অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩০

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩০
ইফা আমহৃদ

গাল গড়িয়ে অশ্রু ধারা ঝড়ে পড়ছে। নয়ন জোড়া রক্তিম হয়ে এসেছে। চোখ মুখ ফোলা ফোলা। কালচে ভাজ পড়েছে। তবুও অবিরাম ভাবে কেঁদে চলেছি আমি। সামনের ছোট পুকুর। পুকুরের থেকে কিছুটা দূরে বসে কাঁদছি। মাটির কুঁচো গুলো পানিতে ছুড়ে ফেলছি। তৎক্ষণাৎ কেউ এগিয়ে এলো সন্ধিক্ষণে। হাত রাখল বাহুতে। চমকে উঠলাম আমি।

আগ পিছু কিছু না ভেবেই ফট করে চাইলাম পেছনে। অরিশ ভাইয়াকে দেখে থেমে গেলাম। পুনরায় সামনের দিকে চাইলাম। অরিশ ভাইয়া টু শব্দটি উচ্চারণ না করে বসলেন গা ঘেঁষে। ততক্ষণে পশ্চিমা সূর্যের রক্তিম আভা আঁধারে তলিয়ে গেছে। অন্ধকারে আবৃত হয়ে এসেছে। হাওয়া বইতে শুরু করে করেছে। মাথায় থাকা সাদা টুপিটা ভাঁজ করে পাঞ্জাবির পকেটে রাখলেন। আমার সাথে তাল মিলিয়ে তিনিও মাটির কুঁচো ফেললেন পানিতে। রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” এখানে মাছদের ডিস্টার্ব করা হচ্ছে কেন শুনি?”
প্রত্যুত্তর দিলাম না আমি। হাত ভাঁজ করে রইলাম। হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে জিম মেরে বসে রইলাম। আরেকটু গাঁ ঘেঁষে বসলেন। হাত টেনে ধরলেন। স্বাভাবিক স্বরে বললেন,
-” এখানে পেঁচার মতো মুখ করে বসে আছিস,‌ ওদিকে আমি তোকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছি।”
একরোখা জবাব দিলাম,-” আমি তোমাকে খুঁজতে বলেছি!”

-” বাবা, মুখে দেখছি খই ফুটছে! তা কেন এতো খই ফুটছে?”
এবারও উত্তর দিলাম না। উঠে দাঁড়ালাম। কয়েক কদম ফেলে অন্য পাশে নারিকেল গাছে হেলান দিয়ে দাড়ালাম। তিনি পেছনে এসে দাঁড়ালেন। তবে এবার কিছুটা দূরত্ব বিরাজ করছে দুজনার মধ্য খানে। দুহাত বুকে গুজে বললেন,
-” আজ কতো গুলো বছর পর, ফুফির কবর দেখতে গেলাম। করব বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। ফুফাকেও দেখেছিলাম। তিনি লোক জড় করে সবাইকে খাওয়াচ্ছে। আমাদের কাছেও এসেছিল। তারু কিছু দেখেও না দেখার ভান করে চলে এসেছে।”

-” ভাইয়া গিয়েছিল..
-” না, মানে অপু। ওকেই তারুণ্য মনে করেছিল।”
সংক্ষেপে ওহ্ বললাম। নিঃশব্দে অধর চেপে কেঁদে চলেছি। আজ ভাইয়ারা কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিল। কিন্তু আমি যাইনি। নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম ক্ষণে ক্ষণে।

নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলেন আমায়। চোখের পানিগুলো মুছে দিলেন স্বযত্নে। মাথায় হাত রেখে বললেন,-” আমার পিচ্চি বউটা এতো কাঁদছে কেন? তার আজকে খুশি হওয়ার কথা।
আচ্ছা তরী, আমার উপহারটা তোর পছন্দ হয়েছে?”
উপহারের কথা শ্রবণ হতেই পায়ের নিকট চাইলাম। কাল রাতে এই পায়েল টা পড়িয়ে দিয়েছিলো ভাইয়া। ব্লাক, সিলভার রঙের। এক গাল হাসি উপহার দিয়ে বিনা অক্ষরে অধর না স্বরুপ নাড়িয়ে বললাম, “হম।” পেছনে ঘুড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন আমায়।

-” তুই কি জানিস, এটা বিয়ের পর তোকে দেওয়া প্রথম উপহার।”
-” হম”
-” শুধু হম। আর কিছু নয়।”
না বোঝার ভান করে বললাম,-” আর কি?”

তিনি কিয়ৎক্ষণ চুপ করে রইলেন। দুপায়ের মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা করে গাছে হেলান দিলেন। তর্জনী আঙুল দিয়ে ঘসলো গালে ইশারা করলেন। আমি জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে আওড়ালাম,-” ছিঃ!”
এবার আড়স ভঙ্গিতে অধরের উপরে রেখে ইশারা করলেন। তার কান্ড দেখে উল্টো পথে হাঁটা ধরলাম। পেছন থেকে ওরনার কোণা টেনে ধরলেন তিনি। ধীরে ধীরে আঙুলে পেঁচিয়ে নিলেন। পুরোটা তার আয়ত্তে চলে যাওয়ার পূর্বে বুকে হাত রেখে টেনে ধরলেন। পেছনে না চেয়ে অসহায় স্বরে বললেন,-” প্লীজ!”

-” উমুহ!”
এবার পুরোটা ধরে টেনে নিজের উপরে ফেলে দিলেন। হাত দিয়ে সামনের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললেন,
-” এবার তাহলে ম্যামের মন খারাপ দূর হয়েছে।”
আমি কি-না কি ভেবে বসে ছিলাম। লজ্জায় মুখ গুঁজে দিলাম হাত বক্ষে। তার শক্ত পোক্ত হাতটা পিঠের উপর রেখে মৃদু শব্দে বললেন,-” পাগলী! আমার সামনে এতো লজ্জা কিসের তোর!”

অতিবাহিত হলো কিছুটা লগ্ন। ফুড়িয়ে গেল কিছু স্পর্শ। বিস্ফোরণ মতো কিছু এটা আশে পাশে পড়লো। বিকট ধ্বনিতে কর্ণদ্বয় ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। কম্পিত হলাম আমি। মাথা তুলে আসে পাশে দৃষ্টিপাত করলাম। মাইক্রোফোনের মাধ্যমে সবাইকে আশ্রমের অন্তর্ভাগে প্রবেশ করার জন্য অনুরোধ করছে। কাঁপা কাঁপা গলায় কিছু বলার আগেই তিনি বললেন,-” আমাদের এখান থেকে ভেতরে যেতে হবে। বলা যায় না কখন কি হয়ে যায়।”

অরিশ ভাইয়া হাত টেনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন সামনে দিকে। কিন্তু আমার পা জোড়া ভীত হয়ে শক্তি ক্ষয় হয়ে স্থির হয়ে আছে। চারিদিকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। আবছা দেখা যাচ্ছে সবকিছু। আমাকে অচল দেখে এগিয়ে এলেন তিনি। হুট করে কোলে তুলে সামনে দিকে এগিয়ে গেলেন। আশ্রমের সামনে নামিয়ে দিয়ে বললেন,
-” তরী, তাড়াতাড়ি ভেতরে যা! আমি বাইরে আছি।”

বলেই তিনি আশ্রমের বহিরাভাগের দিকে অগ্ৰসর হলেন। ধীরে ধীরে আমিও আশ্রমের দিকে গেলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। কোথা থেকে কালো পোশাক ধারী লোক এসে বন্দুক ধরলো আমার মাথায়। আকাশের দিকে বন্দুক তাক করে সুড করলো। অতঃপর ভারী গলায় বলল,

-” সবাই থেমে যা, পাখি আমার হাতে বন্দী! যাকে পাওয়ার তাকে পেয়ে গেছি!”
তিনি থামার পরবর্তী সেকেন্ডে গোলাগুলি শব্দ থেকে গেল। আমি ছোট বাচ্চাদের ন্যায় গুটিয়ে গেলাম। ভীড় জমে গেল। সবাই একত্রে এসে হাজির হলো। অপূর্ব ভাইয়া দাঁতে দাঁত ফিসে বললেন, -” ওকে ছাড়!”
ছাড়ার পরিবর্তে দৃঢ় করে ধরলেন। বন্দুক টা মাথায় গেঁথে যাওয়ার উপক্রম। উল্লাসের স্বরে বলে,-” এবার তোর খেলা শেষ! আমাদের খেলা শুরু!”

তার হাঁটুতে পা দিয়ে আঘাত করতেই বন্দুক দূরত্বে পড়ে গেল। আমাদের পশ্চায় দিকে পিছিয়ে গেল লোকটি। আমি দৌড় দিয়ে যাওয়ার আগেই মুহূর্তে সূচের ন্যায় বাহুতে আঘাত করে কিছু একটা ফোটালো। চরণ জোড়া বোধশক্তি হারিয়ে থেমে গেল। সেকেন্ড দশেকের মধ্যে মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমে যেতে লাগলো। দেহটা কেমন নিস্তেজ হয়ে আসছে। অন্ধকারে ঢেকে গেল চারপাশ। হাত দিয়ে বার কয়েক চোখ পরিষ্কার করে তাকালাম। অন্ধকারে ছাড়া কিছুই দৃষ্টিগোচর হলো না আমার। মনে হলো, এটাই পৃথিবীর দীর্ঘতম অন্ধকার রাত্রির। ধীরে ধীরে নুইয়ে পড়লাম মাটিতে। শ্রবণ শক্তি হ্রাস পেতে লাগলো। ক্লান্তি স্বরে আওড়ালাম,-” এতো অন্ধকার কোথা থেকে এলো! দেখ-তে পা-পারছি না।” একসময় পুরোপুরি জ্ঞান শক্তি হারিয়ে ফেললাম। তারপরে কি হলো জানা নেই।

চোখের পাতা ভারী ভারী ঠেকছে। হাত দুটি নাড়াতে ব্যর্থ হচ্ছি। পা সরানো দায়। অধর জোড়া শুকিয়ে এসেছে। মিনমিনিয়ে বললাম,-” পা-পানি! পানি খাবো!”
চোখে পাতা ধীরে ধীরে মেলে চাইতেই অন্ধকারে আবৃত ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। বন্ধ জানালা দিয়ে মৃদু মৃদু আলোর রেখা অন্তর্ভাগে প্রবেশ করছে। শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলো প্রচেষ্টা। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম। আওয়াজ গুলো অধরের কড়ায় এসে চাপা হয়ে থেমে গেল। কিছুতেই চিৎকার করতে পারছি না। হাত পা মুখ বেঁধে মাটিতে ফেলে রেখেছে। আশে পাশে কেউ নেই, একদম ফাঁকা।

দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দে অবলোকন করলাম দরজার দিকে। প্রখর আলোয় দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। দুইজন লোক প্রবেশ করেছে। একজন খাবার রেখে চলে গেলেন। আরেকজন লোক চেয়ার টেনে সামনে বসলেন। মুখের বাঁধন খুলে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে কিছুটা মুখে দিয়ে দিলেন। গ্লাসটা পাশে রেখে বললেন,-” তা কেমন লাগছে এখানে? দুদিন তো জ্ঞান হারিয়ে এখানে পড়ে আছো। চিন্তা করো না, কিছুদিনের মধ্যেই তোমাকে বাকিদের সাথে দূরে পাঠিয়ে দিবো। সেখানে ভালো থাকবে তুমি।”

আঁতকে উঠলাম আমি। সেদিনের কথা মনে করতে লাগলাম। মাঝখানে দুদিন কেটে গেছে। না জানি অপূর্ব ভাইয়া, অরিশ ভাইয়া, আরশি কেমন করছে। নিজেকে সামলে বললাম,
-” কে আপনি? কেন এমন করছেন আমার সাথে? কি দোষ করেছি?”
ফিচেল হাসলেন লোকটি! বিচ্ছিরি দাঁতের হাসি দিয়ে বললেন, -” আমি জলিল! তুই কিছু করোস নি। তোর ভাই অপূর্ব করেছে। তোর ভাই তোর জন্য আমার ভাইকে চির নিদ্রায় শায়িত করেছে। এবার তোকে তিলে তিলে শেষ করে আমার ভাইকে শান্তি দিব!”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৯

-” কে আপনার ভাই?”
-” জালাল! মাস তিন আগে যাকে নদীর ধারে লাশ উদ্ধার করা হয়, সে। তোকে পাচার করে, তোর দেহের ঝাঁঝ কমিয়ে দেব। দেখি তোর ভাই কিছু করতে পারে কি-না? ”
পলক হীন ভাবে চেয়ে রইলাম কিয়ৎক্ষণ। আর কখনো দেখা পাবো না আমার প্রিয় জনদের। তারা জানতেও পারবে না, আমি কোথায়? বেঁচে আছি নাকি চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছি।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩১