অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৭

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৭
ইফা আমহৃদ

ভোরের আভা চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি করার পূর্বেই বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়েছি আমরা। বৃদ্ধ লোকটি আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন হলেও দায়িত্বে কোনো রুপ ত্রুটি রাখে নি। ভোর ভোর আমাদের জন্য গাড়ি ভাড়া করে এনেছে। দেরী না করে আমরা বেড়িয়ে পড়েছি। সকাল সকাল ফোন করে জানতে পেরেছি, টুর শেষ করে ফিরে গেছে সকলে। তাই থানচি শহর হয়ে বাসে চড়ে নিজেদের শহরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ব। যেই ভাবা সেই কাজ।
ভাইয়ার হাত জড়িয়ে বাহুতে মাথা দিয়ে আছি। তখন তিনি নির্বিকার ভাবে বলে উঠে,

-” আমার পিচ্চিটা এখন আর পিচ্চি নেই। কাল রাতে থেকে আমার রাজ্যের রানী হয়ে উঠেছে। কিছুদিন পর আমার পিচ্চির মা হয়ে উঠবে। তবে আফসোস বাসর টা এখন করা হয়নি। চিন্তা করিস না, ধুমধাম করে তোরে নতুন ভাবে নতুন রুপ আবার বিয়ে করব। বাসর না করাতে তুই কি রাগ করেছিস, তরী?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বলেই ভ্রু নাচালেন তিনি। আমাকে লজ্জায় ফেলতে তিনি এমন কথা বলেছেন, তার কোনো দ্বিমত নেই। আমিও লজ্জা পেয়েছি, তবে লজ্জা না পাওয়ার ভঙ্গিমা দেখালাম। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। আমাদের এই সম্পর্কে আদোও কি কোনো ভিত্তি আছে মামুনির কাছে? তবুও আমি চাই, তিনি মেনে নিক আমায়‌।
তবে লুকাতে পারলাম বলে, মনে হলো না। আমার চিবুক ধরে আলতো উপরে তুলে বললেন,

-” হয়েছে, আর লজ্জা পেতে হবে না। তুই জানিস না, লজ্জা পেলে তোর গাল দুটো গাল থাকে না। একদম বেদানার দানার মতো টুকটুকে লাল হয়ে যায়। ইচ্ছে করে, টুস টুস করে চিবিয়ে খেয়ে..
আর কিছু উচ্চারণ করতে পারলেন না তিনি। আঙুল ছুঁইয়ে দিলাম তার অধরের উপরে। কিয়ৎক্ষণ নির্বাক চেয়ে থেকে হুট করেই হাত টেনে উল্টো পিঠ অধর ছুয়ে দিলেন।

তার কাঁটা কাঁটা কথার মাঝে আমরা এসে পৌঁছালাম থানচি। সেখানে আগে থেকেই আরশি আর অপূর্ব আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম, অপূর্বের ব্যবহারে।
আমাদের এগিয়ে আসতে দেখেই অপূর্ব ভাইয়া নিজের মধ্যে মুড়িয়ে নিয়েছিল আমায়। একদম ছোট্ট বাচ্চাদের ন্যায়। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন আমায়। চোখের কোণের অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়েছিল আমার চোখে। তবু তার ঠোঁটের কোণে ছিলো, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুগ্ধ করা হাসি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শুধালো,

-” খুকি, তোর কিছু হয় নি তো!”
হুট করে তিনি আমাকে ছেড়ে দাঁড়াতেই আরশি এসে ধরলো আমায়। জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে আওড়ালো,
-” কতোটা ভয় পেয়েছি, তোরে বলে বুঝাতে পারব না। ভাইয়া আর তুই স্ব শরীরে ফিরে এসেছিস, আমার আর কিছু চাই না!”

-” মানে কি আরশি, আমরা ফিরে এসেছি। তুই কি খুশি হয়নি?”
মাথা নাড়িয়ে মৃদু শব্দে হ্যাঁ বললো সে। আমি গড়িয়ে পড়া পানিটুকু মুছে দিলাম। নাক ধরে টেনে বললাম,
-” পাগলি, তাহলে কেন কাদছিস?”
অতঃপর আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত সাতটা বেজে গেল। বাড়িতে ফিরতেই সম্মুখীন হতে হলো মামুনির।

সকলের সামনে পরপর কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলেন গালে। গালে হাত দিয়ে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। তীক্ষ্ম দৃষ্টি আকর্ষণ করে রইলেন তিনি। নিজের ভেতরের ক্ষোভ সংযত করতে ব্যর্থ হয়ে চুল চেপে ধরলেন আমার। আমাদের পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা হয়তো ভার্সিটির কেউ জানিয়েছে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,

-” তোর মতো অপয়া, অলক্ষী মেয়েকে আমি যেতে বারণ করেছিলাম। কিন্তু আমার কথা শুনলি না। মরতে গেছি, সেই পাহাড়ে। তোর মরার শখ হয়েছে, মরতে গেছিস। আমার অরিকে কেন মারতে নিয়ে গেছিলি। তোকে তো আমি..
শক্ত লোপ পেল আমায়। চুলে ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। আরশি মামুনিকে থামানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে। অরিশ ভাইয়া অপূর্ব ভাইয়াকে বিদায় দিয়ে আসবে।

ততক্ষণে চলে এলেন তিনি। মামুনির থেকে ছাড়িয়ে নিলেন আমায়। আমি পেছনে থেকে ভাইয়ার শার্ট আঁকড়ে ধরে গুটিয়ে রইলাম। ভাইয়া মামুনির ব্যবহারে অধ্যর্য হয়ে উঠলেন,
-” মা, থামবে তুমি? এমন করছো কেন?”
-” যতদিন পর্যন্ত এই অপয়া অলক্ষী মেয়েটা আমার বাড়ি থাকবে, ততদিন আমি শান্ত হবো না। বাড়িতে শান্তি আসবে না। বুঝেছিস তুই?”

মামুনির একরোখা জবারে অরিশ ভাইয়া নীরবে সবকিছু সহ্য করার চেষ্টা করলো। কিয়ৎক্ষণ দম মেরে বসে থাকার পরে ফোন বের করে কাউকে একটা ফোন করলেন। বললেন,
-” কোথায় তুই অপু? ৫ মিনিটের মধ্যে বাড়ির সামনে আয়!”

ভাইয়ার কথার ধরন শুনে বুঝতে সক্ষম হলাম, এটা অপূর্ব ভাইয়া। স্পিকারে না থাকার কারণে ওপাশে মানুষটির প্রত্যুত্তর কি ছিলো, জানা হয়নি। অরিশ ভাইয়া এবার ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,
-” তুই যদি এখন না আসতে পারিস, বলে দে! আমি তোর বোনকে নিয়ে বহুদূরে চলে যাচ্ছি। তুই চাইলেও খুঁজে পাবি না।”

বলেই ফোন রেখে দিল। শীতলতার মাঝেও তার ললাটে লবনাক্ত জলকণা। উপরের অধর চেপে চোখ গ্ৰথণ করে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছেন‌। ফুঁ দিয়ে নিজের চুলগুলো উড়িয়ে দিলেন। আমাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে শব্দ করে উপরে চলে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পেরুবার আগেই ফিরে এলেন তিনি। দুহাতে দুটো লাকেজ। রাখলেন আমার সামনে।
অপূর্ব ভাইয়া প্রবেশ করেই বিচলিত হয়ে পড়লেন। ভাঙা স্বরে হাহাকার করে বললেন,-” কি হয়েছে অরি? কোনো সমস্যা হয়েছে? এভাবে ডাকলি কেন?”

অরিশ ভাইয়া টু শব্দটি করলেন না। হাতের তর্জনী আঙুল তুলে আমার দিকে ইশারা করলেন। মিনিট খানেক চেয়ে করলেন আমার দিকে। আমার এলোমেলো চুল, ফোলা ফোলা চোখ মুখ, আর্তনাদ। তিনি ছুটে এলেন আমার সম্মুখে। স্বযত্নে চোখ মুছিয়ে দিলে বললেন,

-” কি হয়েছে তোর? বল আমাকে?”
আমার কান্নার স্বর আড়ষ্ট হয়ে এলো। জড়িয়ে গেল গলা। হেঁচকি উঠে গেল। শব্দ উচ্চারণ করতে কষ্ট পেতে হচ্ছে। তিনি স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
-” যা! রাস্তায় গাড়ি রাখা আছে, ওখানে গিয়ে বস।”
অরিশ ভাইয়ার মুখশ্রীর দিকে অবলোকন করতে তিনিও সায় দিলেন। দ্বিমত পোষণ না করে ছোট ছোট চরণ দুটি ফেলে বেরিয়ে এলাম।

অপূর্ব তরীকে দরজার আড়াল হয়ে যেতে দেখে অনিতার দিকে ভয়ঙ্কর চাওনি দিলো। অনিমা অপূর্বের এই দৃষ্টি সাথে বেশ অপরিচিত। আগে সে ছিলো তারুণ্য, এখন অপূর্ব।
দাঁতের সাথে দাঁতের অদ্ভুত ঘর্ষণ সৃষ্টি করল। তার চোখ দুটি আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় ফুটছে। চোখ দুটি স্বাভাবিক তবুও তাকে ভয়ঙ্কর লাগছে। টেনে টেনে বললেন,

-” তুমি আমার মামুনি! মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের মতো করে মানুষ করেছ। তোমার কাছ থেকে ভালোবাসা আশা করা যায়, অত্যাচার নয়। আমার, আমার মায়ের দেওয়া আমানত তোমার কাছে রেখে গেছিলাম। কিন্তু তুমি যত্নে রাখতে পারলে না। তাই সাথে নিয়ে গেলাম। ভবিষ্যতে যাতে আর তোমাকে আমার বোনের আশে পাশে না দেখি। (অরিশের কাঁধে হাত রেখে)

তোর ইচ্ছে হলে দেখে আসিস। আসছি! পাগলিটা হয়তো কাঁদছে।”
বলেই লাকেজগুলো দুইহাতে নিয়ে নিল। কর্ণার তাকে রাখা সো পিচটা মাটিতে ফেলে দিল। দুই টুকরো হয়ে গেল। অপূর্ব প্রস্থান করলো। একটা তার মামুনির। নিজের পছন্দের জিনিস গুলো ভেঙে গেলে কতোটা কষ্ট হয় বুঝাতে চাইলো।

লাকেজ গুলো সে চাইলে ফেলে দিতে পারত, কিন্তু এগুলো তার বোনের পছন্দের। তাই সাথে করে নিয়ে গেল।
অরিশ শব্দ হীন উপরে চলে গেল। আরশি নিজের জিনিস পত্র নিয়ে প্রস্থান করলো। অনিমা সোফায় বসে পড়লেন। পিচ্ছিল ফ্লোর গড়িয়ে গড়িয়ে তার পায়ের কাছে এসে থামলো সো-পিচ টা। এক খন্ড হাতে তুলে নির্বাক হয়ে রইলেন। খুব পছন্দের। অপূর্ব তারুণ্য হলেও, সে অপূর্ব। কতো কতো মানুষকে খুন করেছে তার হিসেব নেই।

অপূর্বের বাড়িতে এসে পৌঁছেছি আমরা। পুরো রাস্তা আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছে কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। মাঝে মাঝেই ভেবে অবাক হয়ে যাই, এতো বড় একটা গ্যাং স্টার আমার জন্য সবকিছু করতে পারে। কিন্তু কেন?
আমাকে ফাঁকা একটা ঘরে বসে আছি। অপূর্ব ভাইয়া নিচে গেছে। রুমটা একদম পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।

ব্লু এন্ড ওয়ার্ট কালারের দেয়ার। জানালায় বিশাল বিশাল ধবধবে সাদা রঙের পর্দা টানা। ছোট বাচ্চাদের খেলনায় সাজানো। বেডের পাশ ঘেঁষে দুটো ফুলদানি। সাদা এবং লাল টুকটুকে দুটো গোলাপ। আমি যখন কক্ষ দেখতে ব্যস্ত তদানীং প্রবেশ ঘটলো কারো। পেছন ফিরে দেখলাম অপূর্ব ভাইয়া। হাতে তার খাবারের ট্রে। ট্রে টা সেন্টার টেবিলের উপর রাখলেন। আমাকে টেনে বসিয়ে দিলেন বেডে। ইলিশ মাছ আর আলু কুচি ফ্রাই। আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই খাবার মেখে খাইয়ে দিলেন আমায়। শেষ লোকমা মুখে দিয়ে বললেন,

-” কেমন লেগেছে খুকি? পছন্দ হয়েছে এই ঘরটা?”
-” জ্বি খুব ভালো! এই ঘরটা একদম আমার মনের মতো, আর খাবারটাও টেস্টি!
-” তাই বুঝি!”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৬

নাক টেনে বললেন তিনি। আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেই রুমের আলো নিভিয়ে দিলেন তিনি। হাতে দুটো ট্যাবলেট আর পানি খেতে দিল। বালিশ ঠিক করে বেডের উপর শুইয়ে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
নিরবতার মাঝে সময় পেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমি হারিয়ে গেলাম নিদ্রার অতলে।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৮