অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩১

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩১
ইফা আমহৃদ

সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন রুমের অন্তর্ভাগ। বিচ্ছিরি গন্ধে ভেতর থেকে তিঁতকুটে ঢেঁকুর আসছে । ভিড়িয়ে রাখা দরজা খুলে প্রবেশ করলো আরশি। আলোক-হীন অন্ধকার বিরাজমান ঘরে স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হলো না কিছু। আরশি হাতরিয়ে হাতরিয়ে পা ফেলে এগিয়ে গেল সামনে দিকে। সিগারেটের মৃদু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। হাতরিয়ে হাতরিয়ে অপূর্বকে ধরলো। সাথে সাথে ছেড়ে দিলো। অপূর্ব ফিরে চাইলো কি-না জানতে পারলো না সে। আরশি পিছিয়ে এলো কয়েক পা। আলো জ্বেলে দিলো। অপূর্ব পিঠ দেখিয়ে উল্টো দিকে ফিরে আছে। আরশি গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

-” শুনছো? বারোটা বাজতে চললো, খাবে না?”
আরশির তুমি সম্মোধন করছে। তবুও অপূর্বের মাঝে কোনো ভাবাবেগ লক্ষ্য করা গেল না। ফোঁস করে দম ছাড়লো সে। নিচের অধর চেপে সেকেন্ড খানেক সময় নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে নিলো। অতঃপর অপূর্বের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
-” শুনতে পারছেন আমার কথা, ক্ষুধা লেগেছে। কিছু খেতে চাই!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অপূর্ব ফিরে চাইলো না। সিগারেটের এক টান দিয়ে বলে,-” যাও, খেয়ে নাও! অরিকেও নিয়ে যাও!”
আরশি ওরনাটা কোমরে পেঁচিয়ে নিল। অপূর্বের হাত থেকে খপ করে জলন্ত সিগারেট টা নিয়ে নিল। ফ্লোরে ঘসে ঘসে আগুন নিভিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে ফেলে দিলো অদূরে। কোমরে হাত দিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-” কি? কি? কি সমস্যা আপনার? আজকাল নিজের বউ মরে গেলেও মানুষ এভাবে দেবদাস হয়ে যায় না। তরীকে কিডন্যাপ করছে। আমরা সবাই খুঁজে খুঁজে ওকে বের করব। এবারে না খেয়ে হাত পা গুটিয়ে থাকলে তরী ফিরে আসবে না, বরং আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

অপূর্ব তার নীলাভ রঙের চোখগুলো দিয়ে আরশির দিকে চাইলো। পড়নে আজও সেদিনের জামাটা। অসহায় কন্ঠে বলে উঠে,-” আমি ব্যর্থ আরু, ব্যর্থ আমি। এতো গুলো বছর, আমি আমার বোনটাকে শুধু এই কারণে দূরে সরে রেখেছি। ভাই থাকতেও আলাদা রেখেছি। চোখের দেখাটাও দেখতে দেইনি। সেই ঘটনাটা কেন ঘটলো।”

আরশি নীরব হয়ে গেল। তরীর জন্য আরশিকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। এতো গুলো বছর কষ্ট সহ্য করেছে। কেন এমন হলো। কী শান্তনা দেওয়া উচিত জানা নেই, আরশির। তবুও অপূর্বের পাশে বসলো। গালে হাত রেখে শান্ত গলায় বলল,
-” তরী হয়তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু তুমি না খেয়ে, না ঘুমিয়ে ওর জন্য চিন্তা করছো। যখন ফিরে এসে দেখবে তোমার এই হাল হয়েছে। কতোটা কষ্ট হবে বলো তো?”

