ। কয়েকপা ফেলতেই পেছন থেকে মৃদু শব্দ শ্রবণ হলো তার। চরণ থামিয়ে পেছনে চাইলো সে। লাল আলো নিভে গেছে। সাদা এপ্রোন পরিহিতা একজন মহিলা বেরুচ্ছে। নিঃসন্দেহে ডাক্তার। অরিশ সামনে না এগিয়ে পেছনে এগিয়ে গেল। সংকোচ নিয়ে কিছু বলার আগেই অপূর্ব কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

-” ডাক্তার তরীর কি খবর? কেমন আছে ও?”
মহিলা একবার চাইলেন অরিশের দিকে। ছেলেটার মুখে আকুতি ভরা। হেঁসে বললেন,
-” ভালো আছে! সৌভাগ্য ক্রমে গুলিটা হার্টের তিন ইঞ্চি উপরে লেগেছে। এবারের মতো বেঁচে গেছে মেয়েটা। আরেকটু নিচে লাগলে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হতো না। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্ত দেওয়া হয়েছে। এখন স্যালাইন চলছে।”
অরিশ উদাসীন হয়ে চোখ গ্ৰথণ করে নেয়। মনে মনে চাপা স্বরে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। কাতর স্বরে হাসলো একবার। চোখ মেলে বলল,

-” আমি কি একবার তরীর সাথে দেখা করতে পারে?”
-” আদোও কি কোনো লাভ হবে দেখে? সকাল হওয়ার আগে জ্ঞান ফিরবে না। মেয়েটার শরীর ক্লান্ত। ঘুমের কড়া ডোজের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তবে চোখের দেখা দেখতে পারো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে কেবিনে সিফ্ট করা হবে। তখন দেখে নিও। তবে এই ধরনের পোশাকে নয়। বুজতে পারছ, রোগীর ইনফেকশন হয়ে যাবে।”

অরিশ হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে তার উত্তর দেয়। রক্তমাখা সাদা শার্ট টেনে কপালের কাছে জমে থাকা ঘাম টুকু মুছে নিলো‌। ঘামে তার জামা ভিজে গেছে‌। কিন্তু সেদিকে তার ধ্যান ছিলো না।
ডাক্তার একবার অপূর্বকে তার কেবিনে যেতে বলে। অপূর্ব যায় তার পিছু পিছু। ডাঃ মিথিলা টেবিলে হাত রাখে। বলতে শুরু করলেন,

-” পেসেন্টের অবস্থা তেমন ভালো দেখছি না, ডান বাম উভয় বাহুতে ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। দিনে রাতে সর্বক্ষণ। জায়গাটা কালচে হয়ে আছে‌। আমার ধারণা..
এইটুকু বলে বিরতি দিলেন ডাঃ মিথিলা। সাথে সাথে অপূর্ব প্রশ্ন ছুঁড়ল,-” কিন্তু কি ডাক্তার?”
-” আমার ধারণা তাকে ড্রাগস দেওয়া হয়েছে। হাই মাত্রায় আ্যালকোহল। সূচ ফোটানোর মাধ্যমেও দেহে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া প্রায় জ্ঞানহীন অবস্থায় ছিল সে। কি হতে পারে বুঝতেই পারছেন। রিপোর্ট হাতে পেলে সিউরলি বলতে পারব।”

অরিশ বাড়ি গেল। বাড়িতে ফিরে মিনিট দশেকের মাথায় হসপিটালে ফিরে এলো। যেখানে বাড়িতে যেতেই দশ মিনিট লাগে। এসে দাঁড়ালো কেবিনের দরজার কাছে। অরিশ বাইরে দাঁড়িয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। ততক্ষণে ভোরে আলো ফুটেছে। তরীর ব্যাপারে কিছুই বলেনি অপূর্ব। অরিশ দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। চোখ বন্ধ করে তার তরী রানী নিদ্রাচ্ছন্ন। অরিশ তরীর বেডের পাশে বসলো। স্যালাইন চলছে।

