অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৯

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৯
ইফা আমহৃদ

রাস্তা দিয়ে সাঁই সাঁই শব্দে গাড়ি অতিক্রম করে চলেছে। ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার ঘরে। যাওয়ার সময় রাস্তার দুই পাশের আম গাছের সাথে সংঘর্ষ হচ্ছে। নিচের দিকের আম গাছের কচি কচি পাতাগুলো ঝড়ে গেছে। উপরে আমের বোলে সাদা হয়ে আছে। বাড়ির ছাদ দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু। ছাদের চিলে কোঠার ঘরটায় বসে আছি আমি। গ্ৰিল বিহীন জানালায় হাত রেখে দূরপানের রাস্তার দিকে চেয়ে আছি।

কারো উপস্থিতি অনুভব করে দুকদম এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে। সবকিছু শান্তশিষ্ট। ঝুনঝুন করে কিছু একটা সমান তালে বেজে চলেছে। এই বাড়িটা কিছু কাল বন্ধ ছিল। তাই মাঝে মাঝেই অদ্ভুত সব আওয়াজ শ্রবণ হয়। জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে নিচের নেমে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামার আগেই মাঝপথে হাত ধরে থামিয়ে দিলো কেউ। দেয়ালের সাথে চেপে ধরলেন আমায়। ভয়ে হাত পা কাঁপতে লাগলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মানুষটি একটু এগিয়ে এলেন। দুজনের মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে নাকের ডগায় নাক ঘসলেন। মোটা কামড় দিয়ে চোখ বেঁধে দিলেন। এতোক্ষণ যতটুকু দৃষ্টিনন্দন হয়েছিলো, এখন সব আঁধারে ঢেকে গেছে। বসে পড়লেন নিচে। আমার পা নিজের হাঁটুতে তুলে নিলেন। নিজের ঠান্ডা হাতের সাহায্যে আমার কোমল পায়ে পড়িয়ে দিলেন কিছু। ঠান্ডা স্পর্শে কেঁপে উঠলাম আমি। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সাথে সাথে সরিয়ে নিলাম।

পেছনে সরে যেতে চাইলে দেয়ালের উপস্থিতি অনুভব করলাম। থেমে গেলাম। হঠাৎ করে কোলে তুলে নিলেন আমায়। নিজের ব্যালেজ বজায় রাখতে গলা পেঁচিয়ে ধরলাম তার। হাঁটা দিলেন সামনের দিকে। নিজের কাঙ্খিত জায়গায় এসে নামিয়ে দিলেন। চোখের বাঁধন খুলে দিলেন। ঝাঁপসা প্রকৃতি পরিস্কার হতে সময় লাগল সেকেন্ড কয়েক। তদানীং ভেসে এলো পরিচিত কন্ঠস্বর,

-” ডিঙিরানী, এই পিচ্চি! সামনে তাকা।”
আমি উপরে তাকাতেই আলোকিত হয়ে গেল সবকিছু। ময়না পাখিটা সমান তালে বলে চলেছে, “উপরে তাকা, উপরে তাকা!”
আমি উপরে তাকাতেই চমকে উঠলাম। আলোয় আলোয় আকাশ আলোকিত। “হ্যাপি বার্থডে তরী!” অদ্ভুত শিহরণে ভরে উঠলো দেহ। অনুভূতিতে পূর্ণ হয়ে চোখ জোড়া গ্ৰথণ হয়ে এলো। চোখের কার্নিস বেড়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু ধারা। জ্ঞানহীন ভাবে আওড়ালাম,

-” আমি স্বপ্ন দেখছি! হ্যাঁ! আমি স্বপ্ন দেখছি! সুখের স্বপ্ন!”
-” না পিচ্চি! তুই স্বপ্ন দেখছিস না, এটা বাস্তব।”
অরিশ ভাইয়ার কন্ঠস্বর নকল করে ময়না পাখিটা বলে,-” না পিচ্চি, বাস্তব!”
অপূর্ব ভাইয়া আর আরশি বেরিয়ে এলেন দূর থেকে। মাথায় চপল মারলেন আমার। বললেন,

-” শুভ জন্মদিন খুকি! কাঁদছিস কেন? আমরা তোর হাসি মুখটা দেখার জন্য এতো আয়োজন করেছি।”
মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম আমি। অরিশ ভাইয়া ফোন করলেন কাউকে। সাথে সাথে রিসিভ হলো। ফোনটা স্পিকারে দিয়ে আমাকে ইঙ্গিত করে বললেন,-” বাবা, কথা বলবে। ফোন ধর।”

ফোনটা হাতে নেওয়ার পূর্বেই মামা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালেন। চুপ করে রইলাম আমি। কিয়ৎক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। একদম ছাদের শেষ প্রান্তে। যে পাশটায় রেলিং নেই। একপা ছাদের কর্ণারে রেখে বললাম,

-” ভাইয়া! কোথায় তুমি? তোমার খুকির জন্মদিন আজ, তাকে শুভেচ্ছা জানাবে না। না-কি ভুলে গেছো? আ’ম স্যরি! আমার আগমনে তোমাকে সবার থেকে আলাদা হতে হয়েছে। মা বাবা সবাইকে ছেড়ে দূরে যেতে হয়েছে। আমি তোমার অপরাধী।”

শরীরের ভার হ্রাস পেতে লাগলো ধীরে ধীরে। গুটিয়ে পড়লাম নিচে। দুহাতে মুখ গুঁজে কেঁদে উঠলাম। পেছন থেকে এগিয়ে এলো কেউ। আঁধারে তার ছায়া দেখতে পেলাম। আমাকে ছুঁতে গিয়েও ছুঁলো না। হাওয়ার বেগে সরে গেল। কাঁধ গুড়িয়ে সেই মানুষটিকে দেখার মতো শক্তিটুকু অবশিষ্ট ছিলো না আমার। আমার নিজের অপরাধ খুঁজতেই তখন ব্যস্ত ছিলাম।

অন্ধকারে আবৃত ঘরের মাঝে সিগারেট খাচ্ছে একটি ছেলে। অন্যহাতে ডিঙ্কের গ্লাস। গন্ধে ঘরে পা দেওয়া মুশকিল। গুপ্তচর ছেলেটি নক না করেই প্রবেশ করলো। মাথা নত করে উচ্ছাসের স্বরে বলল,
-” বস, সেই মেয়েটির খবর পাইছি।”
বস নামক লোকটি গুপ্তচর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে,-” কি পাইছোস?”

-” এতো দিন আমরা যেই মেয়েটিকে খুঁজছিলাম। তার নাম তরী। অপূর্বের পাতানো বোন। গত দুই মাস ধরে অপূর্বের বাড়িতে থাকছে। মেয়েটিকে সেফ রাখার জন্য, বাড়িতে কোনো কাজের লোক রাখে নি। অপূর্ব নিজেই মেয়েটির জন্য রান্না করছে।”

কথাগুলো শ্রবণপথে যেতেই উঠে দাঁড়ালো সে। কয়েকমাস পূর্বে হসপিটালের মেডিসিন আনার সময় আরশি আর তরী যে ছেলেদের মুখোমুখি হয়। তাদের অপূর্ব খুন করেছিলো পহেলা জানুয়ারি। নদীর তীর থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। তবে, কেউ চিহ্নিত করতে পারে নি, কে এমন নির্মম ভাবে হত্যা করেছিলো। তবে মেন ছেলেটির ভাই, অপূর্বকে সন্দেহ করেছে।
নাক কুঁচকে এক ঢোকে গ্লাস ফাঁকা করে বলে,

-” ফাইনালি..! পাওয়া গেল তাকে। আর কি জানতে পারলি?”
-” বস, আজ মেয়েটির জন্মদিন। অপূর্ব তার পাতানো বোনকে নিয়ে কাল সকাল সকাল বৃদ্ধ আশ্রমে যাবে।”
খুন হওয়ার লোকটির ভাই এগিয়ে এসে গুপ্তচর ছেলেটির শার্টের কলার টেনে বলে,-” অপূর্ব! অপূর্ব খবর দিয়েছিস। ঐ তরী না পরী, ওকে আমি নিজের হাতে খুন করে অপূর্বকে উপহার পাঠাবো।
আমি তো খুশি হয়ে গেলাম!”

-” এবার তাহলে আমাকে খুশি করে দিন।”
লোকটি দুই হাত মিলিয়ে আওয়াজ তৈরি করলো। তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ ঘটলো। এসে মাথা নত করে। লোকটি হেঁসে বলল,-” ওকে একটা মেয়ে দিয়ে দাও। যত টাকা লাগে দিয়ে দিও আর কালকের জন্য প্রস্তুতি নিও।”
তৃতীয় ব্যক্তিটি বলে,-” বস, কালকে আমাদের ১০০ টা মেয়ে পাচারের কথা। মাত্র ৯৫ টা আছে। এখন এই ছোকড়াকে ১ মেয়ে দিলে ..

গুপ্তচর ছেলেটি বলে উঠে, -” বস, আপনি চাইলে তরীকে পাচার করে দিতে পারি। সে দেখতে পরীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। একাই ১০ টা মেয়ের দাম তুলে দিতে পারবে। মেয়েটাকে পাচার করে দিলে, অপূর্বও জ্বলবে, তরীকেও নরক যন্ত্রনা সহ্য করতে হবে। আমাদের প্রতিশোধও নেওয়া হবে।”
গুপ্তচরের কথায় কিয়ৎক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে রইলো। অতঃপর বললেন,-” তবে, তাই হোক!”

রোদ্দুর ছড়ানো শান্ত পরিবেশ। বৈশাখ মাসের পাঁচ তারিখ হলেও তেমন প্রতাপ নেই। আজ আমার জন্মদিন, তাই হয়তো প্রকৃতি আমার সহায়ক। আমরা এসেছি আশ্রমের সামনে। গাড়ি থামতেই অপূর্ব ভাইয়া নেমে গেলেন। কাল রাত থেকে আমার সাথে একটি কথাও উচ্চারণ করেনি তিনি।

একে একে সবাই নেমে দাঁড়ালাম। অপূর্ব ভাইয়া আশে পাশে না চেয়ে আরশির হাত ধরলেন। গার্ডদের ইশারায় কিছু বললো। আরশি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। অপূর্ব আর দৃঢ় করে চেপে ধরলো। রাস্তার এপাশ ওপাশ চেয়ে একবার আরশির দিকে চাইলো। বলে,

-” সাপের মতো মুচরা মুচরি না করে, চুপ করে হাঁটো।”
আরশি দাঁতে দাঁত চেপে মৃদু শব্দে বলে,-” হাত ছাড়ুন আমার।”
-” ছাড়িয়ে নাও।”
আরশি অপূর্বের থেকে হাত ছাড়ানোর প্রচেষ্টা করলো। ব্যর্থ হয়ে দম মেরে রইলো। অপূর্ব আড়চোখে চাইলো। ফিচেল হেঁসে বলল,-” বাঁদরের বাঁদরামি শেষ?”
-” আমি বাঁদর?”

অপূর্ব রাস্তার অন্যপাশে এসে আরশির হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
-” কি সন্দেহ আছে, নাও আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে নাও নিজেকে।”

আরশি অপূর্বের চোখের দিকে চাইলো। অপূর্ব তখন নির্বিকার দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আরশির মুখশ্রীর দিকে। অপূর্বের চোখের নেশালো ভাবটা আরশিকে দৃষ্টি সরাতে দিচ্ছে না। তবুও নিজের সাথে যুদ্ধ করে দৃষ্টি ফেরালো। অপূর্ব পুনরায় হাসলো। ভ্রু উপরে অবস্থান করলো। বামগালে গর্তের সৃষ্টি হলো। তবে টোল নয়।
অপূর্ব আরশির সাদা ঝুলন্ত ওরনাটা টেনে আরশির মাথায় তুলে দিলো। টানা টানা কাজল বিহীন চোখের কোণে কুড়ে আঙুল দিয়ে ঘসলো কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর বলে,

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৮

-” তুই নিজেই তো আরশি! আয়না! সে ভাঙা আয়না হোক বা ভালো। দুটোতেই নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।”
আরো কিছুটা বলতে চাইলো অপূর্ব, কিন্তু বলা হলো না। মাথার চুলগুলো ঠিক করতে করতে অন্তর্ভাগে প্রবেশ করলে। আরশি নীরব বচ্ছিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অপূর্বের গমন করা পথের দিকে। সে তাকে অপমান করে গেল না-কি প্রশংসা! তার হিসেব মেলাতে মেলাতে হাঁটা ধরলো সে।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ৩০