অপূর্ব কিয়ৎক্ষণ গভীর ধ্যান ভাবণায় লিপ্ত হলো। মনে মনে নিজেকে শক্ত করলো। প্রাণ হীন মুখের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলে,-” খাবার আছে আরু?”
আরশিও মনে মনে হাসলো। মাথা উপর নিচ ঝাঁকিয়ে বলল,-” হ্যাঁ!”
-” খাবার নিয়ে আয়, খাবো।”

-” ও মুলো যা, এইভাবে খাবে না-কি? শরীরের গন্ধ শুঁকেছো একবার? ভেড়া ভেড়া গন্ধ আসছে। কি বিচ্ছিরি। আমার বমি পেয়ে যাচ্ছে। বন বিভাগের লোকেরা তোমার খবর পেলে এসে নিয়ে যেত।”
বলেই দুহাতে মুখ চেপে ধরলো আরশি। অপূর্ব নিজের কলার টেনে শার্টটা কদাচিৎ উপরে টেনে বাস নিলো। তেমন বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে এলো না। ললাট ভাঁজ করে বললো,-” কই কোনো গন্ধ তো আসছে না। আমার মনে হয় তোর শরীর থেকে আসছে, সেটা আমার উপর চাপানোর চেষ্টা করছিস!”

আরশি অপূর্বের কথা তোয়াক্কা করলো না। আওয়াজ তুলে কাবার্ড খুলে পাতা রঙের টাওয়াল বের করলো। সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে ছুঁড়ে মারলো অপূর্বের কাঁধে। হাত জোড় করে বলে,
-” বকবক করো না তো। যাও, একটু ঘসে ঘসে শরীরটা পরিষ্কার করে এসো।”
অপূর্ব এক পা বাড়ানোর আগে ফট করে বলে,-” আর এই নোংরা জামা কাপড় গুলো এখানে রেখে এসো। ঐগুলো সাবান দিয়ে ঘসে ঘসে পরিষ্কার করতে হবে।”

অপূর্ব ভ্রু কুঁচকালো। ঠোঁট বাঁকিয়ে ফিচেল হাসলো। বলল,-” দিনদিন সাহস বেড়ে যাচ্ছে আরু, আমি এই অবস্থায় না থাকলে তোকে যে কি করতাম।”
-” হয়েছে, হয়েছে! এখন জ্ঞানের ঝুড়ি নিয়ে বসো না। তোমার এই অবস্থা না হলে আমি তোমার আশেপাশেও থাকতাম না।”

অপূর্বকে নীরব হয়ে বসে থাকতে দেখে আরশি বিরাগী হয়ে উঠলো। ঠেলেঠুলে অপূর্ব কে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলো। অপূর্বের বের হতে সময় লাগবে। ল্যাপটপ খুলে বসলো সে। আশ্রমের চারপাশের সমস্ত ফুটেজ অপূর্বের ঘরে রাখা। সেখানে যে গাড়ির নাম্বার গুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো সব ফল্স।
ফুটেজ অন করে ফোনের ক্যামেরা দিয়ে পরপর কয়েকটা ছবি তুলে নিল। ল্যাপটপ টা পূর্বের ন্যায় অগোছালো করে ফেলে রেখে রান্না ঘরে ছুটল। রান্না ঘরে ময়না পাখিটা বসে অনবরত বলে চলেছে,

-” ডিঙিরানী, এই পিচ্চি। রেগে আছিস।”
আরশি একবার পাখিটার দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসছে। দিন দুই পূর্বে পাখিটা পেয়ে তরীর মুখে ছিল রাজ্য সমান হাঁসি, আজ সেই মানুষটি নেই।

অপূর্বের পড়নে ধূসর রঙের ট্রাউজার। টাওয়ারের সাহায্যে শরীরের পানি ধারা গুলো মুছে নিল। আরশির প্রবেশ ঘটল। অপূর্ব ফিরে চাইলো। এক লাফ দিয়ে কাবার্ডের কাছে এসে টি শার্ট বের করে গায়ে জড়িয়ে নিল। পরিপাটি করে টেনে টেনে পরিধান করল। দরজার বাইরে উঁকি ঝুঁকি মেরে বলল,-” অরি কোথায়?”
-” বাবা ডাক পাঠিয়েছে, ভাইয়া বাড়িতে গেছে!”