শেষের পথে। অরিশ হাত দিয়ে তরীর এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিল। শব্দ করে ললাটে অধর ছুয়ে দিল। ক্যানেল বিহীন অপর হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে সেখানে অধর ছুঁয়ে দিলো। অরিশের চোখ জোড়া ছলছলিয়ে উঠলো। দ্বি মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই চোখ পূর্ণ হয়ে অশ্রু ঝরে পড়লো তরীর চোখে। তরীর চোখে পরতেই কেঁপে উঠলো। গড়িয়ে পড়লো চোখের কার্নিশ বেয়ে। তখনও নির্বিকার ভাবে অরিশের হাতের মুঠোয় তরীর হাত। বিরামহীন ভাবে বলে চলেছে,

-” তরী, এই তরী! দেখ তোর অরিশ ভাইয়া এসেছে। কথা বলবি না। এবার চোখটি মেলে তাকা। কতো গুলো দিন তোকে দেখা হয়না। জানিস..
আর বাক্য উচ্চারণ করতে পারল না অরিশ। চোখ আঁটকে গেল তরীর চোখের মাঝে। তরীর চোখের পাতা নিভু নিভু করছে। পায়ের আঙুল নড়ছে। তরীর অধর জোড়া নড়ছে। কিছু একটা উচ্চারণ করার চেষ্টা করছে সে। অরিশ ঝুঁকল একটু। তরীর শব্দ গুলো শ্রবণ করার চেষ্টা করলো। তরী জ্ঞানহীন অবস্থায় বলছে,

-” আমাকে ছেড়ে দাও। প্লীজ আমাকে যেতে দাও। আমি এখানে থাকবো না। অরিশ ভাইয়া কোথায় তুমি? তারু ভাইয়া প্লীজ তোমার খুকিকে নিয়ে যাও।”
অপূর্ব আর শ্রবণ করলো না। পুরোপুরি ঝুঁকে পড়লো। একহাতে দেহের ভার বহন করে অন্য হাত গালে রেখে পরপর কয়েকটা চপল মেরে বলে,

-” তরী! এই তরী তাকা আমার দিকে! প্লীজ তাকা।”
চিৎকার করে উঠলাম আমি। কাতরাতে লাগলো। ফট করে চেয়ে দেখলাম অরিশ ভাইয়ার মুখ। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ মেলতেই চার জোড়া চোখের চোখাচোখি হয়ে গেল। দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম আমি। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। অরিশ ভাইয়া সরে গেলেন। কাতর স্বরে বললেন,

-” তরী, কিরে কথা বলছিস না কেন?”
তবুও কোনো কথা বললাম না আমি। চাপা আয়াসে চাদর চেপে ধরলাম। কখনো তাকে কাতর হয়ে কথা বলতে শুনি নি। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। তার চোখের দিকে তাকানোর সাহস খুঁজে পাচ্ছি না। অরিশ ভাইয়াকে উদাসীন হয়ে উঠলেন। হয়তো ভেবেছিলেন, জ্ঞান ফেরার পর কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দিবো। কিন্তু তেমন কিছু করলাম না। অন্যপাশে গিয়ে বললেন,

-” কথা বলবি না আমার সাথে।”
এবার ফুঁপিয়ে উঠলাম আমি। দুহাতে মুখ আড়াল করতে চাইলে স্যালাইনের ক্যানেলে টান পড়লো। চাঁপা আর্তনাদ করে উঠলাম। অরিশ ভাইয়া ছুটে এসে টেনে বের করলেন। আমাকে টেনে নিজের বাহুডোরে নিয়ে নিলেন। ভাইয়ার বুকে মাথা ঠেকিয়ে শব্দ হীন কেঁদে উঠলাম আমি। নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। অসহায় হয়ে পড়লেন তিনি। পিঠে হাত রেখে বললেন,

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩২

-” কাঁদিস না তরী! আমার তরী কাঁদলে তার অরি কি শান্তিতে থাকতে পারে। বল!”
আর পাঁচটা দিন হলে হয়তো ধমকে চুপ করিয়ে রাখতেন আমায়। আজকে তেমন করলেন না। বরং শান্ত করতে উঠে পড়ে লাগলেন তিনি।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৪