অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩২

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩২
ইফা আমহৃদ

বন্ধ দরজা খোলার মৃদু শব্দে কানে এলো। ভারী ভারী চোখের পাতা টেনে অবলোকন করলাম সেই দিকটায়। জ্যৈষ্ঠ মাসের শীতল হাওয়া প্রবেশ করলো অন্ধকারে আবৃত ঘরে। মাথা তুলে মিনমিনে স্বরে আওড়ালাম,
-” কে? কে আপনি?”

অপর পাশের মানুষটির কোনো প্রত্যুত্তর কর্ণপথে এলো না। কিন্তু পাশের ছোপ ছোপ শব্দ জানান দিচ্ছে কারো উপস্থিতি। শরী’রে হাত দিলাম। ওরনা নেই। পড়নের জামা টেনে টেনে দিলাম। আলো জ্বলে উঠলো। আপনাআপনি চোখের পাতা বুজে গেল। ধীরে ধীরে ঝাঁপসা ঝাঁপসা চোখে মেলে একজন মধ্য বয়স্ক লোক দেখতে পেলাম। কতো গুলো দিন কেটেছে এই অন্ধকার ঘরে, কতো গুলো দিন খাওয়া হয়নি জানা নেই। জ্ঞান ফিরলেন বাহুতে ইনজেকশন পুশ করে দেয়। ঘুমিয়ে পড়ি আমি। ব্যাথায় বাহু নাড়ানোর শক্তি নেই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ওরনা বিহীন উঠে বসার প্রচেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হয়ে নিচে ঢলে পড়লাম। ঠান্ডা ফ্লোর ঘেঁষে ঘেঁষে পিছিয়ে গেলাম কিছুটা। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসলাম। কাতর গলায় বললাম,-” কোথায়? কোথায় আমি? অপূর্ব, অপূর্ব ভাইয়া, অরিশ ভাইয়া, আরু ওরা কোথায়?”

লোকটি বি’শ্রী দাঁত বের করে হাসি দিলো। লাল লাল দাঁত গুলো দেখে ভেতরটা গুলিয়ে এলো আমার। মুখ কুঁচকে অন্যপাশে সরিয়ে নিলাম। নত স্বরে বললাম,-” প্লীজ ছে’ড়ে দিন আমায়! আমাকে ছে’ড়ে দিন।”
আপনাআপনি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা। আমার কথায় সামনের লোকটি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। এক হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লো সামনে। গাল চেপে বলে,

-” দিবো তো ছে’ড়ে। সময় হলে ঠিক ছে’ড়ে দিবো। তবে এখানে নয় বিদেশে। বিদেশে গিয়ে অনেক অনেক অরিশ, অপূর্বের দেখা পাবি। তবে তারা তোর ভাই নয়, -“খো -দ্ধে -র! ”
শেষের কথাটা টেনে টেনে বললেন তিনি। ঘৃনায় চোখ মুখ কুঁচকে এলো আমার। মিনমিনিয়ে বললাম,-” খো -দ্ধে -র?”
আগেই জানতাম তারা আমাকে পা’চা’র করে দিবে। কিন্তু তাই বলে দেশের বাইরে। প’তি’তা’ল’য়ে‌। সবাই আমাকে দে’হ’র’ক্ষী হিসেবে চিনবে? ভয়ে গুটিয়ে এলো দেহ। মনে মনে চাপা আর্তনাদ করে অরিশ ভাইয়াকে ডাকলাম। ভীতি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগলো। উপরে অধর জিভ দিয়ে ভিজিয়ে বললাম,

-” পানি, একটু পানি দাও। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে।”
পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। কাঁপা কাঁপা হাতে চট করে গ্লাস তুলতেই নাক বি’শ্রী গন্ধ কড়া নেড়ে গেল। পেটে চাপ দিয়ে উঠলো। অসহায় গলায় বললাম,-” এটা পানি নয়, বিশ্রী গন্ধ আসছে।”

অপর পাশের লোকটি কথা না বলে গ্লাস তুললো। একহাতে গ্লাস চেপে অন্যহাতে মুখ চেপে ধরলো। অধর চেপে গলিয়ে দেওয়ার পূর্ব মুহুর্তে দরজার কড়া নড়লো। সরে গেল লোকটি। ভেতরে প্রবেশ করলো চল্লিশোর্ধ মহিলা। পড়নে জর্জেটের শাড়ি। ধবধবে ফর্সা শরীরের ভাঁজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটে রক্ত রাঙানো রঙের লাল লিপস্টিক। ভারী সাজ। আধুনিকতার ভাঁজ থাকলেও আমার কাছে পৃথিবীর অ’দ’ম মানুষের তালিকায় পড়েছে।

আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। চিবুক ঈষৎ উঁচু করে দেখে বললেন,-” বাহ্! বাহ্! বাহ্! দেখতে তো বেশ। কিন্তু না খেতে খেতে একদম শুকিয়ে গেছে। তোরা কি ওকে খেতে দিস না?”
-” আসলে, এই মেয়েটার জ্ঞান ফিরলেই ওকে ইনজেকশন পুশ করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। প্রচন্ড ধুর্ত বাজ মেয়ে। খাবারও খাওয়ার সময় থাকে না”

-” ওহ্। কিন্তু এমন হলে তো চলবে না। একে আর কেউ ঘুম পাড়াবে না। ড্রা’গ’স দিয়ে কন্ট্রোল করতে হবে। যা এবার খাবার নিয়ে আয়‌।”
মধ্য বয়স্ক মহিলার কথায় খাবার নিয়ে আসা হলো। দুটো শুকনো রুটি আর আলু ভাজি। খাবার দেখেই পেটের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে খেতে লাগলাম। অনেক দিন কিছু না খাওয়াতে গলায় আটকে গেল খাবার। খুকখুক করে কেশে উঠলাম আমি। পাশে রাখা তরল পানীয় খেয়ে ফেললাম। মাথাটা জিম দিয়ে উঠলো। মাথায় হাত চেপে বসে রইলাম। নিজেকে বড্ড অগোছালো লাগছে।

চোখের পাতা গুলো বড্ড ভারী ভারী ঠেকছে আজকাল। নেশায় আসক্ত মানুষের মতো দেহের ভার হালকা লাগছে। নিজেকে চিনতেই আজকাল আয়াস পেতে হচ্ছে। প্রায় প্রায় দহনে পুড়তে হচ্ছে আমায়। মাথা জিম মেরে থাকে সর্বক্ষণ। প্রাণ হীন হয়ে আয়নার দিকে মুখ করে বসে আছি। জীবন্ত পুতুলের থেকে কোনো অংশে কম নয়। দৃষ্টি আয়নাতে নয়, দৃষ্টি ঘোলাটে। আমার সন্নিকটে দুজন তরুণী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। সাজানো শেষ করে কোথায় একটা নিয়ে যাবে আমায়।

ভারী মেকআপ এর ব্রাশের শেষ টান দিয়ে ডান পাশের মেয়েটি বলল,-” কি গো মেয়ে, আমার সাজানো তোমার পছন্দ হয়েছে?”
সন্ধ্যায় ঘনিয়ে এসেছে। আজ একমাস দুইদিন হলো বাড়ি থেকে নিখোঁজ আমি। আমার আত্মীয় পরিজন এতো দিনে হয়তো আমাকে খুঁজতে খুঁজতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসেনা।

আমার দৃষ্টি তখনও নির্বিকার ভাবে আয়নায় অবস্থিত। মুখে কথা নেই, চোখে পলক নেই, ঠোঁটে হাঁসি নেই।‌ বাম পাশের মেয়েটি মাথায় লাল সিল্কের ওরনা টেনে দিয়ে বলল,-” বাহ্, বাহ্। দেখতে তো বেশ লাগছে। কিযে বলিস তুই, আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারছে না আর তুই বলছিস পছন্দ হয় নি। আশ্চর্য বলি হারি!”
-” তোমাকে কেউ জ্ঞান দিতে বলেনি। আশ্চর্য যাও এখান থেকে।”

একরোখা জবাব দিলো ডানপাশের মেয়েটি। আমার হাত ধরে দাঁড় করালো। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
গোডাউন জনশূন্য হয়ে এসেছে। চারদিক ফাঁকা ফাঁকা কেউ নেই। বাকি কয়েক জন হাতে গোনা লোক রয়েছে। তারা ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়েছে। আমাদের বেরুতে দেখে তারাও সকলকে তাড়া দিলো। মেন প্রবেশদ্বারের সমীপে অগ্ৰসর হওয়ার আগে হনহনিয়ে প্রবেশ করলেন দুইজন। বন্দুকের গুলি ছুড়ে বলল,

-” আই এম ব্যাক টু এগেইন। এবার নিজেকে বাঁচা।”
অতি পরিচিত কন্ঠস্বর শ্রবণপথ পর্যন্ত পৌঁছালো। ঠোঁটের কোণে অদৃশ্য হাসির রেখে মিললো। কিন্তু তা দৃষ্টির অগোচরে। মাদকতায় আচ্ছন্ন চোখের পাতা কোনো কিছুতে ব্যস্ত নয়।

অরিশ এক পলক চাইলো তার ডিঙিরানীর দিকে। সে তার বিলাতি ইঁদুরকে দেখে কি করে স্থির হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে, তরীর কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে বলতে, “ডিঙিরানী আমি এসেছি। এখনও কি রেখে আছিস পিচ্চি।” কিন্তু পিচ্চির কথা ভেবে এগিয়ে গেল না সে। চুপ করে দাড়িয়ে রইল বন্দুক সমেত। পুলিশ এলো। একে একে গ্ৰেফতার করে নিয়ে গেল। ইতিমধ্যে পা’চা’র করা গাড়ি তাদের কব্জায় গেছে। পা’চা’র করা মেয়েরা নিরাপদ।
বস নামক মধ্য বয়স্ক লোকটি গেল না। কিছুদূর গিয়ে ফিরে চাইলো পিছনে। অতিশয় ক্ষোভে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,

-” আমার ভাইকে মেরে ফেলেছিস তুই! আমি চলে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু তোর বোনকে রেখে যাচ্ছি না। ওকে ধুঁকে ধুঁকে মারতে পারছি না, কিন্তু বাঁচিয়ে রাখছি না।”
পুলিশের বন্দুক নিয়ে গুলি ছুঁড়লো তরীর সমীপে। পরপর দুটো গুলি ছুঁড়লো তরীর বাম পাশের দিকে। তৃতীয় গুলি ছোড়াল পূর্বে বন্দুক নিয়ে মাথায় আঘাত করলো তার। টানতে টানতে নিয়ে গেল একদল। আরেকজন পুলিশ ফোন করলো এম্বুলেন্জ আনতে।

ধীরে ধীরে রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল তরীর দেহ। অরিশ কিয়ৎক্ষণ বাকহীন হয়ে তরীর দিকে চেয়ে আছে। তরীর কোনো অনুভূতি নেই। হঠাৎ একসময় তরীর অনুভূতি প্রকাশ পেতে লাগলো। একসময় নিজের ডান হাতটা ক্ষত স্থান রেখে নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে নিলো। মস্তিষ্ক উঁচু করে ভারী শ্বাস টানলো। চোখ খুলে বেশ কয়েকবার ঘনঘন পলক ফেললো। নিচের অধর কামড়ে হাঁটু ভাঁজ করে আধ বসা হলো। ধপাস করে নিচে পড়ে ছটফট করতে করতে চোখ বন্ধ করে ফেললো। কাঁতরাতে কাঁতরাতে নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

অরিশ ছুটে গেল তরীর দিকে। বুক থেকে হাত সরিয়ে দৃঢ় বাঁধনে আবদ্ধ করে নিল তরীকে। গালে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,-” তরী, তরী। চোখ মেল, দেখ আমাকে! আমি এসেছি। তোকে নিতে এসেছি।”
তরীর রক্তে অরিশের শার্ট মেখে গেছে। অপূর্ব ছুটে এলো তরীর নিকট। বোনের নিথর দেহের দিকে চেয়ে রইল। অরিশের চোখে অশ্রু। তাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই। অপূর্ব অরিশের কাঁধে হাত রেখে কাতর গলায় বলে,-” আমাকে ক্ষমা করে দিস অরি। আমি তোর আমানত যত্নে রাখতে পারলাম না।”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩১

-” অপু, এভাবে বলিস না। আমি আমার পিচ্চির কিছু হতে দিবো না। এই দুই মাস দুই দিনে আমি শুধু তরীর জন্য মরে মরে বেঁচে আছি।”
অরিশ তরীকে কোলে তুলে নিলো। আশে পাশে না চেয়ে ছুটতে লাগলো। অপূর্ব পূর্বের ন্যায় বসে আছে। অতঃপর অরিশের পেছনে পেছনে ছুটতে লাগলো। (চলবে.. ইনশাআল্লাহ)
শব্দের মাঝে হাতে গোনা কয়েকটা জায়গায় (‘ -) চিহ্ন গুলো ব্যবহার করা হয়েছে। বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ রইল।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩৩