অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৮

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৮
ইফা আমহৃদ

কোমড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া লম্বা লম্বা কেশ সমূহতে টান পড়ছে। টেনে টেনে তেল দিয়ে দিচ্ছে অপূর্ব ভাইয়া। আজ দুই মাস পূর্ণ হয়েছে, এই বাড়িতে এসেছি। আরশির সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়, ভার্সিটিতে। এখন আর নিয়মিত ভার্সিটিতে যেতে দেয় না অপূর্ব ভাইয়া। সব নোট গুলো অরিশ ভাইয়া পাঠিয়ে দেয়। সপ্তাহে দুইবার তার ক্লাস। তখনই একটু চোখের দেখা দেখতাম। এই বাড়িতে আসে নি। আমাদের বিয়েটা হয়তো তিনি ভুলে গেছেন। ভুলে গেছেন, আমাদের সব স্মৃতি। কিন্তু আজোও চোখের পাতা গ্ৰথণ করলে সেই দিনগুলোর ছবি ভেসে উঠে।

আমার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে মাথার দুপাশে দুটো বেণুণী করে কাঁধে ঝুলিয়ে দিল। পেছন থেকে দুগাল টেনে বলল,
-” একদম খুকি, খুকি লাগছে তোকে!”
সামান্য কাঁধ ঘুড়িয়ে বললাম-” তাই বুঝি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” হম।” বলে উঠে গেলেন তিনি। সূর্য ডুবে আঁধারে ডুবে গেছে শহর। সময় ছয়টা পঁয়তাল্লিশ। কৃত্রিম আলোয় পাখিদের গন্তব্যে ফিরতে দেখা যাচ্ছে। আমি উঠে বসলাম। ভাইয়া বিকেলে ঘুমিয়ে ছিলেন। আমি বেড গুছিয়ে ফ্লোর পরিষ্কার করলে নিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়ালাম একটু। আজ অরিশ ভাইয়া থাকলে আমার গাল টিপে দিয়ে বেণুণী টেনে ধরতেন। আদুরে মাখা গলায় বলতেন,

-” এই তরী রানী! তুই তো পিচ্চি, একদম পিচ্চি! তুই রাজকুমারী, এতো ছোট মেয়ে কিছুতেই রানী হতে পারে না। আমার ভাবতেই অবাক লাগছে, এই পিচ্চি বউটা আমার।”
আমি তখন লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠতাম। তিনি আমার চিবুক ঈষৎ উঁচুতে তুলে বলতেন,-” হয়েছে, হয়েছে পাগলী। তোকে আর লজ্জা পেতে হবে না‌। আমার কাছে কিসের লজ্জা।”

কথা গুলো ভাবতে ভাবতে আয়নাকে ভাইয়া হিসেবে গ্ৰহণ করলাম। যখন বুঝতে পারলাম, এটা আমার ভ্রান্ত ধারণা। তখন ফিচেল হাসলাম। বেজে উঠলো ফোন। কর্ণপথে এলো মৃদু শব্দ। হাসিটা তৃপ্তিকর হয়ে উঠলো। দৌড়ে ছুটলাম কক্ষে। কিছুটা দূরত্বের পথ, কয়েক বছরের পথের মতো লাগল। কাবার্ডের উপরে থেকে ফোনটা তুলতেই দৃষ্টিনন্দন হলো। হাঁসিটা মিলিয়ে গেল। চোখ বুজতেই চোখের কার্নিস বেড়ে গড়িয়ে পড়লো জলধারা। ২৪০০! ফোনটা টেবিলের উপর রেখে বসে পড়লাম বেডে। প্রবেশ ঘটলো কারো। মাথা তুলে চাইবার আগে চোখ মুছে নিলাম। পায়ের দিকে চেয়ে বুঝলাম, অপূর্ব ভাইয়া এসেছে। বসলেন আমার পাশে। মাথায় হাত রেখে বললেন

-” ওদের খুব মিস্ করছিস। তাই না?”
বলেই আমার ফোনটা তুলে অরিশ ভাইয়াকে ফোন করলেন। রিসিভ করলেন না। তাই নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে ডায়াল করলেন। প্রথমবার ফোন বাজতেই রিসিভ করলেন তিনি। ঝাঁঝালো স্বরে বললেন,

-” কি-রে কই তোরা? একবারও তো তোর তরীকে দেখতে এলি না। মেয়েটার মন খারাপ হয় না বুঝি!”
দম মেরে ফোন কেটে দিলেন অপূর্ব ভাইয়া। অধর ছুয়ে দিলেন মাথায়। বুকে টেনে বললেন,
-” অরিশ তোকে আমার কাছে রাখতে বলেছে, জেলখানায় নয়। যখন ইচ্ছে হবে, আমাকে বলবি।”
আরশির সাথেও কথা হয় না, তিনি অপূর্ব ভাইয়ার জন্য দেখা করতে আসেনা। চট করে ভাইয়ার হাত থেকে ফোন নিয়ে আরশির নাম্বারে ডায়াল করলাম।কিয়ৎক্ষণ খুঁজেও তার কন্টাক্ট নাম্বার পেলাম না। অপূর্ব ভাইয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,

-” ভাইয়ার আরশি নাম্বার টা পাচ্ছি না।”
-” সার্চ করে দেখ, জান্ডুবাম দিয়ে সেভ করা।”
কদাচিৎ ফাক হয়ে এলো ওষ্ঠ যুগল। ধীরে ধীরে শুধালাম,-” জান্ডুবাম!
-” হ্যাঁ! আগে সারাক্ষন ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করতো। দিন নেই, রাত নেই। আমার কল লিস্টে শুধু ওর নাম্বার।”
-” আর এখন? এখন ফোন করে না।”
অপূর্ব ভাইয়া একবার আমার পানে চেয়ে থেকে চোখ সরালেন। অপরাধীর ন্যায়। টু শব্দটি উচ্চারণ না করে ক্লান্ত ভারী পা জোড়া টেনে নিয়ে গেলেন। পুরোনো দাগে আবার আঘাত লেগেছে তার। আজ সে চায়, আরশি তাকে ফোন করুক। কিন্তু করে না।

রুমের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পায়চারী করছি। অরিশ ভাইয়া আর আরশি এলো বলে। মন খারাপ নিয়ে বসে আছি। আজ অরিশ ভাইয়া এলে বেশ করে বকে দিবো। কি হতো, যদি আমার সাথে দেখা করতো। সেদিন বেশ তো বলেছিলো, আমি তার রাজ্যের রানী। তার পুচকির মা! কোথায় সেই মা।
বেলকেনির পাল থেকে ভেসে এলো অপরিচিত কন্ঠস্বরে,
-” ডিঙিরানী, এই পিচ্চি! রেগে আছিস?”
প্রথম সেই পরিচিত কষ্ঠস্বর পেয়ে থমকে গেলাম আমি! চুপ করে রইলাম! কিন্তু সামনে এলেন না। পুনরায় সেই একই সুরে বললেন,

-” ডিঙিরানী, এই পিচ্চি! রেগে আছিস?”
-” ডিঙিরানী, এই পিচ্চি! রেগে আছিস?”
-” ডিঙিরানী, এই পিচ্চি! রেগে আছিস?”

তিনবার একই কথা উচ্চারিত হতেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম আমি। এদিক ওদিক চাইলাম। কিন্তু অরিশ ভাইয়ার উপস্থিতি অনুভব করলাম না। তার শরীরের সেই মাতাল করা সুবাস আমি অনুভব করছি না। তাহলে কি, ভুলে গেছি আমি তাকে?
আওয়াজের উৎস খুঁজতে ছুটে গেলাম বেলকেনিতে। অন্ধকারে সবকিছু স্পষ্ট না দেখা গেলেও কারো উপস্থিতি নেই। আমি গ্ৰিলবিহীন বেলকেনি দিয়ে বাইরে এদিকে ওদিক চাইলাম। দেখা মিললো না কারো। ভাঙা মন নিয়ে ছুটে এলাম রুমে। বেডের উপরে একটা ময়না পাখি বসে আছে। পা আর ঠোট দুটি হলদে রঙের। ছাই রাঙা পাখিটা। পাখিটা পেছনে ফিরে লেজ নাড়িয়ে আবার উচ্চারণ করলো,

-” ডিঙিরানী, এই পিচ্চি! রেগে আছিস?”
এবার বোধগম্য হলো, এই ময়না পাখিটাই আমাকে এতোক্ষণ ধরে ডাকছে। কিয়ৎক্ষণ দম মেরে বসে থেকে পাখিটাকে দুইহাতে আঁকড়ে ধরলাম। অবিকল অরিশ ভাইয়ার কন্ঠস্বর। ময়না পাখি কথা বলতে পারে, কিন্তু অবিকল একটা মানুষের কথা নকল করতে পারে, জানা ছিলো না।
পাখিটার ডানার সাদা অংশটায় হাত দিয়ে দেখতে দেখতে বললাম,

-” আমি যে ডিঙিরানী, তুই জানলি কেমনে?”
পাখিটা পূর্বের ন্যায় লেজ নাড়িয়ে বলে,
-” ডিঙিরানী, এই পিচ্চি! রেগে আছিস?”
একটা জিনিস খেয়াল করলাম, একটা কথাই জানে

-” ডিঙিরানী, এই পিচ্চি! রেগে আছিস?” এই কথাটা যতোবার বলবে ততবার লেজ নাড়াবে। পাখিটা নিয়ে বেরিয়ে আসার উদ্বেগ হতেই পশ্চাৎ থেকে পেঁচিয়ে ধরলো কেন। পড়ে গেল হাত থেকে। পাখিটা উড়ে গেল জানালার গ্ৰিলে। ছোট ছোট চোখ দুটি দিয়ে চাইছে। আমি সেই পাখিটির পানেই চেয়ে আছি। এবার পোষা পাখিটির গৃহস্থ বললেন,
-” ডিঙিরানী, মুখ ভার করে আছে! সে কি আমায় ভুলে গেছে?”

মানুষটিকে দর্শন করা তৃষ্ণা থাকলেও ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালালাম। কিন্তু সফল হতে পারলাম না। ময়না পাখিটি অরিশ ভাইয়ার কষ্ঠস্বর ধীরে ধীরে আওড়ালো,
-” ডিঙিরানীর মুখ ভার! ডিঙিরানীর মুখ ভার!”
ফিক করে হেসে দিলাম আমি। নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলেন আমায়। দুহাত রেখে বলল,
-” তাহলে রাগ ভাঙল।”

তাকে আর উচ্চারণ করতে না দিয়ে সরিয়ে দিলাম আমি। ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিলাম। পুনরায় নিজের কাছে টেনে নিলাম আমায়। দৃঢ় বাঁধনে আবদ্ধ করলো। সরে যেতে ব্যর্থ হয়ে অশ্রু মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,
-” কেন? কেন রাগ ভাঙবে আমার? কেন ভাঙবে শুনি? আমি তো এখন আর কারো পিচ্চি হইনা! যদি পিচ্চি হতাম, তাহলে আমার কথা সবার মনে পড়ত।”

মাথায় চুলে হাত ডুবিয়ে বললেন,-” আমার মনে পড়েনি! কারণ তুই সবসময় আমার মনে ছিলি। আমি এলে আর যেতে পারতাম না। কষ্ট তুইও পেতি আর আমিও। পাখির সাথে কথা বলে, আমাকে মনে রাখবি।”
-” ভাইয়া, ত..

মাথা নাড়িয়ে আয় দিতেই আরশি প্রবেশ করলো। আমাদের দিকে এক নজর অবলোকন করে অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। চোখে হাতে দিয়ে অধর কামড়ে বলে,-” এভাবে দরজা খুলে কেউ ওপেনলি করে, এই দরজা বন্ধ করে নিবি তো!”
-” কে করছিলাম আমরা, যাবি এখান থেকে? নাহলে চড়িয়ে তোর গাল লাল করে দিবো!”
-” আমরা বললেই দোষ।”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৭

অপূর্ব ভাইয়া পশ্চায় থেকে এসে অরিশ ভাইয়াকে চোখ মারলেন। লজ্জায় কাতর হলাম আমি। অধর দিয়ে জিভ ভিজিয়ে আশেপাশে না চেয়ে ছুটলাম। শেষে কি-না সবার সামনে! ছিঃ! ছিঃ! কি লজ্জা!

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৯