সংক্ষেপে ওহ্ হলে খাবারের খালা টেনে খেতে বসলো। লবন সমেত ভাত মাখতে গেলেই হাতে জ্বালা করে উঠলো। অপূর্ব হাত সরিয়ে নিল। অপূর্ব নিজের হাতের দিকে এক পলক চেয়ে বলল,-” যাও, একটা চামচ নিয়ে এসো।”
আরশি গেল না। বরং নিজের হাতে খাবার মাখতে লাগল। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,-” অন্যের রাগ নিজের উপর ঝাড়তে গিয়ে হাতের কি অবস্থা করেছো, একটিবার দেখেছো!”

অপূর্ব একবার হাতের উপর অবলোকন করে আরশির মুখের দিকে অবলোকন করল। অতঃপর আবার হাতের দিকে। দাঁত কেলিয়ে বলল,
-” দুইটি বার দেখেছি। এবার হয়েছে?”

জনশূন্য নির্জন জায়গা। অবস্থিত নদীর ধারে। ছোট একটা ব্রিজ। সেখানে বসে আছে অরিশ। সোঁ সোঁ করে হওয়া বইছে। স্রোতের টানে বহুদূরে ছুটে চলেছে অম্বুধারা। অরিশ পানিতে ঝাঁপ দিলে তাকেও বহুদূরে নিয়ে যেতে সক্ষম। ইচ্ছে করছে, এই পানিতে ডুবে নিজেকে শেষ করে দিতে। কিন্তু তার কিছু হয়ে গেছে তরীর কি হবে?

অরিশের দুহাত রেলিং এর দুইদিকে বন্দী। চোখের পাতায় বারবার তরীর ছবি ভেসে ভেসে উঠছে। তার জ্ঞান হীনতার জন্য তরীকে বিপদে পরতে হয়েছে। যদি কয়েকটা পা ফেলে তরীকে আশ্রমের ভেতরে রেখে আসতো, তাহলে তরীকে হারাতে হতো না। সেও কি বুঝতে পেরেছিল, তারা তরীকে কিডন্যাপ করতে এসেছিলো।

অরিশের ভাবনার মাঝে ফোন বেজে উঠলো। তরী ফোন করেছে ভেবে, পকেট থেকে বের করলো। কিন্তু কোনো কল আসনি। এম.এ.এস এসেছে। এই নাম্বার থেকে প্রায়ই তাকে বিভিন্ন মেসেজ করা হয়। প্রাইভেট নাম্বার হওয়াতে জানা সম্ভব হয়নি। অরিশকে কয়েকটা ছবি আর ভিডিও পাঠানো হয়েছে। তরী জ্ঞানহীন অবস্থায় পরে আছে। তার হাত, পা, মুখ বাঁধা। ভিডিও অন করতেই দৃষ্টিনন্দন হলো তরীর হাহাকার।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩০

যেখানে তরীকে ইনজেকশন পুশ করা হচ্ছে। তরী চিৎকার করে জ্ঞান হারাচ্ছে। অরিশ একই ছবি বারবার দেখলো। ভিডিও অন করে বারবার একই জিনিস দেখলো এবং শুনলো। অস্ফুট পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ আসছে। এমন শব্দ শুধু জঙ্গলেই পাওয়া সম্ভব। এই জায়গাটা তার কাছে, গভীর জঙ্গল বলে মনে হচ্ছে। অপর পাশের ব্যক্তিটি সবগুলো আনসেন্ড করার পূর্ব মুহুর্তে সবকিছু সেভ করে নিল। কাউকে ফোন করে ভিডিও আর ছবি গুলো পাঠিয়ে দিল। অপেক্ষা না করে অরিশও বাইক সমেত ছুটল।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩২