অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৬

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৬
ইফা আমহৃদ

তাপমাত্রা কমে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গভীর রাতের দিকে তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দূর থেকে অস্ফুট ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। অন্ধকারে ফোনের টর্চের আলোয় মৃদু দেখা যাচ্ছে। তার মাঝে আরশি এদিক ওদিক নড়াচড়া করে চলেছে। অপূর্ব বিরাগী হয়ে একবার আরশির মুখপানে চায়, পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হচ্ছে। আরশির সিল্কের ওরনাটা ঘাসের উপর বিছিয়ে দিল।

টান টান করে কুঁচকানো জায়গা গুলো ঠিক করে নিল। পরপর কয়েকটা ওরনা গিট দিয়ে চারপাশের চারটে গাছ পেঁচিয়ে বেড়ার ন্যায় করলো। উপরে শূন্য মেঘহীন অন্তরিক্ষ। একটু আগে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে, তবে পাহাড়ের অন্য প্রান্তে। এখানে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। কাঁধ থেকে ব্যাগটা বের করে ওরনার উপরে রাখল। আরশির দিকে না চেয়ে ইশারায় বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” এখানে শুয়ে শাল জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়।”
আরশি চুপ করে ওরনার উপরে গিয়ে বসল। নিচের দিকে চেয়ে বলল,
-” অনেকটাই জায়গা আছে, অন্য কেউ চাইলে শুতে পারে।”
অপূর্ব ফোন রেখে আড়চোখে আরশির দিকে অবলোকন করলো। বুঝতে অসুবিধে হলো না, এখনো রেগে আছে। এখন অবধি টু শব্দটি করে নি। ধপ করে বসে পড়লো ঘাসের উপরে। বেড়া দেওয়া ঘাসের উপরে বসে বলল,-” প্রয়োজন নেই।”

-“ডং!” মৃদু শব্দে বলে উঠলো সে। অপূর্বের শ্রবণ গোচর হলো সেই শব্দ। বেশ মিষ্টি ঠেকলো তার নিকট। আরশি ব্যাগের উপরে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। অপূর্ব ফোন রেখে বসে রইল। চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। বোনকে না পাওয়া অবধি তার ঘুম অনিশ্চিত। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে অর্ধ খাওয়া সিগারেট টা আবার ধরালো। খক খক করে কেশে উঠলো আরশি। সাথে সাথে নিভিয়ে দিলো। মাটির সাথে পিষে জলন্ত আগুন নিভিয়ে ফেললো।
আরশি অপূর্বকে পিঠ দেখিয়ে শুয়ে আছে। না ফিরে পশ্চাৎ থেকে বলে,

-” ভাইয়া আর তরী কখন আসবে?”
অপূর্ব জবার দিলো না। আরশি আরো একবার একই প্রশ্ন করল। এবারও জবার মিললো না। অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে চাইলো। জায়গাটা ফাঁকা। উঠে বসলো সে। আশে পাশে গভীর ভাবে অপূর্বকে খুঁজতে লাগলো, কিন্তু পেল না। কাতর হয়ে হাঁটা ধরলো। চারপাশ আরশির কাছে ভয়ংকর হয়ে উঠলো। সবকিছু ফেলে রেখে অগ্ৰসর হলো সামনের দিকে।

অপূর্ব তদানীং শুকনো খড় পাতা, ডাল খুঁজতে গিয়েছিল। রাত গভীর হওয়ার সাথে শীতলতা বাড়তে লাগছিলো। তাপ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেরিয়েছে সে। দুহাতে আষ্ঠে পিষ্ঠে মুড়িয়ে নিয়ে এলো ডাল পালা। আরশি ঝড়ের গতিতে এসে ধাক্কা খেল অপূর্বের বুকে। অপূর্বের এতোক্ষণ কুড়িয়ে কুড়িয়ে আনা খড় কুটো গুলো নিচে পড়ে গেল। অপূর্ব চমকে উঠলো। আবার সেই মাতাল করা নিদ্রা কেড়ে নেওয়া গন্ধ। কম্পিত হলো দেহ। সেই হরিণী নয়ন জোড়া দিয়ে চাইলো একবার। আজ তার চোখে ভীতি। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল বাঁকা চাঁদের ফালি। যেন এতোক্ষণ তার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়লো বুকে। তোতলাতে তোতলাতে বলে,

-” কোথায় গিয়েছিলে তুমি? আমার ভয় করছিলো।”
অপূর্ব তার কাঁপা কাঁপা হাতটা আরশির মাথায় ঠেকালো। আশ্বাসের স্বরে বলল,
-” কি হয়েছে আরু? ভয় নেই, এই তো আমি। চোখ মেলে ভয়কে জয় করো।”
আরশি একবার ভালো করে চেয়ে দূরত্বকে প্রাধান্য দিয়ে সরে গেল। ঘন ঘন পলক ফেলে আমতা আমতা করে বলে,
-” স্যরি আসলে..

আর বলতে হলো না। অপূর্ব হাতের ইশারায় থামিয়ে দিল। ফোনটা আরশির দিকে এগিয়ে দিল। আরশি ফোনটা স্পর্শ করতেই অপূর্ব পুরো ছেড়ে দিলো। পড়ে যাওয়া খড় কুটো গুলো গুছিয়ে আরশির পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে হাঁটা দিলো।

পূর্বের স্থানে এসে ধড়াম করে ফেলে দিলো। একে একে সাজিয়ে গুছিয়ে লাইটারের সাহায্য কে আগুন ধরিয়ে দিলো। হলদেটে আলোয় চারপাশ আলোকিত হলো। সর্ব প্রথম অপূর্ব নিজের শীতল হাতটা আগুনের তাপে উষ্ণ করে নিল। তার দেখাদেখি আরশিও গিয়ে বসে তাপ পোহাতে লাগলো। অপূর্ব তার ব্যাগের জিনিস পত্র গুলো চেইন খুলে উল্টো করে ধরলো।

সবগুলো জিনিস নিচে পড়ে গেল। অপূর্ব হাতিয়ে হাতিয়ে নিজের কাঙ্খিত জিনিসটা পেল। আসার আগে চারটা কাপ নুডুলস এনেছিলো সে। নুডুলস খাবার টা অপূর্ব আর তরী, দুজনেরই খুব পছন্দের খাবার। আসার সময় নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু সবকিছুর ব্যস্ততায় ভুলে গেছিলো। পাহাড়ি পথে আসার সময় সাথে ফ্লাক্স নিয়ে এসেছিলো।
ফ্লাক্সের পুরোনো পানিগুলো ফেলে দিয়ে বোতলের পানিতে হাফ ভরে নিলো। অতঃপর আগুনে জলন্ত ডালের উপর রেখে দিলো।

প্রয়োজনীয় পানি দিয়ে দুই কাপ পূর্ণ করে নিলো। একটা কাপ আরশির দিয়ে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে হলে খেয়ে নিও‌। কতোদিন না খেয়ে থাকতে হবে, জানা নেই।
বলেই অপূর্ব নিজের হাতে, নিজের মতো খেতে লাগল। দুপুরে খেয়েছে, এখন না খেলে থাকতে পারবে না। আরশিও বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিল।

চোখের পাতা জ্বলছে। বড্ড ভারী ভারী ঠেকছে। গাছের সাথে হেলান দেওয়া অপূর্ব। আরশি গুটি শুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। বন জঙ্গলের রাত, বোঝা যাচ্ছে না কয়টা বাজে। অপূর্বের ফোন বন্ধ করে রেখেছে। চার্জের অভাবে লো হয়ে আছে। আরশির দিকে চাইলো। মেয়েটা শীতে ঠকঠক করে কাপছে। তাদের সব প্রয়োজনীয় জিনিস রিসোর্টে রেখে এসেছিল। আগুনের শিখার মাঝে আরো একটা ডাল দিয়ে দিলো। আরশির পাশে ফাঁকা জায়গা গিয়ে শুয়ে পড়লো।

শালের কিছুটা অংশ নিজের শরীরে পেঁচিয়ে নিল। বিনিময়ে শো শো করে বাতাস অন্তর্ভাগে প্রবেশ করতে লাগলো। অপূর্ব অসন্তোষ প্রকাশ করলো। নিজের শরীরের সবটুকু ভার আরশির শরীরে দিলো। উপর থেকে শালটা পেঁচিয়ে নিলো। ধীরে ধীরে ঝটফটানি কমে এলো তার। অপূর্ব মাথা তুলে হাত বুলিয়ে সরে আসতে চাইলো।

হাত গিয়ে ঠেকলো আরশির গলায়। খানিকটা জায়গা ফুলে আছে। অপূর্ব স্লাইড করলো জায়গাটা। জলন্ত আগুনের দন্ডা নিয়ে আরশির উপরে দেখলো। গলার জখম টা মারাত্মক ছিল। কালো হয়ে ফুলে গেছে বেশ। অনুসূচনায় পূর্ণ হয়ে উঠল অপূর্ব। অপূর্ব ঝুঁকে পড়লো। সময় নিয়ে দৃঢ় করে অধর ছুঁয়ে দিলো আরশির গলায়। আরশি নড়েচড়ে উঠলো। অপূর্ব সরলো নয়। বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে ধরে নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে নিলো। মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করে,

-” হ্যাঁ! ঠিক বলেছিলে তুমি, আমি পাষান, অমানুষ, জানোয়ার, স্বার্থপর। আমি তোকে এভাবে আঘাত করেছি। আ’ম স্যরি আরু। আমি অন্যায় করেছি। এভাবে মতো আমাকে গ্ৰহন করে নে। তুই কথা না বললে, কেমন অন্ধকার লাগে সবকিছু। প্লীজ!”
বলতে চাইলো অনেক কিছু, কিন্তু বলা হয়ে উঠলো না। রাতের আঁধারে, মনে গহীনে চাপা পড়ে গেল সবকিছু। সে উচ্চারণ করেছি ঠিকই কিন্তু সবকিছু অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। তবে এই রাতের পর আরশিকে আর কোনো কষ্ট পেতে দিবে না,কখনো দিবে না।

অরিশ ভাইয়া টান টান হয়ে শুয়ে আছে দুজনের উপযোগী চৌকিতে। টুলে বসে দাঁতের সাহায্য নক কেটে চলেছি আমি। ভাইয়াকে দেনমোহর রেখে আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।
টুলের উপরে খাবারের ফাঁকা থালা ঢেকে রাখা। ভাইয়া আর আমি খেয়ে নিয়েছি। কিন্তু সে আমার সাথে একটাও কথা বলেনি। ল্যাম্পের আরো নিভে নিভে আসছে। তেল ফুরিয়ে এসেছে। পিনপিনে নিরবতা ভেঙ্গে বললাম,

-” ভাইয়া, কি হয়েছে তোমার? আমার সাথে কথা কেন বলছো না?”
কোনো উত্তর দিলেন না তিনি। আরো একটা ডাক দিলাম। উঠে বসলেন তিনি। হাঁটুতে একহাত রেখে তীক্ষ্ম দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন,

-” কি হই আমি তোর?”
কিছু না ভেবে ফট করে উত্তর দিলাম,-” কেন ভাইয়া!”
-” আজ পর্যন্ত কোনো বউকে শুনছিস, ভাইয়া ডাকতে ডাফার। আমি তোর ভাই হই? এদিকে আয়, চড়িয়ে তোর দাঁত গুলো ফেলে দেই।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে উঠলাম,

-” কি করব, আমি! তুমি তো আমার ভাইয়া ছিলে। এখন তাহলে কি ডাকব?”
-” তারমানে তুই আমাদের বিয়েটা মানিস না। মানিস আর না মানিস, বিয়েটা হয়ে গেছে। সম্মান দিয়ে এবং ওগো, শুনছো প্রতিটি লাইনে ব্যবহার করবি।”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৫

বলেই উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। আমিও সংকোচ নিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়লাম। আমার উপস্থিতি অনুভব করে ফিরলেন আমার দিকে। দু আঙুলের সাহায্যে আলো নিভিয়ে দিলেন। হাত ধরে টেনে তার বুকে নিয়ে নিলেন। নেশালো মানুষের ন্যায় টেনে টেনে বললেন,
-” এই বুকটা সহ আমি শুধু তোর। আগেও ছিলাম, এখন লিখিতভাবে তোর। কখনো সরে যাস না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে।”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ২৭